ফেলে আসা সেসব স্টুডিওর দিন
আমার ফুপুর বিয়ে হয় ২০০৬ সালে। বিয়ের আগে যখন বায়োডাটার ছবি লাগবে, আমার মা তখন তাকে নিয়ে চলে গেল লালবাগের কোনো এক স্টুডিওতে। যাবার সময় ব্যাগে করে কিছু ভালো শাড়ি নিয়ে গেল। সেইসাথে ম্যাচিং করে গয়নাগাটি, লিপস্টিক, আর পাউডার তো আছেই। ছবিগুলো ওয়াশ করিয়ে আনার পর দেখলাম অনেকগুলো ছবি। কোনোটায় ফুপু চুল ছেড়ে হাতের ওপর মাথা ভর করে রেখে তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। কোনোটায় আবার দাঁড়ানো, কোনোটায় সোজাসুজি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে। আবার একটায় টিয়া সোনালি কাজের জর্জেট শাড়ি, সাথে স্টোনের নেকলেস, একটায় আবার লাল-নীল সুতির শাড়ি, সাথে কাঠের, মাটির গয়না। এরকম মোট দশটা ছবি। ছবিগুলো এখনো বাসার পুরোনো অ্যালবামে রাখা।
আশির দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত স্টুডিওতে গিয়ে এই ছবি তোলা ছিল অতি সাধারণ একটি বিষয়। তা সে পাত্র-পাত্রীকে দেবার জন্য হোক, বিদেশি ভিসার জন্য হোক, কিংবা একাডেমিক কাজ বা শখের বশে হোক। যেহেতু তখনও হাতে হাতে মোবাইল বা ডিজিটাল ক্যামেরা আসেনি, তাই স্টুডিওতে গিয়েই ছবি তুলতে হতো। যে কারণে মহল্লার ভেতরেই অন্তত পাঁচটা ছয়টা করে স্টুডিও থাকত তখন।
ঢাকার প্রথম স্টুডিও
ইন্টারনেটের বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে জানা যায়, ঢাকার প্রথম স্টুডিও ছিল আর সি দাস অ্যান্ড সন্স। যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১০ সালে, ১৬ নম্বর নবাবপুর রোডে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত 'বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা'র 'চারু ও কারু কলা' অংশে গবেষক অনুপম হায়াৎও একই কথাই বলেছেন।
তবে এ দাবি নাকচ করে দিয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার 'ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন অন্য একটি স্টুডিওর কথা, যা ১৯০৩-০৪ সালের দিকে ফ্রিৎজ ক্যাপ নামের এক জার্মান আলোকচিত্রী প্রতিষ্ঠা করেন।
আবার বেশকিছু প্রতিবেদনে ঢাকার প্রথম স্টুডিও হিসেবে বলা হয়েছে নবাবগঞ্জের স্টুডিও এইচের কথা। এই স্টুডিও নাকি সাতচল্লিশের আগেই ছিল এবং স্বাধীনতার পর বন্ধ হয়ে গেছে। একসময়ের স্বনামধন্য স্টুডিও পদ্মা, হানসা, কামার স্টুডিও, ফটোমুভির কর্ণধারদের সঙ্গে কথা বলেও স্টুডিও এইচের কথা জানা যায়। তারা জানান, পঞ্চাশের দশক থেকেই শুরু হয় স্টুডিওর যুগ। তবে তা ছিল অভিজাতদের দরজা পর্যন্তই সীমিত। সাধারণ মানুষের দরজায় ফটোগ্রাফি এসে পৌঁছে আশি ও নব্বইয়ের দশকে। আর সে সময়টাতেই দেশে জমজমাট স্টুডিওকেন্দ্রিক ফটোগ্রাফি চর্চার আয়োজন শুরু হয়।
স্টুডিওতে ছবি তোলার জন্যও থাকত আলাদা বাজেট
'এখন যেমন বৈশাখ, পূজা, ঈদ, নতুন জামাকাপড় বা অন্যান্য খরচের জন্য আয়ের একটা অংশ তুলে রাখা হয়, তখন স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলবে বলে একটা বাজেট রাখা হতো। সে ধনী বা গরীব হোক, সামর্থ্য অনুযায়ী একটা অংশ রাখা হতোই। ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ছুটির দিনে ঘুরতে বের হলেই স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব মিলে চলে যেত স্টুডিওতে'—জানান পদ্মা স্টুডিওর আক্কাস মাহমুদ।
এসব ছুটির দিনে স্টুডিওগুলোতে সন্ধ্যার পর লেগে থাকত প্রচণ্ড ভিড়। কারণ সারাদিনের কাজকর্ম শেষে সবাই আসত কয়েকটা ছবি তুলতে। অনেকে আবার ঈদের দিন নামাজ শেষে সেমাই খেয়েই ছেলেমেয়ে, পরিবার সমেত চলে যেতেন স্টুডিওতে। স্টুডিওগুলোও তখন লাইটিং করা হতো, যাতে দূর থেকেই মানুষ চিনতে পারে, ওখানে একটি স্টুডিও আছে!
