গানে গানে অঞ্জনের ৩০: যাপিত জীবনে নিরন্তর আশা জাগিয়ে যায় এখনো
হতে চেয়েছিলেন আপাদমস্তক সিনেমার মানুষ। সে উদ্দেশ্যে চেষ্টাচরিত্রও করেছেন বিস্তর। কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে মৃণাল সেনের মতো পরিচালকের সঙ্গেও। নিজেও সিনেমা বানিয়েছেন, একেবারে কম নয় তার পরিমাণ। বানিয়েছেন চমৎকার কিছু টেলিফিল্মও। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে মানুষের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে তার গায়ক পরিচয়।
তিনি অঞ্জন দত্ত। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গানের সঙ্গে তার যাপিত জীবনের ৩০ বছর হতে চলেছে।
শুরুটা ১৯৯৪ সালে শুনতে কি চাও অ্যালবামের মাধ্যমে। এরপর পুরনো গিটার (১৯৯৫), ভালোবাসি তোমায় (১৯৯৬), কেউ গান গায় (১৯৯৭), চলো বদলাই (১৯৯৮), হ্যালো বাংলাদেশ (১৯৯৯), অসময় (২০০০), রঙ পেন্সিল (২০০১), অনেক দিন পর (২০০৪)-সহ বেশকিছু অ্যালবাম বেরিয়েছে তার।
অঞ্জনের কৈশর কেটেছে দার্জিলিংয়ে। সেখানকার পাহাড়ের সবুজ তার মনে বুনেছে সংগীতের বীজ। সে সময়টা ছিল নানান উত্থান-পতনে ভরপুর। নিজস্ব সেসব স্মৃতি প্রচ্ছন্নভাবে উঠে এসেছে তার গানেও। আদ্যন্ত সিনেমার মানুষ হয়ে থাকতে চাওয়া অঞ্জনের লেখা গীতিকবিতাগুলোও যেন হয়ে উঠেছে ছোট ছোট একেকটা সিনেমা কিংবা রং-তুলিতে আঁকার রঙিন ক্যানভাস।
ধরনের দিক থেকে ষাটের দশকের ব্রিটিশ পপ, কান্ট্রি মিউজিক, র্যেগে, জ্যাজ, ব্লুজের অনবদ্য প্রয়োগ আমরা দেখি অঞ্জনের গানে। আর তার সঙ্গে সিনেম্যাটিক লিরিক আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে সেসব রঙিন দিনকে।
অঞ্জনের গানগুলোয় আমরা পাই বিচিত্র সব চরিত্রকে। বেলা বোস, রঞ্জনা, মালা, ববি রায়, ম্যারি অ্যান, জেরেমি, মিস্টার হল; বহু বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে অঞ্জনের গানে।
'এটা কি ২৪৪১১৩৯' — টেলিফোনের একপ্রান্তে প্রেমিক তার বহু আরাধ্য চাকরিটি পেয়ে যাওয়ার পর প্রেমিকা বেলা বোসকে বলছে বুনতে থাকা স্বপ্নের সংসারের কথা। 'সাদা-কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে/তোমার আমার লাল-নীল সংসার' — এই রঙিন স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ পায় কি না তা আর আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়না। এভাবে একটি ছোটগল্পের মতো অপূর্ণতা রেখেই বেলা বোসকে জানানো সেই 'স্বপ্ন এবার হয়ে যাবে বেলা সত্যি'র কথা শেষ হয়।
এমন বিভিন্ন চরিত্রকে অঞ্জনের অনেক গানেই আমরা দেখতে পাই। 'রঞ্জনা'কে যেমন তার বেপরোয়া অথচ খানিকটা ভীত প্রেমিক বলছে, 'পারব না হতে আমি রোমিও/তাই দুপুরবেলাতে ঘুমিও/দাঁড়াতে হবে না আর বারান্দায়।'
অঞ্জনের গানে টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো একসঙ্গে গড়ে তোলে সুনির্মিত মণিকোঠা। সেখানে ভালোবাসা প্রকাশিত হয় বহুমাত্রিকভাবে।
