জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি লবণ উৎপাদনেও পড়ছে?
২০২৩ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে আভেশ ভাই গুজরাট রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পেয়েছিলেন। বার্তাটিতে তাকে সতর্ক করে জানিয়ে দেওয়া হয়, ঘূর্ণিঝড় বিপর্যয় আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে গুজরাটে আঘাত হানবে।
আভেশ ভাই মরবি জেলার মালিয়া শহরে বসবাস করেন যেটি উপকূল থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এর ফলে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব শহরটিতে পড়া প্রায় নিশ্চিত ছিল।
তিনি প্রত্যাশিত ক্ষতি মোকাবেলা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেন। তিনি শুরুতেই সৌর প্যানেলগুলি খুলে নেওয়া শুরু করেন যেটি দিয়ে তিনি একটি পাম্প চালাতেন। তিনি গুজরাট সরকার থেকে ভর্তুকি নিয়ে পাম্পটি কিনেছিলেন। এটি দিয়ে তিনি লবণাক্ত পানি পাম্প করে সমুদ্র থেকে ভূগর্ভ দিয়ে প্রবাহিত করে সমতল ভূমিতে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসতেন। এটি লবণের প্যান নামে পরিচিত। এখানে লবণাক্ত পানি ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয় এবং এর ফলে লবণ পাওয়া যায় যেটি তার জীবিকার প্রধান উৎস।
আভেশ ভাই বলেন, "যে মুহূর্তে আমি আমার শ্রমিকদের আসন্ন ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে জানালাম, তারা সবাই তাদের অস্থায়ী কুঁড়েঘর গুছিয়ে নিয়ে নিরাপত্তার জন্য লবণের খামার থেকে চলে গেল। আমরা সময়মতো প্যানেলগুলো খুলতে পারলাম না।"
জুনের মাঝামাঝি ঘূর্ণিঝড় বিপর্যয় মালিয়াতে আঘাত হানে। আভেশ ভাই তার ১৬টি সোলার প্যানেলের মধ্যে আটটি হারিয়ে ফেলেন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। তার সংগ্রহ করা ৫০০ টন লবণের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে উড়ে আসা ধুলা মিশে গিয়ে সেগুলোকে বিক্রির অযোগ্য করে ফেলে।
তিনি বলেন, "আমরা যে ১০ একরের বেশি জায়গায় লবণ চাষ করি সেখান থেকে গত বছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছিল।"
আভেশ ভাই একজন আগারিয়া। গুজরাটের চারটি ভিন্ন বর্ণ ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছোট একটি ঐতিহ্যবাহী লবণ প্রস্তুতকারকদের গোষ্ঠীকে আগারিয়া বলা হয়। তারা ১৯৪৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিজ্ঞপ্তির অধীনে (কোন ব্যক্তি ১০ একরের কম জমিতে লবণ তৈরি করলে তাকে ইজারা পাওয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়) লবণ প্রস্তুত করার কাজ করে।
আনুমানিক ৪৫ হাজার আগারিয়া গুজরাটের কচ্ছের ছোট রণে লবণ তৈরি করে। এটি পাঁচটি জেলা (মোরবি, কচ্ছ, সুরেন্দ্রনগর, পাটান এবং বনাসকান্তা) নিয়ে বিস্তৃত একটি ত্রিভুজাকার মরুভূমি। গুজরাট ভারতের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদনকারী রাজ্য এবং মোট লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ৮৫ শতাংশ। ২০২২ সালে রাজ্যটিতে প্রায় ২২৮ লক্ষ টন লবণ উৎপাদন করা হয়েছিল। উৎপাদিত লবণ মানুষের ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করার পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য যেমন কস্টিক সোডা, সার এবং রঙের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
গুজরাটে উৎপাদিত মোট লবণের ৩১ শতাংশ আসে কচ্ছের ছোট রণের আগরিয়াদের থেকে।
গত কয়েক বছরে পুরো লবণ উৎপাদনকারী রাজ্যে লবণের উৎপাদন কমে এসেছে। রাজ্যসভায় করা একটি প্রশ্নের উত্তরে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, গুজরাটে গত ছয় বছরে (২০১৬-২০২২) লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ৪ শতাংশ কমেছে।
ইন্ডিয়ান সল্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসএমএ) সভাপতি ভারত রাভাল বলেন, "গুজরাটে এই পতন প্রধানত দুটো কারণে হয়েছে; এপ্রিল এবং মে মাসের মধ্যে উপকূলে ঘূর্ণিঝড় বৃদ্ধির কারণে এবং বর্ষাকালের পরিধি বাড়ার কারণে।"
