অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রিয় মিষ্টি বাকলাভা বঙ্গভবনে পৌঁছে যেভাবে আলোচনায়
বঙ্গদেশে বাকলাভা
গোপাল হালদার ঠাট্টার ছলেই একবার বলেছিলেন, বাঙালি সংস্কৃতি রসগোল্লা আর সন্দেশের সংস্কৃতি। এ আর ভুল কি! সেই নলেন গুড়ের পায়েশই হোক আর তুর্কির অতিথি বাকলাভা, বাঙালির সাথে বাঙালির এক মিষ্টি সম্পর্ক। এজন্যই বাকলাভাও ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মিষ্টির রাজ্যের অংশ হয়ে উঠছে। যার প্রেক্ষিতে এবার দেখা গেল বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রীদের দেশি-বিদেশি নানা খাবারের সাথে পরিবেশন করা হয়েছে বাকালাভাও।
গত বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের আপ্যায়নে বৈচিত্র্যময় সব খাবারের আয়োজন করা হয়। নতুন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের আপ্যায়ন করা হয় মাটন শিক কাবাব, চিকেন শাশলিক, ভেটকি মাছের ফিশ ফিঙ্গার, ভেজিটেবলস, মাশরুম, পনির সমুচা ও স্পাই। কমলা, আপেল, আঙুর দিয়ে সাজানো ফলের ঝুড়িও ছিল আপ্যায়নে। এছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্যদের মিষ্টিমুখ করানোর জন্য পরিবেশন করা হয় পাটিসাপটা পিঠা আর মিষ্টি বাকলাভা।
বঙ্গভবনে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আপ্যায়নের তালিকায় নাম ওঠানোর পর থেকেই আলোচনায় এসেছে বাকলাভা। এই বাকলাভা কোত্থকে এসেছে? আদিনিবাস তুরস্ক? ঢাকায় কি পাওয়া যায়!
বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন পেস্ট্রি শপ, বেকারি ও মিষ্টির দোকানে বাকলাভা তৈরি হচ্ছে। আল-অ্যারাবিয়ান কেক অ্যান্ড সুইটস বাকলাভা তৈরি করে বিক্রিয়কারীদের এক উৎস। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার জাকির হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ২০১১ সাল থেকে বাকলাভা তৈরি করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। কেজিপ্রতি বর্তমান মূল্য ১,৬০০ টাকা। আর বাকলাভা তৈরির নানা উপকরণ তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। জাকির হোসাইন বলেন, 'আমাদের শেফের সৌদি আরবে ৫-৭ বছর বাকলাভা তৈরির অভিজ্ঞতা আছে। সেখান থেকে শিখে এসে তিনি এখানে বাকলাভা তৈরি করেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি এখানে কাজ করছেন। আমরা নিজেরাই বাকলাভা প্রস্তুত করে থাকি।'
আল-অ্যারাবিয়ানে তৈরি হয় কয়েক ধরনের বাকলাভা: বাকলাভা ভ্যানিলা ফ্লাওয়ার, এর দাম ১,৪০০ টাকা। এই একই দামে তাদের কাছে পাওয়া যায় বাকলাভা মুকাদ্দাহ, বাকলাভা চকলেট ফ্লাওয়ার, শাকিন, কুনাফা কাজু, ফিঙ্গার, হুরবাথ. কালুসকুর বাকলাভা।
ব্রেড অ্যান্ড বিয়ন্ড বাকলাভা বিক্রি করে তিন পিসের বক্স। দাম ২০০ টাকা। মি. বেকারে বিভিন্ন রেঞ্জের বাকলঅভা মিলে। এদের আসাবা, সুরাহ, সাক্কিনিয়েন, বুলবুল, অরবাথ, লেবানিজ—এইসব নামের, ধরনের বাকলাভার দাম ২,১০০ টাকা।
ঢাকায় আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বাকলাভা বিক্রি করে থাকে। ওয়েল ফুড বেভারেজ কোম্পানিও বাকলাভা বিক্রি করে। তাদের দশ পিসের বাকলাভার দাম পড়বে ৪৫০ টাকা আর ২৬ পিসের বাকলাভা ৯০০ টাকা।
বাকলাভা বানায় বাকলাভা সুইটস অ্যান্ড বেকারি ডেজার্টও। তাদের কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম-কাঠ বাদাম কুঁচি স্তরে স্তরে দিয়ে ঘি ও মধুতে তৈরি বাকলাভা অনলঅইনেও অর্ডার করা যায়।
