৫০০ সিনেমার বারী স্টুডিও যেভাবে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ থেকে হারিয়ে যায়!
স্টুডিও নামের সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। চলচ্চিত্রের স্টুডিও বলতে এমন প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়, যেখানে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সকল সামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ বিদ্যমান। ভারত ভাগের এক দশক পর পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) গঠিত হয়। তবে তখনও বেসরকারি কোনো স্টুডিও ছিল না। ষাটের দশকে প্রথমবারের মতো পূর্ববাংলায় বেসরকারি চলচ্চিত্র স্টুডিও স্থাপিত হয়। ষাটের দশকের শুরুর দিকে কারওয়ান বাজারে 'ইস্টার্ন থিয়েটার' নামে একটি স্টুডিও আত্মপ্রকাশ করলেও কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৬৮ সালে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে ইস্টার্ন থিয়েটার নাম পরিবর্তন করে 'বারী স্টুডিও' নামে চালু হয়। তবে এবার নামের সাথে স্থানও পরিবর্তন করা হয়। স্টুডিওটি স্থাপিত হয় ফার্মগেট এলাকার পূর্ব তেজতুরী বাজারের চৌরঙ্গী মোড়ে। দীর্ঘকাল সিনেমা স্টুডিওটি রমরমা ব্যবসা করার পাশাপাশি ব্যাপক সুনাম অর্জন করে।
তবে এখন আর স্টুডিওটি নেই। ইন্টারনেটে বারী স্টুডিও লিখে খোঁজ করলেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। স্টুডিওর জায়গায় নতুন করে তৈরী হয়েছে মসজিদ। নাম 'মসজিদুল বারী-তা'য়ালা'।
বারী স্টুডিও শুরুর গল্প
বারী স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা এম. এ বারী সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র আহমেদ ইসমাইল হোসেন। বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের উপদেষ্টা হিসাবে কর্মরত আছেন। তার সাথে কথা বলে বারী স্টুডিওর আদ্যোপান্ত জানা গেল।
জনাব এম. এ বারীকে বাংলাদেশে বেসরকারী ফিল্ম স্টুডিওর পথিকৃৎই বলা যেতে পারে। সিনেমা দেখার তীব্র আকর্ষণ থেকেই একসময় তৈরী করেছিলেন এই বারী স্টুডিও। বারী সাহেবের সাথে স্টুডিও ব্যবসায় সহযোগী মালিক মাজিদ। তিনি আহমেদ ইসমাইল হোসেনের মামা। মূলত তিনিই বারী স্টুডিওর ব্যবসা দেখভাল করতেন। আরো পরে ব্যবসা পরিচালনার দ্বায়িত্বে আসেন বারী সাহেবের কনিষ্ঠ ছেলে ইউসুফ আহমেদ তপু।
স্টুডিও ব্যবসা করার পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসাবে ইস্টার্ন থিয়েটার সামনে এসেছিল। জানা যায়, ইস্টার্ন থিয়েটার প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম 'মাটির পাহাড়'। এটি মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। কথা প্রসঙ্গে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন আহমেদ ইসমাইল হোসেন। তিনি জানান, ইস্টার্ন থিয়েটারে বারী সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। কাইয়ুম চৌধুরী নিজেও ছিলেন চলচ্চিত্র পাগল মানুষ। ষাটের দশকে হলিউডের সিনেমা ঢাকায় আসতে শুরু করলে তারা বন্ধুরা মিলে নিয়মিত ছবি দেখতে যেতেন। মহিউদ্দিন আহমেদ পরিচালিত 'মাটির পাহাড়ে'র পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশ', ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রের কলাকুশলী হিসাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকেই যুক্ত ছিলেন। তবে, ইস্টার্ন থিয়েটারের তৈরী 'মাটির পাহাড়'-ই ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র, যার প্রতিটি শিল্পী-কলাকুশলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের। এই সিনেমার কাহিনী ও সংলাপ রচনা করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন কাফি খান, সুলতানা জামান, সুমিতা দেবী প্রমুখেরা।
১৯৭০ সালে বারী স্টুডিওর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার কারণে স্টুডিও অচল হয়ে পড়ে থাকে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে স্টুডিওর কাজ আবার নতুন করে শুরু হয়। কিন্তু সে বছরই মৃত্যুবরণ করেন এম. এ.বারী সাহেব। এই ১৯৭৩ সালেই বিখ্যাত পরিচালক খান আতাউর রহমান পরিচালিত চলচ্চিত্র 'আবার তোরা মানুষ হ' মুক্তি পায়, এ ছবিটি সম্পাদনা করা হয়েছিল বারী স্টুডিওতেই। এ ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক হয়ে আছে।
