জব্বার আলীরা কেন আর সমুদ্রে গিয়ে সুবিধা করতে পারছেন না?
মাছের নৌকা যখন দাঁড় বেয়ে চালাতে হতো তখন থেকে রহমত উল্লাহ সমুদ্রে যান। ১৯৮৭ সাল সেটা, আর রহমত উল্লাহর বয়স ছিল পনের। তীর ঘেষে চলে ধলঘাটা, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, সন্দ্বীপের কাছে পৌঁছাতে মাছে ভরপুর হয়ে যেত নৌকা (সাম্পান)। তারপর ভাসানচর হয়ে হাতিয়া পেরিয়ে মেঘনার মোহনায় গেলে তো কমদামী অনেক মাছ ফেলে রেখে চলে আসতে হতো। তখন বিভিন্ন দফায় বিভিন্ন রকম জাল নিয়ে জলে যেতেন রহমতউল্লাহ। সেগুলো ছিল ইলিশের, রূপচাঁদার বা লাক্ষার জাল। কোনোটা হতো চার আঙুল ফাঁকা, কোনোটা আট আঙুল।
রূপচাঁদার মণ তখন ১,২০০ থেকে ১,৪০০ টাকা ছিল। সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হতো রূপচাঁদা। লাক্ষার বাজার ছিল চীনে। সাধারণত তিন-চার দিনের মধ্যেই আবার জেলেরা ফিরে আসত কক্সবাজারের ফিশারি ঘাটে। তখন ফিশিং বোটগুলোতে একজন মাঝি বা বোট ম্যানেজার, একজন সহকারী মাঝি আর ৪-৫ জন জেলে থাকত, সবমিলিয়ে ছয়-সাত জন।
ফিশারি ঘাটে অনেক মহাজন ছিলেন, তারাই বোট মালিক, মাঝিকে দায়িত্ব দিতেন দল গোছাতে। কোনো কোনো মহাজন কেবল রূপচাঁদার কারবারি ছিলেন, কেউবা লাক্ষার, তবে ইলিশের কারবারিই ছিলেন বেশি।
তখন দিনে পাঁচ বা সাতশ বোট সাগরে যেত। গর্জন কাঠে তৈরি হতো বোট। ৫-৭ হাজার টাকায় বোট তৈরি হয়ে যেত। হিমছড়ির অল্প আগে যে দরিয়ানগর বা বড়ছড়া সেখানকার পাহাড়ে অনেক গর্জন গাছ ছিল। কলাতলীর মিস্ত্রিরা নৌকা তৈরিতে ওস্তাদ ছিলেন। নব্বই সালে কক্সবাজারে পর্যটন বলতে গেলে ছিলই না। পর্যটন করপোরেশনের শৈবাল, উপল, প্রবাল, লাবনী ছাড়া বেসরকারি হোটেল-মোটেল ছিল না। কিছু বিদেশি আসতেন বেড়াতে, দেশীয় লোকেরা খুব কমই বেড়াতে আসত।
যারা আসত তারা সদরের লালদীঘির পাড়ে কোনো হোটেলে থাকত, দিনে দিনে সমুদ্র বেড়িয়ে আবার হোটেলে ফিরে যেত। বিচ বা সাগর পাড়ে বড় স্থাপনা ছিল নগণ্য। সন্ধ্যার পর আলো জ্বলত না, খাবার খাওয়ার হোটেল ছিল না। এখন যেখানে সী-গাল (সুগন্ধা বিচের কাছে) হোটেল সেখানে সাম্পান নোঙর করে রাখতেন রহমতউল্লাহসহ অন্য মাঝিরা। বিচ এলাকায় তখন দু-তিন ধাপের ঝাউবন ছিল, পাড় ভাঙত কম।
একবার লাবনী পয়েন্টে তার সঙ্গী জেলে নাজির উদ্দিনকে হাঙরে ধরেছিল। ডান পায়ে মাংস ও শিরা টেনে ছিড়ে নিয়ে গিয়েছিল। তখন কক্সবাজারে হাসপাতাল ছিল টিনের। সেখানের এক ডাক্তার ছাগলের শিরা (রগ) দিয়ে জোড়া লাগিয়েছিলেন নাজিরের মাংসপেশি। নাজির এখনও বেঁচে আছেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারেন।
সাগর নেই আগের মতো
রহমতউল্লাহ বললেন, "লাবনী পয়েন্টে তিন রকম ডলফিন দেখতাম-ধবধবে সাদা, ছাই রঙা আর কুচকুচে কালো। ভাটা লাগলে ছোট ছোট লাল কাঁকড়ায় সাগর পাড় রাঙা হয়ে থাকত। কচ্ছপেরা লাবনী পয়েন্টে ডিম ছেড়ে আবার সাগরে চলে যেত। সী গালের জায়গাটায় জেলেদের বড় বসতি ছিল— লং বিচ হোটেল, সি ক্রাউন, সি প্যালেসের জায়গায় ধান চাষ হতো। ঢেউয়ের সঙ্গে অগণিত ছোট ছোট শামুক-ঝিনুক ভেসে আসত পাড়ে। সেগুলো দিয়ে মালা গেথে, শো পিস বানিয়ে ছেলেমেয়েরা বিক্রি করত। সাগর আর আগের মতো নেই।"