সামর্থ্যের কারণে অনেকেই এত ছবি তুলতে পারত না। অনেক মাকে দেখেছি, টাকার অভাবে সন্তানের শখ মেটাতেই শুধু আসতেন। বাচ্চাটি যখন কাপড় ধরে টেনে বলত, মা চলো তোমার সাথেও তুলি। তখন মা বলতেন, বাবা, বেতন পেলে একদিন আসব আবার। সেদিন তুলব। আজ না বাবা। এগুলো দেখলে খুব কষ্ট লাগত। তখন আমরা এমনিই ছবি তুলে দিতাম কিছু।
ঈদ, পুজো-পার্বণ ছাড়াও ছবি তোলা মানেই ছিল তখন এক অন্যরকম আনন্দ। মন ভালো লাগছে না, হাতে কিছু টাকাও আছে, ব্যস, চলে যাই স্টুডিওতে!
তিন-চার ঘণ্টা ধরে একজনের ছবি তুলে যেতে হতো
এখন আমরা স্টুডিও বলতে বুঝি একাডেমিক, ভিসা বা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে লাইটের সামনে বসে গম্ভীর মুখে ছবি তোলা। তাতে কান দেখা যেতে হবে, চশমা খুলে নিতে হবে…আরও কত কী। তিন থেকে পাঁচ মিনিটে ছবি তোলা আর দশ থেকে পনেরো মিনিটেই সে ছবি হাতে পেয়ে যাওয়া। কিন্তু সেকালে স্টুডিও ছিল এক শৌখিন জায়গা। হ্যাঁ, তখনও প্রাতিষ্ঠানিক কারণে বা প্রয়োজনে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলত মানুষ। কিন্তু একইসাথে বিনোদন আর শৌখিন জায়গাও হয়ে উঠেছিল এই স্টুডিও।
কৃত্রিম পাহাড়, জঙ্গল, পানির ঝরনা, আইফেল টাওয়ার, তাজমহল, নদী, সুন্দরবনের বাঘ, ভালুক—নানা রকম প্রাকৃতিক দৃশ্য বা স্থাপনার ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তোলা ছিল তখনকার একটি স্টাইল। সাথে থাকত আলাদা কাঠের সিঁড়ি, বারান্দা, আলাদা টেলিফোনের ব্যবস্থা, যাতে গ্রাহকরা এসে নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে ছবি তুলতে পারে। কেউ হয়তো ফোনটা কানে নিয়ে প্রিয়জনের সাথে ফোনে কথা বলছে, এমন মিষ্টি মুখ করে কথা বলছে। কেউ আবার ঠোঁটে বাঁশি ধরে পেছনে কোনো গ্রামের দৃশ্য রেখে ছবি তুলছে। কারও কারও আবার শখের ছবির জন্যও পেছনে সাদা বা একরঙের ব্যাকগ্রাউন্ডই পছন্দ ছিল। কেউ কেউ আবার চিত্রালি সিনেপত্রিকা, পূর্বালীর ছবিগুলো কেটে কেটে রাখতেন, আজাদ প্রডাক্ট ভিউ কার্ড মার্কেটে ছাড়লে সেগুলো নিয়ে আসতেন। সালমান শাহ, শাবনূর, মৌসুমীসহ তাতে থাকত বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ছবি। ওগুলো দেখে পোজ দিতেন তারা।
একটি স্টুডিও মানেই ছিল তখন ঘরোয়া একটি পরিবেশ। যাতে আস্তে-ধীরে অনেক সময় নিয়ে বিভিন্ন পোজে কয়েক ঘণ্টা ধরে ছবি তোলা যেত। মাঝে বিরতি নিয়ে চা বিস্কুট খাওয়া হতো।
কিছু কিছু তরুণ-তরুণী আসত একদম লাগেজভর্তি কাপড়, ব্যাগ নিয়ে। এসে এক একটা কাপড় বদলাত আর বিভিন্ন পোজে ছবি তুলত। 'তিন-চার ঘণ্টা ধরে একজনের ছবি তুলে যেতাম আমরা। অনেকসময় বাড়তি কাপড় রেখে দিতাম সাথে। ছবি তুলতে তুলতে ঘেমে ভিজে গেলে, কাপড় বদলে অন্য একটা পরে নিতাম। তবে ঈদের দিনে এটা বেশি হতো,' বলেন স্টুডিও পদ্মার কর্ণধার আক্কাস মাহমুদ।
