সাফল্যের সৌরভ: ইন্টেরিয়র ডিজাইনার থেকে নাসরিনের পারফিউম উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
স্বামী সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহম্মদ জামিরের সাথে ফ্রান্সে থাকাকালীন নাসরিন পারফিউমের প্রতি আকৃষ্ট হন।
ফুলের সুগন্ধ, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাদা ফুল যেমন দোলনচাঁপা, বেলি, গার্ডেনিয়া, রজনিগন্ধা ও জুঁইয়ের সুগন্ধ তার বিশেষ পছন্দ।
পেশায় একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হলেও পারফিউমের প্রতি আবেগ নাসরিনকে ফুলগুলি ব্যবহার করে পারফিউম তৈরির উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করে।
তবে সুগন্ধি তৈরির দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ ও গবেষণার পর নিজ দেশে ফিরে নাসরিন হতাশ হয়ে পড়েন। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের মধ্যে একটি উচ্চমানের ল্যাব ও কারখানা খুঁজে পেতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
সেক্ষেত্রে নাসরিন পারফিউম তৈরির স্বপ্নপূরণে মালয়েশিয়া যেতে বাধ্য হন। তিনি দেশটির একটি কারখানায় পাঁচটি স্বতন্ত্র পারফিউম তৈরিতে সাফল্য পান। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশের বাজারে 'জোনাকি' নামে একটি সুগন্ধি ব্র্যান্ড চালু করেন; যা বাংলাদেশি ফুলের ফ্লেভারের সমন্বয়ে তৈরি পারফিউম বিক্রি করে।
নাসরিন নিজেকে বাংলাদেশে পারফিউম নিয়ে কাজ করা একমাত্র ব্যক্তি বলে দাবি করেন। তিনি একটি অনন্য বাংলাদেশি ফ্লেভার তৈরি করতে পেরেছেন। যদিও বর্তমানে অনেক ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশ থেকে পারফিউম আমদানি করছেন। বিপরীতে নাসরিন তার নিজস্ব অনন্য ব্র্যান্ড তৈরিতে বিনিয়োগ করেছেন।
নাসরিন জামির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "আমি যখন আমার প্রফেশন ছেড়ে পারফিউম নিয়ে কাজ করার চিন্তা করি তখন মাত্র ৩ হাজার ডলার ইনভেস্ট করি। এখন আমার ব্যবসার পরিধি অনেক বেড়েছে। আমি আমার প্রোডাক্ট মালয়েশিয়া থেকে তৈরি করে আনি। যা আমি সরাসরি তদারকি করি। বাংলাদেশে ১৪ জন কর্মচারী আমার অধীনে কাজ করে। আমার কোম্পানির আমিই একমাত্র মালিক।"
নাসরিন আরও বলেন, "আমি স্বপ্ন দেখি জোনাকি একটি ইউনিক বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হবে। বাংলাদেশে পারফিউমের মার্কেট অনেক বড়। তাই যদি সঠিক কোনো ইনভেস্টর পাই তাহলে আমার ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করবো।"
পারফিউম ছাড়াও জোনাকি নারীদের জন্য বিউটি প্রোডাক্ট চালু করেছে। উপরন্তু তারা নিজেদের সংগ্রহে ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় এবং দেয়ালে ঝুলানো নকশা অন্তর্ভুক্ত করেছে; যার মূলে রয়েছে বাঙালি ঐতিহ্য।
জোনাকির বিশ্বমানের পারফিউমগুলো ঢালি, ইউনিমার্ট, পারফিউম বাংলাদেশ ও আলমাসের মতো বেশ কয়েকটি স্টোরে পাওয়া যাচ্ছে। এটি ব্র্যান্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও পাওয়া যায়।
সম্প্রতি পণ্যগুলির প্রতি বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জোনাকি রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিজেদের প্রথম ফ্ল্যাগশিপ স্টোর উদ্বোধন করেছে।
জোনাকি পারফিউমের সুবাস এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়িতেও জায়গা করে নিচ্ছে।