আপনারা কেন হোটেল বা পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হননি?– জানতে চাইলে রহমতউল্লাহ বলেন, "এই কাজ আমরা জানি না, বুঝি না। অনেক টাকাও লাগে, আমাদের ততো টাকা নেই। আগে কক্সবাজারের মানুষের পেশা বলতে ছিল এই মাছ ধরা। এখন অনেক রকম ব্যবসার পথ খুলেছে, কিন্তু আমরা পারি না। বাইরের দেশের (চট্টগ্রাম, ঢাকা, নোয়াখালি) লোক এসে করে।"
রহমত উল্লাহ কাজ করতেন নূরুল আম্বিয়া কোম্পানির বোটে । আশ্বিন থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত মাছ ধরার ভরা মৌসুম। যতদিন উত্তরে বাতাস বয়, ততদিন সাগরে মাছ ধরা চলে। দক্ষিণী বাতাস শুরু হলে সাগর ফুসে ওঠে। সাগরে যেতে হয় খুব হুঁশিয়ার থেকে। তবে সে আমলের সাগরে এমনকি বৈশাখ মাসেও মাছ ধরা পড়তো অনেক।
লাইট হাউস পাড়ায় বৈশাখ সন্ধ্যা
চলতি বৈশাখের ছয় তারিখ। লাইট হাউস পাড়ার জামে মসজিদের কাছের মাঠটিতে সে সন্ধ্যার আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন জব্বার আলী আর শহীদ হোসেনও। সুগন্ধা পয়েন্টের কাছে এই পাড়া একটি পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের একটা বড় অংশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন, সেখানে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর পরিচালিত একটি বাতিঘর আছে। ১৯৭৬ সালে এটি নির্মিত হয়।
রহমতউল্লাহর পরিবার টেকনাফ থেকে প্রথম যখন এখানে আসেন, তখন মোটে ১০-১২টি ঘর ছিল। সন্ধ্যার পর বেশি কেউ ঘর থেকে বের হতেন না। জব্বার আলী মহেশখালী থেকে আসেন ২০০৩ সালে। শহীদ হোসেন চকরিয়া থেকে আসেন ২০০৫ সালে। এখন এই পাড়াতে বাজার বসে, মসজিদ আছে একাধিক।
সাত ঘোড়ার (সেভেন হর্স পাওয়ার) ইঞ্জিন অবশ্য চলে এসেছিল একানব্বই সালের মধ্যেই। তারপর আসে ১৫ ঘোড়া, ১৮ ঘোড়া ইত্যাদি। যত পাওয়ার বাড়তে থাকে তত নৌকা বড় হতে থাকে।
রহমতউল্লাহর কাছ থেকে জানলাম, সেকালে ডিজেলের দাম ছিল ১১ টাকা ৪ আনা। তিন-চার দিনের যাত্রায় তেল লাগত হাজার-বারোশ টাকার। রাতে নৌকায় জ্বালানো হতো চেরাগ। ১৫-২০ হাজার টাকা নৌকা প্রতি বিনিয়োগ করতেন মহাজন, যার মধ্যে খাবার খরচ ৫-৭ হাজার টাকা। খাবারের প্রয়োজনে নেওয়া হতো চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, লবণ, কিছু সবজি, এক-দুই বেলার গোশত। পেট ব্যথা-মাথা ব্যথার ওষুধ, স্যালাইন এবং গ্লুকোজও নেওয়া হতো।
সাগরের কোথাও কোথাও ইলিশ মাছ এতো বেশি থাকত যে গন্ধ পাওয়া যেত দূর থেকে। ইলিশ গোনা হতো লেজ দিয়ে। জেলেরা পেত হাজারে ২০ টাকা। মাঝি পেতেন জেলেদের তিনগুণ আর অ্যাসিস্ট্যান্ট মাঝি পেতেন দেড়গুণ। সাগর থেকে ফিরে আসার পর ফিশারি ঘাট বা বদরমোকামে গিয়ে মহাজনের কাছে প্রাপ্ত মাছ বুঝিয়ে দিতেন মাঝি। মহাজন মাছ বিক্রি করে দেওয়ার পর সবার পাওনা টাকা বুঝিয়ে দিতেন। দু-একদিন পরিবারের সঙ্গে আবার সাগরে ভেসে পড়তেন জেলেরা।
