একাত্তরের কোলাজ
দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মতো বড় ফাটল নিয়েই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। সৃষ্টিলগ্নে পূর্ব বাংলার দুর্বল ও দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় শাসনের ন্যূনতম কর্তৃত্বও হাতে তুলে নিতে পারেনি। ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের যেটুকু ভাগ কখনো কখনো পূর্ব বাংলার ভাগ্যে জুটেছে, তা ছিল মূলত তাঁবেদারির। তাঁবেদারির বৃত্ত ভাঙতে চেষ্টা করা হলেই কেন্দ্রীয় শাসনের সিনিয়র পার্টনার হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার দুর্বল নেতৃত্বকে তাচ্ছিল্য করে অচিরেই নিষ্ক্রিয় করে দিত।
যে উদার গণতন্ত্রী লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭০-এ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করবে, এটা অনুমান করতে পারলে নির্বাচন পরিচালনার কৌশলগত প্রক্রিয়াটি হতো ভিন্ন। স্মরণ রাখা আবশ্যক, সে নির্বাচনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন একজন বাঙালি, বিচারপতি আবদুস সাত্তার।
পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির বুলি মুখে নিয়ে আইয়ুব আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোই হয়েছেন পাকিস্তান ভাঙার প্রধান কারিগর এবং ২৫ মার্চ ঢাকায় সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে সেদিনই ইয়াহিয়ার মতো তিনিও ঢাকা ছাড়েন। যখন করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন, তার পাকিস্তানি সমর্থকেরা স্লোগান দেয়: 'এক রহেগা পাকিস্তান, এক রহেগা পাকিস্তান—লজিন্দাবাদ'। তিনি বিমানবন্দরেই জনতাকে জানিয়েছেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুসংবাদ: করুণাময় আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। পরদিনের সংবাদ সম্মেলনে যে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তান রক্ষা করেছেন, সে 'গৌরবের কথা' শোনান। তার সঙ্গে সেদিন ছিলেন ছিলেন আবদুল হাফিজ পরীজাদা, গোলাম মোস্তফা খার, মির্জা রফি রাজা, আলী খান তালপুর ও মাহমুদ আলী কাসুরী।
ভুট্টো বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে একটি ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক সরকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন, তিনি পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন না। ২৩ মার্চ ১৯৭১ আমাদের চূড়ান্ত খেলা দেখানো হয়েছে—পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলে নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে এবং জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নার প্রতিকৃতি পায়ে মাড়ানো হয়েছে। ভুট্টো বলেন, বক্তৃতা, স্লোগান দিয়ে ১২ কোটি মানুষের দেশকে বিভক্ত করা যাবে না। নাইজেরিয়ার মতো দেশ যেখানে একটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন হতে দিল না, সেখানে পাকিস্তান ভাগ হতে দেয়া যাবে না। আর পাকিস্তানের বিষয় নিয়ে ভারতের নাক গলানোর কোনো অধিকারই নেই।
মুজিবের চার দফা
একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর করাচির দ্য ডন ৮ মার্চ ১৯৭১ শিরোনাম সংবাদ করে 'Awami League to Attend National Assembly Session if Four Point Demand Accepted'—চার দফা দাবি পূরণ হলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যাবে। শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোও নির্বাচনের রায় মেনে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। সেদিনের সংবাদের সূচনা অংশটুকু:
সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঘোষণা করেছেন তার চার দফা দাবি পূরণ হলে সংসদে যাবেন। অপরাহ্নে রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব তার চার দফা পেশ করেন:
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে সরিয়ে নিতে হবে।
৩. সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে।
৪. নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
আওয়ামী লীগ নেতা বাংলাদেশের সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছেন এবং বাঙালিদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার খাজনা ও কর দেওয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল।
