অভিজাত শ্রেণির চাহিদায় বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরবরাহকারী থেকে ভোক্তা দেশ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ: গবেষণা
দুই দশকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশ হয়েছে বাংলাদেশের। এতে লাখ লাখ মানুষ যেমন দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে, তেমনি সম্পদের অসম বন্টনের হাত ধরে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অভিজাত শ্রেণি। পয়সাওয়ালা এই শ্রেণির মধ্যে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তৈরি তথাকথিত বিভিন্ন ওষুধ ও প্রসাধনীর চাহিদা বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিপন্ন বেঙ্গল টাইগার (বৈজ্ঞানিক নাম– প্যান্থেরা টাইগ্রিস)-এর আবাসস্থল দেশগুলোর মধ্যে একটি। ঐতিহাসিকভাবে যেখানে বিদেশে পাঠানোর জন্য বাঘ হত্যা করেছে চোরাশিকারিরা। কিন্তু, বর্তমানে কেবল বহির্বিশ্বের চাহিদা নয়– বরং স্থানীয় চাহিদার হাত ধরেও বাড়ছে এই অবৈধ বাণিজ্য।
চীনের ইউনান থেকে প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক গণমাধ্যম মঙ্গা বে'কে গবেষণা নিবন্ধের মূল লেখক নাসির উদ্দিন বলেন, "অতীতে জ্যান্ত প্রাণী বা মৃত বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একটি প্রধান সরবরাহ উৎস ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা উদ্বেগজনক একটি প্রবণতা: সম্পন্ন অভিজাতদের মধ্যে এগুলো দিয়ে তৈরি পণ্যের চাহিদা বাড়ার ঘটনা লক্ষ করছি। এদের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক এবং এখানে বসবাসকারী বিদেশি– উভয়েই রয়েছেন।"
"তবে গবেষণায় অভিজাত বাংলাদেশিদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে"- বলেও উল্লেখ করেন তিনি। নাসির বলেন, এসব ভোক্তারা বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাণিজ্যে একটি বড় প্রভাব ফেলছেন, এতে করে বাংলাদেশ শুধু অবৈধ রপ্তানির উৎসই নয় বরং আমদানিকারকও হয়ে উঠছে। এই চাহিদা পূরণে ভারত ও মিয়ানমারে বাঘ চোরাশিকার করা হচ্ছে।
"বাঘ চোরাশিকার ও পাচার প্রতিরোধে এই অঞ্চল যথেষ্ট দুর্বল। এখানকার সম্প্রদায়গুলোর মাঝে থাকা সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিল যা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই ধরনের সম্পর্ক বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে," যোগ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ এই চোরাচালানের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। ফলে সহজেই আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের ব্যবসায়ীদের সাথে স্থানীয় ক্রেতা-বিক্রেতাদের নেটওয়ার্ক যুক্ত হচ্ছে। একারণে অবৈধ এই বাণিজ্য চক্রকে ভেঙে ফেলা আরও কঠিন হয়ে গেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়।
এতে জানানো হয়, এখনও বাংলাদেশ থেকে ১৫টি দেশে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করা হচ্ছে। এই তালিকার শীর্ষে মালয়েশিয়ার মতো বিপুল প্রবাসী বাংলাদেশি থাকা দেশসহ রয়েছে চীন ও ভারত। এরপরেই রয়েছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান।
বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁত ও শুকানো মাংস সবচেয়ে বেশি চাহিদা-সম্পন্ন পণ্য বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো বাংলাদেশের বিমান ও সমুদ্র বন্দরসহ স্থল সীমান্ত ক্রসিংগুলো দিয়ে আনা-নেওয়া করা হয়।
ওয়াইল্ডলাইফ জাস্টিস কমিশন (ডব্লিউজিসি)-র এক প্রতিবেদনে, বাংলাদেশে জ্যান্ত বাঘের শাবক পাচার হয়ে আসারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়েছে, পূর্ণ বয়স্ক বাঘের চেয়ে ব্যাঘ্র শাবকের বেশি দাম পাওয়া যায়, যা ৭ হাজার ৬৪৮ ডলার থেকে শুরু করে শাবকপ্রতি সাড়ে ১৭ হাজার ডলার পর্যন্ত হয়। একটি ক্ষেত্রে, পাচারকারীরা থাইল্যান্ড থেকে একটি বাঘের শাবক বাংলাদেশে বিমানে করে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ডলার বেশি চেয়েছিল।
বাংলাদেশের বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট এর প্রধান মো. সানাউল্লাহ পাটোয়ারি বলেন, "বন্যপ্রাণী পাচার অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কথিত গুনাগুণ নিয়ে তাদের অনেকের মধ্যেই সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিশ্বাস, ধ্যানধারণা প্রচলিত আছে, যা অবৈধ এই বাণিজ্যের একটি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।"
"এছাড়া, পাচার প্রতিরোধে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ ও জনবলের কারণে মনিটরিং সক্ষমতা কম। এটাও আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর কাছে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত করেছে," আরও বলেন তিনি।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের এক অসম লড়াই
সরবরাহের উৎস থেকে বাংলাদেশের বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের গন্তব্য হয়ে ওঠার ঘটনা– তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে হয়েছে। বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য নজরদারি বিষয়ক সংস্থা- ট্রাফিক এর ২০২২ সালের একটি প্রতিবেনে, গত দুই দশকে বাঘের অবৈধ চালান জব্দ করার দিক থেকে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক হটস্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত, বাংলাদেশে ৩৬টি বাঘের চালান আটকের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় উদ্ধার করা হয় ৫০টি বাঘ (জীবিত বা মৃত)। কিন্তু, এই সময়ে মাত্র ছয়জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, আর মাত্র চারজনকে পাচারে জড়িত থাকায় দায়ে জরিমানা করা হয়।
ভারত ও বাংলাদেশ মিলে বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনভূমি সুন্দরবন। এই বন বাঘের অন্যতম আবাসস্থল। ২০১৭ সাল পর্যন্তও সুন্দরবনে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য ছিল, যারা অনেক বাঘ হত্যা ও পাচারের সাথে জড়িত ছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে অভিযান চালিয়ে এসব দস্যুদের দলগুলো ভেঙে দেয়। অনেকেই আত্মসমর্পণও করে।
তবে দস্যুরা না থাকায় এখন তাঁদের শূন্যস্থান দখল করেছে কয়েক ডজন বাঘ-চোরাশিকারী দল। এতে সুন্দরবনের বাঘেরা এখনও ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
গবেষক নাসির উদ্দিন বলেন, "জলদস্যুদের দ্বারা ডাকাতি ও মুক্তিপণ আদায়ের ভয় দূর হওয়ায়– বাঘ চোরাশিকারিদের দলগুলো আরও বনের ভেতর আরও ঘন ঘন প্রবেশ করছে।"
সুন্দরবনের একজন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ২০১৭ সালে জলদস্যু বিরোধী অভিযানের পর থেকে বনে বাঘ চোরাশিকার অনেকটাই কমেছে। তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন করছে ট্রাফিকের প্রতিবেদন। যেখানে বলা হয়েছে, আগের চার বছরের তুলনায় ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে এই পাচার ৭৫ শতাংশ হ্রাস পায়।