টাকার ইতিহাস
বিভিন্ন মূল্যমানের নোট এখন সহজলভ্য হলেও, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুদ্রার প্রচলন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতায় এলে তারা ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হয়। স্বীকৃত মুদ্রা ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিছুদিন বাংলাদেশি সিলমোহর লাগানো পাকিস্তানি রুপি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না।
একই বছর জরুরি ভিত্তিতে ১ ও ১০০ টাকার নোট ছাপানোর জন্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, যা চূড়ান্তভাবে ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাজারে ছাড়া হয়।
এগুলো ছিল বাংলাদেশের প্রথম নিজস্ব টাকা। দেশের স্বাধীনতার স্মরণে বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে নোট ডিজাইন করা হয়।
এর প্রায় দুই মাস পর ১০ টাকার নোট এবং এক মাস পর ৫ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়।
কিছুদিন পর আরেক নতুন সমস্যা দেখা দেয়। নোটগুলো ভারতে ছাপা হওয়ায় সেগুলো নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। জাল নোট ছড়াতে শুরু করলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৯৭৩ সালের ১ মে নোট বাতিল করে। এক বছর পর ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ এক টাকার নোট বাতিল করা হয়।
তখন এক মার্কিন ডলারের দাম ছিল প্রায় ৮ টাকা। এরপরই নতুন নোট আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। নতুন নোট যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ যেকোনো উন্নত দেশে ছাপানো যেতে পারে।
কিন্তু এর ডিজাইন কেমন হবে? সদ্য স্বাধীন একটি দেশের মুদ্রা ডিজাইনের দায়িত্ব কে নেবে?
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিটিকে নতুন নোটের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কাইয়ুম চৌধুরীকে নোট ডিজাইনের দায়িত্ব দেওয়া হলেও কাজ এগোতে না পারায় স্থানীয় একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্য ডিজাইনার খোঁজা হয়।
এক পর্যায়ে কামরুল হাসান খবর পান চারুকলার শিল্পী কে জি মুস্তাফার কথা, যিনি করাচির সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। তার খোঁজে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি এবং শেষ পর্যন্ত কামরুল এই মানুষটিকে পেয়ে যায়।
তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মুস্তাফাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আ ন ম হামিদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যান। সেখানেই মুস্তাফাকে নতুন নোটের নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুস্তাফা প্রথমে পাঁচ টাকার নোটের দুটি সংস্করণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। দুই সপ্তাহ পর তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে তার নকশা জমা দেন। হামিদুল্লাহ নকশাটি দেখে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তিনি এটি প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দেখিয়েছিলেন। অবশেষে নকশাগুলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
কে জি মুস্তাফা তার স্মৃতিকথায় বঙ্গবন্ধুকে নকশা দেখানোর দিনটির কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, 'বঙ্গবন্ধু এসব নকশা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি এগুলো বিদেশ থেকে বানিয়েছেন?'
ওই দিনই বঙ্গবন্ধু নোট ছাপানোর অনুমতি দেন এবং এর জন্য চুক্তি দেওয়া হয় ব্রিটিশ কোম্পানি টমাস দে লা রুকে।
৫ টাকা মূল্যমানের দুটি নোটের নকশা প্রণয়ন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং আগস্ট মাসে লন্ডনে ছাপা হয়। পরের বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশের নতুন নোট দুটি বাজারে আসে।
কী ছিল এই মনোমুগ্ধকর ডিজাইনে? একপাশে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকল। মিলের বাম পাশে ছিল একটি পাটগাছ।
অন্য নোটে শিল্পী এক কোণায় একটি প্রস্ফুটিত শাপলা এবং পাটের তৈরি ঝালরের ছবি দিয়েছিলেন।
কেজি মুস্তাফা তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, নোট দুটির ব্যাকগ্রাউন্ডে সুরক্ষা প্যাটার্নসহ একটি ফুলের প্যাটার্ন ছিল। টাকার মূল্যের ঠিক পেছনে ছিল বাংলাদেশের নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী লোকজ মোটিফ।
এরপর দুটি এক টাকার নোট, দুটি ১০ টাকার নোট ও একটি ১০০ টাকার নোট তৈরি করতে প্রায় তিন মাস সময় নেন মুস্তাফা।
১ টাকা মূল্যমানের নোটের সামনের দিকে ধানের শিষ এবং পেছনের ডান পাশে জাতীয় প্রতীক রয়েছে।
অন্য নোটে মুস্তাফা একগুচ্ছ ধান হাতে এক নারীর ছবি দিয়েছিলেন এবং অন্যপাশে জাতীয় প্রতীক ব্যবহার করেন।
দুটো নোটই ছিল কিছুটা গাঢ় নীল রঙের।
এরপর ১০ টাকার দুটি নোট বাজারে আসে এবং সবশেষে ১০০ টাকার নোট বাজারে আসে।
সবগুলো নোটের নকশায় বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জনজীবনের প্রতিফলন ঘটেছে, যা দেশের লোকজ ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে।
মুস্তাফা বলেন, ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, 'একটি দেশের মুদ্রা সে দেশের দূত'।
এরপর আসে ১৯৭৫ সালের কুখ্যাত ১৫ আগস্ট। সেদিন সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রপতি ভবনে অভ্যুত্থানের সময় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
রাষ্ট্রক্ষমতা হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে নোট থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। প্রতিটি নোটে পরিবর্তন আসতে শুরু করে এবং গ্রামীণ দৃশ্যগুলো হারিয়ে যেতে থাকে।
একের পর এক নতুন নোট বাজারে আসতে শুরু করে। ২ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, নতুন ডিজাইন করা ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকা ভিন্ন যুগের সূচনার ইঙ্গিত দেয়।
কাগজের নোট লেনদেনের একমাত্র উপায় ছিল না। মুদ্রার ব্যবহারও ছিল।
১৯৭৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম এক পয়সার কয়েন বাজারে আসে, এরপর ১৯৭৪ সালে পাঁচ পয়সা কয়েন, ১০ পয়সা এবং আরও কয়েকটি কয়েন বাজারে আসে। ১৯৯৫ সালের ১ অক্টোবর চালু হয় ৫ টাকার কয়েন।
অন্যদিকে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে স্মারক নোট ও মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছে।
যেমন- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী, জাতীয় কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর পূর্তিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে স্বাধীনতার ৪০ বছর, ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি ও অন্যান্য ঘটনা উপলক্ষে বিভিন্ন মূল্যমানের স্মারক নোট রয়েছে।
সময়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল আর্থিক সেবার জগতে আরেকটি বিপ্লব ঘটিয়েছে, বর্তমান যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় এক দশক আগে ২০১১ সালে 'বিকাশ' যাত্রা শুরু করে এবং এরপর থেকে তার আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এখন একটি বোতাম টিপেই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে সহজেই টাকা পাঠানো যায়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও বিকাশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
কাগজের টাকার আধিপত্য বজায় থাকলেও, নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে।