ঢাকা ক্লাবের সদস্যরা যেদিন পাঞ্জাবি-পায়জামা পরার অনুমতি পেতে আদালতের দ্বারস্থ হন
ঢাকা ক্লাব লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাব্বির আহমেদ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেন, "ম্যাম, আমরা আপনাকে কোনো তথ্য দিতে পারছি না। কারণ আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।"
এমনকি ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট আশরাফুজ্জামান খানও আমাকে একই কথা বলেন যখন আমি ৩৫ বছরেরও বেশি সময় আগে ঢাকা ক্লাবে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার তথ্য চেয়েছিলাম।
আমি ভেবেছিলাম দেশের প্রাচীনতম ব্রিটিশ-অরিজিন ক্লাবগুলির মধ্যে অন্যতম ঢাকা ক্লাবে ১৯৮৭ সালে হওয়া এক প্রতিবাদ সম্পর্কে কিছু তথ্য অন্তত পাওয়া যাবে।
এক্ষেত্রে ১৪-দিনের ডেডলাইন মাথায় নিয়ে আমি অভিজাত ক্লাবের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য-অনুসন্ধান করতে থাকি। যাতে করে সেই সময়ের স্মৃতি থেকে তথ্য জোগাড় করতে পারি।
আমি সেই সুবাদে সাব্বির আহমেদ ও আশরাফুজ্জামান খানের সাথে দেখা করেছি। তাদের সম্পর্কে পরবর্তীতে ফের আলোকপাত করবো।
১৯৮৭ বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু বড় ঘটনা ঘটে। সেই বছর মোহাম্মদ তোয়াহা, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও সঙ্গীতশিল্পী হ্যাপি আখন্দের মতো ব্যক্তিত্বরা মারা যান। আর জাতীয় ক্রিকেট দলের দুই তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম জন্মগ্রহণ করেন।
বছরটিতে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে চলছিল বিক্ষোভ। পুরো দেশে তখন টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। একই বছরের ১০ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত হন আন্দোলনকারী নূর হোসেন।
দেশ ১৯৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল; যা জুলাই-আগস্ট জুড়ে বহাল ছিল। এতে দেশের প্রায় ৫৭,৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ঠিক ঐ সময়টাতেই রমনায় রাজধানীর অভিজাত ঢাকা ক্লাবের অভ্যন্তরে একটা ছোটোখাটো বিপ্লব ঘটেছিল।
ওয়াকার এ খান তার 'ঢাকা ক্লাব ক্রনিকলস' বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯১১ সালের আগস্টে পূর্ব বাংলা ও আসামের তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ল্যানসেট হেয়ার বর্তমান রমনার জমিতে ঢাকা ক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এটি সম্ভবত ঢাকার নবাবের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছিল।
আমি বইটির লেখকের সাথে ক্লাব এবং ঐ বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তখন তিনি বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ সময়ের ব্রিটিশ ক্লাব সংস্কৃতির উপর খুব বেশি কিছু লেখা হয়নি। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে এমনটা হয়েছিল। কিন্তু আপনি যদি কলকাতায় যান তবে আপনি অনেক কাগজপত্র ও বই খুঁজে পেতে পারেন।" অর্থাৎ ঘটনাটি সম্পর্কে আমাকে নিজ থেকেই তথ্যগুলো জানতে হবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ১৯৮৭ সালে একদিন ৩৫ বছর বা কিংবা তার বেশি বয়সী একদল যুবক পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে ঢাকা ক্লাবে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে তা তৎকালীন সদস্যদের জন্য ক্লাবের ড্রেস কোডের স্পষ্ট লঙ্ঘন ছিল।
তাই ড্রেসকোড অনুযায়ী তাদের ক্লাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি পরবর্তীতে বিচারিক আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে ক্লাবে নোটিশ পাঠানো হয় এবং অবশেষে ক্লাব পুরুষ সদস্যদের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতে দেয়।
এই প্রতিবাদের সাথে কতজন জড়িত ছিল সেই সংখ্যা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন জানা যায়। সেক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট সদস্যদের একজন শওকত ওসমানের মতে, ঐ বছর প্রায় ৩০ জন এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। তিনি, তারেক আহসান এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এই প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন।
