ডালপুরি, ভেলপুরি, আলুপুরির নাম শুনেছেন, কিন্তু খ্যাতাপুরি?
পুরির নাম খ্যাতা। অবাক করা কাণ্ড! খ্যাতাপুরি আবার কেমন ধরনের নাম? ডালপুরি, ভেলপুরি, আলুপুরির নাম শুনে থাকলেও খ্যাতাপুরির নাম তো আগে কখনো শুনিনি। প্রথমে নাম শুনলে একটু উদ্ভট মনে হতে পারে যদি না আপনি পুরান ঢাকার বাসিন্দা হন। তা নামে কী আসে-যায়? স্বাদ কেমন সেইটে হলো সব থেকে বড় কথা।
রুটি-পুরির জন্ম কথা
রুটি-জাতীয় যে খাবারের ইতিহাস সেটি প্রথম পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। ঋগ্বেদে পুরোডাশ নামে একটি খাবারের উল্লেখ আছে। সেটা ছিল যবের মণ্ড। এটাই ভারতবর্ষে রুটির আদিরূপ। পুরোডাশের সাথে মাংস, মধু মিশিয়ে সনাতন ধর্মের ঋষিরা যজ্ঞে আহুতি দিতেন।
দক্ষিণ ভারতে রাজাভোজ নামে একজন রাজা ছিলেন। রাজাভোজের একটি রান্নার বই ছিল, যেটিকে ভারতবর্ষের সবথেকে প্রাচীন রান্নার বই মনে করা হয়ে থাকে, 'মানসোল্লাস'। এই গ্রন্থে পুর দেয়া ছোটোখাটো একটি খাবারের উল্লেখ আছে। একে যদিও অনেকে ইডলি বলে উল্লেখ করে থাকেন। আবার আরেকটি ধারণা, এটিই পুরির প্রাচীন সংস্করণ।
এবারে চলে আসা যাক রাজস্থানে। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে রুটির প্রচলন সেভাবে ছিল না। কিন্তু রাজস্থান যেহেতু মরু এলাকা, সেখানে ময়দা দিয়ে গোলাকৃতির এক ধরনের খাবারের প্রচলন ঘটেছিল। আর এই রুটির স্বাদে নতুনত্ব আনার জন্যে ছোলার ডালসহ বিভিন্ন ডালের বেসন ব্যবহার করা হতো। রুটির মধ্যে বিভিন্ন ডালের পুর দেওয়ার কারণে রুটিগুলো ফুলত এবং অল্প খাবারে পেট ভরে যেত।
একটা সময় ভারতবর্ষে সুলতানি শাসন আমলের সূচনা ঘটল। সুলতানি শাসকরা ছিলেন মুসলিম এবং এসেছিলেন তুরস্ক বা আরব থেকে। তুরস্ক কিংবা আরবের এই শাসকদের হাত ধরে রুটির ভেতর মাংস পুরে শর্মা বা এ-জাতীয় খাবার এলো ভারতবর্ষে। পরবর্তীতে রাজপুতদের খাবারের সাথে সুলতানি শাসকের খাদ্যশৈলীর একটা মেলবন্ধন তৈরি হলো।
মোগল আমলে এলো মোগলাই পরোটা। ময়দা দ্বারা রুটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের গোলাকৃতির খাবার, নাম পরোটা। পরোটার ভেতরে মাংস আর ডিমের কিমা দিয়ে হয়ে গেল মোগলাই খানা—মোগলাই পরোটা।
বাংলায় তখন সুলতানি শাসন। সুলতান হুসেন শাহের আমলে আবির্ভাব ঘটল শ্রীচৈতন্যের। এই সময়টাতে রাধাবল্লভির উৎপত্তি। লুচি তো বাংলায় আগে থেকেই ছিল। লুচির ভেতরে ডালের পুর দিয়ে হয়ে গেল রাধাবল্লভি। তখন বৃন্দাবন, মথুরায় নিরামিষাশী বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন। এরা মাংসের পুর দেওয়া খাবার ধর্মীয় কারণে খেতেন না। সেজন্যে বিভিন্ন ধরনের সবজি, ডাল, ছাতুর ছোটো ছোটো মণ্ড বানিয়ে ময়দার মধ্যে পুর দিয়ে এক বিশেষ ধরনের খাবারের প্রচলন হলো। খাবার থাকবে, নামকরণ থাকবে না, তা কেমন করে হয়? নাম দেয়া হলো কচুরি।
