কায়পুত্র: শূকর পালকদের গল্পগাথা
চোখ যতদূর যায়, মনুষ্যবসতির চিহ্ন পাওয়া ভার। কেবল ধু-ধু সবুজ প্রান্তর আর নীলচে আকাশ দূরের দিগন্তে গিয়ে একাকার হয়েছে। মাথার ওপর চৈত্রমাসের সূর্য গলগলে সিসার মতো কড়া রোদ মেলে বসে আছে। উত্তাপে মনে হয় এই বুঝি ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। রোদ থেকে খানিকটা রেহাই পাওয়ারও কোনো বন্দোবস্ত নেই আশপাশে; না আছে গাছ, না কোনো ছাউনি।
তবে দূরের নিচু বিলে কয়েকজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। এসব বিল আগামী কয়েক মাস পর বর্ষাকালে থৈ থৈ করবে। এমন ছাতি ফাটানো রোদেও লোকগুলোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, একমনে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন।
মাথার ওপর ছাতা, হাতে বড় লাঠি, কাঁধে ঝোলা — তার ভেতর কিছু কাপড়চোপড় আর দুই লিটারের একটা পানির বোতল — এমন বেশভূষার মানুষগুলোর মুখ থেকে 'আআআয়', 'হুরর', '্সসস' ইত্যাদি শব্দ এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছাচ্ছে।
তাদের তত্ত্বাবধানে একদল শূকর দলবেঁধে চরে বেড়াচ্ছে, মাঝেমধ্যে ঘোঁতঘোত শব্দ করছে। তাগড়া থেকে শুরু করে বুড়ো, বিভিন্ন বয়সের কয়েকশ কালো শূকর মাঠের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে, মাটিতে মুখ গুঁজে খাবার খুঁজছে — আগাছা, শিকড়, কন্দ, পোকামাকড়। কোনোটা একটু দলছাড়া হলেই পিটিয়ে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে সীমানার ভেতর।
আশপাশে তাকিয়ে আরও দুখানা মাঠে দুটো শূকরপাল চোখে পড়ল। সবমিলিয়ে জনাপনেরো রাখাল প্রায় ৫০০ শূকরের এ তিনটা দলকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। পরে জানা গেল, সবগুলো একই দঙ্গলের শূকর।
জায়গাটা গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বলাকইড় পদ্মা বিলের গভীরে। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ নেমে তারপর একটার পর একটা খেতিজমি আর বিল পার হয়ে, কয়েকবার ভুলপথে ঘুরে অবশেষে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি।
উঁচু আইল ধরে পালটার দিকে এগিয়ে যেতেই নাকে শূকরের বিষ্ঠার তীব্র পূতিগন্ধ এসে আঘাত হানল। চল্লিশের কোঠায় থাকা এক রাখাল গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কই যাচ্ছেন, ভায়েরা? এখানে চারপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কিছু নাই।'
'আপনাদের সঙ্গেই দেখা করতে এলাম,' চেঁচিয়ে জবাব দিলাম আমরাও।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের কাছে দৌড়ে এসে অর্ধেক ভর্তি একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। খেয়াল করে দেখলাম, রাখালের সারা গায়ে পুরোনো অনেক ক্ষতচিহ্ন। গায়ের রং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তামাটে, বোধকরি দীর্ঘসময় ধরে সূর্যের নিচে থাকার বদৌলতে।
'গলা শুকিয়ে তো কাঠ হয়ে যাবার কথা। আধাঘন্টা ধরে দেখছি আপনারা আসছেন। এ ভরদুপুরের সূর্যের নিচে হাঁটলে জান বেরিয়ে যায়,' বললেন রাখাল প্রশান্ত মণ্ডল।
বোতল থেকে পানি খাওয়ার সময় প্রশান্ত জানালেন, এ পানি তারা নিয়ে আসেন একটা খামারের টিউবওয়েল থেকে। এখান থেকে তার দূরত্ব ৩০ মিনিটের হাঁটাপথ। কলের পানি সাধারণত ঠান্ডা আর শীতল হয়, কিন্তু এতক্ষণ ধরে সূর্যের সরাসরি নজরে থাকায় তা এখন উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