বৃষ্টি না হলে মাছ লুকায়
ইলিশ হলো ঝাঁকের মাছ। একটা জালে বাঁধলে অন্যরাও তেড়েফুঁড়ে এসে ঢোকে। যখন বাঁধে না তখন একটাও বাঁধে না। পানির রং দেখে মাঝি জাল ফেলার স্থান নির্ধারণ করেন। সাদা ও সবুজ পানিতে মাছ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা। বৃষ্টি হলে সাগরের কোনো কোনো জায়গা সাদা বর্ণ ধারণ করে। বৃষ্টির মিঠা পানি সমুদ্রের লোনা পানির সঙ্গে যখন মেশে, তখন তা ইলিশ মাছকে খুব আকর্ষণ করে। সে পানিতে মাছের গায়ে চর্বি জমে, আর পেটে আসে ডিম। বৃষ্টি না হলে মাছ লুকিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। তাকে খুঁজে পাওয়া তখন জেলের সাধ্যির বাইরে।
রহমতউল্লাহ সাগরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন ১০ বছর হলো। এখন তীরে বাটা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
জব্বার আলীর বাড়ি রামুতে হলেও বৈবাহিক সূত্রে থাকতেন মহেশখালি। ফিশারি ঘাটে টুকটাক নানান কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু কিছুতেই সুবিধে হচ্ছিল না দেখে শেষে সাগরে মাছ ধরতে যান।
২০০৬ সালের কথা। ততদিনে অবশ্য সাগরে মাছের মন্দা দেখা দিয়েছে। ১২০০, ১৫০০, ১৮০০ ঘোড়ার ইঞ্জিন এসেছে। গাড়ির ইঞ্জিন সব, হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে নয় সুইচ দিয়েই স্টার্ট হয়েছে। বোটে দুটি করে ইঞ্জিন থাকে, একজন ইঞ্জিনম্যান থাকে– যাকে বলা হয় ড্রাইভার। ব্যাটারি দিয়ে বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা। একেক যাত্রায় ১৫-২০ দিন সাগরে কাটান জেলেরা। মহাজনের কাছ থেকে পাওয়া তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যান বাড়িতে, খাই-খরচ চালানোর জন্য।
প্রতি যাত্রায় ৩-৪ বস্তা শুধু চালই ওঠানো হয় নৌকায়। একজন ডেডিকেটেড বাবুর্চি থাকে বোটে যার কাজ শুধু রান্না করা। সকালে রুটি, দুপুরে ও রাতে ভাত আর তিন বেলা চা হয় বোটে। ২০-২২টি মিঠা পানির ড্রাম ওঠানো হয় ২৫০ লিটারের। ইঞ্জিনের শক্তি বেড়ে যাওয়ায় সাগরের এমাথা ওমাথা চষে বেড়ায় বোটগুলো। ভারতের সীমান্তে পৌঁছাতে চার ঘণ্টার বেশি লাগে না এখন।
জব্বার আলীর মতে, দক্ষিণ হাতিয়া থেকে সেন্ট মার্টিনের নামা পর্যন্ত এলাকাজুড়ে মাছ বেশি পাওয়া যায়। সাধারণত দুপুর চারটায় প্রথম দফা জাল ফেলা হয়, বোট চলতে চলতে জাল টেনে নিয়ে যায় মাঝির নির্দেশিত জায়গা পর্যন্ত, জাল টেনে তুলতে রাত আটটা বেজে যায়। এর মধ্যে চলে তাস খেলা, গান করা বা গল্প করা। জাল টেনে তোলার পর জেলেরা উপযোগী মাছ বাছাই করে বরফের ভিতর চালান করে দেয়। রাত ১২টায় আবার জাল ফেলে ইঞ্জিন ছুটিয়ে চলা, টেনে তুলতে তুলতে ভোর ৪টা। মাছ সাধারণত রাতেই ধরা পড়ে ভালো। রাতে মাছের আনাগোনা থাকে বেশি।
