বাংলার বিজ্ঞাপন: জবাকুসুম থেকে ‘যদি লাইগা যায়’
তখন রবীন্দ্রনাথের মতো তারকা আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না বঙ্গভূমে। বিশ শতকের শুরুর কথা। নোবেল পুরস্কার পেতে তখনো কবির বছর দশেক বাকি, তার মধ্যেই ঠাঁই করে নিয়েছেন ঘরে ঘরে। একাধারে জমিদারনন্দন, কবি, অভিনয়শিল্পী, গদ্যকার, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার — একই অঙ্গে তার এত রূপ যে, বাঙালি বিভোর হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে ইংরেজ বাংলা ভেঙে দিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী গণজাগরণের ঢেউ উঠল। ফলাফলে সংগঠিত হয় স্বদেশি আন্দোলন। ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্য উৎপাদন ছিল এ আন্দোলনের অন্যতম দাবি। সাবান, লবণ, চিনি, তাঁত বস্ত্র, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরির স্বদেশি কারখানা গড়ে উঠতে থাকল। ফলে ভারতবাসী পেলেন জবাকুসুম তেল, এশিয়ান পেইন্টস, টাটা স্টিল, ল্যাকমের মতো ব্র্যান্ড। রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। স্বদেশি পণ্য প্রচারে নিজের ছবি, বাণী ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন সময়ের মহাতারকা।
বিজ্ঞাপনে রবির আলো
কবির মডেল হওয়া শুরু সেই ১৮৮৯ সালে। আর তার ধারাবাহিকতা ছিল ১৯৪১ সালে তার মৃত্যুর পরেও। বিশ্বভারতীর জন্য তহবিল জোগাড়ের উদ্দেশ্যও ছিল তার বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়ার কারণ। গোদরেজ সাবান, বোর্নভিটা, কুন্তলীন কেশ তেল, রেডিয়ম ক্রিম, বাটা জুতো, ডোয়ারকিন হারমোনিয়ম, সমবায় বিমা, কটন মিল, ফটো স্টুডিও, ঘি, দই, কাজল-কালি, দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্স, ভারতীয় রেলসহ আরও বহু কিছুর — সবমিলিয়ে প্রায় ১০০টি বিজ্ঞাপনে পাওয়া গিয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। সেগুলোর বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, প্রবাসী, তত্ত্ববোধিনী, ক্যালকাটা গেজেটে; বিদেশের দ্য গার্ডিয়ান আর দ্য গ্লোবের মতো পত্রিকায়ও।
'সুলেখা কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো' — বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ক্রমে সুলেখা কালির জনপ্রিয়তা এত বেড়ে যায় যে, বিদেশি কলমের কালি বাজার হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে মাসে ১০ লাখ বোতল বিক্রি হচ্ছিল সুলেখা কালি। এর জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত মহাত্মা গান্ধিও। তিনি চিঠি ও আবেদনপত্র লেখার জন্য দেশি পদ্ধতিতে তৈরি কালি খুঁজছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্তকে তিনি তার প্রয়োজনের কথা লিখে জানান। সতীশের কাছে এ কথা জানতে পেরে ননীগোপাল ও শঙ্করাচার্য মৈত্র নামক দুই ভাই মিলে কালি তৈরির উদ্যোগ নেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে ১৯৩৪ সালে যাত্রা শুরু করে সুলেখা কালি।