শওকত ওসমান একজন বাংলাদেশী লেখক। তিনি খাবার, রান্না ও খাবার সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেছেন।
তবে মোহাম্মদ হাবিবুল আলম (বীরপ্রতীক) মনে করেন, এই প্রতিবাদে সংশ্লিষ্ট লোকেদের সংখ্যা আট-নয়-এর বেশি ছিল না। প্রয়াত আলী যাকের, কাজী শাহবুদ্দিন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এই প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন মনে করেন, উদ্যোগটির সাথে ১৫ জন জড়িত ছিল। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথমে সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে ক্লাবের ভেতরে গিয়েছিলেন।
সেক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ সংখ্যাটাই নেওয়া যাক; অর্থাৎ ১০ থেকে ১২ জন। যাদের মধ্যে রয়েছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, মোহাম্মদ হাবিবুল আলম, শওকত ওসমানসহ বেশ কয়েকজন।
এছাড়াও আরও রয়েছে আলী যাকের (অভিনেতা, ব্যবসায়ী, পরিচালক ও লেখক; যিনি ২০২০ সালে মারা গেছেন), কাজী শাহাবুদ্দিন শাহজাহান বেবী (ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; ২০১৯ সালে মারা গেছেন), শাহুদুল হক, ফতেহ আলী চৌধুরী (ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, কনসোলিডেটেড সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক), কাজী শাহাজাহান, তারেক আহসান প্রমুখ।
অবশ্য আমি যাদের সাথে কথা বলেছি তাদের কেউই আমাকে প্রতিবাদটি সম্পর্কে সঠিক তারিখ, সময়, এমনকি বছরও বলতে পারেনি। নাসির উদ্দীন আমাকে একমাত্র তথ্য দিতে পেরেছিলেন যে, ঘটনাটি যখন ঘটেছিল তখন শামসুর রহমান ছিলেন ক্লাবের সভাপতি এবং মেজর (অব.) এবিএম রহমতুল্লাহ ছিলেন সম্পাদক।
এই সূত্র ধরেই সাব্বির আহমেদ আমাকে তথ্য পেতে সাহায্য করেছেন। ক্লাবের ১৯৮৭-৮৮ এর বইতে, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ থেকে ড্রেস কোড নিয়ে কিছু আলোচনা পাওয়া যায়।
দিনটি ছিল বুধবার। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানকার আলোচনায় ক্লাব সদস্যদের জন্য ড্রেস কোড চূড়ান্তকরণ শিরোনামের একটি সেকশন রয়েছে। তথ্যের এই অংশটি একটি বিষয় অবশ্য নিশ্চিত করেছে যে, প্রতিবাদটি আগস্টের দ্বিতীয়ার্ধে হয়েছিল।
নাসিরুদ্দিন বলেন, "আমার মাস বা তারিখ মনে নেই। তবে আবহাওয়া আর্দ্র ও গরম ছিল। পায়জামা-পাঞ্জাবির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তটি প্রতিবাদের দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ক্লাব থেকে এসেছিল"।
সেক্ষেত্রে ব্রিটিশদের নির্মিত এই অভিজাত ক্লাবটিতে কখন, কোথায় এবং কারা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরার প্রতিবাদ করেছিল সে সম্পর্কে কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গিয়েছে। আসুন, এবার আমাদের গল্প শুরু করা যাক।
'পাজামা-পাঞ্জাবি পরার কারণে সেক্রেটারি আমাকে বাধা দিয়েছিলেন'
আগস্টের এক আর্দ্র বিকেলে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক ৩৭ বছর বয়সী নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে রমনার ঢাকা ক্লাবে যান। তার পরনে ছিল সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি।
তিনি কম্পাউন্ডের ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে ক্লাবের সেক্রেটারি মেজর রহমতুল্লাহ (অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবুল বাশার রহমতুল্লাহ, প্রয়াত গায়িকা শাহনাজ রহমাতুল্লাহর স্বামী) তাকে থামান।
তিনি নাসিরকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কী পরেছ?" চমকে উঠল নাসির; আসলে বুঝতেই পারছিল না কী হচ্ছে।
তখন রহমতুল্লাহ বলেন, "আপনি যা পরেছেন তা ক্লাবের ড্রেস কোডের সাথে যায় না।"