প্রতি যাত্রায় মহাজনের খরচ হয় ৬-৮ লাখ টাকা। এখন আকালের দিনে মহাজনের লাখ-দুই লাখ টাকা গচ্চা যায় । তার ওপর আছে জলদস্যুদের তাণ্ডব আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
ভেসে গিয়েছিলেন ভারত সীমান্তে
শহীদ হোসেন এক দুর্যোগে পড়েছিলেন কিছু কাল আগে। মাঝ সমুদ্রে তাদের বোট তলিয়ে গিয়েছিল। ১৬ জন জেলে ছিল বোটে। ৮ জনকে কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাকি আটজনের সবাই ভাসতে ভাসতে চলে যায় ভারতের জলসীমায়।
সেদিনের ঘটনা মনে করে শহীদ বলছিলেন, "আকাশ কালো করে খুব ঝড় উঠেছিল। আমাদের সকলের সব চেষ্টা গিয়েছিল বিফলে। বোট তলিয়ে যাবার পর আমি ও আরেকজন একটি পানির ড্রাম ধরে ভাসতে থাকলাম। অন্য দুজনকে দেখলাম দুটি ফ্লুট (জাল ভাসিয়ে রাখে যেসব প্লাস্টিকের বল) ধরে ভাসছে। আমরা শুধু উপরওয়ালাকে ডাকছি আর চেষ্টা করছি পানি যেন গিলে না ফেলি।"
"হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া সব কাপড়চোপড় খুলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। বিকাল চারটায় নৌকা ডুবেছে। রাত ১১টায় ভারতের নৌবাহিনী আমাদের জাহাজে তুলে নেয়। জাহাজে ওঠার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরদিন তারা আমাদের কাপড়চোপড় দিয়েছিল। খাবারও দিয়েছিল ভালো। দিল্লীতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে কোম্পানির লোক গিয়ে চারদিন পর আমাদের ফিরিয়ে আনে," যোগ করেন তিনি।
সাগরে কি জলদস্যুদের উৎপাত আছে?— প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলাম সবার উদ্দেশেই। জয়নাল আবেদীন ভুট্টো যিনি সৈকতে লাইফগার্ডের কাজ করেন এবং চলতি আড্ডার ব্যবস্থাপক, উত্তর তিনিই দিলেন, "হ্যাঁ আছে, তবে আগের চেয়ে কম।"
"২০২২ সালের একদিন এক বৃদ্ধকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেছিলাম। তখন আমার ডিউটি প্রায় শেষ। হঠাৎ দেখি তীর থেকে কিছু দূরে কী যেন ভাসছে! আরেকটু ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝতে পারি, একজন মানুষ। রেসকিউ বোট নিয়ে দ্রুত ছুটে চললাম। বোটে উঠিয়ে তাকে পাড়ে নিয়ে এলাম। সারা গায়ে ক্ষত ছিল, হাত-পা বাঁধা লোকটা অচেতন ছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর দীর্ঘ শুশ্রূষায় তার জ্ঞান ফেরে। আমরা জানতে পারি, তাদের নৌকা জলদস্যুরা আক্রমণ করেছিল। অন্য কোনো জেলেকেই তারা বাঁচিয়ে রাখেনি। তিনি (বৃদ্ধ) খুব মিনতি করে বলেছিলেন, বাবারা আমার তিনটা মেয়ে, আমি মারা গেলে ওরা পথে বসবে। একটু দয়া করো। তাই তাকে জানে না মেরে হাত-পা বেঁধে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এমন এক-দুটি দস্যুতার ঘটনা ঘটে প্রতি বছরই। আগে অবশ্য বেশি ঘটত," বললেন তিনি।
'ইলিশ খাই না তিন বছর'