এ বিষয়ে একবারের ঘটনা জানান একসময়ের নিউমার্কেটের বিখ্যাত স্টুডিও হানসা ফটোস্টুডিওর কর্ণধার জাহিদ হোসেইন। তিনি বলেন, 'লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতার জন্য হলিক্রস কলেজ, ইডেন থেকে বহু তরুণী এসে ছবি তুলেছিল, আমার মনে আছে। সারা দিনব্যাপী তাদের ছবি তুলতাম আমি তখন। তাদের তুলে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অন্যদেরটাও তুলে দিতাম আবার।'
'আপনাদের এখানে কিছুই নাই, আর আসব না।'
যারা অবস্থাসম্পন্ন বা শিক্ষিত শ্রেণি তারা নিজেরাই ব্যাগে করে নিয়ে আসত পোশাক-আশাক, আনুষঙ্গিক সবকিছু। কিন্তু যেসব স্টুডিওর গ্রাহকশ্রেণি থাকত একটু অসচ্ছল বা অনগ্রসর ব্যক্তিরা, তাদের জন্য স্টুডিওগুলোই রেখে দিত বিভিন্ন শাড়ি, লিপস্টিক, আলগা লম্বা চুল, সানগ্লাস, পাউডার, কাজল এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাজা-রানির পোশাকও!
আর যদি বা এসব না থাকত, গালমন্দও কম শুনতে হতো না! যেসব স্টুডির লক্ষ্য ছিল অভিজাত বা শিক্ষিত শ্রেণি, সেসব স্টুডিওতে সাধারণত এত কিছু থাকত না। হয়তো ঘামটুকু মুছে নেওয়ার জন্য একটি তোয়ালে, একটা পাউডারবক্স—এই তো। কিন্তু কিছু কিছু গ্রাহকদের তাতে হতো না। তারা এসব না পেয়ে বলে যেতেন, 'আপনাদের এখানে কিছুই নাই, আর আসব না।'
'কোনো কোনো নারী এসে আবার ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলত। খুলে জিজ্ঞেস করত, "আপনাদের এখানে আলগা চুল আছে…আছে? এটা আছে, ওটা আছে?" না থাকলে সটাং করে দরজাটা আটকে বেরিয়ে যেতেন'—বলেন আক্কাস মাহমুদ। আবার পেছনের দৃশ্য বেশি না থাকলে যাওয়ার সময় 'আপনার স্টুডিও ভালো না, আর আসব না', বলে বেরিয়ে যেত অনেকেই।
আসলে এ শ্রেণির মানুষদের সন্তুষ্ট করা কঠিন ছিল। অনেক সময় ক্যামেরায় এক্সপোজারের কারণে চোখ বন্ধ হয়ে গেলেও গ্রাহকের গালমন্দ শুনতে হতো তাদের। যদিও ডিজিটাল ক্যামেরা আসার আগে ছবি কেমন হয়েছে তা আগেই দেখে নেওয়ার সুযোগ ছিল না, তাই ছবি প্রিন্ট করানোর পর যখন কিছু ছবি নষ্ট আসত—হয়তো পলক পড়ে গেছে বা নড়ে গেছে বা অন্যকিছু—তখন গ্রাহকরা রেগে যেতেন। কেন ফটোগ্রাফার দেখলেন না, কোনো অভিজ্ঞতা নেই—এ-জাতীয় কথা শুনতে হতো।
ছেলেদেরও ছবি তোলার কতশত পোজ ছিল। চুলের কাটিং নিয়ে কত উদ্বেগ ছেলেদের! ছবি তোলার আগে তারাও মুখে একটু পাউডার, আর চুলে পানির ছিটা দিয়ে পরিপাটি হয়ে নিত। 'একবার একজন যুবক এলেন। অনেকক্ষণ ধরে ডানে-বামে বসে, শুয়ে নানাভাবে পোজ দিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছিলেন। একসময় তিনি দরজার দিয়ে বেরিয়ে গাড়ির কাছে গেলেন। গাড়ি থেকে একটা ভিসিডি প্লেয়ার নিয়ে ঢুকলেন স্টুডিওর ভেতরে। এরপর বললেন, আমি এখন গানের তালে তালে নাচব, আর তুমি ছবি তুলতে থাকবে। আমি তো কাণ্ড দেখে অবাক, আর মনে মনে ভাবছি, এত ছবি তুলছে, এ কি শেষ পর্যন্ত বিল দিয়ে যেতে পারবে? পরে দেখি তিনিই আমাদের নায়ক সোহেল চৌধুরী। এখানে তুলে যাওয়া সেই ছবিগুলো দিয়েই তিনি নায়ক হয়েছিলেন,' বলেন আক্কাস মাহমুদ।
