১৮৯৭-এর ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ কেঁপে উঠে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, উত্তরাঞ্চল
আজ থেকে ১২৬ বছর আগের কথা। ১৮৯৭ সাল। জুন মাসের ১২ তারিখ। বছরের প্রায় মাঝামাঝি সেই সময়ে শনিবার বিকেলে ভারতবর্ষের আসামে আঘাত হানে একটি ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে সেটির মাত্রা ছিল ৮.১। ভয়াবহ সব ক্ষতির খবর আসতে শুরু করে। শুরুতে অনেকেরই তখন ধারণা ছিল যে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে অতিরঞ্জন করা হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন প্রতিবেদনের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনাপঞ্জি মোটেও অতিরঞ্জিতভাবে পরিবেশিত হয়নি। বরং খবরের পাতায় উঠে আসা ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে বেশি বিধ্বংসী ছিল এই ভূমিকম্প।
আসামের তৎকালীন প্রধান কমিশনারের মতে, এই ভূমিকম্পে চেরাপুঞ্জি পাহাড় ও সিলেট জেলায় সাড়ে নয় শ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। প্রচুর বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এরপরও আহসান মঞ্জিলসহ অসংখ্য ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
কথিত এই 'গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক' বা ভারতবর্ষের মহাভূমিকম্প নিয়ে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের মুখপত্র 'দ্য ইংলিশম্যান' পত্রিকায় একের পর এক বিবরণ আসতে থাকে। প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পটির দালিলিক প্রমাণ রাখার উদ্দেশ্যেই ওই পত্রিকার বিবরণী পরবর্তী সময়ে স্থান পেয়েছে পুস্তকে। 'দ্য আর্থকোয়েক ইন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম' শীর্ষক বইয়ে ইংলিশম্যানের প্রতিবেদনগুলো পুনরায় মুদ্রিত হয়। সেসব বিন্যস্ত হয়েছে কালানুক্রমিকভাবে।
১৮৯৭ সালের সেই বিধ্বংসী ভূকম্পনের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কী রূপ সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় এই বই থেকে। বইয়ে সূত্র হিসেবে ইংলিশম্যান পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্যও উদ্ধৃত হয়েছে, পাশাপাশি অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরও জবানবন্দি উঠে এসেছে।
ভূমিকম্পের মাত্র দুদিন পর ইংলিশম্যান পত্রিকায় জুন ১৪-তে লেখা হয়েছে, 'শনিবার সন্ধ্যায় উত্তর ভারত জুড়ে যে মহাভ'মিকম্পটি হয়েছে, তা নিয়ে এখনই নির্ভুলভাবে কিছু বলা অসম্ভব। তবে বর্তমান প্রজন্ম এই ধরনের কোনো ঘটনা তাদের জীবদ্দশায় দেখেনি আর যেসব দেখেছে, এর তীব্রতা যে সব কটিকেই ছাড়িয়ে গেছে, তাতে সন্দেহ সামান্যই। আমাদের টেলিগ্রাম থেকে এটি জানা গেছে যে ভূকম্পনের ঢেউটি বাংলা, মণিপুর, আসাম এবং বম্বেতে কম-বেশি সব জায়গাতেই অনুভ'ত হয়েছিল। ভূমিকম্পের ব্যাপ্তি থেকে ধারণা করা যায় যে এটা একদিকে বিহার অন্যদিকে মধ্য প্রদেশকে স্পর্শ করেছিল। একই সঙ্গে আরেক দিকে দার্জিলিং এবং শিমলার মতো দূরবর্তী জায়গায়ও এর কম্পন অনুভূত হয়েছে।'