পরবর্তীতে পর্তুগিজদের হাত ধরে এলো আলু। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ অবধি আলুর ব্যবহার সেভাবে ছিল না। উনিশ শতকের পরে আলুর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। জনপ্রিয় হতে থাকে আলু নামক বিদেশি সবজি। এবারে কচুরির থেকে হালকা আবার লুচির থেকে ভারী, দেখতে কিছুটা রাধাবল্লভির স্টাইলে আকারে ছোটো করে ভেতরে ডাল বা আলুর পুর দিয়ে পুরি তৈরি করা হলো। আর তাই রাধাবল্লভির ছোট সংস্করণ হিসেবে পুরিকে পরিচয় দিলে খুব একটা ভুল করা হয় না। এভাবেই পুরোডাশের ধারণা থেকে রুটি, রাধাবল্লভি, কচুরি কিংবা পুরির ক্রমবিবর্তন।
পুরান ঢাকার খাদ্য সংস্কৃতিতে খ্যাতাপুরি ঠিক কবে নাগাদ কার হাত ধরে যুক্ত হয়েছিল সেটি জানা যায় না। লিখিত ইতিহাস সেভাবে নেই। লিখিত ইতিহাস না থাকলেও খ্যাতাপুরি থেকে গেছে ভোজনরসিক বাঙালির পাতে। তৃপ্ত করেছে রসনা।
প্রস্তুত প্রণালি
খ্যাতাপুরির প্রস্তুত প্রণালি অন্যান্য পুরির থেকে বেশ আলাদা। এই ধরনের পুরির ভেতরে দুই থেকে তিন রকমের ডালের পুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাথে থাকে নানা ধরনের মশলা। মশলার মধ্যে রয়েছে জাই ফল, জৈত্রী, দারুচিনি, এলাচ এবং আদা। এই মশলার গন্ধ ও স্বাদের কারণে খ্যাতাপুরির স্বাদে বেশ একটা ঝাল ঝাল টক টক ব্যাপার আসে। পুদিনা পাতা, ধনেপাতা, বোম্বাই মরিচ আর পাতিলেবুর ব্যবহার স্বাদে নতুনত্ব আনে।
প্রথমে ময়দার মধ্যে তেল আর লবণ মিশিয়ে খামির করে নিতে হয়। খামির করা আটার মধ্যে মশলা দিয়ে মাখানো ডালের পুর দেয়া হয়। এরপর বেলন দিয়ে ছোট রুটির আকৃতিতে বেললেই তৈরি হয়ে যায় খ্যাতাপুরি। এবারে গরম গরম তেলে ভাজবার পালা। ডালপুরি যে রকম ডুবো ডুবো তেলে ভাজা হয়, খ্যাতাপুরি কিন্তু তেমনটি নয়। খ্যাতাপুরি ভাজতে হয় কম তেলে। হালকা তেলের প্রলেপে শুকনোভাবে সেঁকলেই ৩ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে পরিবেশন করা যায় খ্যাতাপুরি। খ্যাতাপুরি সাধারণত কাসুন্দি কিংবা টক-জাতীয় চাটনির সাথে পরিবেশন করা হয়। আবার মাংসের ঝোল দিয়ে খেতেও মন্দ লাগবে না।
কেন খ্যাতাপুরি?
খ্যাতাপুরি খাবারটি কাঁথার মতন পুরু। সাথে কাঁথা যেরকম নরম তুলতুলে, এই খাবারটিও সেরকমই। মুখের মধ্যে দিলেই মশলা আর ডালের সংমিশ্রণে তৈরি বিশেষ খাবারটি গলে একেবারে নরম হয়ে যায়। আর তখনই পাওয়া যায় একটা অতুলনীয় স্বাদ। পুদিনা পাতা মুখে পড়তেই ঝাঁঝালো অথচ সুন্দর একটি গন্ধ চলে আসবে নাকে। আর পুরের ভেতরে থাকা লেবু তাতে টকের ছোঁয়া যোগ করে খিদে বাড়িয়ে দেবে নিমেষেই।
জিভে এসে যাবে জল। মনে হবে, আরেকটিবার খাই। কাঁথাকে আঞ্চলিক ভাষায় কেউ কেউ 'খ্যাতা' বলে থাকেন। কাঁথার সাথে এই খাবারের বৈশিষ্ট্যে কিছুটা মিল থাকবার দরুন নরম আর সুস্বাদু এই পুরির এমন অদ্ভুত নাম হয়ে গেল খ্যাতাপুরি। নামটি কিছুটা অন্যরকম আর বলতে সহজ হওয়ায় লোকমুখে ছড়াতে থাকে। খ্যাতাপুরি তাওয়ায় করে ভাজা হয় বলে একে তাওয়া পুরিও বলে থাকে কেউ কেউ। তবে খ্যাতাপুরিই বেশি প্রচলিত।
কোথায় পাবেন?