গত তিন দশকে গুজরাটের জলবায়ুতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সময়কাল বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ শতাংশ এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
এই অঞ্চলের বাসিন্দারা আরো উল্লেখ করেছেন, ছোট রণে বৃষ্টির পরিমাণ সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও লিটল রণ সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না, আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী, রণ অঞ্চলে ১৯৮৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে (৩০ বছরের মধ্যে) বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৭৮ মিলিমিটার থেকে ৬৭৪ মিলিমিটার হয়েছে।
জলবায়ুর এই পরিবর্তন লবণ শিল্পের জন্য বিপজ্জনক যেহেতু মরুভূমিতে সীমিত বৃষ্টি এবং তীক্ষ্ণ সূর্যালোক লবণ উৎপাদনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ুর এই পরিবর্তন লবণ উৎপাদনের মৌসুমকে সংক্ষিপ্ত করছে, নেতিবাচকভাবে লবণের গুণমানকে প্রভাবিত করছে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময় বাড়াচ্ছে এবং বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করছে।
রাভাল বলেন, "লবণ সবচেয়ে সস্তা এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর একটি। এই মুহূর্তে সরকার এই সমস্যার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। তারা যখন শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিবে তখন আসলে দেরি হয়ে যাবে। সরকার রাতারাতি এই শিল্প পুনরুদ্ধার করতে পারবে না।"
জলবায়ুর এই পরিবর্তন ক্ষুদ্র লবণ উৎপাদনকারীদের জীবিকাকে ব্যাহত করছে।
আভেশ ভাই বলেন, "আমাদের এই পেশা সম্পূর্ণ আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন আবহাওয়া পাল্টে যাচ্ছে।"
কচ্ছের ছোট্ট রণ প্রায় ৫ হাজার বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত। বর্ষাকালে মৌসুমি নদীগুলো মরুভূমিতে চলে যায় এবং সমুদ্রের পানি সরাসরি উপকূলের কাছাকাছি জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি মরুভূমিকে একটি কার্যকরী দুর্গম জলাভূমিতে রূপান্তরিত করে।
প্রতি সেপ্টেম্বরে সমুদ্র পিছিয়ে যায় এবং মৌসুমি নদীগুলো শুকিয়ে গেলে সমতল ভূমির বিশাল বিস্তৃতি দেখা যায়। এই সময়েই লবণ উৎপাদন শুরু হয়ে পরের বছরের মার্চ এবং এপ্রিল পর্যন্ত চলতে থাকে।
সাধারণত দুই ধরনের লবণ উৎপাদনকারী আছে। উপকূলের কাছাকাছি এবং হাইওয়েতে সহজেই প্রবেশ করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার একর জমি জুড়ে লবণ তৈরি করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত করকচ তৈরি করে যা একটি পাউডারি ধরনের লবণ এবং
প্রতি দুই মাস পরপর তৈরি করা যায়। কিছু আগরিয়া উপকূলের কাছাকাছি কাজ করে এবং করকচ তৈরি করে।
তবে বেশিরভাগ আগরিয়ারা উপকূল থেকে আরও ভেতরে কাজ করে এবং ভাদাগার লবণ তৈরি করে। এই ধরনের লবণ বড় স্ফটিক দিয়ে তৈরি এবং উৎপাদন করতে আট মাস সময় লাগে।
লবণ তৈরির মাসের শুরুতে আগারিয়ারা ট্রাক্টর ভাড়া করে। রেশন এবং তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সেই ট্রাক্টর বোঝাই করে। তারপর তারা শহর ও গ্রাম থেকে জলাভূমির মধ্য দিয়ে মরুভূমির যেখানে লবণের খামার আছে সেখানে পৌঁছায়।
তারা বাঁশ এবং ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী কুঁড়েঘর তৈরি করতে থাকা অবস্থায় জলাভূমি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যায় যেটি পরবর্তী আট মাস লবণ তৈরির জন্য উপযুক্ত।
সৌরচালিত মোটর দিয়ে প্রায় এক ফুট গভীর বড় এবং অগভীর গর্তে লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানি পাম্প করা হয়। সেখান থেকে সামান্য ঢালু নালার মধ্য দিয়ে পরপর আরো চারটি গর্তে পানি প্রবাহিত হয় যা আগারিয়ারা প্রতি বছর খনন করে। এই প্রক্রিয়ায় পানি বাষ্পীভূত হয় অবশিষ্ট পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি করে। মার্চ এবং এপ্রিলের মধ্যে চূড়ান্ত গর্ত থেকে পানি প্রায় সম্পূর্ণরূপে বাষ্পীভূত হয়ে লবণের স্ফটিক তৈরি হয় এবং আগরিয়ারা তা সংগ্রহ করে।
আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং জলবায়ুর তারতম্য এই উৎপাদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
আগারিয়াদের মধ্যে যারা বয়স্ক তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বেড়েছে। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় শুধু সৌর প্যানেল, অস্থায়ী কুঁড়েঘর এবং লবণের গুণমানের ক্ষতি করার পাশাপাশি লবণ উৎপাদনের মৌসুমকেও ছোট করে ফেলছে।
আইএসএমএর রাভাল বলেন, "সাধারণত জুনের শেষে লবণের মৌসুম শেষ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় মে মাসে আঘাত হানার কারণে কার্যকরভাবে এক বা দুই মাস আগে লবণ উৎপাদনের কাজ শেষ হয়ে যায়। দুই মাস আগেই উৎপাদন শেষ হওয়া মানে প্রায় ৬০ লাখ টন লবণের ক্ষতি।"
৫২ বছর বয়সী আগারিয়া করিম জুমা উল্লেখ করেন, ঘূর্ণিঝড়ের সাথে শক্তিশালী জোয়ার নদীর মাধ্যমে মালিয়া পর্যন্ত লবণাক্ত পানি বহন করে। পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে চলাচলের রাস্তাগুলোকে ডুবিয়ে দেয় পানি কমতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
তিনি বলেন, "এই সময়ে পানির জন্য আমার গাড়ি নিয়ে মরুভূমিতে প্রবেশ করতে পারি না। তখন আমাদের সংগ্রহে থাকা বিক্রয়যোগ্য লবণ আমরা কারখানায় বিক্রি করার জন্য পরিবহণ করতে পারি না।"
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মোরবি জেলায় দেব সল্টের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোরও ক্ষতি হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর ৭ হাজার একর জায়গা আগারিয়াদের লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি যান্ত্রিক সংস্করণের মাধ্যমে প্রতি বছর ৫ লক্ষ টন লবণ তৈরি করে।
গত বছর ঘূর্ণিঝড় বিপর্যয়ের কারণে বড় ক্ষতি হয় প্রতিষ্ঠানটির। ঘূর্ণিঝড় এবং তার সাথে উঁচু জোয়ার মরুভূমিকে করে এবং প্রতিষ্ঠানটি মরুভূমিতে লবণ উৎপাদনের কাজ করায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দেব সল্টের শিল্প সম্পর্ক ও যোগাযোগ কর্মকর্তা বিবেক ধ্রুণার ভাষ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটি তার লবণ উৎপাদনের ৫০ শতাংশ ক্ষমতা হারিয়েছে।
মোরবিতে লবণ উৎপাদককারীরা পাঁচ ফুট উঁচু মাটির বাঁধ তৈরি করেছে যাতে সারা বছর ধরে উঁচু জোয়ারের কারণে আসা সমুদ্রের পানি লবণের প্যানের সাথে মিশে না যায়।
তবে ধ্রুনা উল্লেখ করেছেন, প্রায়ই এই বাঁধগুলো তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সহ্য করতে পারে না।
আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য, আগারিয়াদের এই অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ঘটনাকে সমর্থন করে। ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের কচ্ছের তিনটি শহরে (কান্ডলা, মুন্দ্রা এবং নালিয়া) অবস্থিত আবহাওয়া স্টেশনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে 'বৃষ্টির দিন' বৃদ্ধি পেয়েছে৷
বিশেষ করে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল এবং ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কান্ডলায় বৃষ্টির দিনগুলোর মাত্রা গড়ে ১২ দিন থেকে ২০ দিন পর্যন্ত বেড়েছে৷ একই সময়ের মধ্যে, মুন্দ্রাতে ১৪.৬ দিন থেকে ২০ দিন এবং নালিয়াতে ৯.৮ দিন থেকে ১৪.৩ দিন বৃদ্ধি পেয়েছে৷
অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য এই অঞ্চলের বাঁধগুলোতে (যেমন নর্মদা এবং মাছু বাঁধ) প্রায়ই ধারণক্ষমতার বেশী পানি হলে কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয় যা খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে কিছু খাল লবণের প্যানের কাছাকাছি প্রবাহিত হয়।