নাসরিন জামির বলেন, একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কীভাবে তার দেশের সুগন্ধি তৈরিতে আগ্রহ তৈরি করেছেন সে সম্পর্কে তাকে প্রায়শই প্রশ্ন করা হয়।
নাসরিন বলেন, "২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিজের অফিসে বসে এক ফরাসি বন্ধুর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে আসে পারফিউম তৈরির বিষয়টি। কারণ, বন্ধুটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আমি আর কী করতে চাই?' আমার উত্তর ছিল, পারফিউম বাজারে আনতে চাই।"
নাসরিন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি ঐ বছরের ডিসেম্বরের মাঝেই প্রস্তুতি শুরু করে দেন। সেক্ষেত্রে টানা দুই বছর তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সুগন্ধিসংক্রান্ত গবেষণা ও পারফিউমের সৌরভ নির্ধারণ, আধার ও মোড়ক নকশায়।
নাসরিন জামির বলেন, "আমি চাই বিদেশি ডেলিগেট যারা বাংলাদেশে আসে তাদের হাতে বাংলাদেশি একটি পণ্য ধরিয়ে দিতে। সুগন্ধি মানুষের মনে প্রেম তৈরি করে, মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিচয়ও বহন করে। এজন্যই গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচতারকা হোটেলে ছোট পরিসরে হলেও একটি ফ্ল্যাগশিপ স্টোর দিয়েছি।"
তিনি বলেন, "পারফিউমের স্থায়িত্ব টেস্ট করতে প্রায় ৬ মাস লেগেছে। আমরা কোনো কালার মিক্স করি না। ডেডিকেটেডলি ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্টল ব্যতীত ঢাকায় আমাদের আটটি বিখ্যাত মার্কেটে প্রোডাক্ট ডিসপ্লে করা আছে।"
সম্প্রতি ভূটানের রাজা, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসা বিভিন্ন দেশের কর্তাব্যক্তিরা জোনাকির এই পারফিউমের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ও সংগ্রহ করেছেন বলেও দাবি করেন নাসরিন।
জোনাকির মূল লক্ষ্য বিদেশি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ হলেও দেশীয় গ্রাহকদের জন্যও অনলাইনে পারফিউম বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাজারে জোনাকির পাঁচ ধরনের পারফিউম রয়েছে। নারীদের জন্য নেরোলি ব্লসম, ফ্রিসিয়া নাইটস ও ওরিয়েন্টাল জেসমিন। আর পুরুষদের জন্য আমারেত্তো ও সানতাল তাবাক। 'জয় অফ লাইট' ট্যাগলাইনে এই পাঁচটি পারফিউমের বাহার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল।
এখনও পর্যন্ত জোনাকির রয়েছে লং লাস্টিং সাটিন ম্যাটের সাতটি শেড এবং সেমি-গ্লস লিপস্টিকের ছয়টি শেড৷
নাসরীন বলেন, "এই লিপস্টিক সব বয়সের জন্যই মানানসই, ট্রেন্ডি ও যেকোনো ত্বকের টোনের জন্য উপযুক্ত। কমপ্যাক্ট পাউডারের রয়েছে তিনটি শেড: লাইট, ওয়ার্ম বেইজ ও গোল্ডেন হানি।"
জোনাকির নিজেদের সংগ্রহে আতরও যোগ করেছে। এক্ষেত্রে এই আতর সম্পূর্ণ হালাল। কেননা হাজার বছরের পুরানো এই সুগন্ধি কোনো অ্যালকোহল ছাড়াই তৈরি করা হয়।
ইন্টারকন্টিনেন্টালে জোনাকির শপে রয়েছে নাসরিনের ডিজাইন করা ফাইন কটন, মসলিনের স্কার্ফ ও কাঠের তৈরি ওয়াল হ্যান্সিং। সাথে মুক্তার মালাও আছে।
নাসরিন জোনাকিকে বিশ্বমানের পারফিউম ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী।
তিনি বলেন, "আমি আশা করি বাংলাদেশেও একদিন উন্নতমানের পারফিউম বানানোর মতো ল্যাব তৈরি হবে। তখন আর বাইরে যেতে হবে না। ডিজাইন থেকে প্যাকেজিং সব আমাদের দেশেই হবে।"