এছাড়া দেশের অভিজাত হোটেলে ডেজার্ট আইটেম হিসেবে পাওয়া যায় বাকলাভা। রমজানের সময় বাকলাভা এসব হোটেলে অত্যাবশ্যকীয় মিষ্টি হিসেবে বিক্রি হয়।
গ্যাস্ট্রোনমিকার এক সংখ্যায় বলা হয়েছিল, 'আপনি যদি বাকলাভা বেক করতে চান, আপনাকে সবার আগে ভালোবাসতে জানতে হবে। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো মিষ্টি বাকলাভার এক টুকরোয় কামড় বসিয়ে আপনিও পেতে পারেন এই ভালোবাসা ও ঐতিহ্যের স্বাদ।'
ভোজনরসিকতায় পৃথিবীর সবচেয়ে আহ্লাদী কিছু কী, বলুন তো? নানান গোমড়ামুখোর মুখে নানান পদের এবং শুভ কাজের শুরুতে বা ভরপেট খাবারের শেষপাতে মিষ্টিমুখ ছেলে-বুড়ো সব গোমড়ামুখোকে করে তোলে আমুদে। মিষ্টির আহ্লাদ আমাদের খাওয়ার জন্য বাঁচার তাগিদ দেয়। সে তাগিদেই গ্রিস অথবা তুরস্কে মাখন, বাদাম, চিনির জাদুতে তৈরি হলো আহ্লাদে আটখানা এক রাজকীয় খাবার, নাম রাখা হলো বাকলাভা। রাজাধিরাজদের মন জয় করা এই রাজকীয় খাবার ইরান-তুরান পার হয়ে আজ মিষ্টতায় মন জয় করছে বিশ্ববাসীর।
নানা দেশে নানা প্রণালী থাকলেও বাকলাভা তৈরিতে মূলত ময়দার তৈরি পাতলা ফাইলো বা ফিলো শিট, বাদামকুচি, মাখন এবং চিনির শিরা ব্যবহৃত হয়। একদম হালকা আবরণের ফিলোর ওপরে পেস্তা বা আখরোট কুচির স্তর বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর আবার ফিলো দিয়ে আবার বাদামকুচি। এভাবে একের পর এক সাজিয়ে নিয়ে ত্রিভুজাকৃতি, চতুর্ভুজাকৃতি বা বরফির ধাঁচে কেটে নিয়ে তার ওপর গলিয়ে নেওয়া মাখন ঢেলে দিয়ে বেক করা হয়। বেক করা গরম বাকলাভার ওপর চিনির শিরা ঢেলে দিয়ে ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষার পালা। বাকলাভার প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে বাদাম, চিনি, মাখনের স্বাদ, ঘ্রাণ। ঘ্রাণে প্রলুব্ধ করা বাকলাভা যখন মুখে গলে যায়, তখন তা স্বাদে বিমোহিত করে মন জয় করতে পারে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যে কারো।
উৎপত্তিস্থল নিয়ে মিষ্টি যুদ্ধ
যে মিষ্টি বিশ্বজয়ী, তার উদ্ভব কোথায়, তা নিয়ে যদি একটু আধটু লড়াই না বাধলো, তাহলে কী করে হয়! 'বাকলাভা' শব্দটি তুর্কি ভাষা থেকে ১৬৫০ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। মূল শব্দ 'বায়লা' বলতে বোঝায় মোড়ানো বা স্তূপ করা। কিছু ভাষাবিদ বলেন, 'বাকলাভা' শব্দটি এসেছে 'বাকল-ই' শব্দ থেকে যার অর্থ খাওয়া। আবার আর্মেনিয়ান শব্দ 'বাখ' অর্থ বীজ, 'হালভা' মানে মিষ্টি। আরবে একে ডাকা হয় 'বাকলাওয়া'। এই শব্দের উৎস ঘিরেই রয়েছে নানান রহস্য।
বাকলাভার সবচেয়ে প্রাচীন উৎপত্তি হিসেবে বলা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের শুরুতে আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের লোকেদের রুটির ভেতরে বাদাম আর মধু দিয়ে বেক করে তৈরিকৃত মিষ্টির কথা। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন রোমের 'প্লাসেন্টা কেক' থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এটি তৈরি, যে শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'প্লেকাস' থেকে। এর পেছনে যুক্তি হচ্ছে, এর রেসিপি লেখক ক্যাটোর রেসিপিতে গ্রিক শৈলী। হোমারের 'ওডিসি'তেও এমন মিষ্টির বর্ণনা রয়েছে যা অনেকটা বাকলাভার মতো। কিন্তু এদিকে ক্যাটো ছিলেন অ্যান্টি-গ্রিক, তিনি কেন গ্রিক রেসিপি ফলো করতে যাবেন, এ নিয়ে রয়ে যায় বিতর্ক।