লবণ চাষীরা উল্লেখ করেছেন, যদি এই মিঠা পানি মরুভূমিতে চলে যায় তাহলে তা আগারিয়াদের গর্তে থাকা লবণের সাথে মিশে যেতে পারে।
একজন লবণ উৎপাদনকারী দেলাভাই খাম্বালিয়া বলেছেন, "এটি পানিতে লবণাক্ততার মাত্রাকে পাতলা করে এবং আমাদের আবার শুরু থেকে লবণ তৈরি করতে হয়।" তিনি সাভাদিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বসবাস করেন এবং মরুভূমিতে তার কুঁড়েঘর রয়েছে।
খাম্বালিয়া আরো বলেন, "আমাদের লবণাক্ত প্যানে মিঠা পানি প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য আমাদের বাঁধ তৈরি করতে হবে।"
আগারিয়ারা হাত দিয়ে যে বাঁধগুলো তৈরি করে সেগুলো প্রায় দুই ফুট উঁচু মাটির তৈরি বাঁধ। এই বাঁধ নির্মাণ একটি সময়সাপেক্ষ কাজ যা তাদের লবণ উৎপাদনের গতিকে প্রভাবিত করে।
বর্ষাকাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ও অমৌসুমি বৃষ্টির কারণে লবণ তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
গত বছর, ৬০ বছর বয়সী দেব ভাই সাভাদিয়া শুধু অক্টোবরে তার গ্রাম পাটদি থেকে মরুভূমিতে ৩০ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কারণে তার লবণ তৈরির প্রক্রিয়া এক মাস বিলম্বিত হয়েছিল।
তিনি বলেন, "বর্ষা দেরিতে শেষ হয়েছে এবং মরুভূমিতে এখনও পানি আছে। তাই আমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারিনি।"
সাধারণত জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত গুজরাটে বর্ষা চলে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেপ্টেম্বর এমনকি অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে।
এক মাস বিলম্বের অর্থ হল সাভাদিয়া সম্ভবত লবণ উৎপাদনের হারানো সময় পূরণ করতে আরও এক মাস থাকবে। কিন্তু এই বর্ধিত সময়কাল ঘূর্ণিঝড়ের আগমনের সাথে মিলে যাবে।
তিনি আরো বলেন, "গ্রীষ্মের মাসগুলোতে বেশিক্ষণ থাকার মানে হল, আমরা ধুলো ঝড় এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি নেব। এর ফলে লবণের সাথে ধুলো মিশে যায়।"
বৃষ্টি অন্যান্য উপায়েও লবণ উৎপাদন ব্যাহত করে।
দেব সল্টের ধ্রুনা বলেন, "অসময়ের বৃষ্টির সাথে থাকা মেঘ বাষ্পীভবনের হার কমিয়ে দেয়।"
এই কারণে লবণ উৎপাদনের কাজ পিছিয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়ায় লবণ তৈরি করতে অতিরিক্ত দেড় মাস সময় লাগতে পারে।
সাভাদিয়া বলেন, "আজকাল আমরা মরুভূমিতে আসার পরে অন্তত তিন থেকে চার বার বৃষ্টি হয় যা আগে ঘটেনি।"
গত বছর অমৌসুমি বৃষ্টিতে তার ১০ একর লবণের প্যান নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তিনি তৈরি করা প্রায় ১৩ শ টন লবণের মধ্যে ৫০০ টন হারিয়েছেন। এতে তার বার্ষিক আয় থেকে প্রায় ১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
লবণ উৎপাদনকারীরা স্ক্রলকে জানিয়েছেন, যদিও ঘূর্ণিঝড় এবং অতিরিক্ত ও অমৌসুমি বৃষ্টির ফলে তারা উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা পায়নি। আগারিয়াদের পাশাপাশি বড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা বলেছে, তারা কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি।
সুরেন্দ্রনগরে অবস্থিত গুজরাটের ঐতিহ্যবাহী লবণ প্রস্তুতকারকদের সমিতি আগারিয়া হিত্ররক্ষক মঞ্চের সমন্বয়কারী ভারত সোমেরা জানিয়েছেন, ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় টাউকটের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রায় ৩ হাজার ৫০০ লবণ উৎপাদনকারী পরিবারের মধ্যে মাত্র ৭৫টি পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।
সোমেরা বলেন, "এই ক্ষতিপূরণ শুধু তাদের দেওয়া হয়েছিল যাদের লবণ স্ফটিক হয়ে গিয়েছিল এবং ঝড়ের কারণে ক্ষতি হওয়ার আগেই লবণ সংগ্রহ করে ফেলেছিল।"
হিত্ররক্ষক মঞ্চের অন্যতম প্রধান পঙ্ক্তি জোগের ভাষ্যমতে, যারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তারা তাদের প্রতিটি লবণের প্যানের জন্য মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছেন যেটি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য খুবই সামান্য সাহায্য।
