জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি: অঙ্গ দানের বিষয়ে আপনার ভাবনা কী
বাংলাদেশের 'হিউম্যান অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট অ্যাক্টটি' ১৯৯৯ সাল থেকে কার্যকর করা হয়। ২০১৮ সালে তা সংশোধন করা হলেও দেশে মরণোত্তর অঙ্গ বা দেহ দানের বিষয়টি খুবই কম প্রচলিত।
গত বছর ২ জানুয়ারি, রাজধানীতে মৃত্যুবরণ করেন প্রখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তার অন্যান্য কাজের সাথে ত্রুটিপূর্ণ নগর পরিকল্পনা বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী এবং অকপট।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আমার সৌভাগ্য হয় বিখ্যাত এই নগর পরিকল্পনাকারীর সাথে কথা বলার। ৬০ মিনিটের এই ফোনালাপে আমাদের কথা হয় শহরের বস্তিগুলো নিয়ে। কথার মধ্যেই মানুষের প্রতি তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পায়।
এ কারণেই হয়ত তিনি মৃত্যুর পর তার দেহ একটি মেডিকেল কলেজকে দান করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। "তিনি আমাদের আগেই জানিয়েছিলেন তার সিদ্ধান্তের বিষয়ে। আমরা তার ইচ্ছা সম্পর্কে অবগত ছিলাম।" বলছিলেন তার মেয়ে সোনিয়া হোসেইন কৃষ্টি।
তার মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। সোনিয়া বলেন, "আমার মনে আছে, গ্রামে নিয়ে যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজনরা তার কবর কোথায় হবে জানতে চাইলে আমি বলেছিলাম, মরদেহ দান করা হবে। একজন ব্যক্তিও এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানাইয়নি। তারা শুধু শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে একটিবার তার মৃতদেহ দেখতে চান।"
মোবাশ্বের হোসেনের মৃতদেহ দান করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান রয়েছে।
সোনিয়া বলেন, "আমার মা তার এই ইচ্ছার বিরোধিতা করতেন সবসময়। কিন্তু তিনি যখন মারা যান, আমার মা প্রায় তৎক্ষণাৎ তার মন পরিবর্তন করেন। তিনি বলেন আমাদের উচিত তার (আমার বাবার) ইচ্ছার সম্মান করা উচিত।"
মরণোত্তর মৃতদেহ কিংবা অঙ্গ দান করার ক্ষেত্রে পরিবারের অনুমতি একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। কারো মৃত্যুর পর মৃতের পরিবার বা আত্মীয়রা মৃতদেহ দানের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানালে শেষ পর্যন্ত তা মৃতের শেষকৃত্য কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয়।
চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণায় মরণোত্তর দেহদান খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অঙ্গ দান কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি গুরুত্ব রাখে। কারণ অঙ্গ প্রদানের মাধ্যমে একেবারে তৎক্ষণাৎ জীবন বাঁচানো সম্ভব।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে 'হিউম্যান অর্গান ট্র্যান্সপ্লান্টেশন অ্যাক্ট' বা 'মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনের' প্রচলন হয় ১৯৯৯ সালে। এই আইন প্রতিস্থাপনের জন্য শুধু ব্রেইন- ডেড রোগী এবং জীবিত আত্মীয়কে অঙ্গদাতা হিসেবে অনুমতি দেয়। পূর্বে শুধু নিকটবর্তী আত্মীয়রা দিতে পারলেও ২০১৮ সালের অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে সংশোধন দূরের আত্মীয়কে অনুমতি দেয় অঙ্গ প্রদানের। কিন্তু মরণোত্তর মৃতদেহ প্রদানের সংখ্যা এখনো বাংলাদেশে খুবই কম।
ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের ইন্সটিটিউট অব বায়োমেডিকেল ইথিকসের পোস্ট ডক্টরেট ফেলো ড. মো সানোয়ার সিরাজ বলেন, "আপনাকে মনে রাখতে হবে, মরণোত্তর এবং জীবিত অবস্থায় অঙ্গ প্রদানের বিষয়টি মূলত স্বাস্থ্যসেবার তৃতীয় ধাপে পড়ে (গুরুতর অথবা অস্বাভাবিক অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে রাখাতে উন্নত সরঞ্জাম এবং বিশেষ জ্ঞান থাকা প্রয়োজনীয়)। অর্থাৎ একে এত গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় না।"