নাসির উদ্দীনের কাছে বিষয়টি বেশ অদ্ভুত লাগলো। কেননা তিনি তো শুধু পায়জামা, পাঞ্জাবি পড়েছেন, যেটা বাঙ্গালির কাছে বেশ ঐতিহ্যবাহী পোশাক। একইসাথে দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কৃতির অংশ। এখানে সমস্যার কী আছে? তাই তিনি বলেন, "আপনি আমাকে এই পোশাক পরতে বাধা দিতে পারেন না।"
কর্তৃপক্ষের অংশ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত ঐ মেজর তখন বলেন, "আপনি এতদিন ধরে এই ক্লাবের সদস্য। আপনার তো ড্রেস কোড জানা উচিত। আপনাকে সেটি অনুসরণ করতে হবে।"
অনেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ৬৪ বছর বয়সী নাসির উদ্দীন ফোনে আমাকে কথাগুলো জানাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, "আমি এই পোশাক পরে আরাম অনুভব করি। আমি বন্ধুদের সাথে কিছু সময় কাটাতে ও বিশ্রাম নিতে ক্লাবে গিয়েছিলাম। আমার কি ফর্মাল পোশাকে আরাম করার কথা ছিল? আমি বিষয়টি বুঝতে পারিনি।"
নাসির উদ্দীনের মতে, এটা আচমকা ঘটেছিল। তার ক্লাবের রুলস ভঙ্গ করা কিংবা প্রতিবাদ করার কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল না।
ক্লাব এ্যাসোসিয়েশনের মেমোরেন্ডাম ও আর্টিকেল অনুযায়ী, ক্লাবের পুরুষ সদস্যদের ক্লাব প্রাঙ্গণে বিশেষ কিছু পোশাক পরিধান থেকে বিরত থাকতে হবে।
তালিকায় রয়েছে পাকিস্তানি সালোয়ার কুর্তা, গোল গলার টি-শার্ট (এমনকি জ্যাকেট পরা অবস্থায়ও), পুরো বা হাফ হাতা শার্টসহ পায়জামা, ধুতি, লুঙ্গি, হাতা বা কলারবিহীন শার্ট, ফতুয়া, হাফ প্যান্ট/শর্টস, পাঞ্জাবি/ট্রাউজারসহ কুর্তা, ফ্যাব্রিকের জুতা, স্নিকার্স (সন্ধ্যা ৬ টার পরে), স্ট্র্যাপলেস রাবারের স্যান্ডেল, মোজা ছাড়া জুতা, বেসবল ক্যাপ ও কানের দুল।
শওকত ওসমান জানান, কেউ যদি এই নিয়ম লঙ্ঘন করেন তবে তাকে ক্লাবে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এমনকি তাকে 'ক্লাবের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে বরখাস্ত করা যেতে পারে।
সেদিন রাতে নাসির উদ্দীন তার ছোটবেলার বন্ধু কাজী শাহাবুদ্দিন শাহজাহান বেবির সঙ্গে ঘটনাটি শেয়ার করেন। "আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তারা পরের দিন আমার সাথে ক্লাবে যাবে কি-না।"
এরপর তিনি অন্যান্য বন্ধু ও সঙ্গী যেমন শাহুদুল হক, বখতিয়ার, মোহাম্মদ হাবিবুল আলম, ফতেহ আলী চৌধুরী, আলী যাকের, শওকত ওসমান এবং অন্যান্যদের পরের দিন তার সাথে ক্লাবে যেতে বলেন।
নাসির উদ্দীন বলেন, "দুই দিন পর আমরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ১৫ সদস্যের একটি গ্রুপ ক্লাব প্রাঙ্গণে প্রবেশ করি। সেক্ষেত্রে যথারীতি যেমন তারা আমাদের থামিয়ে দিয়েছিল।" কথাগুলো বিস্তারিত বলার সময় আমি তার কণ্ঠে বেশ উত্তেজনা আন্দাজ করছিলাম।
সেদিন সন্ধ্যায় প্রতিবাদকারীরা ক্লাব প্রশাসনের কাছ থেকে একটি চিঠি পায়। যেখানে তাদের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য তাদের ক্লাবের ইসি কমিটির সামনে উপস্থিত হতে বলা হয়।
স্যামসন নামে পরিচিত শামসুর রহমান তখন ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। নাসির উদ্দীন বলেন, "তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় সিএসপি (পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস অফিসার)। যিনি ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানে বসে বাংলায় স্বাক্ষর করেছিলেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসাবে, তাকে ক্লাবের সংবিধান অনুসরণ করতে হয়েছিল।"
ইসিতে আরও ছিলেন মাহবুব হোসেন খান, চৌধুরী দবির এ সিদ্দিকী, রাশেদুল আমীন, এটিএম হায়াতুজ্জামান, মোঃ শফিউল ইসলাম, কামাল আহমেদ, হায়দার আলী, সেলিম ভূঁইয়া ও তৌহিদ সামাদ।
নাসির উদ্দীন বলেন, "কয়েকদিন পর আমরা কমিটির সাথে দেখা করতে গেলে তারা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চায় এবং আমরা কী বলতে চাই তা শুনতে চায়। যেহেতু আলী যাকের এবং আমি এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, আমি প্রথমে কথা বলতে শুরু করি।"