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ভ'মিকম্পের তরঙ্গের শক্তি কলকাতার মতো দার্জিলিংয়েও তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। ত্রিপুরার কসবা থেকে টেলিগ্রাফযোগে একজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন, আসাম-বাংলা রেলপথে ১০০ মাইলেরও বেশি সীমানা জুড়ে কম্পন মারাত্মকভাবে অনুভ'ত হয়েছিল এবং শমশেরনগরে একটি ট্রেন উল্টেও গিয়েছিল। খবর আসে, মিশ্র যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে মন্টোল্লায় আটকে যাওয়ার। ওেলের এই দুটি উদাহরণ থেকে অনুমান করা যায় এই ভূমিকম্পের তীব্রতা: একটি ভূমিকম্প, যা সেতু ধ্বংস করেছে এবং ট্রেন লাইনচ্যুত করে দিয়েছে, এবং এটা মানুষের জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ভারতবর্ষে ভূমিকম্পের ঘটনা একেবাওে অজানা নয়। অনেকেই আছেন, যারা ১৮৮৫ এর জুলাইয়ের বা ১৮৮৮ এর ডিসেম্বরের ভূমিকম্পের কথা জানেন। তবে এর কোনোটিই ১৮৯৭-এর জুনের সেই শনিবারের মতো এতটা তীব্র ছিল না।
ঢাকায় প্রাণহানী– জুন ১৩, ১৮৯৭
পাঁচ মিনিট স্থায়ী হওয়া এই ভূমিকম্প জানমালের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। শাহীন মেডিকেলের হল ধসে পড়ে সাত সদস্যের একটি আর্মেনিয়ান পরিবারের দুজন মারা গেছে। বাকি পাঁচ জনকে পরবর্তী সময়ে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। ডাকবাংলো, মিটফোর্ড হাসপাতাল আর হোসেনি দালানও ভেঙে পড়েছিল। মিটফোর্ড হাসপাতালের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হওয়ায় অনেক রোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে বাইরে তাঁবুতে এনে রাখা হয়েছিল।
তৎকালে ঢাকায় থাকা অধিকাংশ ইউরোপীয় ভবনের দেয়াল ফেটে গেছে। কিছু বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। নবাবের দিলকুশার বাড়ির ওপরের তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার প্রাসাদ আহসান মঞ্জিলের হালও নাজুক ছিল। ভূমিকম্পের সময় এটি গভীর সমুদ্রে থাকা জাহাজের মতো দুলেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। অবশ্য ঝাঁকুনিতে তিনতলার কক্ষে ফাটল ধরে গেছে। ইডেন মহিলা স্কুল আর শাহবাগ হাউসও ভেঙে পড়েছে।
ঢাকা ও ময়মনসিংহে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
তৎকালীন সরকারের গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী জে জি এইচ গ্লাসের আনুষ্ঠানিক রেকর্ড অনুযায়ী ঢাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মধ্যে ছিল ঢাকা কলেজ, কলেজিয়েট স্কুল ভবন, জেল ভবন, পুলিশের ব্যারাক, অফিস কোয়ার্টার, সার্কিট হাউস, পুলিশ লাইনস, চার্চ, জজকোর্ট, কোতোয়ালি পুলিশ স্টেশন, বিচারপতির বাসভবন, প্রশাসকের বাসভবন ইত্যাদি। তার ভাষ্যমতে, ঢাকার ভবনগুলো মেরামত চলা অবস্থাতেই বসবাস করা যাবে, তবে কিছু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু ময়মনসিংহের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ, সেখানে ভবনগুলোর অবস্থা এতটাই নাজুক যে সেসব খালি করার আগপর্যন্ত তাতে মেরামতকাজ সম্ভব না। আর তা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তাই অফিসের পরিবর্তে সাময়িকভাবে তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভূমিকম্পের পর ঢাকার পরিস্থিতি
শুরুতে যা অনুমান করা হয়েছিল, এই ভূমিকম্পে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দোতলা সব বাড়িঘরে ফাটল ধরে গেছে। ফাটলে নতুন করে জুড়ে দেওয়া প্লাস্টার বা দুর্বল মর্টারের কাজ দেখে প্রথমেই মাথায় আসবে যে এই ভবনগুলো দীর্ঘ সময়ের ঝাঁকুনি কীভাবে সহ্য করেছিল! সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল না কেন? চিকিৎসক, কালেক্টর, বিচারপতি, পাদ্রি– সবাইকে নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। মূলত তারা তাদের বন্ধু-স্বজনদের বাড়িতেই থাকছেন; কারণ, এখন অন্য কোথাও-ই আর তাদের যাওয়ার জায়গা নেই।