শেখ মুজিব ঘোষণা করেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না। জনগণের দাবি আদায় করতে চান। করাচির ডন পত্রিকায় চার দফা নিয়ে পাকিস্তানি নেতাদের যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়, তা আংশিক অনূদিত হলো:
পশ্চিম পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেতা এবং নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আকবর বুগতি শেখ মুজিবুর রহমানের পেশ করা চার দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য অবিলম্বে এই দাবিগুলো পূরণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গত রাতে জারি করা এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকদের একজন এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে বিশ্বাসী।
তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে তার জানাশোনা। তিনি জানেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানের সংহতি অখণ্ডতার প্রশ্নে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। জনগণের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক সংগ্রামে তার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে যারা অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য করছেন, তারা তার বিপুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত এবং তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা নস্যাৎ হওয়ায় তারা বিরক্ত।
শেখ মুজিবুর রহমানের অভিযোগ, বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। কারণ, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি বলেন, 'বর্তমান অবস্থায় একমাত্র তিনিই পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে পারেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আমিও জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই।'
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান আজ প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া খানকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি যেন অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান সফর করে বিবাদমান জাতীয় সমস্যাগুলো শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য দেশপ্রেমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিষ্পতি করেন।
নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই ক্ষমতার উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একজন রাজনীতিবিদ (জুলফিকার আলী ভুট্টো) তার দলের গুরুত্ব কতটা, তা প্রকাশ করতে গিয়ে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকেও একটি রাজনৈতিক শক্তি আখ্যা দিতে দ্বিধা করেনি। একই নেতা দেশের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করে একটি ধারণা দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যে তিনি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন।
'সুন্দরবন' ও 'পদ্মা'য় বাঙালি নিধনের সামরিক সরঞ্জাম যাচ্ছে
কাকতালীয় হলেও রসিকতাটি নির্মম। বাঙালি নিধন করতে এবং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাৎ করতে ১৯৭১ সালের মে এবং জুন মাসে যে দুটো সমুদ্রগামী পাকিস্তানি কার্গোতে সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করা হয়, তার একটির নাম 'সুন্দরবন', অন্যটি 'পদ্মা'।
গণমাধ্যমের সন্ধানী চোখ এড়িয়ে সুন্দরবন বন্দর ছেড়ে চলে যাবার প্রায় চল্লিশ দিন পর পদ্মা বোঝাই হয়। পদ্মার করাচি যাত্রায় গণমাধ্যম তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, ডেমোক্র্যাট নেতারা নিক্সন প্রশাসনের উপর ক্ষিপ্ত হন, ফিলাডেলফিয়ায় এই কার্গোর গতিরোধ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ৬ আমেরিকান তরুণ।
নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ইভনিং বুলেটিন ফিলাডেলফিয়া এবং ওয়াশিংটন স্টার-এ প্রকাশিত সংবাদ:
ওয়াশিংটন ২১ জুন: সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণে দাপ্তরিক নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও দৃশ্যত এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে নিউইয়র্ক থেকে করাচিতে প্রেরণের লক্ষ্যে আজ একটি মালবাহী সামুদ্রিক জাহাজে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত। এ বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিশ্চিত করেছেন অন্তত আরও একটি জাহাজ 'বিদেশি সামরিক বিক্রয়' চিহ্নিত দ্রব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাত্রা করতে যাচ্ছে।