ভুট্টো দুঃখ করে বললেন, "গত তিন বছরে একটিও ইলিশ মাছ খাইনি। অথচ আমাদের ইলিশ বিদেশে যায়, সেখানকার লোক খেয়ে তৃপ্তি পায়। আমরা বাটা, চেউয়া, লইট্টা খেয়ে দিন কাটাই। অথচ ২০-২৫ বছর আগে ফিশারি ঘাটে স্তুপ করা ইলিশ, ইলিশের ডিম দেখেছি। এতো ইলিশ যে সারা মৌসুমে খেয়েও শেষ হতো না, শুটকি দিয়ে রাখা হতো। এখন আর সেটা দেখি না।"
শহীদ আর জব্বারের এই একটি সুবিধা, সমুদ্রে গেলে প্রায় সব বেলাতেই ইলিশ খায়। শহীদ আর জব্বার গেল মৌসুমেও সাগরে গিয়েছিলেন। দুঃখের ব্যাপার, যে বোটে তারা সাগরে গিয়েছিল সেটি কোম্পানি বিক্রি করে দিয়েছে। কাহা তক আর লোকসান গোনা যায়। আগে যেখানে এক যাত্রায় ৮-১০ হাজার মাছ পাওয়া যেত, সেখানে এখন দুই হাজার মাছও মেলে না। তাহলে মহাজনের খরচ উঠবে কেমন করে?
মৌসুম ছাড়া বছরের বাকি সময় শহীদ ও জব্বার দিনমজুরি করে সংসার চালান। জব্বারের তবু চলে যায় কারণ ছেলে বড় হয়েছে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শহীদের চার ছেলে-মেয়ের সবাই তার ওপর নির্ভরশীল। তাই শহীদের 'দিন আনি দিন খাই' অবস্থা। উপরন্তু, মাসে ৪,০০০ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয় তাকে।
মাছ কম কেন?
কিন্তু সাগরে মাছ কমে গেল কেন?— ভুট্টোই প্রথম জবাব দিলেন, সাগরের মেজাজ আগের মতো নেই। মাঝে মধ্যেই রুক্ষ হয়ে ওঠে। জলবায়ু পরিবর্তন তার কারণ হতে পারে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য ও তীব্রতার একটা ধারাবাহিকতা ছিল আগে, এখন আর তা নেই।
জব্বার বললেন, "বৃষ্টি হওয়ারও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন না হয়ে ১০ দিন পরে হচ্ছে বা আগে হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি আর স্বাভাবিক নেই। তাছাড়া, এখন অনেক নৌকা। সাগরের একই জায়গায় শত শত নৌকা দেখা যায়। আমার মনে হয়, একই সময়ে সাগরে লাখখানেক জেলে থাকে। সবাই মাছ চায়। আগে তো এতো নৌকা যেত না। কম বেশি মাছ সবাই পেত।"
শহীদ অবশ্য কোনো উত্তর দেন না। তার উত্তর খোঁজার সময় নেই। আগামীকাল কীভাবে চলবে, সে ভাবনায় অস্থির তিনি। মহাজনদের ক্ষতিতে তার দুর্গতি। তিনি আশা করেন, সাগর দ্রুতই শান্ত হয়ে যাবে। মাছ পাওয়া যাবে ভরপুর। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সুযোগ তাদের মতো মানুষের আবার হবে।
কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমানের কাছে মাছ কমে যাওয়ার প্রসঙ্গটি তুললে তিনি বলেন, "জলবায়ুর পরিবর্তন মাছের প্রজননেও প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাছ খাবার গ্রহণ করে কম, তাতে তার পুষ্টি হয় না, আর পুষ্ট না হলে ডিম কম ছাড়াই স্বাভাবিক।"
"মাছ ডিম ছাড়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট পরিবেশে। তার জন্য বৃষ্টি হওয়া জরুরি। এ বছর এখনো (আর্লি মনসুন) কক্সবাজারে বৃষ্টি হয়নি, তাই উপকূলে মাছের আনাগোনা কম," যোগ করেন তিনি।