আর স্বাদ? সে আর না বলাই ভালো। এ পানি দিয়ে রান্না করতে গেলে বোধহয় সেটায় আর আলাদা করে লবণ দিতে হবে না।
আমরা প্রশান্তকে নিজেদের পরিচয় দিলাম। আমরা সাংবাদিক, ঢাকা থেকে এসেছি তাদের সন্ধানে, যাতে 'তাদের নিয়ে কিছু একটা লিখতে পারি যেখানে তারা হবেন গল্পের নায়ক'।
'আমরা এখানে বহিরাগত বটে, তবে আপনারা আমাদের অতিথি। কিন্তু আমাদের আর দেওয়ার মতো কিছু নাই,' প্রশান্তের মুখটায় আফসোস স্পষ্ট। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তার কথায় একটুও আঞ্চলিকতার টান নেই।
'আপনারা তাহলে এখানকার স্থানীয় নন? আসছেন কোথা থেকে?' জিজ্ঞেস করলাম তাদেরকে। কিন্তু এ প্রশ্নের সোজাসাপটা কোনো জবাব নেই তাদের কাছে।
শূকরপালটির মালিক যশোরের তারাগঞ্জের ভায়েনা মণ্ডলপাড়ার দফা তরফদার। আর রাখালদের বাড়ি একই জেলার ঢাকুরিয়া গ্রামে। তবে তারা সরাসরি যশোর থেকে এখানে আসেননি।
পৌষের প্রথম সপ্তাহে গোপালগঞ্জ আসার আগে তারা বরিশালে কিছুদিন ছিলেন। আষাঢ়ে তাদের যাত্রা শুরুর পর রাখালদলটি মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, মাদারিপুর ও শরীয়তপুর ছুঁয়ে এখানে এসে থিতু হয়েছেন।
কেউ হয়তো ভাববেন, চরানোর জন্য এ শূকরগুলোকে কেন এতদূরের এ নিম্নভূমি এলাকায় নিয়ে আসা হলো। এর মূল কারণ বর্ষায় এসব স্থান প্রায়ই পানির তলায় থাকে, চাষবাষ করা যায় না। ভেজা এলাকায় জন্মানো বিভিন্ন সবুজ উদ্ভিদ ও শিকড়বাকড় খেয়ে এসব স্থানে দিব্যি থাকতে পারে শূকরগুলো।
শূকর সর্বভুক। এগুলো পোকামাকড়, ছোট জন্তু, আস্তাকুঁড়ের বর্জ্য সবই খায়। তাই বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এ প্রাণী।
শূকরের মালিকের সঙ্গে প্রশান্তদের দলটির এক বছরের চুক্তি রয়েছে। আগামী আষাঢ়ে তা শেষ হবে। ওই মাসেই যশোরে ফেরার পরিকল্পনা তাদের। তার আগ পর্যন্ত গোপালগঞ্জে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে দলটির। তবে বলা বাহুল্য, যেকোনো সময় ক্ষণিকের নোটিশে এখান থেকে চলে যেতে হতে পারে তাদেরকে।
এ যেমন, স্থানীয় প্রভাবশালী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো কারণে তাদের ওপর নাখোশ হয়ে তাদেরকে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বলতে পারে। অন্যদিকে পালের মালিকও খবর পাঠিয়ে অন্য জায়গায় যেতে বলতে পারেন। এছাড়া জমির মালিকও রাখাল আর শূকরদের এখানে অবস্থানের অনুমতি বাতিল করতে পারেন।
কাল কী হবে এ ভাবনাটা নিয়ে রাখালদের সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে আর এ যাযাবর জীবনটাকে রোমাঞ্চের দৃষ্টিতে দেখাটা ঠিক মনে হয় না। যখন যাপিত জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া যায় না, বরং ভাগ্যের ফেরে পড়ে জীবনের হিসেবনিকেশ করতে হয়, তখন আর ব্যাপারটা রোমান্টিক থাকে না।
'প্রায়ই মনে হয় আমাদের কোনো শিকড় নেই। একদিন এখানে তো পরদিন অন্য কোথাও যাত্রা করা; সে গন্তব্যে খানিকটা অভ্যর্থনার আভাস থাকুক বা না থাকুক,' প্রশান্ত বললেন।
'পরিবারকে শেষবার দেখেছি নয় মাস হয়ে গেছে। আমার মতো আরও কয়েকজন আছে। দুর্গাপূজার সময় অল্প কয়েকজন ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেছিল।' কিন্তু সেটাও পাঁচ মাস আগে।