ডা. উশেচন্দ্র রায়ের পাগলের মহৌষধের বিজ্ঞাপন ছাপা হতো রবীন্দ্রনাথের সনদসমেত, যাতে কবি লিখেছিলেন: 'আমি এর উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি।' বোর্নভিটা পানীয়ের সনদ দিয়েছিলেন এই বলে যে, 'বোর্ন-ভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি।'
কবি নজরুলও ছন্দে-ছন্দে বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন কোয়ারকিন অ্যান্ড সন্স কোম্পানির হারমোনিয়মের। বাহাদুর কোম্পানির এক বিজ্ঞাপনে নজরুল লিখেছিলেন: 'মিষ্টি বাহা বাহা সুর চান তো, কিনুন 'বাহাদুর'।
নায়িকা, গায়িকা মানে সেলিব্রেটি দিয়ে পণ্যের প্রচার শুরু হয় ১৮৯১ সালে। লিটল ল্যাংট্রি নামক এক ব্রিটিশ হোটেল গায়িকা সেবার পিয়ার্স সাবানের মডেল হয়েছিলেন। লন্ডনের টমাস জে ব্যারাটের মাথা থেকে বেরিয়েছিল বুদ্ধিটি। সেকালে এমন বুদ্ধিকে উদ্ভাবনার মর্যাদা দেওয়া চলে। আর সে কারণেই ব্যারাটকে লোকে আধুনিক বিজ্ঞাপনের জনক বলে মানে।
হিকির গেজেটে বিজ্ঞাপন
ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট। প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮০ সালে। সম্পাদক অগাস্টাস হিকি দুইবছর পর্যন্ত পত্রিকাটি টানতে পেরেছিলেন। মাঝে ঘটে যায় অনকে ঘটনা, অঘটনও কম ঘটেনি। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে পর্যন্ত তুলোধুনা করেছেন হিকি। জেরে জেলও খেটেছেন। তার পত্রিকাটি ভরা থাকত বিজ্ঞাপনে, খবর থাকত বিজ্ঞাপনের ফাঁকফোকরে। কী ধরনের বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত সে আমলে?
এখনকার সঙ্গে তখনকার দুস্তর ফারাক। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি পাওয়ার পর ইংরেজরা রাজ্যপাট জাঁকিয়ে বসতে থাকে। ভাগ্যান্বেষি ইংরেজ মুচি, ধোপা, নাপিত, ফেরিওয়ালারাও কলকাতায় আস্তানা গাড়ে। তাদেরই বিজ্ঞাপন থাকত বেঙ্গল গেজেটে। গৃহভৃত্য চেয়ে, পুরোনো আসবাবপত্র বিক্রি করতে চেয়ে কিংবা কর্মপ্রার্থী হয়ে তখন বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো।
হিকির গেজেট বন্ধ হয়ে গেলেও বিজ্ঞাপন তো চালু ছিল। হেস্টিংসের সমর্থনপুষ্ট কাগজ ইন্ডিয়া গেজেটেও সেগুলো প্রকাশিত হতো। আরও ছিল ক্যালকাটা গেজেট। ১৭৮৪ সালের একটি বিজ্ঞাপন ছিল এমন: মেসার্স উইলিয়াম এন্ডলি একটি ঘোড়া বিক্রি করবেন ৩০০ সিক্কা টাকায়। ১৮০১ সালে শ্রীরামপুরের জনৈক আব্রাহাম একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে, তার স্ত্রী কাউকে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। তিনি যদি কোথাও কোনো ধারদেনা করেন, তার দায় আব্রাহামের নয়।
বাইসাইকলে, টুথপেস্ট, টেবিল সল্ট
ভারতবর্ষে সেই যে বিজ্ঞাপনের জগত উন্মুক্ত হয়েছিল, তারপর থেকে তার ক্রমবিকাশ ঘটেই চলেছিল। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি কিছু আগে বিজ্ঞাপনে যুক্ত হয় পণ্যের ছবি যেমন হাত ঘড়ি, দেয়াল ঘড়ি, সোনা ও রুপার গহনা, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র, পারফিউম, হেয়ার ক্রিম ও তেল, শিকারের সরঞ্জাম, বাইসাইকেল, গ্রামোফোন ইত্যাদি। ওষুধ, কেশরঞ্জন তেল, ফ্লেক্স বুটপালিশ, কেরোসিন তেলে চালানো পাখা ইত্যাদি তখনকার বিজ্ঞাপনের বিষয় হয়ে ওঠে। শেষের দুই দশকে প্যাকেটজাত পণ্য যুক্ত হয়; যেমন বিস্কুট, সাবান ইত্যাদি। পিয়ার্স সাবান, কোকোয়া ক্যাডবেরি, নেসলে চকলেট, ব্রুক বন্ড চা ইত্যাদি ব্র্যান্ড তখন জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত ছিল।