পাঞ্জাবি ও পায়জামা বাঙালি পরিবারের প্রতিটি অনুষ্ঠান বা উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠান, হাতেখরি থেকে শুরু করে বিয়েতে পুরুষ সদস্যরা এই পোশাক পরেন। কেউ মারা গেলে শোক ও প্রার্থনার সময় আমরা এটি পরিধান করি।
তিনি ইসি কমিটিকে প্রশ্ন করেন, "আমাদের সমগ্র জীবন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই পোশাকটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। এটি আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য একটি খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। পোশাকটির সাথে অন্য কোন জটিল ধর্মীয় বা অর্থবোধক অর্থ নেই। এটি কেন আমাদের আমাদের জাতীয় পোশাক হতে পারবে না?"
এর জবাবে ইসি কমিটি জানায়, সংবিধানে বাংলাদেশের কোনো জাতীয় পোশাক নেই।
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, "আমরা বলেছি, সংবিধানে এ ধরনের কিছু উল্লেখ না থাকলেও প্রচলিত পোশাক সবার জন্য মেনে নিচ্ছেন না কেন?"
যদিও এই কথোপকথন কোনও সমাধানের দিকে পরিচালিত করেনি। বরং বাচ্চু, ফতেহ আলী ও হাবিবুল আলমসহ দলের সদস্যদেরকে ক্লাব থেকে তিন মাসের জন্য বহিস্কার করা হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার, আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি এবং ১৯৮৭-৯১ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক তানভীর মাজহার তান্না সেদিন ক্লাব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি সরাসরি এই প্রতিবাদের অংশ ছিলেন না। তবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরার জন্য ক্লাব থেকে তার বন্ধুদের সাসপেন্ড করা হয়েছে শুনে তিনি ক্লাব ভবনের ছাদের দিকে হাতের গ্লাসটি ছুড়ে ফেলে বলেন, "কে তোমাকে সাসপেন্ড করেছে?"
এটি কমিটিকেও জানানো হয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে তানভীর মাজহারকে ছয় মাসের জন্য ক্লাব থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। এটি অবশ্য সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাস্তি ছিল।
নাসির উদ্দীন বলেন, "এটা আমাদের জন্য বেশ অশান্ত সময় ছিল। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চরমে ছিল। আমি তখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তাই আমরা আমাদের আবেদন নিয়ে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি তখন পুরানা পল্টনে থাকতাম। একই এলাকায় ব্যারিস্টার রফিক উল হকের (যিনি ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন) চেম্বারে গিয়েছিলাম।
তখন ব্যারিস্টার রফিক তাকে বলেন, "এটা নিম্ন আদালতের মামলা। সেখানে আমি তো এখন হাজির হতে পারছি না। আমি আপনাকে অন্য একজন আইনজীবীর কাছে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আমরা আইনজীবীরা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করছি। তাই আমরা বর্তমানে আদালতে উপস্থিত হচ্ছি না।"
নাসির উদ্দীন বলেন, "আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম যে, তিনি যেন আমাকে একটি লিখিত নোটিশ দেন। তিনি আমাকে ছোটলু ভাইকে (আলি জাকের) তার কাছে নিয়ে যেতে বলেন; যিনি তখন বেইলি রোডে থাকতেন। আমি তাকে তার চেম্বারে নিয়ে যাই। সেখানে চেম্বারের ভেতর ছোটলু ভাই, আমি ও রফিক স্যারের সহকারী ছিলাম। আমরা সবাই নথিটি শুনেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে কী লেখা ছিল তা আমার ঠিক মনে নেই।"
ব্যারিস্টার রফিক দুজনকে পরদিন আদালতে হাজির হওয়ার পরামর্শ দেন। এতে তারা রাজি হয়ে পরদিন সদরঘাটের নিম্ন আদালতে যায়। তবে শওকত ওসমান ও হাবিবুল আলমের ভাষ্যমতে ওই দিন তারাও আদালতে যান।
যথারীতি বিচারক আদালতে প্রবেশ করেন এবং কার্যপ্রণালী শুরু হয়। বিচারক তাদের কথা বলতে বলেন। নাসির উঠে দাঁড়িয়ে 'মিলর্ড' বলে বক্তৃতা শুরু করেন। বিচারক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আদালত মুলতবি।
ঐ স্মৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাসির উদ্দীন বলেন, "আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কি ভুল কিছু বলেছি? কী হয়েছে?"
আলী যাকের বলেন, "আমার মনে হয় ওরা এখন আমাদের গ্রেফতার করতে যাচ্ছে, বাচ্চু। তুমি কী করলে?"
কিছুক্ষণ পর আরদালি এসে বললেন, "স্যার (বিচারক) আপনাদের দুজনকে ভেতরে ডাকছেন।"
"ছোটলু ভাই ও আমি লোকটিকে অনুসরণ করে বিচারকের কক্ষে প্রবেশ করলাম। চেম্বারের ভেতরে বিচারকের সাদা হেডগিয়ার ছিল না এবং আমি তার দিকে তাকাতেই মুখটি পরিচিত মনে হলো। বিচারক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমাকে চিনতে পেরেছেন বাচ্চু ভাই? আমার বিসিএসের পর আপনি আমাকে আইন পেশায় আসতে সাহায্য করেছিলেন।"
ঘটনার এই অংশে হাবিবুল আলমের স্মৃতি অবশ্য আলাদা।
তার মতে, "আমার মনে আছে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের কারণে আমাদের আদালতে হেঁটে যেতে হয়েছিল। বিচারক আমাদের তার চেম্বারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কারণ আলী যাকের আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি তখন একজন বিখ্যাত অভিনেতা। তার নাটক বিটিভিতে নিয়মিত প্রচারিত হতো।"
হাবিবুল আলম বলেন, "বিচারক জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে। আমি তার কাছে বিষয়টি বর্ণনা করলাম এবং তিনি বললেন, 'আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, তারপরও এ সব? কে এটা করেছে?'"
এরপর বিচারক একটি আদেশ লিখে দেন এবং এটি বহনের জন্য তাদের সাথে একজনকে নিয়ে আসেন। দুপুর আড়াইটার দিকে তখন ধর্মঘটের ৭২ ঘন্টা কিংবা ৬৮ ঘন্টা তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি) শেষ হয়েছে। তারা দরবারিদের সাথে ঢাকা ক্লাবের দিকে গাড়িতে উঠল।
লোকটি ক্লাবে প্রবেশ করল এবং দুজনকে (আলি যাকের ও নাসির) সাসপেন্ড থাকায় তারা ক্লাবের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
"দরবারি বাইরে এলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? লোকটি বলল, 'কেউ আদালতের আদেশ নিতে চায়নি। তাই আমি নোটিশ বোর্ডে কাগজটি সাঁটিয়ে দিলাম এবং বেশ জোরে একটি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিলাম।'"
ততক্ষণে ক্লাবের অভ্যন্তরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, আদালত সবাইকে তলব করেছে এবং তারা গ্রেপ্তার হতে চলেছে।
ওইদিন জাকের ও নাসির উদ্দীন বাড়ি ফিরে যায়। বিকেলে নাসিরের কাছে ফোন আসে ক্লাব সচিবের। তিনি বললেন, "আপনি কি আজ ক্লাবে আসতে পারবেন? প্রেসিডেন্ট আপনার সাথে দেখা করতে চান।"
জবাবে নাসির উদ্দীন বলেন, "আপনাকে সাসপেনশন প্রত্যাহার করতে হবে; অন্যথায়, আমি যদি ক্লাবে প্রবেশ করি, তাহলে এটি আদেশ লঙ্ঘন করবে।"
জবাবে সচিব তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি ক্লাবে প্রবেশের সাথে সাথেই প্রত্যাহারের চিঠি পাবেন।
এরপর নাসির উদ্দীন সবাইকে ডাকলেন। বললেন, "অনেকটা হিরোদের দলের মতো আমরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ক্লাবে ঢুকলাম।"
পরবর্তীতে ক্লাব সদস্যদের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরার বিষয়টি গ্রহণ করে।