কথা বলার মাঝে প্রশান্তের কপালে ফোঁটাফোঁটা ঘাম জমে উঠেছে। ঝোলা থেকে একটা ডোরাকাটা গামছা বের করে সেগুলো মুছলেন। সেই সকাল ৬টার পর থেকে সাতঘণ্টা একটা অগ্নিগোলকের নিচে থাকা কারও পক্ষে একটানা সুসংগত কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া কঠিন। প্রশান্তের সামনে আরও সাতঘণ্টা বাকি। তবুও নিজের নামের মতোই শান্ত কণ্ঠস্বর বজায় রেখেছেন এ রাখাল।
তিনি জানালেন, এ বছর সুযোগ করত পারলে তারা এখান থেকে কাছাকাছি বরগুনা, ঝালকাঠি এমনকি বাগেরহাটও যেতে পারেন।
এক বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার পর শূকর-মালিক প্রতি দুই মন (১ মনে প্রায় ৩৭.৩২৪ কেজি) পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা দাম ধরে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে শূকরগুলো বিক্রি করবেন। ঢাকার ফার্মগেটে শূকরের মাংসের একটি বাজার রয়েছে। সেখানে এসব শূকর বিক্রি করা হবে প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা দামে।
প্রশান্ত নিজেকে পরিচয় দেন নমঃশূদ্র হিসেবে। তবে তাদের আরেকটি সুনির্দিষ্ট পরিচয় আছে।
আধুনিক লিটারেচার ও গণমাধ্যমে তাদের অভিহিত করা হয় কায়পুত্র হিসেবে, যারা প্রথাগতভাবে শূকর পালনের পেশায় নিয়োজিত এবং যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করেন।
২০১৯ সালে সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (এসইএইচডি)-এর প্রকাশিত এক মনোগ্রাফ অনুসারে, কায়পুত্র সম্প্রদায়ের আনুমানিক জনসংখ্যা ১২ হাজার। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলার ৪১টি গ্রামেই তাদের বসবাস বেশি।
গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা ও ১৮৬০ সালের দিকে হিন্দুদের মতুয়া সম্প্রদায় গঠনের জন্য পরিচিত হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২–১৮৭৮) কায়পুত্রদের আদিপুরুষ হিসেবেও সম্মানিত। এখনও কায়পুত্ররা তাদের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে হরিচাঁদ ঠাকুরকেই মান্য করে।
তবে অতীতে কায়পুত্রদের কাওরা নামে ডাকা হতো। 'কিন্তু এটা দিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দু বোঝায়, তাই কিছুটা অসম্মানের। আমরা দেখেছি আমাদের মুরুব্বিরা এ শব্দটাকে ঘেন্না করতেন। আমরাও চাই না কেউ আমাদের এ নামে ডাকুক,' বলেন প্রশান্ত।
তবে অনেকে তাদেরকে এ নামে এখন ডাকা বন্ধ করলেও বাংলাদেশি সমাজে অবজ্ঞারই সম্মুখীন হন তারা। কারণ তারা 'নোংরা', ও মুসলমানদের জন্য হারাম শূকর পালন করেন। এছাড়া উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছেও 'অচ্ছুত' এ কায়পুত্ররা।
পালাক্রমে তিনটি পশুপালের রাখালদের সঙ্গে আলাপ হলো আমাদের। তারা সবাই খুবই সাধারণ বলে মনে হলো। ব্যাপারটা আমাদের জন্য দারুণ একটা সারপ্রাইজ, কারণ এখানে আসার পথে আমরা ভাবছিলাম তারা আদৌ আমাদের উপস্থিতি পছন্দ করবেন কি না।
তবে মনে হলো এ রাখালেরা আমাদের মতো অপরিচিত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি করেন না। আমরা যে একটু পরপর তাদের ছবি তুলছি, তা নিয়েও বিরক্ত হচ্ছেন বলে মনে হলো না। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছবিগুলো দেখার কৌতূহল প্রকাশ করলেন। 'এ ছবিগুলোর মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া যাবে কি না' সেটা নিয়েও কিছুক্ষণ জল্পনাকল্পনা করলেন।
তাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পর আমরা সুমন, বিধান, মণি ও অন্য রাখালদের কাছে জানতে চাইলাম, বছরের বেশিরভাগ সময় পরিবার থেকে দূরে থাকা, দিনে ১৪–১৫ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম, রাতে তাঁবুতে ঘুমানোর এ চাকরি তারা কেন করেন।
সবার একটি সাধারণ উত্তর হলো, তাদের কাছে সত্যিই অন্য কোনো বিকল্প নেই। ভাগ্য বদলের জন্য কেউ পড়ালেখা করতে পারেননি। অন্য ধরনের কাজ করারও বিশেষ সুযোগ নেই। কায়পুত্র পুরুষদের কেবল ক্ষুদ্র একটি অংশই অন্যান্য খাতে কাজ করেন।
এসইএইচডি-এর গবেষণা অনুসারে, প্রায় ৮০ শতাংশ কায়পুত্র নিরক্ষর, মাত্র ২–৩ শতাংশ এসএসসি'র গণ্ডি পেরোতে পেরেছে। ফলে গোষ্ঠীটির খুব কম লোকই আনুষ্ঠানিক চাকরি পায়।
তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভাগ্যও আশাব্যঞ্জক বলে মনে হয় না। যাদের সঙ্গে কথা হলো, তারা সবাই বললেন তাদের ছেলেরা হয়তো প্রাইমারি পর্যন্ত পড়াশোনা করবে, তার বেশি পড়িয়ে লাভ নেই। বিশেষ করে কারণ তাদের নিজের গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। ছেলেদের স্কুলে পড়ার জন্য কাছের অন্য গ্রামে যেতে হয়। আর মেয়েদের পড়াশোনার সম্ভাবনা? সেটা প্রশ্নাতীত।
শূকর পালনের পাশাপাশি গোষ্ঠীটির কিছু পুরুষ সদস্য কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, দর্জি, ভিক্ষুক ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কায়পুত্র মাছ ধরার দিকে ঝুঁকছেন।
শূকর পালনের কাজে কি পোষায়? সুমন জানান, 'কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় ভালো আয় করেন। এ অল্প কয়জন মাসে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারেন। অন্যরা আট থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান।'
এটুকু মাইনে দিয়েই রাখালদের নিজেদের খরচসহ অন্তত পাঁচ থেকে আটজনের পরিবারের দায়িত্বও বহন করতে হয়। তাই দেশের অন্যতম পিছিয়ে পড়া এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী যে তারা, তা আর আশ্চর্য কী।
তার ওপর কায়পুত্র নারীদের অবস্থা বিশেষভাবে অনিশ্চিত। মণির কাছে যখন জানতে চাইলাম তাদের স্ত্রী-কন্যারা কী করেন, তখন আমরা কী বলতে চাইছি সেটা বেচারাকে বোঝাতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। কারণ ছোট থেকেই তার ধারণা, তাদের নারীরা 'আদতে কিছু করেন না'।
শেষে বোঝার পর বললেন: 'আচ্ছা, আপনারা জানতে চাচ্ছেন ওরা টাকাপয়সা আয় করে কি না? না, সেটা কেমনে সম্ভব? একবার বিয়ে হয়ে গেলে ঘরকন্নার কাজ আর সন্তান লালন-পালনই তাদের করতে হয়।'
৯০ শতাংশেরও বেশি কায়পুত্র নারী মূলত গৃহিণী। আনুমানিক ৪ শতাংশকে শূকর পালনকারী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ প্রতিবছর শূকরগুলো অল্প কিছুদিনের জন্য তাদের গ্রামের আশপাশে চরার সময় পুরুষদের বদলে সেগুলোকে তারা সামলান। মুষ্টিমেয় কিছু নারী কায়পুত্র হয় কৃষি কাজ করেন নয়তো ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন।
গল্পে গল্পে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। রাখালেরা পশুগুলোকে একটা ছোট পুকুরে নিয়ে গেলেন। ওখানে সেগুলো গোসল করে। বেশ কয়েকবার ডুব দেওয়ার পরে শূকরগুলো আবার চাঙা হয়ে উঠল।
