স্মৃতির পাতায় সাদি মহম্মদ
এই বছরের গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের কল্যাণীর বাড়িতে সাদি এলো। ওবাড়ি একখানা বিশাল হল ঘর আছে, যেখানে ১৫০ জন মানুষ বসতে পারে অনায়াসে। এখানেই সাদি মহম্মদকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। ওঁ বললো, শান্তিনিকেতন যাব, দার্জিলিং যাব। কিন্তু যায়নি। পরদিনই হঠাৎ ঢাকা ফিরে এলো। সংবর্ধনার দিন সাদির সাথে কথা হলো, ওঁর প্রথম কথা ছিল, মা চলে গেলেন। আমার তো আর কেউ নেই, কেউ রইলো না।
শান্তিনিকেতন থেকে বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের স্মৃতিচারণ করছিলেন আশিস মজুমদার, যার এবং যার পরিবারের সাথে এই গুণী শিল্পীর ছিল অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক।
বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি। মন টানছিল গান। আর গানের টান নিয়ে গেল শান্তিনিকেতন। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে ১৯৭৬ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে গেলেন।
"আমার বছর দশেকের ছোটো ভাই ড. কল্যাণ মজুমদার এর সাথে সেবার ভর্তি হলো সাদি মহম্মদ। আর সেই ১৯৭৬ সাল থেকে সাদির সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের সূচনা। আমরা তখন আসানসোলে থাকি। বাবা এ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ভাইকে ভর্তি করতে আমি এলাম শান্তিনিকেতন। পরে শান্তিনিকেতনে সীমান্ত পল্লীতে বাসা নিলাম আমরা।
"আমার মা বাংলাদেশের বর্তমান মেহেরপুর জেলার (তৎকালীন নদীয়া) মেয়ে। যখন আমার মা বাবার বিয়ে হয়, তখনো দেশভাগ হয়নি। দেশভাগের কারণে ভারত-বাংলাদেশ নামে দুটো দেশ হলো। আমরা পড়লাম ভারতের অংশে। আমার মায়ের, তাঁর বাপের বাড়ি বাংলাদেশের প্রতি একটা অন্যরকম টান কাজ করতো। সেই টান কাজ করে আমারো। নাড়ির টান। কেননা আমার জন্ম হয়েছে মামারবাড়ি মেহেরপুরে। সাদি তখন নতুন এসেছে শান্তিনিকেতনে। সাদি বাংলাদেশের ছেলে। ওঁর প্রতি অগাধ স্নেহ আমার মায়ের।
"সাদির অনুরোধে প্রথমবারেই আমার মা রেনুকা মজুমদার ওর স্থানীয় অভিভাবক হতে রাজি হয়ে গেলেন। বিশ্বভারতীর নথিপত্র ঘাটলে এখনো সেসব কাগজ হয়তো পাওয়া যাবে," গল্পে গল্পে এভাবেই পুরোনো কথা, পুরোনো স্মৃতি উঠে আসছিল আশিস মজুমদারের ভাষ্যে।
শান্তিনিকেতনে সপরিবারে চলে আসবার পর আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রায় গানের আসর বসত। মোহর দি (কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়), নীলিমা সেন এঁরা পারিবারিক বন্ধুর মতন হয়ে গেলেন। রেজওয়ানা চৌধুরি বন্যা ছিলেন আমার ভাই কল্যাণ, সাদির তিন বছরের সিনিয়র। শান্তিনিকেতনে আমাদের বাড়িতে আনাগোনা ছিল এঁদের অনেকেরই। নন্দলাল বসুর বাড়ির ঠিক বিপরীতে নন্দসদন ছাত্রাবাস। এই ছাত্রাবাসে একই রুমে থাকতেন সাদি মহম্মদ ও ড. কল্যাণ মজুমদার। পরে কল্যাণ পরিবারের সাথে থাকা শুরু করলেন হোস্টেল ছেড়ে। সে সময় থেকে সাদি প্রতিদিন কল্যাণ মজুমদারের বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন।
সাদি মহম্মদের স্থানীয় অভিভাবক, বাংলাদেশের মেয়ে রেণুকা, ভালো গান গাইতেন। হিমাংশু দত্ত, জগন্ময় মিত্র থেকে শুরু করে পুরনো দিনের শিল্পীদের গান গাইতেন। সংগীতের প্রতি একটা আলাদা অনুরাগ ছিল ছোটোবেলা থেকেই। তার বাবা তখন নদিয়ার নামকরা আইনজীবী। রেণুকাকে গান শেখাতে কৃষ্ণনগর থেকে এক ওস্তাদ যেতেন মেহেরপুরে। পরবর্তীতে রেণুকার বিয়ে হলো, দেশভাগ হলো। কিন্তু গান ভুললেন না তিনি।