আবার শিশুদের ছবি তুলতে গেলে বেগ পেতে হতো কিছুটা। এক বছরের ছোটো হলে, তাদের কোথাও বসিয়ে রেখে ছবি তোলা যেত না। গড়িয়ে একপাশে পড়ে যেত। আবার হাই ভোল্টেজ লাইট অন করলেই কেঁদে দিত অনেকসময়।
ছোটোদের না শুধু, বড়দেরও বেলায়ও বারবার দেখে নিতে হতো, ক্যামেরা সামনে বসা ব্যক্তির কাঁধ, চোখ, মুখ, হাত-পা সব ঠিক আছে কি না। সামনে বসে থাকা সবার মাথা, চিবুকে হাত দিয়ে আর কাঁধে চাপ দিয়ে সবার পজিশন ঠিক করে দিয়ে তারপর বড় স্ট্যান্ডের জোড়া লাইট জ্বালাতে হতো। তারপর শেষবারের মতো সবাইকে আরেকটু দেখে নিয়ে, ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে 'মুখ একটু উপরের দিকে তুলেন', এবং 'সামনের দিকে তাকান' বলে এরপর 'রেডি' শব্দটি উচ্চারণ করে ক্যামেরার বাটন টিপতে হতো। আর উঠে যেত ছবি। এখনো অবশ্য ফটোগ্রাফারের এসব নির্দেশনা মেনে চলতে হয় বিয়ে-জন্মদিনের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কিন্তু তখন ছিল ফিল্মের যুগ। ডিজিটাল আসেনি। তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আলোর সামনে ঘেমে একাকার হয়ে তুলতে হতো এসব ছবি।
অবাঙালির হাত ধরে
ঢাকায় ফটোগ্রাফি বা স্টুডিও ব্যবসা মূলত শুরু হয় অবাঙালিদের হাত ধরেই। নিউমার্কেটে যে ১৭টি দোকান ছিল, তার মধ্যে ১৪টিই ছিল অবাঙালি দোকান। সিকো, চিত্রা, ইমেজ, ফটোপ্লে ইত্যাদি ছিল সে স্টুডিওগুলোর নাম। যেমন হানসার আগের নাম ছিল মিনারবা, যা ছিল অবাঙালিদের দোকান। আর ছিল চিত্রা।
স্বাধীনতার সময় এরা চলে গেল। যারা এসব স্টুডিওর কর্মচারী ছিলেন, স্টুডিওগুলো চালানোর জন্য সরকার তাদেরই লিজ দিলো। সবচেয়ে বেশি নামডাক ছিল আকস স্টুডিওর। আস্তে আস্তে দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সতেরোটা থেকে চারটায় এসে থামে। এখন আছে একটাই।
ঢাকার একসময়কার জনপ্রিয় স্টুডিওগুলো
রাজধানীর একসময়কার জনপ্রিয় স্টুডিওগুলোর মধ্যে রয়েছে লালবাগের ম্যানিলা, গুলশানের কুইক ফটো, গ্লিটার ও ভিআইপি স্টুডিও, বেইলি রোডের ফটোম্যাটিক, তোপখানা রোড বা প্রেসক্লাবের সামনে ছিল কামার স্টুডিও, হাটখোলা রোডের স্টুডিও ২৭, আরামবাগের ডালাস, এলিফ্যান্ট রোডের ফুজি ও মাস্টার কালার, নিউমার্কেটের ফটোমুভি অ্যান্ড স্টিলস, ধানমন্ডির ফটোহাট ও মান্নাস হ্যাভেন, লালমাটিয়ার কালার ওয়ার্ল্ড, মিরপুর-১ এলাকার এশিয়া স্টুডিও, মগবাজারের পদ্মা স্টুডিও ইত্যাদি।