মরণোত্তর দেহদানের ক্ষেত্রে, দাতার কোনো কিছু হারানোর ভয় থাকে না। তবুও সামাজিক- সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, ধর্ম, এ সম্পর্কে কম ধারণা থাকা এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামো না থাকায় মরণোত্তর মৃতদেহ বা অঙ্গ প্রদানের বিষয়ে অনেকেই আগ্রহী হয় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ এবং ডাক্তাররা।
মোবাশ্বের হোসেনের মতো যে-সকল মৃতদেহ মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রদান করা হয় তা ব্যবহৃত হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র এএইচএম নাইম বলেন, "প্রথম বর্ষের মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ডাইসেকশন ল্যাবে মরদেহ ব্যবহার করে পেশি, শিরা, ধমনি এবং স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাপারে শেখানো হয়। মেডিকেল তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজ অথবা হাসপাতালের মর্গে যায় ফরেনসিক মেডিসিন শেখার জন্য। এর জন্য প্রয়োজন দেহের গভীর পর্যবেক্ষণ।"
এছাড়া ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হলে বিভিন্ন কাজে মরদেহগুলো ব্যবহার করা সম্ভব। বিশেষত্বের ভিত্তিতে স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্রদের পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় এই মরদেহগুলো। চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং ঔষুধের মানোন্নয়নের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় মানুষের মরদেহ।
শিক্ষা পদ্ধতির অগ্রগতি এবং নৈতিকতার অভাবে চিকিৎসা প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ক্ষেত্রগুলোতে মরদেহ ব্যবহার ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। এমনটাই জানান বিএসএমএমইউ এর এনাটমি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিনাত আরা ইয়াসমিন। তিনি মনে করেন, চিকিৎসা গবেষণা বাড়াতে মরদেহ গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে নিজেদের তথ্য সমগ্র বা ডাটাবেজ তৈরি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিএসএমএমইউতে বছরে কত মরদেহ দান করা হয়?
জিনাত বলেন, "চার থেকে পাঁচটির মতো মরদেহ পাওয়া যায় বছরে। তবে মহামারির গত ৩ বছরের মতো কোন কোন বছর কোন মরদেহ আসেনি।"
এই সংখ্যা শিক্ষা ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত নয়। প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে যখন সবাই শোকাহত তখন মরণোত্তর দেহ দানের বিষয়টি নিয়ে তেমন কেউই চিন্তা করে না। সাধারণত মৃত্যুর পূর্বে কোন ব্যক্তি তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেলে, তার মরদেহ দান করা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা খাতে।
মরণোত্তর দেহ দানের প্রক্রিয়া জটিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সোনিয়া বলেন "একেবারেই না। আমার বাবা মেডিকেল কলেজকে আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিল। সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি ছিল পূর্বেই। ফোন দিয়ে জানানো ছাড়া কিছুই করতে হয়নি।"
একটি জীবনের জন্য একটি চোখ
সন্ধানী'র প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. তোসাদ্দেক হোসেইন সিদ্দিকী জানান, বহুবার আত্মীয়স্বজনের আপত্তির কারণে মৃতের বাড়ি থেকে মরদেহ না নিয়েই ফিরতে হয়েছে তাদের।
৪০ বছরের পুরোনো 'সন্ধানী', মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন। যারা রক্ত এবং প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খোঁজ দিয়ে থাকে। এই সংগঠনটি দেশের কর্ণিয়া প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন।