ময়মনসিংহ থেকে লেখা চিঠিতেও বলা হয়েছে, বিকেল ৫টা ১০ মিনিটের সময় প্রচণ্ড ভূমিকম্পন অনুভূত হলো। সেখানকার একজন রেলওয়ে গার্ডের ভাষ্যমতে জানা যায় যে, ভূমিকম্পটির স্থায়ী হয়েছিল দেড় মিনিট। এতে সেই এলাকার পাকা বাড়িগুলোর মধ্যে কেবল টাউন হল আর জেলা প্রশাসকের বাসভবনই টিকে ছিল। এ ছাড়া জজকোর্ট ও অফিস ভবন ধসে পড়েছে।
ভূমিকম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়: সেখানে প্রথমে হালকা একটি গর্জনের শব্দ শোনা যায়, যারা ১৮৮৫ সালের ভ'মিকম্পের সাথে পরিচিত ছিলেন, তারা আওয়াজ শুনেই নিজেদের ঘর ছেড়ে বাইরে এসে আশ্রয় নেয়। ময়মনসিংহের রেলপথে প্রায় ২৩ মাইলের রাস্তা খুবই বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেল চলাচল স্বাভাবিক হতে দুই সপ্তাহের বেশি সময় প্রয়োজন হবে, এর মাঝে রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে। মফস্বলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে কিছু কিছু ফাটলের দৈর্ঘ্যে ২৫ ফুটের চেয়েও বেশি। সবচেয়ে বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজবাড়ি আর দুটি চার্চ। নীলফামারীর রেললাইন এবং স্টেশন ধসে গেছে।
সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি
সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রবীণদের স্মৃতিতেও এই ভূমিকম্প ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। তারা অন্য ভূমিকম্পের সাথে এটির তুলনা করে বলেছিলেন যে ওসব এর কাছে কিছুই না। স্মৃতিতে তাদের কাছে ভূমিকম্পের আগের সময়টা অন্য রকম ঠেকেছে। কিন্তু তারা ভূমিকম্পের আগাম বার্তা অনুমান করতে পারেননি। আকাশে কালো মেঘ ভরে ছির, এরপর শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। এর আগের প্রায় প্রতিটি ভূমিকম্পেই তীব্র গর্জন শোনা যেত। কিন্তু সেবার এমন কিছুই শোনা গেল না ভূমিকম্প আঘাত হানার আগে।
এমন আচমকা শুরু হলো যে, মানুষ যে দৌড়ে ঘর থেকে পালাবে, সেই সুযোগটিও পাওয়া যায়নি। প্রকাণ্ড সব গাছ মাটির কাছে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল। তিন মিনিটের মতো স্থায়ী হওয়া এই ভূমিকম্পটির ঢেউ উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে ধাবিত হয়েছিল।
মার্টিঙ্গা ফ্যাক্টরির বিপরীতে ধলাই নদীর কূল ছাপিয়ে ঢেউ ডাঙায় আছড়ে পড়ে। মুনশি বাজারে সেদিন হাট বসেছিল। মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্প আঘাত হানা এলাকাবাসী প্রাণভয়ে পালাবার চেষ্টা করলেও নদীর ফাটলের মুখোমুখি হয়। শুরুতে ইংলিশম্যান পত্রিকায় সন্দেহ করা হয়েছিল, এলাকাবাসীর এসব বয়ান অতিরঞ্জিত। কিন্তু পরে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ আসতে শুরু করলে ক্ষক্ষতির পরিমাণ সঠিক ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
আসাম-বাংলার রেলপথ করিমগঞ্জের কাছাকাছি লাইনচ্যুত হয়। তেলাগাঁওয়ের কাছে অবস্থান করা এই ভারী ট্রেনের ইঞ্জিন আর কয়েকটি ট্রাক ছাড়া বাদবাকি অংশ নিচের ধানখেতে গিয়ে পড়ে।