"আমাদের তখন ভাড়া বাড়ি। বাড়ি থেকে হেঁটে নন্দসদন ছাত্রাবাসের দূরত্ব মিনিট দশেক। এই বাড়িটা ছিল অর্মত্য সেন এর বাড়ির কাছেই। আমার মায়ের কাছে বসে একের পর এক গান শুনত সাদি। মায়ের কাছেই কত কত তখনকার বাংলার গান তুলেছে ওঁ। আমার মাকে সাদি মাসিমা বলে ডাকত। আমার মাকে একদম মায়ের মতন করে দেখত। কখনো কখনো মায়ের খাটে হেলান দিয়ে, হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকত। শিখত হিমাংশু দত্তের গান। সাদি সদ্য দেশ ছেড়ে, মাকে ছেড়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছে। মন বসাতে পারছে না। আমাদের বাড়িতে এসে পারিবারিক একটা পরিবেশ পেত।
আমাদের বাড়িতে গানবাজনা লেগেই থাকত। তখন বাংলাদেশের মৃদুল চক্রবর্তীসহ অনেকে সঙ্গীতভবনে পড়ালেখা করছেন। সন্ধ্যেবেলা গানের আসর হয়ে উঠলো নিত্যদিনের ঘটনা। সেখানে সাদি আসবেই। সাদি খুব সুন্দর গাইত। ওঁর গলায় রবীন্দ্রসংগীত অনন্যসাধারণ বললেও কম বলা হবে। গানকে অন্তর দিয়ে অনুভব না করলে বোধ হয় এত সুন্দর গাইতে পারা যায় না। সাদিকে 'শান্তিনিকেতনের দ্বিজেন মূখার্জী' বলে ডাকতাম আমরা," কাঁপা কাঁপা গলায় পুরোনো দিনের কথা জানাতে জানাতে আশিস মজুমদার যেন ফিরে যাচ্ছিলেন সেসব দিনগুলোতে।
"এরপর সাদি পাশ করে বাংলাদেশে ফিরে গেল। আমার বছর দশেকের ছোটো ভাই কল্যাণ। সাদি কল্যাণের বন্ধু হলেও আমাদের সকলের সাথেই তার সমান হৃদ্যতা। দাদা বলে ডাকত আমাকে। ওকে আর কল্যাণকে কখনো আলাদা করে দেখিনি। আমার সাদির সাথে এই সমস্ত স্মৃতিকে অতীত নির্দেশক শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে হবে কখনো ভাবিনি। সাদি বাংলাদেশে ফিরে গেলেও ওঁ শান্তিনিকেতন এলেই আমাদের বাড়িতে একটা দিন কাটাবেই। সাদির ভাই শিবলি, সাদির বোনরা আমাদের বাড়িতে এসছেন অনেকবার। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে আমার ছেলে রূপমের বিয়েতে ১২/১৪ জন ছাত্র নিয়ে এসছিল সাদি। বরযাত্রী গেল আমাদের সাথে।
আমাদের ভাগ্নির বিয়েতে প্রথম ঢাকা গেলাম ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। ঢাকাতে যখন গেলাম, উঠেছি বোনের বাড়িতে। সাদি হঠাৎ করে জানতে পারলো, আমি বাংলাদেশে। সাদি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো আমার সাথে দেখা করবার জন্যে। আমার বোনের বাড়িতে সাদি চলে এলো আমার সাথে দেখা করতে। সাদি আসছে শুনে আশেপাশে ফ্ল্যাটগুলো থেকে মানুষজন চলে এসছে। একটা ভিড় জমে গেল।
বাংলাদেশে সাদির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আমি শুনেছি অনেক, সেবার প্রথম নিজ চোখে দেখা। সাদি বললো, দাদা, আমাকে না বলে-কয়ে আসবে কেন? আমি তোমাকে ঢাকা শহর ঘোরাবো। এরপর সাদির গাড়িতে করে ঢাকার বহু জায়গায় ঘুরলাম। বহু রাতেই 'হাজী বিরিয়ানি' খাওয়াতো। আমার মেয়ে রুপাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছে বক্তৃতা দিতে। সাদি ওরঁ কালো রঙের বিশাল গাড়ি করে ঘুরিয়েছে ঢাকার এদিক-সেদিক।
সাদির বাড়িতে গিয়েছি। শিবলী আর সাদির সংগীত ও নৃত্য সাধনার জন্যে রয়েছে বিশাল ব্যবস্থা। বিরাট বিরাট হল ঘর রয়েছে, সেখানে আছে কার্পেট পেতে বসবার ব্যবস্থা। ছাত্ররা তালিম নেয় এখানে বসেই। আমি গেলাম, শিবলী আর সাদি কার্পেটে বসে আমাকে বসালো অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায়। মনে হচ্ছে যেন আমি ওঁদের গুরু, শেখাব কিছু। এতটাই বিনয়," গল্পের পর গল্প চলতে থাকলো। স্মৃতিচারণায় চোখের সামনে ফুটে উঠতে শুরু করলেন ব্যক্তি সাদি মহম্মদ।
"ওঁদের বিরাট ৪ তলা বাড়ি। ৭ মার্চ ৭১ এ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিলেন, সাদি তখন সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। বাড়ি ফিরেই সাদি ওঁর মা জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ্কে বলে বসলো, 'মা, সবুজ রঙের পতাকা বানাতে হবে।' মা ভালো সেলাই করতে পারতেন। চারতলা বাড়ির ছাদে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের দিন পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে টাঙানো হলো বাংলাদেশের পতাকা। সাদির কাছে গল্প শুনেছি, ওদের পাড়াটা ছিল অবাঙালিদের লোকালয়।