মজার বিষয় হলো, গৃহপালিত এ শূকরগুলো আমাদের দেখা সম্ভবত সবচেয়ে ভীতু প্রজাতি। এমনকি ভাব করার মতো করে এগিয়ে গেলেও সেগুলো ভয় পেয়ে উলটোদিকে দৌড় দেয়।
গোসলের কাজ চলার ফাঁকে বিধান আমাদের জানালেন, মাঝে মাঝে তাদের স্ত্রীরা তাদের অনুপস্থিতিতে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেন। এতে পরে তাদের ওপর চাপ বেড়ে যায়।
গত বছর এমন এক ঘটনা ঘটেছিল। সেবার অক্টোবর মাসে এক ঝড়ে গ্রামে বিধানের ঘরটার বড়রকমের ক্ষতি হলো। তার ওপর ঘরের খাবারদাবারও যা ছিল, সব ততদিনে ফুরিয়ে গেছে।
দলের অন্য রাখালদের সঙ্গে বিধান তখন উত্তরবঙ্গের কোথাও শূকর চরাতে ব্যস্ত। স্ত্রী হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও মোবাইলে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেন না।
শেষতক বিপদ থেকে উদ্ধার হতে তিনি এক মহাজনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তার সুদ ছিল মোটা — ৫০ শতাংশ; পরিশোধের সময় পেলেন তিন মাস।
অনেক পরে ঘটনা জানার পর বিধানের মেজাজ মারাত্মক চড়ে যায়। এ ঋণ শোধ করবে কে! সেবার ডিসেম্বরে অল্প কয়দিনের জন্য বাড়ি যাওয়ার পরও স্ত্রীর ওপর গোস্সা করে ছিলেন তিনি।
তারপর আগের ঋণ মেটাতে আরেক মহাজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নেন বিধান। নতুন এ ঋণ সুদে-আসলে ২৫ হাজার টাকা আগামী আষাঢ়ের মধ্যে তাকে শোধ করতে হবে।
'এতগুলো টাকা কই পাব বুঝতে পারছি না,' বলেন বিধান। 'একটা কাজ শুয়োর পালনই জানি খালি, কিন্তু এ করে কোনোদিন ঋণের জাল থেকে মুক্তি মিলবে না।'
কায়পুত্রদের এ পেশা কি আগামী প্রজন্মের জন্যও টিকে থাকবে? বিধান বা আমাদের আলাপ করা অন্য কোনো রাখালদের কেউই এ নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শূকর পালন ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। গত বছরও এ সময়ে গোপালগঞ্জে রাখালদের চারটি ভিন্ন দল ছিল। কিন্তু এবার শুধু একটাই, কারণ অন্য মালিকেরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
'সারাদেশে কমবেশি একই দৃশ্য। পেশা হিসেবে শূকর পালন এখন শেষ পর্যায়ে,' বলেন দলের আরেক রাখাল সুরঞ্জিত।
অতীতে গোপালগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী জেলার অনেক নিচুজমি শুকনো মৌসুমে শূকর পালনের জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরকম অনেক জমি মাছচাষের উদ্দেশ্যে ঘেরে রূপান্তর করা হয়েছে। ফলে শূকর পালনের জন্য উপযুক্ত জায়গা কমে যাচ্ছে।
অনেক কায়পুত্রও তাদের পেশা পরিবর্তন করেছেন। যেমন, খুলন-যশোরে কিছুসংখ্যক এবং সাতক্ষীরার মোট ২৯টি কায়পুত্র গ্রাম এখন জেলেগ্রামে পরিণত হয়েছে।
বিশিষ্ট গবেষক ও এসইএইচডি'র পরিচালক ফিলিপ গাইন বলেন, 'প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জোটা অসম্মান এড়াতে কায়পুত্ররা তাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় গোপন রাখেন।'
'শূকর পালনের পেশা এ প্রজন্মের মধ্যেই বিলুপ্ত হতে পারে,' আশঙ্কা সুমনের। 'যারা মাছ ধরার দিকে ঝুঁকেছে, তাদের মতো আমাদেরও বিকল্প পেশার সন্ধান করতে হবে।'
সন্ধ্যা নেমে এল। কায়পুত্রদের ভবিষ্যৎটাও কি একদিন এমন অন্ধকারে ঢেকে যাবে?