তারা ইঙ্গিত করেছেন, এই দ্রব্যগুলো এসেছে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা দপ্তরের বাড়তি দ্রব্যের গুদাম থেকে। পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণের উপর তিন মাসের জন্য আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সৃষ্ট অস্পষ্টতার মধ্যেই শেষ পর্যন্ত এগুলো জাহাজীকরণ করে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কর্মকর্তা বললেন, এর মধ্যে স্পষ্টতই কিছু লুকোচুরি রয়েই গেছে।
নিউইয়র্ক থেকে পাকিস্তানে নিবন্ধিত 'পদ্মা' নামের যে জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং মধ্য আগস্টে যার করাচি পৌঁছার কথা, তাতে উড়োজাহাজের ৮টি প্যারাশ্যুট এবং অন্যান্য মালামালের মধ্যে উড়োজাহাজ ও সামরিক গাড়িতে ব্যবহার্য লাখ পাউন্ড ওজনের খুচরা যন্ত্রাংশ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
পাকিস্তানে নিবন্ধিত আরও একটি জাহাজ সুন্দরবন গত ৮ মে সামরিক যন্ত্রাংশ নিয়ে পাকিস্তান রওনা হয়ে গেছে। জাহাজের দ্রব্যের ম্যানিফেস্টো এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের রপ্তানি লাইসেন্স জাহাজের রয়েছে। ম্যানিফেস্টো অনুযায়ী এতে রয়েছে সামরিক যন্ত্রাংশ এবং সামরিক যানের স্পেয়ার পার্টস।
যুক্তরাষ্ট্রের 'ফরেন মিলিটারি সেলস অ্যাক্ট' অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র এয়ারফোর্স এগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করেছে। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য-অধ্যুষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বশাসনের আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেবার হুকুম দেবার পর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা করেছিল যে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি স্থগিত করা হয়েছে এবং ১৯৬৭ সালে চালু করা এই কর্মসূচিটি 'পর্যালোচনাধীন' রয়েছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের পদ্মা ও সুন্দরবন নামক জাহাজের সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করে নিউইয়র্ক ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা জানিয়েছেন এটা সঠিক যে পাকিস্তানে সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির উপর প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে।
কর্মকর্তারা বলেন, মার্চের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে তা নস্যাৎ করতে মারাত্মক নিপীড়ন শুরু করা হলে অল্পকাল পরে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্ট অনুমান করছে এই লড়াইয়ে কমপক্ষে ২ লাখ পূর্ব পাকিস্তানি নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৬০ লাখ শরণার্থী ভারতে পালিয়ে গেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ২৫ মার্চের পর সামরিক সরঞ্জামভর্তি জাহাজ পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে—এমন বিষয় তারা অবহিত। তারা শিকার করেছেন, এ ধরনের মালামাল জাহাজীকরণ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতির বরখেলাপ।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে যে 'ফরেন সেলস প্রোগ্রাম'-এর আওতায় কোনো ধরনের সামরিক সরঞ্জাম ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সরকার কিংবা তাদের কোনো প্রতিনিধিকে সরবরাহ করা হয়নি।
আজ (২১ জুন ১৯৭১) স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের বক্তব্য নিশ্চিত ও পুনরাবৃত্তি করেছে। ২৩ এপ্রিল এবং ২১ মে যথাক্রমে সুন্দরবন ও পদ্মা কার্গো জাহাজের যে 'বিল অব ল্যান্ডিং' পাকিস্তান দূতাবাসে দাখিল করা হয়েছে, পেন্টাগনের বক্তব্যের সাথে তা মেলাতে পারলেন না।
প্রকৃতপক্ষে জাহাজীকরণের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান দূতাবাসে সামরিক ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা লেফেটন্যান্ট কর্নেল এম আমরান রাজাকে দুটি জাহাজের মালামাল গ্রহণের ডক রিসিট ২১ মে পাঠিয়েছেন। প্রতিরক্ষা দপ্তরকে গত শনিবার (১৯ জুন) এবং আজও জাহাজে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তারা স্টেট ডিপার্টমেন্টকে এই জবাবই দেন। নিষেধাজ্ঞার পরও কেমন করে জাহাজ ছেড়ে গেল, এ প্রশ্নে কর্মকর্তাদের দিশেহারা মনে হয়েছে। তবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট সূত্র প্রতিরক্ষা দপ্তরকে উদ্ধৃত করে বলছে দ্বিতীয় জাহাজে পাঠানো সরঞ্জাম দাপ্তরিক নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ক্রয় করা। কিন্তু তা কেন ২৫ মার্চের পর সরবরাহ করা হচ্ছে এবং ডক এলাকায় ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে তারা কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