ভূমিকম্পে ওেলের বাঁধগুলো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কোথাও কোথাও নিচে চিড় ধরে গেছে। সব দিক থেকে তখন কেবল দুর্যোগের সংবাদ আসতে শুরু করে। সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জমিদার ছিলেন আলী ওমজিদ খান, তার বাড়ি ও তদসংলগ্ন এলাকা থেকেও ভূমিকম্পের নির্ভরযোগ্য বয়ান পাওয়া যায়:
মহররমের সময় (১১ মহররম ১৩১৫ হিজরি) হওয়ায় জনসমাগম ছিল। গুঞ্জন আছে যে জমিদারবাড়িটি পাকা হওয়ার পরও, সেখানে ১০ জন আহত হয়েছেন আর তিনজনের অবস্থা মৃত্যু-সংকটাপন্ন। ভবনটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, প্রথমে গুজব রটেছিল যে ওমজিদ খান নিজেও এই ধ্বংসাবশেষের নিচেই চাপা পড়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জীবিত ফেরেন। এবং এলাকাবাসীর প্রিয় হওয়ায় তার জীবিত থাকার সংবাদে স্বস্তি নেমে আসে। এই ভূমিকম্পে আসাম-বাংলার যোগাযোগেও ছেদ ঘটেছিল সাময়িক সময়ের জন্য।
জুলাই ৩, ১৮৯৭-এর ইংলিশম্যান পত্রিকা থেকেও জানা যায় সিলেটের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ। পত্রিকারটির নিজস্ব প্রতিবেদক লিখেছেন, 'ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও অভ'তপূর্ব প্রকৃতি সম্পর্কে ইতোমধ্যে সবকিছু জানানো হয়েছে, তাই আমি মোটামুটি সবচেয়ে খারাপ ক্ষতির একটি সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চা শিল্পে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডের ক্ষতি হব– এটা বাজে কথা। আশঙ্কা হলো, এক পাউন্ড চা-ও নষ্ট হবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চায়ের গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যদিও এর তেমন উদাহরণ নেই। তবে একটি সম্পূর্ণ চা কারখানার মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ভালো চা তৈরির অন্যান্য যন্ত্রপাতি কমবেশি ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে চা কারখানা ও প্রক্রিয়ায় চা শিল্পের জন্য যথেষ্ট অসুবিধার তৈরি করবে।
সিলেটের ফসলের ৫০ শতাংশের নষ্ট হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পাকা বাংলোগুলোর। সেখানকার বারান্দার স্তম্ভগুলো ভূমিকম্পের ধকল সহ্য করতে পারেনি। আর ভূমিকম্প শেষে হয়েছে, বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে এগিয়েছে। তবে যে বাংলোগুলোতে লোহার পিলার ছিল, সেগুলো আশ্চর্যজনকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে এবং খুব বেশি ক্ষতির মুখোমুখিও হয়নি। কিন্তু মনুমুখ, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের মতো অনেক জায়গা পলিমাটির ওপর গড়ে ওঠা, ফলে মনুমুখে ভ'পৃষ্ঠের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, এখানে চা মিল পুরো মাটির নিচে তলিয়ে গেছে।
ফেঞ্চুগঞ্জে এখন পর্যন্ত স্টিমার অফিসের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বড় লোহার গোডাউনের মেঝে নিচে দেবে গেছে এবং পুরো গোডাউনটিই যেন উপড়ে পড়েছে। করিমগঞ্জ তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তবে মাটিতে যথেষ্ট চিড় ধরেছে। সিলেট শহর এই মুহূর্তে যেন একটা নদীর মতো। জেলা প্রশাসক, জজ, পুলিশ সুপাররা নৌকায় বসবাস করছেন। খাজাঞ্চির খাজানাখানাও মাটিতে তলিয়ে গেছে। মাটি থেকে মূল্যবান পুরোনো রেকর্ড পুনরুদ্ধারের জন্য কুলিদের নিয়োগ করা হয়েছে। অবিরাম বর্ষণে সব ছত্রখান।
বগুড়ায় ক্ষয়ক্ষতি