নিউমার্কেট, মগবাজার—ঢাকার এদিকটায় আসত মূলত অভিজাত বা শিক্ষিতরা। অভিজাত স্টুডিও ছিল ফটোমেটিক, প্রেসক্লাবের সামনে স্টুডিও কামার, স্টেডিয়ামে ছিল স্টুডিও ফটোগ্রাফো, হাটখোলাতে ছিল স্টুডিও ২৭। স্টুডিওপাড়া এক লাইনেই ছিল চল্লিশটা। ছবি তোলা মানেই মানুষ ভাবত হয় হাটখোলায় যেতে হবে, নয়তো নিউমার্কেট! ইস্কাটনের অনেক বাসিন্দা ছিল যারা নিউমার্কেট যেত। শিল্পী, শিক্ষিত সংস্কৃতমনা শ্রেণি যেত মগবাজারে পদ্মা স্টুডিওতে, আবার তোপখানা রোডে অবস্থিত প্রেসক্লাবের সামনে ছিল কামার স্টুডিও। যেখানে যেত বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বাকিদের ভিড় থাকত রায়ের বাজার, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জের মতো জায়গায়।
স্বামী-স্ত্রীর ছবি তুলে মামলায় সাক্ষী দিতে হয়েছে
কেউ কেউ নিয়মিত বা মাসে একবার করে আসতেন স্টুডিওতে। আক্কাস বলেন, কিছু জুটি ছিল তারা প্রতি মাসে আসতেন ছবি তুলতে। বা কোথাও হয়তো ঘুরতে গিয়েছেন, ফেরার পথে ছবি তুলে যেতেন। অনেক জামাই-কনে তো বিয়ের দিনই রিকশায় করে এসে ছবি তুলে যেতেন।
আবার কিছু মা ছিলেন যারা প্রতিমাসে বাচ্চাকে নিয়ে আসতেন। সামনে একটি দুধের কৌটা ফেলে রেখে বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিতেন। বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে ওটা ধরতে যাচ্ছে, এমন ছবি তুলতে হতো। এভাবে প্রতিমাসে একটু একটু করে বাচ্চার বড় হওয়াটার স্মৃতি রেখে দিতেন অনেক মা।
আবার সামর্থ্যের কারণে অনেকেই এত ছবি তুলতে পারত না। 'অনেক মাকে দেখেছি, টাকার অভাবে সন্তানের শখ মেটাতেই শুধু আসতেন। বাচ্চাটি যখন কাপড় ধরে টেনে বলত, মা চলো তোমার সাথেও তুলি। তখন মা বলতেন, বাবা, বেতন পেলে একদিন আসব আবার। সেদিন তুলব। আজ না বাবা। এগুলো দেখলে খুব কষ্ট লাগত। তখন আমরা এমনিই ছবি তুলে দিতাম কিছু,' বলেন আক্কাস।
এছাড়া স্টুডিও হয়ে উঠেছিল সামাজিক সম্পর্কের সেতু। কত বিয়ের শুরু যে এই স্টুডিও, তা হয়তো আজ এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভাবা বিস্ময়কর হবে। কিন্তু ছবি তুলতে এসে দেয়ালে টাঙানো কোনো মেয়ের কিংবা ছেলের ছবি দেখে অনেক বাবা-মা-ই পছন্দ করে যেতেন পুত্রবধূ বা কন্যাজামাই হিসেবে। আবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, কিন্তু না জানার কারণে সে ছবি দেয়ালে টাঙানো থাকায় বহুদিন পর যখন সাবেক স্ত্রী সেই ছবি দেখলেন, নিজেই ছবিটি ছিঁড়ে ফেলেছেন, এমন ঘটনাও আছে।
আবার এমন গল্প আছে যে কোনো বাবা ছেলেকে নিয়ে এসেছেন পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলতে। এসে দেখলেন দেয়ালে টাঙানো তার ছোটোবেলার একটা ছবি। সাথে আছেন তার মরহুম বাবাও। হয়তো ছোটোবেলায় নিজের বাবার সাথে এসে তোলা হয়েছিল ছবিটা। আজ বাবা বেঁচে নেই, নিজের ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। দেয়ালে ঝোলানো বাবার সাথে নিজের ছোটোবেলার ছবি দেখে আবেগে চোখে পানি চলে এসেছে। পরে নিজেই এক কপি নিয়ে গেছেন সে ছবির।
আবার পালিয়ে বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রীর ছবি তুলে মামলায় সাক্ষী দিতে হয়েছে, এমন স্মৃতিও আছে এসব স্টুডিওর ঝুলিতে!