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড থেকে ইমামবাড়া যাওয়ার রাস্তা। এই রাস্তার গলির মুখে কয়েকটা দোকান পেরোলে প্রথমেই পাবেন ভাজাভুজির দোকান। ছোটোখাটো দোকান। আতিশয্য নেই। দোকানের সামনে বসবার দুটো বেঞ্চি। এই দোকানেই রোজ সন্ধ্যা নাগাদ বিক্রি হয় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খ্যাতাপুরি। বিক্রি চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।
দোকানের মালিক আব্দুল কাদির জানালেন, তিনি পাশেরই একটা খাবার হোটেলে কর্মচারীর কাজ করতেন। এই এলাকার মানুষ কী খেতে পছন্দ করে তার একটা ধারণা সেখান থেকেই পেয়েছেন। পরে নিজ উদ্যোগে খ্যাতাপুরির দোকান দিলেন। প্রথমে অবশ্য শুধু চা বিক্রি করতেন। কিন্তু আশপাশে চায়ের দোকান অসংখ্য। তাই বিক্রিবাট্টা সেভাবে হতো না। বিক্রি বাড়াতে চিন্তাভাবনা করে খ্যাতাপুরি বানাতে শুরু করলেন। এরপর থেকেই বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। দোকানটি বিশেষভাবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে।
প্রতিদিন ৩-৪ কেজি আটার খ্যাতাপুরি নিজ হাতে বানিয়ে থাকেন কাদির। ২০০-২৫০ পিস খ্যাতাপুরি দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। সন্ধ্যা হলেই খ্যাতাপুরির খোঁজে এলাকার স্থানীয় মানুষের ভিড় জমে এই দোকানে। ছেলে-বুড়ো-শিশু হাতে প্লেট নিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছেন খ্যাতাপুরি। কেউ কেউ দূরদূরান্ত থেকেও আসেন জিভে জল আনা খ্যাতাপুরি খেতে। অনন্য নাম আর অনন্য স্বাদ খ্যাতাপুরির জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি পিস খ্যাতাপুরি তিনি ৫ টাকা করে দাম ধরে থাকেন। লাভ সামান্য। তবে নতুন ব্যবসা হিসেবে এই সফলতায় যথেষ্ট খুশি তিনি, জানাচ্ছিলেন কাদির।
পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার বাহিরপথের ডানপাশের কোনাতে রয়েছে খ্যাতাপুরির আরেকটি দোকান। লালবাগ এলাকায় এই দোকানের বেশ নামডাক। আশেপাশে আরো কয়েকটি দোকান থাকলেও খ্যাতাপুরির জন্যে বিশেষভাবে বিখ্যাত লালবাগ কেল্লার গেটের এই দোকানটি। ২৫ বছর ধরে এখানে খ্যাতাপুরি বানিয়ে বিক্রি করেন বলে জানালেন দোকানটির মালিক মোহাম্মদ ইব্রাহীম। এর আগে ওস্তাদের কাছ থেকে খ্যাতাপুরি বানানো শেখেন। ইব্রাহিম খ্যাতাপুরি তৈরিতে খেসারি,মুসুরি ও অড়হড় ডাল ব্যবহার করে থাকেন। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে রাত ৮টা অবধি খ্যাতাপুরি বানান। তিনি প্রতি পিস খ্যাতাপুরি বিক্রি করেন ১০ টাকায়। রোজ ২-৩ হাজার টাকার পুরি বিক্রি হয় বলে জানালেন ইব্রাহীম।
লালবাগ আর নাজিমুদ্দিন রোড ছাড়াও পুরান ঢাকার নবাবপুর, বংশাল বাজার, সাতরওজা, কসাইটুলি, জিন্দাবাহার, বঙ্গবাজার, বাদামতলী, কায়েতটুলি, বাংলাদেশ মাঠ, ধোলাইখাল, বকশিবাজারের অলিগলিতে একটু খোঁজ করলেই পাবেন সুস্বাদু খ্যাতাপুরি। রাস্তার পাশের ব্যক্তিউদ্যোগে তৈরি ছোটো ধরনের দোকান কিংবা ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে এই খ্যাতাপুরি ভাজা হয়।
পুরান ঢাকাবাসী খ্যাতাপুরিকে সবসময় রেখেছে আলাদা কাতারে। খ্যাতাপুরির আলাদা এক ধরনের চাহিদা থেকেই গেছে। এখনো অল্প কিছু দোকানে খ্যাতাপুরির চল রয়েছে, তবে সীমিত পরিসরে। খ্যাতাপুরি অতি সাধারণ রেসিপির অসাধারণ এক খাবার তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবে খাদ্যরসিকেরা।
ইতিহাসের সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে পুরির বিবর্তন ও ভিন্ন স্বাদকে ধরে রাখতে পেরেছে এ অদ্ভুত নামের অপূর্ব স্বাদের খ্যাতাপুরি। এই খাবারকে, ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। বাঙালির কবজি ডুবিয়ে খ্যাতাপুরি খাওয়ার গল্প যেন পরবর্তী প্রজন্মকে শুধু বইয়ের পাতায় না পড়তে হয়। শুধু স্ট্রিট ফুড হিসেবে নয়, বাঙালি মা-বোনের হাতের ছোঁয়ায় খ্যাতাপুরি বেঁচে থাক বাড়ির হেঁশেলে। খ্যাতাপুরি বাঁচুক বাঙালির খাদ্যরসনায়, স্বাদে-আহ্লাদে।