ডা. হোসেইন বলেন, "কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন হলো সবচেয়ে সহজ অঙ্গ প্রতিস্থাপন। মৃত ডোনারদের থেকে কর্ণিয়া সংগ্রহ করে রোগীদের চোখে তা প্রতিস্থাপিত করা পর্যন্ত সন্ধানীর রয়েছে সম্পূর্ণ একটি দল। এছাড়া কর্ণিয়া সংরক্ষণের জন্য আমাদের রয়েছে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি। আমরা কর্ণিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকলেও আমাদের অভাব মূল জিনিসের- কর্ণিয়ার।"
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার কর্ণিয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর বিপরীতে সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালের অধীনে থাকা বাংলাদেশের একমাত্র চক্ষু ব্যাংক জোগাড় করতে পারে মাত্র ২০-২৫টি কর্ণিয়া। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে টিবিএসের/ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের করা এক প্রতিবেদনে উঠে আসে।
কোনো রোগী সন্ধানীর সাহায্যে চোখের আলো ফিরে পেতে চাইলে তাকে প্রতি কর্ণিয়ার জন্য খরচ করতে হবে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এই খরচটা একেবারেই কম। কর্ণিয়ার জন্য কোন টাকা খরচ করতে না হলেও সার্জনদের ফি এবং ওষুধ ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করতেই মূল খরচ হয়ে থাকে। তবে কেউ যদি বাইরে থেকে আনা কর্ণিয়া ব্যবহার করতে চায় তাহলে প্রতি কর্ণিয়া বাবদ খরচ পড়বে ৩-৪ লক্ষ টাকা।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকার 'ব্লাইন্ড রিলিফ' বা চোখের জন্য অর্থ সহায়তা প্রদানের একটি আইন জারি করে।
এখন পর্যন্ত 'সন্ধানী' প্রায় ৪,১৬১ কর্নিয়া সংগ্রহ এবং ৩,৫০৪ কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন করেছে। প্রতিস্থাপিত এসব কর্ণিয়ার মধ্যে মাত্র ১৩০টি কর্ণিয়া সংগ্রহ করা হয়েছে মরণোত্তর দেহ প্রদান পদ্ধতিতে।
সন্ধানীর সমন্বয়কারী সাইফুল ইসলাম বলেন, "এমুহুর্তে প্রায় ৪৪,১০৬ টি মরণোত্তর দেহ দানের আবেদন জমা আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ড. সানোয়ার সিরাজ বলেন, "মৃতের পরিবার থেকে স্পষ্ট অনুমতি না পেলে মৃত ডোনারের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গ নেয়া একপ্রকার অসম্ভব।" বাংলাদেশের অঙ্গদানের ক্ষেত্রে বাধা, বায়ো এথিকস এবং ধর্মীয় অবস্থান তুলে ধরে জার্নালও প্রকাশ করেছেন ড. সিরাজ।
২০৩টি কর্ণিয়া সংগ্রহ করতে মৃতের পরিবারের সাথে কথা বলতে হয়েছে 'সন্ধানী'র। ডা. হোসেইন বলেন, "২০১১ সাল থেকে আমরা 'গ্রিফ কাউন্সিলর ব্যবহার করতে শুরু করি। এবিষয়ে আমাদের আগে কোন ধারণা ছিল না।" আর যেসব মৃত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায় না তাদের থেকে সংগ্রহ করা হয় বাকি কর্ণিয়া।
২০১৮ সালের সংশোধিত মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনের সেকশন ৫ অনু্যায়ী, "যদি কোন মরদেহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত করা না যায় তাহলে প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি মরদেহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখবে।"
এছাড়াও চক্ষু, স্কিন এবং টিস্যু দানের ক্ষেত্রে, কোন মরদেহ যদি কোন প্রতিষ্ঠানে থেকে থাকে বা এমন কোথাও যা জেলা কমিশনারের এলাকায় থাকে তাহলে মরদেহ দানের বিষয়টি জেলা প্রশাসকের অনুমোদনের আওতাভুক্ত হবে।
আইনি জটিলতা না থাকলেও অনেক চক্ষু বিশেষজ্ঞ এসব মরদেহ অস্ত্রোপচার করতে দ্বিধাবোধ করেন বলে জানান ডা. হোসেইন। তিনি আরো বলেন, অর্বিস ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শনাক্ত হয়নি এমন মরদেহ থেকে কর্ণিয়া সংগ্রহ করা নিষেধ। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সনদ ধরে রাখতে খেয়াল রাখতে হয় ডাক্তারদের। এ কারণেও হ্রাস পায় থাকে বার্ষিক কর্ণিয়া সংগ্রহ।
কীভাবে ২০ মিলিয়ন মানুষের কষ্ট কমানো সম্ভব?