স্টুডিওপাড়া
দৈনিক প্রথম আলোর ২০২৩ সালের 'ছবি হওয়ার পথে ছবি তোলার ব্যবসা' শিরোনামের প্রতিবেদনে শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আশির দশকে রাজধানীর পুরান ঢাকার হাটখোলা এলাকায় একসারিতে অর্ধশত ছবি তোলার স্টুডিও ছিল। জায়গাটি তখন ঢাকাবাসীর কাছে পরিচিত ছিল 'স্টুডিওপাড়া' নামে। ইত্তেফাক মোড় থেকে অভিসার সিনেমা হল হয়ে টিকাটুলী পর্যন্ত রাস্তায় একসারিতে অর্ধশতের বেশি স্টুডিও ছিল। নিউমার্কেট এলাকায়ও ছিল ১৭টি স্টুডিও। রাজধানীর কিছু কিছু এলাকা পরিচিত ছিলই স্টুডিওপাড়া নামে। সেগুলোর মধ্যে টিকাটুলির হাটখোলা রোড, লালবাগ, নিউমার্কেট, ঢাকা স্টেডিয়াম, মোহাম্মদপুরে, গ্রিন রোডে, নারায়ণগঞ্জ অন্যতম। যেমন গ্রিন লাইফ হাসপাতাল এখন যেখানে ঠিক সে লম্বা রাস্তাটা ধরে ছিল মোনালিসা, নাহার, ফ্রেন্ডস, পিঙ্কি, স্টুডিও ফটোফেয়ার, কালার ইমেজ, হাকসা স্টুডিও। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো পিংকি আর মোনালিসা। এরপরেই পুরোনো হলো নাহার স্টুডিও। যা এখনো টিকে আছে কোনোমতে। রাস্তার উপর থেকে এটি বর্তমানে ভবনের দোতালায় চলে যাওয়াতে চোখেও পড়েনা পথিকের। পিংকি স্টুডিওটি নাকি নায়করাজ রাজ্জাক উদ্বোধন করেছিলেন। এ দুটো একও জায়গা থেকেই আলাদা হয়েছে। নায়ক নায়িকাদের ভিড় লেগে থাকত মগবাজারে। আশির দশকের পদ্মা স্টুডিওর জন্মের আগেও সেখানে ছিল আরেক শিল্পী আমিরুল হক চৌধুরীর একটি স্টুডিও।
পাইলট বন্ধুকে দিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে এসেছিলেন
একসময় গুলিস্তান ও সদরঘাট এলাকায় বক্স ক্যামেরা দেখা যেত গুলিস্তান সদরঘাটের ওদিকটায়। কেননা সে জায়গাগুলো থাকত ব্যাপক জনবহুল। ছবি তুলে দ্রুত সে ছবি কমদামে গ্রাহকদের পৌঁছে দেওয়া যেত। স্বাধীনতার আগে দেশে মূলত সাদাকালো ছবিই তোলা হতো। ১৯৭২ সালের দিকে দেশে প্রথম রঙিন ছবির প্রচলন হয়। সেক্ষেত্রে ছবি তুলে তা জাপান, হংকং, ব্যাংকক, ভারত, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ থেকে প্রিন্ট করে আনা হতো।
নিউমার্কেটে টিকে থাকা একমাত্র স্টুডিও ফটোমুভির কর্ণধার ইফতেখার হোসেন নিজেই যেবার প্রথম ছবি তোলেন, সেবার তার পাইলট বন্ধুকে দিয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ছবিটি। স্বাধীনতার পর দেশে রঙিন ছবির চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। তবে অন্য দেশ থেকে ছবি প্রিন্ট করিয়ে আনা ছিল সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ।