বগুড়ায় ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সেখানেও ভূমিকম্পের জের তিন মিনিট ধরে স্থায়ী ছিল। প্রথমে মৃদু গর্জন এবং হালকা ধাক্কার মতো শুরু হয়। গাছ এবং ভবন কাঁপতে শুরু করে, লোকজনের মধ্যে খুব দ্রুতই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে শুরু কওে। মুসলমানরা 'আল্লাহ, আল্লাহ' বলে চিৎকার করতে থাকে। প্রায় প্রতিটি সরকারি ভবনেরই ছাদ উড়ে যায়, বাড়িঘরের দেয়ালে জুড়ে বড় বড় ফাটল। জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবনও ধ্বসে পড়ে। বগুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট তার পরিবার-সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে কোনোভাবে নবাব আব্দুল সোবহান চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এ বাড়ির অবস্থাও বিশেষ ভালো না।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারিবাড়ির ছাদ উড়ে গেছে। সার্কিট হাউসও একইভাবে ভেঙে পড়েছে। গণগ্রন্থাগারের অবস্থাও শোচনীয়। বাজার ও শহরের সব পাকাবাড়ি হয় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, নয়তো খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু পাকাবাড়ি না, মাটির ঘরগুলোও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বগুড়ায় অবস্থানরত ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের এসপি ও জজ তাঁবুতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তিন দিনের জন্য শহরের সাথে বাইরের যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। টেলিগ্রাফ দিয়ে যোগাযোগ করাও জটিল ছিল।
পাবনায় হারিয়ে গেছে গ্রাম?
পাবনার নাকালিয়া থেকে লেখা চিঠিতে একজন লিখেছেন, 'যমুনার পাশে থাকা পাঁচ-ছয়টি গ্রাম হারিয়ে গেছে। ভূমিকম্প হওয়ার পর দুদিনের মাথায় আরও ২০টি আফটারশক অনুভূত হয়েছে।' সেই চিঠির প্রত্যুত্তরে আরেকজন লিখেছেন, 'আমি এইমাত্র যমুনা নদীর তীরবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রামের উধাও হওয়ার একটি বিবরণ পড়েছি। কিন্তু এটি স্রেফ কল্পনা।'
ভূমিকম্পটি সেখানে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। এখানকার বাড়িগুলো প্রধানত মাদুরের দেয়াল এবং খড়ের ছাদ দিয়ে তৈরি। ফল অধিবাসীদের বিপদ কম হয়েছে। আতঙ্কিত লোকজন দিশেহারার মতো ঘরবাড়ির ছেড়ে পালাতে শুরু করে। মোহনগঞ্জে কাঁচা ছাদের পুরোনো নীলের একটা কারখানা খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেয়ালগুলোতে বড় ফাটল ধরে গেছে এবং জায়গার জায়গায় অনেক মেরামতের প্রয়োজন হবে। মেরামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারখানার বাসিন্দারা অন্য আশ্রয়ে সরে গেছেন। আমার জানামতে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ মাইল ব্যাসার্ধের ভেতরে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। ভূমিকম্পের সময় নদী ও বড় জলাধারের পানি ছিল খুবই বিক্ষুব্ধ। ১০ মিনিটের মতো ভ'মিকম্পের পর উত্তর-পূর্ব দিকে ভিন্ন ধরনের একটি গর্জন শোনা যাচ্ছিল।
ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটির পর, কাঁপন থামলেও সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল যে, ভূমিকম্প আবার আঘাত হানবে, উত্তর-পুব দিকের গর্জন সে কথাই বলছে। তবে ধীরে ধীরে গর্জন কমে আসে। স্বস্তি ফিরে আসে আফটারশক আসছে না ভেবে। তবে এই সদ্যঅতিক্রান্ত ভূমিকম্পের আগে কোনো এ গর্জন শোনা যায়নি; আর ক্ষীণভাবে শোনা গেলেও তা কারও কানে আসেনি।
টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ক্ষয়ক্ষতি