মালিয়াতে আগারিয়ারা ক্ষতিপূরণের দাবিতে জেলার অধিকারীদের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে।
রাজেশ ভিমানি নামে এক আগরিয়া যুবক বলেছেন, "এমনকি আমরা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমাদের লবণের ক্ষয়ক্ষতির ভিডিও প্রকাশ করেছি। অধিকারিরা গত বছর ক্ষয়ক্ষতি জরিপ করতে আসলেও আমরা এখনও পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি।"
লোকসানের জন্য আর্থিক সহায়তা না থাকায় অনেক আগারিয়াকে টাকা ধার করতে হয়।
সুরেন্দ্রনগর জেলায় লবণের প্যানগুলি নিকটতম পৌরসভা থেকে ৩০ কিমি থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। আগরিয়ারা এখানে ব্যবসায়ীদের কাছে লবণ বিক্রি করে। এই ব্যাবাসায়ীরা এখানে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করে। এই ব্যবসায়ীরা ব্যয়বহুল পরিবহণ খরচের কারণে আগারিয়াদের কাছে থেকে কম দামে (প্রতি টন মাত্র ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে) লবণ কেনে। আগারিয়ারা যখন লোকসানের সম্মুখীন হয় তখন তারা প্রায়ই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধার করে পরের বছরও লোকসানের শিকার হলে তারা ঋণের চক্রে আটকা পড়ে।
আগারিয়ারা যে ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তা তারা কোন ধরনের লবণ উৎপাদন করে তার উপর নির্ভর করে ।
আগারিয়া হীত্ররক্ষকের ম্যানেজিং ট্রাস্টি হরিনেশ পান্ড্য বলেন, "যেহেতু ভাদাগার লবণ বছরে একবার তৈরি হয় সেহেতু ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টি হলে আর্থিক ক্ষতি বেশী হয় কারণ পুরো মৌসুমের প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যায়। করকচের ক্ষেত্রে ক্ষতি কম কারণ এই ধরনের লবণ দুই মাস পরপর উৎপাদন করা যায়।"
পান্ড্য বলেন, মঞ্চ ভাদাগার লবণ উৎপাদনকারীদের ঝুঁকি কমাতে করকচ তৈরি করতে উৎসাহিত করছে এবং তাদের প্রচেষ্টা কিছুটা সফল হয়েছে।
একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসাবে আইএসএমএ দাবি করছে, লবণকে খনির পণ্য হিসেব না করে একটি কৃষি পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করা হোক।
রাভাল বলেন, "লবণকে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর সমস্ত প্রভাবের মুখোমুখি হয় যেমনটা কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে হয়।"
এর ফলে, লবণে একটি ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে লবণের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি উৎপাদনকারীদের ফসলি বীমা করার অনুমতি পাবে।
পঙ্ক্তি জোগ বলেন, "এই ধরনের বীমা অমৌসুমি বৃষ্টি এবং ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে লবণ চাষীদের সাহায্য করবে। তিনি এটি ক্ষয়ক্ষতি এবং ক্ষতিপূরণের মূল্যায়নের জন্য একটি সঠিক নীতিমালা তৈরি করতে সাহায্য করবে।"
কিন্তু লবণ উৎপাদনকারীরা জানিয়েছেন, সরকারের কাছ থেকে সমর্থন কমে আসছে।
দেব সল্টের ধ্রুনা বলেন, আগের বছরগুলোতে রাজ্য সরকারের শিল্প তদারকি করার জন্য একটি অফিস ছিল কিন্তু তারপর সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
লবণ কমিশনারের কার্যালয় নামে পরিচিত অফিসটি মান নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণের মতো বিষয়গুলি তত্ত্বাবধান করে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লবণের উৎপাদনের কাজে ক্ষয়ক্ষতি হলে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ ছিল।
২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক বিষয়ক বিভাগের সুপারিশে অফিসটি বন্ধ করার এবং পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
রাভাল বলেন, "এটিই একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক বিভাগ ছিল যা লবণ এবং উৎপাদনকারীদের খেয়াল রাখতো। কিন্তু এটি বন্ধ করে করে দেওয়া হয়েছে এবং পুরো শিল্পটি আসলে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়