স্রেফ আধঘণ্টার মধ্যে পুরো এলাকা অন্ধকারে ঘিরে ফেলল। দূরের বাজার আর জনবসতি থেকে আসা আলোর ম্লান ঝলক ছাড়া আশপাশের আর কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। আকাশটাও অস্পষ্ট, নক্ষত্ররিক্ত, চাঁদেরও দূরতম আভাস কোথাও নেই।
তবে রাখালদের জন্য হাত-পা ঝাড়ার সময় এখনো আসেনি। 'শূকরের পেট আশ্চর্য বড়, অনেকটা মানুষের মতোই। বোধহয় ওজন্যই 'শুয়োরের বাচ্চা' গালিটা আমাদের মধ্যে এত কমন,' নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন মণি।
মোদ্দাকথা হলো, অন্তত রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত শূকরগুলো চরে বেড়িয়ে খাবার খাবে। আমাদের তা-তে আপত্তি নেই, কারণ ইতোমধ্যে আমরা রাতটা রাখালদের সঙ্গে কাটাব বলে ঠিক করে ফেলেছি। তাই কাজ শেষ করা নিয়ে আমাদের কোনো তাড়া নেই। পাখির কিচিরমিচির শব্দ এখন থেমে গেছে, তার জায়গা নিয়েছে কীটপতঙ্গের ঐকতান।
কিন্তু আস্তে আস্তে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রথম থেকে যেমন আতিথ্যের বোধটুকু রাখালদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম, এবার যেন সেটা কমতে লাগল। কয়েকজন রাখাল তাদের সঙ্গে রাত্রিযাপনের বিষয়ে স্পষ্ট আপত্তি জানালেন। অন্যরা পুরোপুরি বিরোধিতা না করলেও সতর্ক করে দিয়ে বললেন, কাজটা বোধহয় ভালো হবে না।
রাখাল দলটির মধ্যে চাপা উত্তেজনা ক্রমেই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, আমাদের থাকা না থাকা নিয়ে তাদের মধ্যেই বিভাজন দেখা দিলো। তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বিস্তর আলাপ করছেন, বোধহয় কীভাবে আমাদের এখান থেকে বিদেয় হতে বলবেন সেটার শলাপরামর্শ করছেন।
সারাদিনে আমাদের প্রশান্তের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি খাতির জমেছে। তাই ওই বিলে তাদের সঙ্গে রাত কাটালে কী সমস্যা হবে তা খোলাখুলিভাবে বলতে তাকে অনুরোধ করলাম।
তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন। স্থানীয়রা যদি টের পায় বাইরের দুজন মানুষ তাদের সঙ্গে থাকছেন, তাহলে তারা ধরে নিতে পারে আমরা শূকরের মালিকের আত্মীয়। তারপর রাতের বেলায় হামলাও করে বসতে পারে। আমাদের ক্যামেরা, মোবাইল ফোনের মতো মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি যাওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা রয়েছে।
'এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে এই গোপালগঞ্জে। দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় এ এলাকায় স্থানীয়দের প্রভাব বেশি,' প্রশান্ত জানান।
তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম, আমরা ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক। 'যদি আমরা আপনাদের সঙ্গে একরাত না থাকি আর সে অভিজ্ঞতা আমাদের লেখায় না রাখি, তাহলে আমাদের চাকরিও চলে যেতে পারে,' মুখটাকে বেশ গম্ভীর করে ব্যাপারটার গুরুত্ব তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
এবার প্রশান্ত সম্মত হলেন। তিনিও চান না আমরা চাকরিটা খুইয়ে বেকার হয়ে পড়ি। রাত সাড়ে আটটার দিকে শূকরগুলো চরা বন্ধ করলে আমরা রাখালদের তাঁবুর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার যেতে হবে তাঁবুতে পৌঁছাতে হলে।