'এই শুভ দিনে নানান কাজের ফাঁকে পড়ছে কি মনে তোমার/এই বারোই মে তুমি চলে গিয়েছিলে জীবন থেকে আমার/যাও তুমি কোথায় চলে রোজ রাত্তিরে মনের ভেতর ঘুমের ঘোরে/তোমার সাজানো শরীরের ভেতরে মালা তুমি কে, তুমি কে?' — মালা চলে যায়, ভালোবাসার মানুষের চেহারায়, বাহ্যিকতায় আসে অনেক পরিবর্তন। পিসিচন্দ্রের কানের দুল কিংবা অপর্ণা সেনের মতো অভিমান প্রেমিকাকে সংজ্ঞায়িত করে। তবে সুসজ্জিত আভিজাত্যে মোড়ানো শরীরের ভেতরে সেই প্রেমিকা-হৃদয়টি কি আজও বেঁচে আছে, নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনের স্রোতে ঘটেছে তারও যবনিকা — এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আমাদের কাছে মেলেনা।
আবার খুব ধীরে ধীরে ক্রমাগত রূঢ় বাস্তবতা ছিনিয়ে নিতে থাকে ভালোবাসার মানুষকে। ভেতরের থাকা সংবেদনশীল হৃদয় যা-ই চাক না কেন, ক্ষুধানিবৃত্তির তাগিদে তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে আক্ষেপ ছাড়া আর তেমন কিছু করার থাকেনা প্রেমিক-হৃদয়ের।
'বছর ঘুরে পদোন্নতির জোয়ারে তুমি ভেসে চলে গেলে দূরে/মেশিনপত্র গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলে তুমি ববি রায়ের ঘরে/আজ তারই আবদারে বাড়ছে তোমার ওভারটাইম, বাড়ছে ঠোঁটের রং/তারই আবদারে তারই গাড়ি চড়ে হয়তো ফিরবে তুমি তোমার ঘর' — কথাগুলো এক প্রেমিক-হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে ফুটিয়ে তোলে। তবে অনিবার্য বাস্তবতাকে মেনে না নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা তার কাছে।
আবার কিশোর বয়সের রঙিন জ্বলজ্বলে স্মৃতির রোমন্থনও আমরা দেখি অঞ্জনের গানে। 'ছোট্ট বেলার প্রেম আমার কালো মেম/কোথায় গেলে হারিয়ে' — মেরি অ্যানের প্রতি এক কিশোর হৃদয়ের একপাক্ষিক ভালোবাসার স্বীকারোক্তি মেলে অঞ্জনের গানে। 'মাথার ভেতর ছিল এলভিস প্রিসলি, খাতার ভেতর তোমার নাম' — মেরি অ্যানরা চলে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে যায় অক্ষত।
তবে শুধু নারীচরিত্র নয়, অঞ্জনের গানে আমরা পুরুষচরিত্রকেও উঠে আসতে দেখি। কখনো তা হয়ে ওঠে তার কিশোরবেলার দার্জিলিং জীবনের প্রতিচ্ছবি, আবার কখনো তা থাকে ভৌতিকতার মোড়কে আচ্ছাদিত।
'চুপি চুপি রাত নেমে এলে 'পরে ভাঙা জানলার শার্সিটা খুলে যায়/কালি-ঝুলি মাখা ঘরটায় কে যেন আবার হেঁটে চলে খালি পায়/… মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়ের রাতে ফিরে ফিরে আসে বেহালার মাস্টার…' — 'জেরেমির বেহালা' গানটিতে এভাবেই পুরোনো, পরিত্যক্ত এক বাড়ির কথা বলা হয়। সেই বাড়ির 'বেহালার মাস্টার' জেরেমি লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ফিরে এসে সুর তোলেন তার বেহালায়! বখাটেদের আড্ডা থেকে উকিলের করা মর্টগেজ; সবকিছু যেন বাড়িটির ইতিবৃত্তকে সিনেমার মতো করে তুলে ধরে আমাদের সামনে।
