মাটির বিস্কুট! সিলেটে কেন এই বিস্কুট খাওয়া হয়, যায় যুক্তরাজ্যেও
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা থেকে বিশেষ এক খাবারের খোঁজে নগরের চাঁদনীঘাট এলাকায় এসেছেন বদরুল আলম। বদরুলের চাচি যুক্তরাজ্যে থাকেন। চাচিকে যুক্তরাজ্যে বিশেষ ওই খাবারটি পাঠাবেন বদরুল।
চাঁদনীঘাট এলাকা ছাড়া তেমন কোথাও পাওয়া যায় না এ খাবার। তাই বিয়ানীবাজার থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দূরে এসেছেন তিনি।
শুনে আশ্চর্য লাগবে, বিশেষ এই খাবার তৈরি হয় মাটি দিয়ে। বিস্কুটের মতো দেখতে, তাই একে 'মাটির বিস্কুট' বলে থাকেন অনেকে। তবে সিলেটে খাবারটি 'ছিকর' নামে পরিচিত। বিস্কুটের মতো কামড়ে খেতে হয় ছিকর। সিলেট অঞ্চলে ছিকর খাওয়ার প্রচলন বহুদিনের।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকেলে চাঁদনীঘাট এলাকায় কথা হয় বদরুল আলমের সাথে। তিনি বললেন, "আমার চাচি লন্ডন থাকেন। অনেক দিন ধরেই তিনি আমাকে ছিকর পাঠাতে বলছেন। তাই আজ কিনতে এলাম।"
"এক কেজি কিনেছি। আগামী সপ্তাহে এক আত্মীয় লন্ডন যাবেন। তার সাথে এগুলো পাঠিয়ে দেবো," যোগ করেন বদরুল।
সুরম নদীর তীরঘেঁষা চাঁদনীঘাট এলাকায় পাশপাশি সিলেটের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। কিনব্রিজ, আলী আমজদের ঘড়ি, সারদা হলের অবস্থান এখানেই। সারদা হলের সামনের ফুটপাতে মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করেন ৪/৫ জন বিক্রেতা। তাদের সবার কাছেই পাওয়া যায় এই মাটির বিস্কুট।
বিক্রেতারা জানান, তাদের মূল ক্রেতা নারীরা। বিশেষত, গর্ভবতী নারীরা ছিকর খেয়ে থাকেন। তবে দেশের চেয়ে বিদেশে বসবাসরত সিলেটের লোকজনই এটির প্রধান ক্রেতা। সিলেট থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে যায় এই মাটির বিস্কুট।
ছিকর কী?
ছিকর হচ্ছে পাহাড়ের এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এক প্রকার পোড়ামাটির বিস্কুট। স্থানীয়দের মতে, ছিকর তৈরি প্রথম শুরু হয় হবিগঞ্জে। এরপর এটি সিলেটসহ আশপাশের জেলার ছড়িয়ে পড়ে। 'ছিকর' শব্দটি এসেছে ফারসি 'ছিয়া' এবং 'কর' থেকে। ছিয়া অর্থ কালো এবং কর মানে মাটি। 'ছিয়াকর' শব্দটিই পরে 'ছিকর' হিসেবে পরিচিতি পায়।
ছিকর কেন খাওয়া হয়?
ছিকর কেন খাওয়া হয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের একেকজন একেক তথ্য দিয়েছেন।
সিলেটের প্রবীণ ও মধ্যবয়সী কয়েকজন নারী ও পুরুষের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আগে দরিদ্র লোকজন খাবারের বিকল্প হিসেবে পাহাড়ের মাটি পুড়িয়ে তৈরি এই বিস্কুট খেতেন। ছিকরে অনেক খনিজ উপাদান রয়েছে এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে এটি কার্যকর ও শক্তি বর্ধক বলেও জানিয়েছেন তাদের কয়েকজন। তাই খনিজ উপাদানের ঘাটতি কাটাতে গ্রামীণ নারীরা গর্ভাবস্থায় ছিকর খেয়ে থাকেন।
এছাড়া, পান-তামাকের মতো দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশতও অনেক প্রবীণ নারী-পুরুষ ছিকর খান।
নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার গৃহিনী লাইলী বেগম ৫ বছর আগে সন্তানের জন্ম দেন। গর্ভবতী অবস্থায় তিনি এই মাটির বিস্কুট খেয়েছেন।
কেন খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "গর্ভবতী অবস্থায় এটি খাওয়ার ইচ্ছা হয়। তাছাড়া, মুরব্বিরও খেতে বলেন। তাই খেয়েছি। তবে এতে কোনো উপকার হয়েছে কি-না জানি না।"
স্ত্রী লাইলী বেগমের সাথে তখন তার স্বামী মুরাদ আহমদও ছিকর খেয়েছিলেন। তিনি বলেন, "এটি খেতে মজাই লাগে। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ। তাই একবার খেলে আবার খাওয়ার ইচ্ছা জাগে।"
সিলেটের দক্ষিণসুরমার রাখালগঞ্জ এলাকার প্রায় আশি বছর বয়সী বৃদ্ধা রেখা রানী দাস বলেন, "ছিকর শক্তি বাড়ায় ও রক্ত স্বল্পতা প্রতিরোধ করে বলে শুনেছি। আগে তো মানুষজন তেমন ওষুধপত্র খেতো না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া বা ওষুধ খাওয়ার সামর্থও তখন ছিল না। সেসময় মানুষজন ছিকর খেতো।"
"বিশেষ করে প্রায় সব গর্ভবতী নারীরাই এটি খেতেন। তবে এখন ছিকর খাওয়া অনেক কমে গেছে," বলেন তিনি।
এই জিনিস কেন খাওয়া হয় তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি চাঁদনীঘাট এলাকার কোনো বিক্রেতাই। প্রায় বিশবছর ধরে এই এলাকায় মাটির জিনিসপত্র ও ছিকর বিক্রি করেন শহিদ আহমদ।
তিনি বলেন, "অনেকেই এটি কিনে নেয়। তবে কেন খায় জানি না। শুনেছি এটি খেলে শক্তি বাড়ে ও খাওয়ার রুচি বাড়ে। এছাড়া, আয়রন ট্যাবলেটের বিকল্প হিসেবেও ছিকর খাওয়া হয়। তাই গর্ভবর্তী নারীরা এটি বেশি খান।"
তিনি বলেন, "যারা রক্ত বিক্রি করে তাদের অনেকেই ছিকর কিনে খায়।"
এ ব্যাপারে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ছিকরের কোন উপকারীতা আছে বলে আমার জানা নেই। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিতও নয়।
তিনি বলেন, "গর্ভবতী অবস্থায় নারীদের ক্যালসিয়াম ও আয়রনের সাপ্লিমেন্টারি দেওয়া হয়। কিন্তু মাটির মধ্যে এই দুই উপাদান নেই, বরং এরমাঝে অনেক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর বা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছু খাওয়াই ঠিক নয়।"
কোথায় ও কীভাবে তৈরি হয় এই 'মাটির বিস্কুট'?