২৬ মার্চ সাদিদের বাড়িতে আক্রমণ করলো অবাঙালিরা। লাগিয়ে দিল আগুন। ওঁরা ১০ ভাইবোন। তখন সাদির মায়ের কোলে দুটি কন্যা। ৮ মাসের বাচ্চা। আগুন লাগার ঘটনায় সাদির পরিবারের সবাই আস্তে আস্তে নিচে নেমে নামছে। ওদের বাড়ির পাশেই একজন অবাঙালি মিলিটারি সেসময় বাড়িতে ঢুকলেন। চেনা লোক। তাই কেউই ভয় পায়নি ওভাবে। কিন্তু এই অবাঙালি লোকটাই ভেতর থেকে ছুরি বের করে সাদির বাবা মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্কে নির্মমভাবে হত্যা করে। ছুরিটা এত ভেতরে ঢুকে যায় যে কিছুতেই বের করা যাচ্ছিল না। সাদির মা সেই অবস্থায় দোতলা থেকে নিচে না নেমে ঝাঁপ দিলেন। মায়ের দু পা ভেঙে গেল। নিচে যেসব অবাঙালি অফিসারগুলো ছিল, তারা বাচ্চাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সাদির কাকাকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হলো। দেশ স্বাধীনের পর সাদির বাবার নামে একটি রাস্তার নামকরণ হয় বলেও সাদি মহম্মদের কাছে গল্প শুনেছি," জানালেন আশিস।
সাদি মহম্মদ মাকে ভালোবাসতেন অত্যধিক। মজুমদার পরিবারকে সব সময় শোনাতেন সাদি মহম্মদের মায়ের জীবনসংগ্রামের গল্প। মা সেলাই করে করে সংসার চালিয়েছেন। মা না থাকলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো দূরে থাক, বেঁচেই থাকতেন না কোনো ভাইবোন। এসব কথা বলতে বলতে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়তো সাদি মহম্মদের সুরেলা কণ্ঠে।
"রাত ৯ টা। আমি তখন কলকাতায়। আমার ভাই পল্লব ভট্টাচার্য বাংলাদেশ থেকে ফোন করে জানালো, একটা দুঃসংবাদ আছে। তখনও বুঝে উঠতে পারি নি এটা হবে সাদির মৃত্যুসংবাদ। ওঁর তো চলে যাওয়ার বয়েস নয়।
এই খবর শোনবার পর কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। এরপর একে একে বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো ফোন আসতে থাকলো। তখন বুঝতে পারলাম, দুঃসংবাদটি সত্যি। মিথ্যে হলেই বেশি খুশি হতাম। বাড়ির ছেলে সাদি চলে গেল। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বড্ড বিষণ্নতায় ভুগত সাদি। একলা হয়ে গেল বড্ড। তবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে ২৫ ফেব্রুয়ারিতেও আমরা বুঝতে পারি নি," আক্ষেপের সাথে জানাচ্ছিলেন আশিস মজুমদার।
বাংলাদেশের অনেক গুণীজন অনেক রাষ্ট্রীয় পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন, কিন্তু সাদি মোহাম্মদের মতো মানুষকে কেন কখনো বিবেচনা করা হয়না তা কেবল ভাগ্যবিধাতাই বলতে পারেন। সাদি মোহাম্মদের মতো মানুষকে মরণোত্তর জাতীয় পদক দিয়ে বিব্রত না করাটাই হয়তো সমিচীন হবে। যে পরিবারটির নাম বাংলাদেশের জন্মের সাথে যুক্ত, তাঁরা যখন এ্যাদ্দিন আড়ালে থেকে গেলেন, তবে থাকুননা আড়ালেই।
স্মৃতি যতদিন থাকে, মানুষও ততদিন থেকে যায়। আর তাই মানুষ সাদি মহম্মদ অত্যন্ত জীবন্ত তার কাছের মানুষদের স্মৃতিতে। মানুষ বাঁচে তাঁর কর্মে। শিল্পী সাদি মহম্মদ বেঁচে থাকবেন তাঁর ভক্তদের মাঝে। যতদিন মানুষ সাদি মহম্মদের গান শুনবে, ততদিন তিনি আমাদের মাঝে রইবেন। বাঁচবেন রবীন্দ্রসংগীতের পঙক্তিতে। সাদির পায়ের চিহ্ন এখন আর না পড়লেও তাঁর পদচারণায় মুখর সংগীত জগৎ তাঁকে মনে রাখবে। কোনো এক বিষন্ন বিকেলে 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন' শুনতে শুনতে কিছুটা মন খারাপ হবে। আর এই মন খারাপেই মিশে থাকবেন সাদি মহম্মদ।