কিছু সামরিক সামগ্রী স্টেট ডিপার্টমেন্টের লাইসেন্সে সামুদ্রিক জাহাজে করে কেন পাকিস্তান পাঠানো হচ্ছে আইডাহোর ডেমোক্রেটিক দলীয় সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ ১৭ মে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যে চিঠি পাঠিয়েছেন, এখনো তারা জবাব দেননি। সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির ফ্রাঙ্ক চার্চ পররাষ্ট্রসচিব রোজার্সকে জানিয়েছেন, তার দপ্তরের জারি করা ১৯২৪২ নম্বর লাইসেন্সে এই সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে।
সুন্দরবন জাহাজের জন্য জারি করা এই লাইসেন্স নম্বরটি পাওয়া গেছে কার্গোতে সরবরাহ করা মালের চালানে, সেখানে কেবল বলা হয়েছে, '২৩ স্কিড, পার্টস'; ওজন ১১৮৯৫ পাউন্ড। চালানে এর বেশি কিছু লিখা ছিল না। সুন্দরবন কার্গোর জন্য প্রেরিত অপর একটি চালানে লেখা হয়েছে—'সামরিক যানবাহনের' অংশ ও খুচরা যন্ত্র; ডকসাইডে চালানের তালিকায় বাক্স এবং কার্টনের মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে—'গাড়ির পার্টস ও খুচরা যন্ত্র' 'স্কিড ও পার্টস' 'বাক্স' এবং 'পার্টস'।
উড়োজাহাজ ও প্যারাশ্যুট
কার্গো জাহাজ পদ্মার জন্য ডকসাইডে যে চালান পাঠানো হয়েছে, তাতে দুটো ফর্দ, তাতে লেখা 'ফোর এয়ারক্রাফট' ১১৩ প্যারাশ্যুট ও পার্টস, অটো পার্টস, খুচরা যন্ত্রাংশ, স্কিডস এবং কাঠের বাক্স। একটিকে বর্ণনা করা হয়েছে—'ক্রাটস, বান্ডেলস অ্যান্ড পার্টস'; ওজন ১৪১৩৩ পাউন্ড।
পাকিস্তানের সাথে সামরিক সামগ্রী বিক্রয়ের কর্মসূচি ১৯৬৭ সালে শুরু হয়; স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা ও মুখপাত্র রবার্ট জে মেকলস্কির মতে, পাকিস্তান প্রতিবছর আনুমানিক ১০ মিলিয়ন ডলারের ক্রয় করে থাকে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহার করে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছে মারণাস্ত্র ভিন্ন অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয়ের সম্মতি হয়। ১৯৭০-এর অক্টোবরে 'ব্যতিক্রম হিসেবে' পাকিস্তানের কাছে অনুল্লিখিতসংখ্যক এফ ১০৪ ফাইটার প্লেন, বি-৫৭ বোমারু বিমান এবং সশস্ত্র সেনাযান বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট আজ জানিয়েছে, ব্যতিক্রম হিসেবে বর্ণিত কোনো কিছু এখন পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়নি। কিন্তু পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানানো কর্তৃত্বসম্পন্ন একজন সোর্স জানিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০-এর এপ্রিল পর্যন্ত ৪৭,৯৪৪,৭৮১ ডলারের সামগ্রী কেবল এয়ারফোর্স থেকে পাকিস্তানের কাছে বিক্রয় করা হয়েছে।
২৮ মে ডেনভারে অবস্থিত এয়ারফোর্স অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফিনান্স সেন্টার থেকে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিরক্ষা ক্রয় বিভাগে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে—এতদসঙ্গে গ্রথিত হলো একটি স্ট্যাটার্স রিপোর্ট, আপনাদের কাছে 'ফরেন মিলিটারি সেলস'-এ বিবরণী, মূল্যমান, প্রাপ্ত অর্থ, সরবরাহকৃত কিংবা সরবরাহ হয়নি—এমন তালিকা। চিঠিটি সই করেছেন এলেইন বি লাভেনথাল, চিফ অব মিলিটারি সেলস ব্রাঞ্চ, কম্পট্রোলার, ডেনাভার সদর দপ্তর—যার শিরোনামে রয়েছে 'ইউএসএএফ বিবরণী—সামরিক বিক্রয় তালিকা, বিস্তারিত চালান তালিকা'।
স্ট্যাটাস রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পূর্ববর্তী সামরিক ক্রয় ২৫,৬৭৯,৬৫৪.১০ ডলার, চালান দেওয়া হয়নি এমন দ্রব্যের মূল্য ২১,৭৩০,১৪০.০৭ ডলার এবং এ পর্যন্ত নগদ প্রাপ্তি ২৪,৩৪২,৭৮২.৩৭ ডলার। এই প্রতিবেদনে প্রকৃতপক্ষে কোন সময়কালের কথা বলা হয়েছে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তা তা নিশ্চিত করতে পারেননি।
পদ্মা ও সুন্দরবন জাহাজের নিউইয়র্কের এজেন্ট ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সি ইঙ্গিত দিয়েছে এর মধ্যেই পদ্মা বেশ কবার সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে নামিয়ে দিয়ে এসেছে, সর্বশেষ চালান নিয়ে পৌঁছেছে ২২ মার্চ। পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান চালানোর তিন দিন আগে।