জাপানের ফুজি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে প্রথম কালার ল্যাব স্থাপন হয় ১৯৭৯ সালে। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে স্থাপন করা হয় দেশের প্রথম রঙিন ছবির স্টুডিও ফুজি কালার ল্যাব ও স্টুডিও। ধীরে ধীরে সারা দেশে ১১২টি শাখা খোলে ফুজি। তাদের দেখাদেখি পরে জাপানি কণিকা, যুক্তরাষ্ট্রের কোডাক ও জার্মানির আগফা কোম্পানি কালার ল্যাব স্থাপন ও ফিল্ম বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে। একসময় দেশে কনিকার প্রায় ৪০টি, কোডাকের ২৫টি ও আগফার ১২টির মতো স্টুডিও ছিল। বর্তমানে ফুজি ছাড়া আর কারোরই কার্যক্রম নেই।(শফিকুল ইসলাম, ৯ জানুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো)
২০০০ সাল নাগাদ শ্যামলী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত পুরো ধানমন্ডি এলাকায় ১২-১৫টির মতো স্টুডিও ল্যাব ছিল। তবে ২০০৫-২০০৬ সালের পর নীলক্ষেতে ফটোগ্রাফির একটা চল শুরু হলে কমতে শুরু করে এই সংখ্যা। এখন মাত্র চার-পাঁচটি ল্যাব পাওয়া যাবে এ এলাকায়।
রাজধানীর মগবাজারের পদ্মা স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী আক্কাস মাহমুদ জানান, একসময় দেশজুড়ে তিন লাখের মতো স্টুডিও ছিল। তখন সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল স্টুডিও। এখন সেই সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজারে নেমে এসেছে। আর রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে কয়েকশ স্টুডিও রয়েছে। মূলত ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া ছবি প্রিন্টও করান না কেউ। আবার সাধারণ কাজের জন্য যেসব ছবি লাগে, তা বিভিন্ন ফটোকপি-প্রিন্টের দোকান থেকে কমদামের কাগজে করিয়ে নেওয়া যায়। তবে ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের জন্য অনেকেই তার বাবা-মাকে নিয়ে এসে সেই গাউন আর টুপি পরে ছবি তুলছেন। এই একটা দিকে অনেকে ঝুঁকছেন বলে জানান আক্কাস মাহমুদ।
তখন স্টুডিওর কদর যেমন ছিল, তেমন খাটনিও ছিল
এখন স্টুডিও মানে নিভু নিভু এক ব্যবসা। কিন্তু আগে কারও স্টুডিও ব্যবসা আছে মানেই সে সচ্ছল। যদি তার স্টুডিও হয় অভিজাতপাড়ায় তবে তো সে বেশ ভালোই অবস্থাসম্পন্ন। আর মহল্লার মধ্যে যাদের ব্যবসা ছিল, তারাও সবাই ছিলেন সচ্ছল। কারণ স্টুডিওগুলোতে শুধু ছবি তোলাই নয়, ফিল্ম-রোল কেনা, ব্যাটারি কেনা, অ্যালবাম এসব বিক্রি করা হতো। ঈদ বা কোনো উৎসবকে ঘিরে বা বনভোজনের মৌসুমগুলোতে বেড়ে যেত এসবের চাহিদা। এসব বিক্রি করেই দোকানভাড়া উঠে যেত বলে জানান আক্কাস মাহমুদ।
তখন স্টুডিওর কদর যেমন ছিল, তেমন ছিল খাটনিও। একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবির জন্য ঘুরতে হতো চার হাত। একজন তুলবে, একজন ছবি ফিল্ম ডেভেলপ করবভে, একজন প্রিন্ট, একজন ড্রায়ার দিকে শুকাবে, কাটবে, রিটাচ করবে, আরেকজন ডেলিভারি।