শহরের সবচেয়ে বড় গোডাউনটি আড়াই মিনিট ধরে ভূমিকম্পে অনবরত কেঁপেছে। টেলিফোনের তার, দরজা, জানালা সব ভয়ানকভাবে কাঁপছিল। ভূমিকম্পের তরঙ্গ উত্তর-পূর্বাংশ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দিকে এগিয়েছে। জয়পুরে ছাদ উড়ে পড়ায় নিহত হয়েছেন দুজন। ভূমিকম্পে মৃতদের অধিকাংশই ছিল শিশু, যাদের বয়স তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। বাড়ি ছাড়া উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের যে কী নিদারুণ যন্ত্রণা, তা লিখে বোঝানো কষ্টকর। করতোয়া নদীর তীর ধরেও অনেক চিড় দেখা গেছে। সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে বালু ও মাটি উঠে এসেছে। জমিরবাড়িয়ায় ভূমি নানা দিক থেকে দেবে গেছে।
ফুলবাড়িয়াতেও গাঢ়রঙা পাথরের অংশবিশেষ মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে। জেলা প্রশাসকের কাছেও নমুনা পাঠানো হয়েছে। শেরপুরে ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, প্রাণহানির কোনো খবর সেখানে পাওয়া যায়নি। তবে ভূপৃষ্ঠের নানা জায়গায় ফাটল ধরে সালফার বেরিয়ে আসার খবরও এসেছে। মূলত কটু গন্ধ থেকেই সালফার চিহ্নিত করা হয়েছে। কালেক্টরেটের কাছারিঘরে সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গায় দ্রুত তাঁবু ও শামিয়ানা টানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকারি স্কুলগুলোতে নানা জায়গায় চিড় পর্যবেক্ষণ করে প্রশাসক এক সপ্তাহের ছুটি ঘোষণা করেছে। সিভিল মেডিকেল অফিসারের বাসভবনের একদিক ধসে পড়েছে , তিনি শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন রান্নাঘরে। পোস্ট অফিস, জেলা বোর্ড অফিস, মিউনিসিপ্যাল অফিস আর জেনানা হাসপাতাল বাদে এই ভূকম্পনের তীব্রতা কোনো সরকারি ভবনই সহ্য করতে পারেনি।
চট্টগ্রামে ক্ষয়ক্ষতি
স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হালকা একটি ভূকম্পন অনুভূত হয়। ধীরে ধীরে সেটির প্রাবল্য বাড়তে থাকে। তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিট সময়ব্যাপী ভ'পৃষ্ঠ সজোরে কাঁপতে থাকে। এ সময় উত্তর-পূর্বাংশ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দিকে কম্পনের ঢেউটি প্রবাহিত হয়। অ্যাগোনিয়া চা-বাগানে উপস্থিত লোকজন, যাদের অধিকাংশই মুসলিম, তারা কান্নাকাটি করতে থাকেন। তাদের সাথে থাকা শিশুরাও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
একজন প্রতিবেদক লিখেছেন, 'কোনো গর্জনের আওয়াজ শোনা যায়নি। সাধারণত ভূমিকম্পের সময় সেটা থাকেই, যেমন চিলির ভ'মিকম্পে আমি এটা শুনেছি। তবে এখানে তেমন ছিল না। কিন্তু চট্টগ্রামে আমি আছি দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ, আমি এ রকম ভূকম্পন আগে কখনোই অনুভব করিনি। আমার চোখের সামনেই নিচে একটি মাঠে গরুদের হাঁটাহাঁটি করতে দেখছিলাম। ওরা নীরব। কিন্তু অন্যদিকে কাক আতঙ্কিত হয়ে খুব উত্তেজিত অবস্থায় ছিল।'
ভূমিকম্পের পরপরই ধূসর আকাশ থেকে মেঘ জমে বৃষ্টি নামা শুরু হয়। জানমালের কোনো ক্ষয়ক্ষতি এখানে হয়নি। সিমেন্টের বাধানো বিভিন্ন জায়গা ফেটে গেছে। পাকা ভবনের দেয়াল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মোটামুটি পুরো জেলাজুড়েই ভূমিকম্পটি সমানভাবে সংঘটিত হয়েছে। নদীর পানির মধ্যে কোনো জোয়ারের ঢেউ আসেনি, এটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার। না হলে নিম্ন ভূমিগুলোও পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যেত। মধ্যরাতে আবার একটি হালকা ভ'কম্পন অনুভ'ত হয়েছে। এর পরদিন আবার আরেকটি আফটারশক লক্ষ করা গেছে।