২৫ মার্চের নিষেধাজ্ঞার পর এই প্রথম সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে করাচি যাবার প্রস্তুতি নিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সুন্দরবনের জন্যও এটি প্রথম যাত্রা। কিন্তু নির্ভরযোগ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে অন্যান্য জাহাজ সম্ভবত ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট কোস্ট থেকে পাকিস্তানে সামরিক চালান নিয়ে গিয়েছে।
জেল খেটেছেন ছয় মার্কিনি
দ্য ইভনিং বুলেটিন ফিলাডেলফিয়া: বাল্টিমোর: পাকিস্তানের কার্গো জাহাজে অস্ত্র বোঝাই ঠেকাতে নৌকায় (ক্যানু ও কায়াক) জাহাজ আটকাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ছয়জন ফিলাডেলফিয়ান। এক রাত জেলে রেখে সতর্ক করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের দলনেতা চার্লস খান বলেছেন, তিনি এবং তার অনুসারীরা কার্গো জাহাজ পদ্মা ফিলাডেলফিয়ায় পৌঁছালে মালামাল ওঠাতে আবার বাধা দেবেন।
১৪ জুলাই, ১৯৭১ চার্লস খানের সঙ্গে আর যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা হচ্ছেন সেজইউক স্ট্রিটের রিচার্ড টেইলর, পাইন স্ট্রিটের স্যালি উইলবি ও স্টেফানি হলিম্যান, উইলোজ এভিনিউর চার্লস গুডউইন এবং মেডিয়ার ওয়েইন লাউসার।
ওয়াশিংটন স্টারের সংবাদ
বাল্টিমোর (অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস) পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ পদ্মাকে ডকে পণ্য ওঠাতে বাধা দিতে আজও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। অভিযোগ রয়েছে, এই পাকিস্তানি জাহাজ যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশে অস্ত্র ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ গত রাতে ছয়জন বিক্ষোভকারীকে জাহাজ ডকে আসতে বাধা দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছে ছিল তিনটি ক্যানু ও একটি কায়াক। একজন কর্মকর্তা জানান, জাহাজের অবাধ চলাচলে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের নিজেদের নিরাপত্তা বিবেচনা করেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিতর্ক চলছে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মায় বোঝাইয়ের জন্য যেসব মালামাল মজুত রয়েছে, তা তোলা হবে কি না। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক লং শোরম্যান অ্যাসোসিয়েশন তাদের বাল্টিমোর শাখাকে নির্দেশ দিয়েছে, যেন জাহাজে মাল তোলা না হয়। কারণ, প্রতিবাদকারীরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এই জাহাজে করে পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছে।
স্পিডবোটে ছয় তরুণ অস্ত্রবোঝাই পাকিস্তানি জাহাজের গতি রোধ করার চেষ্টা করছেন
ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল নামের ফিলাডেলফিয়াভিত্তিক একটি সংস্থার ৩০ জন সদস্য তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। জাহাজ আটকানোর অপরাধে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়েছেন। দ্য ইভনিং বুলেটিন ফিলাডেলফিয়া জানিয়েছে, ক্যানু ও ক্যায়াকযোগে পানিতে নেমে জাহাজ আটকানোর চেষ্টা করার অপরাধে গ্রেপ্তার ছয়জন কারামুক্তি লাভ করেছেন। দলনেতা চার্লস খান বলেছেন, অস্ত্রবাহী জাহাজটিকে তারা পুনরায় ফিলাডেলফিয়ায় আটকাতে চেষ্টা করবেন।
নিউইয়র্ক বন্দর থেকে ছেড়ে আসা এই জাহাজের গন্তব্য পাকিস্তানের করাচি বন্দর—কয়েক সপ্তাহ ধরে এই জাহাজ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। অভিযোগ উঠেছে, এই জাহাজে পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হচ্ছে, সিনেটে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। একজন সিনেটর এই মালবাহী জাহাজের মালামাল প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
১৬ জুলাই, ১৯৭১ বাল্টিমোর সান জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিপূর্বে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তবে পুরোনো ক্রয়ের অংশবিশেষ পাঠানো না হয়ে থাকলে তা জাহাজে উত্তোলন করা যাবে। সিনেটে খোলামেলাভাবেই বলা হয়েছে, পাকিস্তান মার্কিনি অস্ত্রের প্রয়োগ করছে নিজ দেশের মানুষের ওপর, পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তানে সরকার বাহ্যত বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটি বিদ্রোহ ধামাচাপা দিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা লড়াই চলছেই।