এখন যেমন ফটোশপের কাজ করা হয় কম্পিউটারে বসেই, তখন এই কাজগুলো করা হতো হাত দিয়ে। সাথে লাগতো আলো, পেন্সিল আর আলতার ব্যবহার। গাল ভাঙা থাকলে ঠিক করা যেত, বা স্মুদ করে দেওয়া হতো নিখুঁত করে। সুন্দর করে বক্স করে নিয়ে নেগেটিভটা বসিয়ে আলোটা প্রতিফলন করত, এরপর পেন্সিল দিয়ে কাজ। আলোতে নিয়ে বসে পেন্সিল দিয়ে চেহারার খুঁতগুলো, দাগগুলো মুছে, সেই ছবিকে আলতা পানিতে ভিজিয়ে নেওয়া হতো, যেন ছবিগুলো একদম মসৃণ হয়। হানসা স্টুডিওর (যা নেই এখন) মালিক জাহিদ জানান, নিউমার্কেটের ভেতরেই স্টুডিওর দোকানগুলোর সামনেই একসময় ছিল ছোটো বাগান। দিনের বেলায় আলোতে ওই বাগানের মধ্যে বসে টাচিংয়ের কাজ করা হতো।
আবার তখন ছবি তুলতেও ক্যামেরার সামনে রাখা হতো বাটি আলো যার তাপে ঘেমে একাকার হতে হতো। এমন অনেক হয়েছে, সারাদিনের কাজের শেষে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অ্যালবাম নিয়ে বসতেন। ছবিগুলো সুন্দর করে রেখে তাতে এঁটে দিয়ে ঘুমোতে যেতেন। এখন ছবি তুলেই যেমন সাথে সাথে দিয়ে দেওয়া যায়, তখন অপেক্ষা করতে হতো দুই থেকে তিন দিন। আর শৌখিন ছবির জন্য প্রায় এক সপ্তাহ। ফলে ছবির মেয়াদও আগের চেয়ে এখন কম হবে বলে জানান আক্কাস মাহমুদ।
ছিল বাংলাদেশ স্টুডিও মালিক সমিতি, যা গঠিত হয়েছিল আশির দশকে। কর (ভ্যাট) নির্মূল থেকে শুরু করে নানারকম অনূকূল-প্রতিকূলতায় নিজেরা সংঘবদ্ধ থেকে কাজ করেছেন তারা। বিভিন্ন বনভোজন, মিলনমেলায় একসাথে পরিবার নিয়ে আনন্দ-উৎসব করতেন। এই সমিতি নাম বদল করে এখন হয়েছে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক অ্যাসোসিয়েশন।
কিন্তু এখন অনেক স্টুডিওতেই প্রিন্টিং মেশিনে ফটোকপি, খাতা স্পাইরাল বাইন্ডিং, মানি ট্রানজেকশন, রিচার্জ, কম্পিউটারে এডিটিংয়ের কাজ ইত্যাদি করেন। অন্যথায় শুধু ছবি তুলে দোকান ভাড়া ওঠানোও কষ্টসাধ্য। বর্তমানে স্টুডিও যেকয়টি টিকে আছে, তারা হয় পাশাপাশি ব্যবসা হিসেবে রেখেছেন নিজেদের জায়গায়, নাহয় তারাও ভাবছেন ভবিষ্যতে এ ব্যবসার যবনিকা টানার কথা। যেমন ইফতেখার হোসেইন, নিউমার্কেটের একমাত্র টিকে থাকা ফটোমুভির কর্ণধার জানান, এখনো তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। দূর-দূরান্ত থেকে এখনো এখানেই আসে মানুষ।
আবার গ্রিনরোডে অবস্থিত স্টুডিওল্যাব নাহার স্টুডিওর পরিচালক জানান, 'একসময় এই স্টুডিও আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। তখন আমরা এখানে অন্য কিছু শুরু করব। অন্য কিছুর দোকান।'
পদ্মা স্টুডিওর জনক আক্কাস মাহমুদ ভাবছেন আবার অন্যভাবে। যেহেতু শুরু থেকেই এটাই ছিল তার উপার্জনের একমাত্র পথ, তাই দরকারি ছবি তোলার পাশাপাশি তিনি এখন চেষ্টা করছেন মগ, টিশার্টে, মোবাইলের কাভার, সিরামিকের ওপর ছবি প্রিন্ট করিয়ে বিক্রি করতে। কিন্তু তাতেও বেশিদিন টেকা মুশকিল। তিন বছর পর দোকান ভাড়া বাড়লে এই উপার্জনে আর পোষাবে না। তখন হয়তো গ্রাহকশ্রেণি বদলে ফেলতে হবে টিকে থাকার জন্য।
এভাবেই স্টুডিওগুলো জায়গা হারিয়ে আজ হারাতে বসেছে অথবা নতুন রূপে জন্ম নেওয়ার কথা ভাবছে। শুধু স্মৃতি হয়ে থাকছে ষাট, সত্তর, আশির, নব্বই দশকের ছবি তুলতে স্টুডিওতে যাওয়ার সেই দিনগুলো।