অন্ধকার বিলের পথে সম্বল মোবাইল ফোনের লাইট। তা-তে বেশিকিছু দেখা যায় না। অনেকবার হোঁচট খেতে হলো। তবে বেশি অসাবধানে পা ফেলা যাবে না, হুট করে কোনো সাপের গা মাড়িয়ে দিলে কামড় থেকে রেহাই মিলবে না।
রাখালদের হাতেও ব্যাটারিচালিত অল্প কয়েকটা টর্চ আর কিছু কুপিবাতি। কিন্তু জায়গাটা তাদের নখদর্পণে, তাই অনায়াসে হেঁটে চলছেন তারা। শূকরগুলোও বিশেষ কোনো ঝামেলা ছাড়াই দলটাকে অনুসরণ করছে।
তাঁবুতে পৌঁছানোর পরে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়ল। মাত্র দুখানা ছোট্ট, ছেঁড়া তাঁবু। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ১৫ জন রাখালকে এগুলোতে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়। তার ওপর রাতে যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে কাকভেজা হওয়া কিছুতেই এড়ানো যাবে না।
এর বাইরে আছে তিনটে খোঁয়াড়। সেগুলোর ওপরে ছাউনির কোনো বালাই নেই। শূকরগুলো খোঁয়াড়ের ভেতর ঠিকঠাক ঢুকিয়ে পাশের একটা ছোট্ট ডোবায় রাখালেরা নাইতে নামলেন।
স্নান সারার পর কয়েকজন বসে গেলেন রান্নার কাজে। তবে রান্না শুরুর আগে তারা আমাদের জন্য চা বানালেন। এক চুমুক দিয়েই টের পেলাম, মেলা কড়া। রাখালদের বক্তব্য, সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর চা-টা কড়া হলে কিছুটা তাকত ফিরে আসে।
রাতের খাবার খুবই সাধারণ, ভাত আর মাষকলাইয়ের ডাল। এগুলো রাঁধতে তাদের বড়জোড় ঘণ্টাখানেক লাগে। তবে রান্নার পরপরই খাওয়ার আয়োজন নয়। তার আগে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা তাস খেলেন। কেউ কেউ নিজেদের বাটন ফোনে গান শোনেন।
কুপির মৃদু আলোয় রাখালেরা তাস খেলছেন গান শুনতে শুনতে। পরিবেশটা মোহনীয় হয়ে উঠছে। কখনও বাজছে 'সাদা সাদা কালা কালা', আবার কখনো বেজে উঠছে 'জব রে মন কৃষ্ণ নাম'।
রাখালদের দেখে মনে হয় না তারা নিয়মিত ধর্মচর্চা করেন। তবুও এ বিলের মাঝখানে অন্ধকার রাতে ভক্তিমূলক গানগুলো যেন তাদেরকে মোহিত করে ফেলেছে, কিছুক্ষণের জন্য তাদের যাপিত জীবনের যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তির দুনিয়ায় নিয়ে গেছে।
খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতে ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে ১১টায় গড়াল। রাখালেরা এবার শোওয়ার আয়োজন করতে লাগলেন। কিন্তু তার আগে তাদের একজন কানাগোল্লা ভূতের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক মোলাকাতের গল্প ফাঁদতে বসলেন।
গাঢ় অন্ধকারে তার মুখটা ঢাকা পড়ে আছে। তার মতে, কানাগোল্লা ভূত রাতের বেলা মানুষকে ভুলিয়ে বিল বা খোলা মাঠে নিয়ে যায়। তারপর তাদেরকে এমন সব জিনিস দেখায় যার অস্তিত্ব আদতে সেখানে নেই।
কয়েক মিনিট আগে তিনি খোঁয়াড়ের কাছে গিয়েছিলেন জলবিয়োগ করতে। সেখানে না-কি তিনি সাদা কাপড় গায়ে কাউকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। বোঝা গেল রাখালের সাহস আছে বেশ। ওই আকৃতির কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। খুব ছোট্ট একটা জবাব এসেছিল: 'সাবধান!'