বারী স্টুডিও প্রযোজিত অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি ছিল 'নদের চাঁদ'। চলচ্চিত্রটি ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায়। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন চিত্রনায়ক ফারুক, সুচরিতা, এ.টি. এম শামসুজ্জামান প্রমুখ। এটি সে সময়ে হিট ছবির তকমা পায়। স্বাধীনতার পর এখানে স্টুডিও চালুর পর বারী স্টুডিও বেশ জমিয়ে ব্যবসা করছিল।
আহমেদ ইসমাইল হোসেন জানালেন বারী স্টুডিওর তখন বেশ কয়েকজন নিয়মিত ক্লায়েন্ট হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা। 'আলোর মিছিল' এবং 'লাঠিয়াল' এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তিনি। চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির, আমজাদ হোসেনেরও স্টুডিও হিসাবে প্রথম পছন্দ ছিল 'বারী স্টুডিও'। এছাড়াও, এখানে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন তৎকালীন অভিনেতা বুলবুল আহমেদ, রাজ্জাক, ববিতা প্রমুখেরাও।
ঢাকায় দুটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন স্টুডিও রয়েছে যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে বেঙ্গল মোশন পিকচার্স স্টুডিও লিমিটেড ১৯৬৯ সালে টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালে, স্টুডিওটির প্রতিষ্ঠাতা বজলুর রহমান একক মালিকানা গ্রহণ করেন; পরবর্তীকালে এর মালিকানা বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়। স্টুডিওটির কোন ল্যাব নেই, মূলত শুটিং, ডাবিং এবং সীমিত সম্পাদনার জন্য এটি উপযুক্ত।
প্রথম ডিজিটাল ডাবিং থিয়েটার
বারী স্টুডিও চলচ্চিত্র শিল্পীদের পছন্দের কারণ কী? জানতে চাইলে ইসমাইল হোসেন বলেন, "১৯৭৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একপ্রকার জোয়ার আসে। শুরুর দিকে আমরা চলচ্চিত্রের শুট্যিংয়ে ব্যবহৃত হতো এমন সব যন্ত্রপাতি ভাড়া দিতাম। কিন্তু এসময়েই আমরা চিন্তা করলাম রেকর্ডিং এবং ডাবিং স্টুডিও স্থাপন করবো। আমরাই প্রথম সাউন্ডপ্রুফ (শব্দরোধী) রেকর্ডিং রুম স্থাপন করি। ক্ষেত্রবিশেষে এফডিসি থেকেও আমাদের স্টুডিওতে চলচ্চিত্র সম্পাদনার কাজ করানো হয়েছে। কারণ আমরা জার্মানি থেকে রেকর্ডিং ইকুইপমেন্ট (চলচ্চিত্র সম্পাদনায় ব্যবহৃত যন্ত্র) আমদানি করেছিলাম এবং অধিকতর দক্ষ কলাকুশলীদের নিয়ে কাজ করতাম। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় বিবেচনা করতেন বলেই বারী স্টুডিও তাদের পছন্দের ছিল।
দেশের প্রথম কালার ল্যাব
চলচ্চিত্র সম্পাদনার সিংহভাগ কাজই সম্পন্ন করা যেত বারী স্টুডিওতে। তবে, তখনও চলচ্চিত্রের প্রিন্ট ও প্রকাশনার কাজ করানোর জন্য এফডিসির শরণাপন্ন হতে হতো। বারী স্টুডিও কর্তৃপক্ষ একসময় বুঝতে পারে তারা এফডিসি কর্তৃক নানাভাবে শিডিউলজনিত ভোগান্তিতে পড়ছে। ফলে ১৯৮৬ সালে নিজেদের ল্যাবরেটরি স্থাপনের তাগিদ অনুভব করেন তারা। কিন্তু চলচ্চিত্রের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা খুবই ব্যয়বহুল ছিল। তখন উপায় হিসেবে বারী স্টুডিও তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহৃত হয়েছে এমন ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করে। ল্যাব তৈরীর জন্য এ সময় টঙ্গীতে এক বিঘা পরিমাণ জমি কেনা হয়। কিন্তু গোল বাঁধে অন্য জায়গায়, ল্যাব তৈরী করার সমস্ত উপকরণ ও জায়গার ব্যবস্থা হলেও ল্যাব চালানোর মতো দক্ষ টেকনিশিয়ান হাতে ছিল না।
টেকনিশিয়ানের খোঁজে তখন দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত 'প্রাসাদ ফিল্ম ল্যাবরেটরি'র সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞ হিসাবে মেনন নামক এক ভদ্রলোককে পাঁচ বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হলো। এই ব্যক্তি ভারতের 'প্রাসাদ ফিল্ম ল্যাবরেটরি'কে শ্রম দিয়ে গড়ে তোলার কাজে অন্যতম একজন। তাকে প্রধান করে একদল তরুণদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম কালার ল্যাবরেটরি হিসাবে বারী স্টুডিও যাত্রা শুরু করে।