সেক্ষেত্রে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ তারিখের আলোচনায় বলা হয়েছে, "বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক সব অনুষ্ঠানে অনুমোদিত। পাজামা ও কুর্তা শুধু শুক্রবার, ছুটির দিন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনুমোদিত। শেরওয়ানির সাথে পায়জামা ক্লাবের অন্যান্য সকল দিনে অনুমোদিত।
হাবিবুল আলম বলেন, "আমি বলব না যে, সবাই আমাদের জন্য খুব খুশি হয়েছিল কিংবা হাততালি দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে এমন একটি দলও ছিল যারা ক্লাবের অভ্যন্তরে যা চলছে তাতে খুশি ছিল না। কিন্তু এখন অনেক দিন হয়ে গেছে।"
এই তিনজনের মনে করেন, প্রতিবাদটি তাদের জীবনে এমন কিছু ছিল না যে সেটা করা অপরিহার্য ছিল। তবে এটি করা প্রয়োজন মনে করেছে বলেই তারা এটি করেছে।
হাবিবুল আলম বলেন, "আমরা ক্ষুব্ধ বোধ করার একমাত্র কারণ ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকার পরেও আমাদের উপনিবেশকারীদের তৈরি করা নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে কেন। আমি যদি একটি স্বাধীন দেশে বাস করি, যদি আমি আর ব্রিটিশ প্রজা না হই, তাহলে আমাকে কয়েকশ বছর আগে উপনিবেশকারীরা তৈরি করা নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে কেন?"
'ঢাকা ক্লাব বরাবরই ড্রেস কোড নিয়ে কম কঠোর ছিল'
অবশেষে ক্লাব সভাপতি আশরাফুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। নিখুঁতভাবে সাজানো অফিসে তিনি জানান, আজও কেউ বাটন-আপ কলার ছাড়া কলকাতা ক্লাবের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি সেই ক্লাবের বাটলাররাও গ্লাভস দিয়ে পরিবেশন করে। চিটাগাং ক্লাব এখনও ড্রেস কোড লঙ্ঘনের অনুমতি দেয় না।
প্রেসিডেন্ট বলেন, "আপনি যদি ক্লাবগুলোর সদস্য শ্রেণি পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে প্রথম থেকেই চিটাগাং ক্লাব (যা পূর্বে ইউরোপীয় ক্লাব নামে পরিচিত ছিল) ব্যবসায়ীদেরকেও সদস্য বানিয়েছে। তবে ঢাকা ক্লাবের সদস্যরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত; যেখানে রয়েছেন সাংবাদিক, লেখক, অধ্যাপক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি। আপনি কি কখনও একজন কবিকে ফর্মাল জ্যাকেট এবং জুতা পরতে দেখেছেন?"
প্রধানত ঢাকা ক্লাবের সদস্যরা যে ক্লাসের অন্তর্গত, সেটির কথা চিন্তা করে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য ব্রিটিশ ক্লাবগুলির তুলনায় এই ক্লাবের ড্রেস কোড একটু বেশি শিথিল।
তিনি আরও বলেন, "ক্লাবটির শতাধিক সদস্য রয়েছে যারা মুজিব কোট পরেন; মন্ত্রী ও এমপিরা। লুঙ্গি কিংবা ধুতি ক্লাবের অভ্যন্তরেও অনুমোদিত নয়। এমনকি যখন জ্যোতি বসু (১৯৭৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন) এসেছিলেন; তখনও তিনি ক্লাবে প্রবেশ করেননি। অনেক ধনী ব্যক্তি চাইলেও পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ টালিগঞ্জ ক্লাবে প্রবেশ করতে পারে না। কারণ তারা পান খায়। সেই তুলনায় ঢাকা ক্লাব খুবই নমনীয়।"