আবারও রাখালেরা দুই দলে বিভক্ত। এক দলের দাবি, তারাও সম্প্রতি একই ধরনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। অন্য দল অবশ্য ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে গল্পকথক রাখালের এমন অভিজ্ঞতার জন্য সন্ধ্যাবেলা সেবন করা বিশেষ এক পদার্থকে দায়ী করলেন।
বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় তত্ত্বটাই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে প্রতীয়মান হলো। তারপরও সে অন্ধকারে বসে হঠাৎ করে ভয়ের এক শীতল শিহরণ মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যাওয়া দিব্যি টের পেলাম। প্রতিটা শব্দ, এমনকি বাতাসের মৃদু আওয়াজও রোম খাড়া করে দিচ্ছে। কানাগোল্লা ভূত কাছাকাছি কোথাও ঘাপটি মেরে আছে কি না সে দুশ্চিন্তাও এক-দুবার মাথায় উঁকি দিলো।
কিছুক্ষণ পর তাঁবুর ভেতরে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম আমরা সবাই।
পরদিন সকাল সাড়ে চারটার দিকে ঘুম ভাঙল। ধীরে ধীরে রাখালেরাও একে একে জাগলেন। সোয়া পাঁচটা নাগাদ সবাই ওঠার পর চায়ের সঙ্গে বাটিভর্তি মুড়ির বন্দোবস্ত করা হলো।
তারপর দুজন রাখাল সকালের জলখাবার আর দুপুরের খাবার জন্য ভাত ও তরকারি রান্নার কাজ শুরু করলেন। বাকিরা প্রস্তুত নিলেন আরেকটা কঠিন দিনের জন্য: তেপান্তরের মাঠে কড়া রোদে শূকর ঠ্যাঙানো।
মাঠের দিকে রাখালদের সঙ্গে আমরাও রওনা দিলাম। চারণভূমিতে পৌঁছানোর পর বিদায় নেওয়ার পালা এল। প্রশান্তের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেষ একটা প্রশ্ন করলাম: 'আপনারা কি এ জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট?'
'সারাদিন এত খাটাখাটনির মধ্যে থাকি, আলাদা করে ভালো-খারাপ লাগার অবসর কই? শুধু দিন গুনতে থাকি কবে বাড়ি ফিরতে পারব,' প্রশান্ত জবাব দিলেন।
বাড়িতে ফিরলেও জীবন তাদের খানিকটা প্রশান্তি নিয়ে অভ্যর্থনা জানায় না। তবে প্রশান্তের কথায়, অনাগত দিনের জন্য ভাবতে সবারই কিছু না কিছুর দরকার হয়। তাদের এই যাযাবর জীবনে ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষাটাই তাদের 'ধন্য আশা কুহকিনী', পরেরদিন আবারও রোদেপুড়ে বিলের মাঝে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার জোরটুকু তৈরির পাথেয়।
ছবি: সাকলাইন রিজভী
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত
মূল লেখা: Kaiputras: The pig herders' song