আবার দার্জিলিংয়ে কাটানো অঞ্জনের কৈশোরের প্রছন্ন প্রকাশ আমরা দেখি তার 'মিস্টার হল' গানটিতে। 'ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস' গানটি 'নিকোটিনে হলদে হয়ে যাওয়া দশটা আঙুল'-এ বাজাতেন মিস্টার হল। 'একশ বার শুনেও একশ বার হতো ভুল' — অঞ্জনের এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্তরের সেই চমৎকার পাহাড় আর চা বাগান, যা সেদিনের এক কিশোরের মনে স্বপ্ন বুনেছিল।
'তখন তো বুঝিনি বড় হওয়া বড়ই শক্ত/বয়েসের সাথে সাথে কমে যায় চোখের জল/থেমে যেতে চায় আজ কতবার আমার মনটা/তবু থামিনি যে আমি এখনো মিস্টার হল' — কথাগুলোর মধ্য দিয়ে কিশোরবেলা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সেখান থেকে প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে যাবার স্বীকারোক্তি দেন অঞ্জন। মিস্টার হলের পিয়ানো থেমে যায়, কিন্তু যে কিশোরের মনে তিনি বুনে দিয়েছিলেন স্বপ্নের বীজ, সেই কিশোর আর থামেনা।
এমনি করে অঞ্জন আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তার অনেক গানেই। 'দুজনেরই নেই নিয়ম ভাঙার বয়স/তবু দুজনেরই আছে নিয়ম ভাঙার মন' — 'চ্যাপ্টা গোলাপ' গানে এভাবেই দুই কিশোর-কিশোরীর প্রেম তুলে এনেছেন অঞ্জন। 'দাম্পত্যের শক্ত মানেটা ওরা দুজনেই জানেনা এখনো' — প্রেমের রঙিন সময়টিকে দাম্পত্যজীবনের হিসেব-নিকেশের বাইরে রঙিন করেই রাখতে চান অঞ্জন।
বাংলা ব্লুজেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন অঞ্জন দত্ত। 'সময় ছুটে চলে, আমি আটকে পড়ে রই/আমার রাস্তা হাঁটে, আমি হাঁটিনা/চোখে নিয়ে স্বপ্ন, বুকে অনেক অনেক কথা/আমার বয়েস বাড়ে, আমি বাড়ি না' — চরম নৈরাশ্য ও সেখান থেকে উত্তরণের স্বপ্নের কথা জানা যায় 'তুমি আসবে বলে তাই' গানে। বাংলা ব্লুজের অনন্য সংযোজন এই গানটিতে তিনি গেয়েছেন: 'আমার মনটা তবু আশা করে যায়/এই মনটা তবু ভালোবাসতে চায়/এই মন আশা করে যায়।'
এই আশাকে, তারুণ্যকেই অঞ্জন ধারণ করেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রজন্মান্তরে। তাই দিনশেষে তার গান নৈরাশ্যের এই ভুবনে আমাদের না বলা কথাগুলো বলে, আমাদের আশাবাদী হতে শেখায়, আত্মোপলদ্ধির পথ খুলে দেয়। তাই রূঢ় বাস্তবতাও আমাদের ভুলিয়ে দিতে পারেনা রঙিন স্বাপ্নিক দিনগুলোকে।
অঞ্জনের গানের কথা দিয়েই শেষ করা যাক — 'একটু ভালো করে বাঁচব বলে/আরেকটু বেশি রোজগার/ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা/আমার নীলচে পাহাড়/পারল না কিছুতেই তোমার কলকাতা আমাকে ভুলিয়ে দিতে/পাহাড়ি রাস্তার ধারের বস্তির আমার কাঞ্চনকে/কাঞ্চন জানা কাঞ্চন ঘর কাঞ্চনজংঘা কাঞ্চন মন/তো পাইলে সোনা ভনু লইয়ো মউল্লা হাঙচুকাঞ্চন।'