এর উৎপত্তিকে ঘিরে বিতর্ক এতই প্রবল যে, ২০১২ সালে গ্রিক স্বাধীনতা দিবসে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে 'গ্রিক বাকলাভা' পরিবেশন করা হয়, তা নিয়ে তুরস্কের গণমাধ্যমে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়।
তবে যতই গন্ডগোল বাধুক, আমরা যে আধুনিক স্বাদের বাকলাভার পাই, তা এসেছে তুরস্কের হাত ধরেই। ষোড়শ শতকে অটোম্যান সাম্রাজ্যে তৎকালীন কনস্ট্যান্টিনোপলের (বর্তমান ইস্তাম্বুলে) তোপকাপি রাজপ্রাসাদের শাহী রান্নাঘরে এর যাত্রা শুরু। বাদশাহদের জন্য বাকলাভা পরিবেশনের আগে আধমিটার উঁচু থেকে বাকলাভার ওপর সোনার কয়েন ফেলে দেখা হতো কয়েনটি ফিলগুলোর ওপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে ট্রের শেষ অবধি যায় কি না। না গেলে সেই ট্রে ফেরত পাঠানো হত।
রমজান উদযাপনে তুরস্কের সুলতান তার শ্রেষ্ঠ সৈনিকদের নিয়ে গঠিত জেনিসারি বাহিনীর জন্য বাকলাভা তৈরি করাতেন। 'বাকলাভা প্যারেডে'র আয়োজনও করতেন। সেখানে সৈন্যরা ব্যারাক থেকে ট্রে নিয়ে কুচকাওয়াজ করত। পরবর্তীতে অটোম্যানদের সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমেই বাকলাভা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন বাকলাভা
একেক দেশের সংস্কৃতি অনু্যায়ী বাকলাভার রকমফের দেখতে পাওয়া যায়। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া এই মিষ্টি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপকরণ বা প্রণালীতে দেখতে পাওয়া যায়।
পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় বাকলাভা বানানো হয় তুরস্কের গাজিয়ান্তেপে। এছাড়া ইস্তাম্বুল, ইরান, গ্রিসের বাকলাভা জগদ্বিখ্যাত। কখনো বাকলাভার ফিলোতে ব্যবহার করা হয় ডিম, কখনো দেখা যায় শুধু পেস্তা বা শুধু আখরোটের ব্যবহার, কখনো কয়েক পদের বাদাম একসাথে। আবার সিরাপে দেওয়া হয় দারুচিনি, মধু।
গ্রিসের কোনো কোনো অঞ্চলের বাকলাভায় অলিভ অয়েলের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বাকলাভার আদলে হাঙ্গেরিতে রয়েছে স্ট্রুডেল খাওয়ার প্রচলন। আবার বাকলাভায়ও লেগেছে আধুনিকতার স্পর্শ, হচ্ছে চকলেট, ক্রিমের ব্যবহার। রকমফের অনু্যায়ী রয়েছে বাহারি সব নাম। গাজিয়ান্তেপ বাকলাভা, কাদায়েফ, বুলবুল ইউভাসি, বুকাজ, কুরু বাকলাভা—যেমন নামের বাহার, তেমনি স্বাদের ভিন্নতা।
বাকলাভা এক বিলাসী খাবার। বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে নানা উৎসবের অনুষঙ্গ এই মিষ্টি। গাজিয়ান্তেপে বলা হয়, 'আমাদের এখানে নবজাতকেরা পৃথিবীতে এসে চোখ খুলতেই সবার আগে দেখতে পায় বাকলাভা।'
ধর্মভেদেও বাকলাভা খাওয়ার নানা রীতির দেখা মেলে। অটোম্যানদের থেকে শুরু হয়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে রমজানের ইফতারে বাকলাভা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
গ্রিসে বাকলাভা বানাতে যীশু খ্রিষ্টের জন্মের তেত্রিশ বছরের প্রতীকী হিসেবে তেত্রিশ স্তরের বাকলাভা বানানো হয় এবং ইস্টারসহ নানা উৎসবে খাওয়া হয়। অন্যদিকে রোশ হাসানাহ উদযাপনে ইহুদিরা নিয়ম অনুসারে হালকা রঙের ব্লাঞ্চ করা বাদাম দিয়ে বাকলাভা তৈরি করে থাকে।