বাংলাদেশে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ নানা ধরনের কিডনি সমস্যায় এবং প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি ফেইলিওর অথবা কিডনি রোগের শেষ ধাপে আছেন। ৭৫ শতাংশ রোগী শনাক্ত করার অভাবে বা কিডনি প্রতিস্থাপনের অভাবে মারা যায়।
দেশে জীবিত ডোনার থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ে থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। ১৯৮২ সালে দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫০০টি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে এদেশে।
কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ অনেক পরিবারের জন্যই বিশাল বোঝায় পরিণত হয়। টিবিএসের কাছে দেয়া আগের এক সাক্ষাৎকারে কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক ড. হারুনুর রশিদ বলেন, "বিশ্বে দুই ধরনের প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো জীবিত ডোনার থেকে এবং অন্য ক্ষেত্রে মরদেহ থেকে নেয়া হয় এসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। পরিবারের অনুমতি এখানে মুখ্য বিষয়।
গত বছর দেশে প্রথমবারের মত মৃত ব্যক্তি থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হয়। ২০ বছর বয়সী সারাহ ইসলাম ছোটবেলা থেকেই ভুগেছেন 'টিউবার স্ক্লেরোসিসে'। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় তিনি মারা যান।
ঐ বছরের ১৯ জানুয়ারি ডাক্তাররা দেশে প্রথম মৃতদেহ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন।
"আমার মেয়ে ছিলেন অন্যরকম একজন মানুষ" বলছিলেন সারাহর মা শবনম সুলতানা। মেয়ের রুমে বসে হাস্যোজ্জ্বল ছবির দিকে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি।
কখন জানতে পেরেছিলেন যে সারাহ তার মরদেহ দান করতে চায়? এমন প্রশ্নে শবনম জানান, গত ২০২২ সালে যখন সারাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বারবার তাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে তখন খুবই ভেঙে পড়ে সবাই। সারাহ বুঝতে পারে সে আর বাঁচবে না। তখনই সারাহ সিদ্ধান্ত নেয় তার অঙ্গ দান করতে চায় সে। তখন শবনমও তার মেয়ের ইচ্ছায় সম্মতি দেয়।
তার অবদানকে স্মরণ করে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে 'দ্য সারাহ ইসলাম ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট সেল' উদ্বোধন করা হয়েছে। এটা তৈরি করা হয়েছে মানুষের মধ্যে মরণোত্তর অঙ্গ দানের বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে।
সারাহ তার দুইটি কর্ণিয়াই দান করে গেছেন। গ্রহীতা দুজনই সুস্থ আছেন। সারাহ তার দুটি কিডনিও দিয়ে গেছেন। শামীমা আক্তার এবং হাসিনা আক্তার নামের ত্রিশোর্ধ দুজন নারীকে দেয়া হয়েছে দুটি কিডনি। এরমধ্যে শামীমা সুস্থ জীবনযাপন করলেও অস্ত্রোপচারের জটিলতায় মারা যান হাসিনা।
এবছর ২৫ জানুয়ারি বিএসএমএমইউ এবং ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনে সম্পন্ন হয় দ্বিতীয় কিডনি প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার। ৩৮ বছর বয়সী 'ব্রেইন-ডেড' রোগী তার দুটি কিডনি দান করেন এবং দুজন ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে এই দুটি কিডনি। ক্যাডাভেরিক বা মৃত ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপন হাজারো মানুষের জন্য আশীর্বাদ রূপে এসেছে।
ডা. সিরাজের মতে প্রতিস্থাপন খুবই ভালো একটি প্রক্রিয়া। তবে 'ব্রেইন ডেড' রোগীদের থেকে সংগৃহীত কিডনি সংরক্ষণের জন্য সুষ্ঠু অবকাঠামো প্রয়োজন।
কী ঘটছে সারা বিশ্বে?
ক্যাডাভেরিক অঙ্গ দান ২০১৩ সালের পর ভারতে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে গবেষকগণ 'ডোনার পুল' বা অঙ্গের উৎস বৃদ্ধি করাকেই মুখ্য হিসেবে দেখছেন। ভারতে সড়ক দুর্ঘটনা ব্যতীত 'ব্রেইন ডেড' রোগীদের, ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের প্রতিস্থাপনের জন্য পূর্ব শর্ত মেনে অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
এদিকে শ্রীলঙ্কায় মরণোত্তর কর্ণিয়া দানের হার ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপে, অঙ্গ দানের ক্ষেত্রে স্পেন শীর্ষস্থানীয়।
দেশটিতে 'অপ্ট আউট' নামের ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ যদি নিজে থেকে 'অপ্ট আউট' না করে, তাহলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে তার সম্মতি রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। বেলজিয়াম, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক এবং পর্তুগালসহ আর কিছু দেশে এই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে।
এক্ষেত্রে ডাক্তার এবং গবেষকরা সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। ধর্মীয় দিক থেকেও অনেকে মনে করে থাকেন যে, মৃত্যুর পর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং দেহ দান করা উচিত নয়।
সারাহর মা সুলতানা বলেন, "কিন্তু কেউ যদি আরো গভীরভাবে দেখে, তাহলে বুঝতে পারবে ইসলাম অঙ্গ দানের ক্ষেত্রে বরং উল্টোটা বলে।"
ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপনের সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
ডা. হোসেইন বলেন, "আমার এখনো মনে আছে 'ওয়ার্ড বয়দের' সাথে আমাদের একটা যোগাযোগ ছিল। জরুরি বিভাগে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের অন্য কোথাও 'ব্রেইন ডেড' রোগী পাওয়া গেলে তারা সরাসরি আমাদের জানাতো। ১৯৮০ শতকের দিকের ঘটনা এগুলো। আমরা খবর পাওয়া মাত্র দৌড়ে যেতাম অশনাক্ত মরদেহ থেকে কর্ণিয়া সংগ্রহ করতে।"