যেভাবে বন্ধ হলো বিখ্যাত এই স্টুডিও
ওই সময়ে একটি ছবির ডাবিং শেষ করতে কয়েক মাস সময় প্রয়োজন হতো। কারণ সিনেমার শ্যুটিং শেষ হলেও ডাবিং করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হতো কলাকুশলীদেরকে। আবার শিডিউল পাওয়াটাও বেশ কষ্টকর ছিল। আজ একজন অভিনেতা সময় দিচ্ছেন তো আরেকজন ব্যস্ত। এজন্য সিনেমা শেষ হতো কচ্ছপের গতিতে। বারী স্টুডিওতে তখনও শ্যুটিং ফ্লোর ছিল না। ছিল ডাবিং, প্রিন্টিং, রেকর্ডিং, এডিটিং এবং ফিল্ম প্রসেসিং এর সাথে ল্যাব টেকনেশিয়ান।
স্বাধীনতার পরে বারী স্টুডিওর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বারী স্টুডিওর মতো আধুনিক সুযোগসুবিধা সরকারি স্টুডিও তথা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থারও ছিল না, বিএফডিসির তখনও আধুনিকায়ন করা হয়নি।
আশি থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। প্রচুর চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হয়। এদিকে, বিএফডিসির স্টুডিও এবংল্যাবরেটরিতে সব ছবির কাজ করার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই, ফলে বেসরকারি স্টুডিও হিসাবে বারী স্টুডিও-ই তাদের ভরসার স্থল হয়ে ওঠে। এভাবে বারী স্টুডিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ চলচ্চিত্রের কাজ সম্পন্ন হয় এখানে।
নব্বই দশকের শেষের দিকে এসে চলচ্চিত্রের মান একেবারেই তলানীতে নেমে আসে। চলচ্চিত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং অশ্লীল দৃশ্যের সংমিশ্রণে বাংলা চলচ্চিত্রের ভরাডুবি ঘটে এ সময়ে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ সিনেমা হলে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ সময়ে চলচ্চিত্র ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়েন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। যোগ্য, কুশলী পরিচালকরা বিব্রত হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে গুটিয়ে নেন নিজেদের। সিনেমা নির্মাণে ব্যাপক অনীহা তৈরি হয়। কলাকুশলী, নির্মাতাদের বিমুখতায় চলচ্চিত্র ব্যবসায়ও প্রভাব পড়ে। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো বারী স্টুডিও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর বারী স্টুডিও আবার চালু করা হয়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নাটক এবং চলচ্চিত্রের কাজ এখানে চলেছে। তবে আগের মতো ব্যবসা আর হচ্ছিল না। ততদিনে স্টুডিও, ল্যাবের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নও জরুরি হয়ে পড়ছিল। অনেক নির্মাতার কাছে বিপুল বাকি, সব মিলিয়ে আধুনিকায়ন ছাড়া এ স্টুডিও আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আর আধুনিকায়নের বিপুল ব্যয়ভারও তখন বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বলা যায়।
সবদিক বিবেচনা করে ২০০৭ সালে বারী স্টুডিও পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হল।
যেভাবে মসজিদুল বারী তা'য়ালা
বারী স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেলে স্টুডিও ফ্লোর প্রায় সাত বছর তালাবদ্ধ ছিল। এখানে আর নতুন করে কিছু করারও কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পরে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় স্টুডিওর জায়গায় এলাকার মানুষের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। পারিবারিক সিদ্ধান্ত মেনে জনাব এম.এ বারীর বড় সন্তান আহমেদ ইসমাইল হোসেন মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত দেন।
নির্মিত এ মসজিদে নামাজের পাশাপাশি নিয়মিত কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। আছেন আরবি শিক্ষক। মসজিদের যাবতীয় তদারকির জন্য রয়েছেন খাদেমসহ আরো ছয় ব্যক্তি। 'এম.এ বারী ট্রাস্ট' থেকে মসজিদের সব খরচ বহন করা হয়।