সিলেটের লালাবাজারের সনাতন পাড়ার সজিব মালাকার প্রায় ৪৫ বছর ধরে ছিকর তৈরি করেন। তার বাবা এবং দাদাও একই কাজ করতেন।
ছিকরের প্রস্তুতপ্রণালী সম্পর্কে তিনি জানান, পাহাড়-টিলার তলদেশের এঁটেল মাটি দিয়ে ছিকর তৈরি করা হয়। প্রথমে গর্ত খুঁড়ে পাহাড়ের তলা থেকে লম্বা বাঁশ দিয়ে মিহি মাটি সংগ্রহ করা হয়। এগুলো সারারাত ভিজিয়ে রেখে নরম করা হয়। তারপর তা মাখিয়ে খাই বানিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়।
পরে এগুলো কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। এরপর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দু-এক দিন শুকিয়ে মাটির চুলায় পোড়ানো হয়। ঘণ্টা দুয়েক পর ছিকর কালচে বর্ণ ধারণ করে সুঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। এতে গোলাপজলসহ বিভিন্ন সুগন্ধী মেশানো হয়।
সজিব মালাকার বলেন, "দেশের চেয়ে বিদেশে এটি বেশি বিক্রি হয়। লন্ডনের ক্রেতারা এটি সবচেয়ে বেশি কেনেন।"
ছিকর এক ধরনের নেশা জাতীয় খাবার উল্লেখ করে সজিব বলেন, "সিগারেটের মতো এটিও এক ধরনের নেশাজাতীয় খাবার। দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে অনেকে এটি খান। সবচেয়ে বেশি খান নারীরা।"
জানা যায়, সিলেটের লালাবাজার ও গোয়ালাবাজার, সুনামগঞ্জের ছাতক, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, বাহুবল ও মাধবপুর এবং মৌলভীবাজারের কয়েকটি এলাকায় ছিকর তৈরি করা হয়। এসব এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক বংশ পরম্পরায় ছিকর তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িত। তবে এখন বিক্রি কমে যাওয়ায় বেশিরভাগই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মৌলভীবাজারের জগৎসী এলাকার ব্যবসায়ী বিষ্ণপদ দে বলেন, "আগে শহরের পাশ্ববর্তী শব্দকর ও কুমার সম্প্রদায়ের লোকজন ছিকর তৈরি করতেন। আমাদের ছোটবেলায় ওই সম্প্রদায়ের নারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছিকর বিক্রি করতেন। তবে এখন আর কেউ বাড়িতে গিয়ে ফেরি করে ছিকর বিক্রি করেন না।"
কেমন ব্যবসা?
চাঁদনীঘাট এলাকার ছিকর বিক্রেতা শহিদ আহমদ জানান, প্রতিকেজি ছিকর ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি ছিকর বিক্রি হয় বলে জানান।
শহিদ আহমদ বলেন, "প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনই বেশিরভাগ ক্রেতা। তারা এগুলো কিনে প্রবাসে তাদের আত্মীয়দের কাছে পাঠান। আবার অনেকে আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানিও করেন। রপ্তানির জন্য আমরা বিশেষভাবে তৈরি ছিকর দিয়ে থাকি। এগুলোর দাম একটু বেশি।"
শহিদ আমদের পাশেরই আরেক বিক্রেতা আল কাইয়ুম রনি বলেন, "এখন ছিকরের বিক্রি একেবারে কমে গেছে। বয়স্ক মানুষরা এটি কিছু কিনে নেন। তবে কমবয়সীরা এসব প্রায় কিনেনই না।"
এখন প্রতিদিন ৪/৫ কেজি ছিকর বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।
"আমরা পাইকারি দরে প্রতিকেজি ছিকর ৪০/৫০ টাকা করে বিক্রি করি। আবার বিদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি ছিকর বিক্রি করি প্রতিকেজি ৮০/৯০ টাকা দরে," বলেন লালাবাজারের ছিকরের কারিগর সজিব মালাকার।