পাটকলের ক্ষয়ক্ষতি
ভূমিকম্পের জন্য কলকাতা জুট মিলে তেমন কোনো ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিছু জায়গায় স্রেফ ফাটল ধরে গেছে। আবার শামনাজ্ঞুর পাটকল ও হুগলি নদীর তীরবর্তী তিতাঘুর পাটকলও এই কম্পনে টিকে থেকেছে। পাশাপাশি বারনাগোর মিলস, বালি মিলসেও তেমন কোনো বিধ্বংসী প্রভাব পড়েনি। তবে পাবনার সিরাজগঞ্জ মিলের লম্বা চিমনি বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাটিতেও ফাটল ধরে গেছে। কিছু কিছু চিড় দৈর্ঘ্যে চার ফুটের মতো।
নারায়ণগঞ্জে ভূমিকম্পের প্রভাব ছিল অত্যধিক। তিন মিনিট ধরে স্থায়ী ভূমিকম্পের গতিপথ ছিল উত্তর-পূর্বাংশ থেকে দক্ষিণ-পূর্বাংশের দিকে। এর তিন দিন পর আবার মধ্যরাত থেকে আরেকটি ভূকম্পন সজোরে অনুভূত হয়। তবে এটি আগেরটির মতো স্থায়িত্ব পায়নি, ৩০ সেকেন্ডের ভেতরই এটি শেষ হয়ে যায়। এর পর থেকে দিন-রাত অসংখ্য বার ভূকম্পন হয়েছে। পাকা ভবনে এর ক্ষয়ক্ষতি ছিল সীমাহীন। গোডাউনগুলোতে চিড় ধরে গেছে, ছাদগুলো ভেঙে পড়ছে। এরই মাঝে কারও কারও বাসস্থানও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল। কারও কারও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য এত বেশি হয়নি, সামান্য অঙ্কের টাকা খরচ করেই সেগুলো পুনরায় মেরামত করা হয়েছে।
কিছু প্রেস হাউসে চিমনি এত বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সেগুলো ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। হাজীগঞ্জে নবাবের যে বাসভবন ছিল, সেটির ওপর দিয়েও যেন একরকম ঝড় বয়ে গেছে। কারাগারের কয়েদিরাও যখন চারপাশে ইট-সুড়কি পড়ে যেতে দেখছেন, তখন তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছেন। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
দিনাজপুরে ফাটল
দিনাজপুরে ভূমিকম্পটি তিন মিনিট ধরে স্থায়ী ছিল। এরপর শহরে অবশিষ্ট আছে দোতলা ভবন খুব কমই দেখা গেছে। রাজবাড়ি, কালেক্টরের বাড়ি এবং জেলা সুপারের বাড়ির মতো সব বড় বড় ভবন ভেঙে পড়ায় বাসিন্দারা তাঁবুতে আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হতে হয়েছে। ভূকম্পনের তরঙ্গ মূলত পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছিল। শহর এবং চারপাশের সমস্ত নিচু জমিতে ফাটল ধরেছে এবং পানি ও বালু থেকে গন্ধকের তীব্র গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। নদীর তলদেশেও বেশ কিছু উত্থান-পতন ঘটেছে। তবে এত কিছুর পরও এই অঞ্চলে প্রাণহানি কমই হয়েছে, একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
অধিকাংশ বিবরণ থেকেই জানা গেছে, এটি যে মাত্রার ভূমিকম্প ছিল, তাতে আরও অনেক বেশি প্রাণহানি হতে পারত, তবে সৌভাগ্যবশত তা হয়নি। পাশাপাশি ভূমিকম্পের আগে তেমন কোনো গর্জন শোনা যায়নি। স্থায়ীত্বের দিক থেকে এটি ছিল ভয়াবহ, গড়পড়তায় স্থানভেদে তিন থেকে পাঁচ মিনিট স্থায়ী হয়েছে। তবে ইংলিশম্যানের প্রতিবেদনে সাধারণ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিত্রের চেয়ে তৎকালীন সরকারি ভবন ও ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের ক্ষয়ক্ষতির বয়ানই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।