এ শতকের শেষ দশকে জাতীয়তাবাদী সচেতনতা বৃদ্ধির ও গণজাগরণের ছাপ লক্ষ্য করা যায় বিজ্ঞাপনে। ব্রিটিশ বিরোধিতা এবং বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বানও পাওয়া যেত এসব বিজ্ঞাপনে। সেসঙ্গে নতুন সেবা, পণ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয়ের উপায়ও হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপন। চা, টেবিল সল্ট, টুথপেস্ট, ফটোগ্রাফি, হোটেলের কথা জানা যায় বিজ্ঞাপন মারফত।
বিজ্ঞাপনের রকমফের
বিজ্ঞাপনের আঙ্গিক ও বিন্যাস বদলে যেতে থাকে মূলত বিশ শতকের শুরু থেকে। শ্রেণিবদ্ধ (ক্লাসিফায়ডে) ও সুবিন্যস্ত (ডিসপ্লে) দুই ধরনের বিজ্ঞাপন আলাদা করে বোঝার সুযোগ হয় এ সময়। শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলো সাধারণত অলংকার, চাকচিক্য ও ছবি ছাড়া কেবল ভাষা দিয়ে প্রকাশিত হয়। এগুলো এক কলামে শ্রেণিবদ্ধভাবে পরপর সাজানো হয়। আকারে হয় সংক্ষিপ্ত, প্রয়োজনীয় কথা সারা হয় অল্প শব্দে।
অন্যদিকে সুবিন্যস্ত বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হয় সংবাদপত্রের অনেকটা জায়গাজুড়ে। পুরো পাতা জুড়েও এমন বিজ্ঞাপন ছাপা হতে দেখা যায়। এগুলোর টেক্সট হয় বৈচিত্র্যময়, ডিজাইন হয় আকর্ষণীয়। যুক্ত থাকে মডেলের ছবি, কোম্পানির লোগো ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ভদ্রেশু রীটা পিএইচডি করেছেন বিজ্ঞাপনশিল্প নিয়ে। তার গবেষণার শিরোনাম: বাংলাদেশের সংবাদপত্রভিত্তিক বিজ্ঞাপনশিল্প এবং এর নান্দনিকতা (১৯৭২-২০০০)। ওই গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সুবিন্যস্ত বিজ্ঞাপনের টেক্সটের মধ্যে থাকে শিরোনাম, স্লোগান, বডি টেক্সট ও কোম্পানি পরিচিতি। এর মধ্যে শিরোনামে পণ্য বা সেবার ধরনটি বলা হয়, স্লোগানে জানানো হয় পণ্যের বিশেষ গুণের কথা, বডি টেক্সটে পণ্যের গুণমান বিস্তারিত বলা হয় গল্পের আকারে; উপদেশ বা পরামর্শের মতো করেও। অনেক সময় ব্যবহৃত হয় উপমা বা রূপক। ছবির মধ্যে থাকে ফটোগ্রাফ, হাতে আঁকা ছবি বা অলংকরণ। ভোক্তার কাছে এর আবেদন গভীর হওয়ার কারণে এটি বিজ্ঞাপনের মূল উপাদান হয়ে ওঠে প্রায়শ।
প্রথম বিজ্ঞাপন সংস্থা
ভারতবর্ষে প্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থা বি. দত্তরাম অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় বোম্বেতে (এখনকার মুম্বাই) ১৯০৫ সালে। তারপর মাদ্রাজে মডার্ন পাবলিসিটি কোম্পানি, কলকাতায় দ্য ক্যালকাটা পাবলিসিটি, তিরুচিরাপল্লিতে ওরিয়েন্টাল অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদেশি মালিকানাধীন বিজ্ঞাপনী সংস্থাও ছিল কিছু, যেমন অ্যালায়েন্স অ্যাডভার্টাইজিং, ডিজে কিমার, লিনটাস ইন্ডিয়া লি., জে. ওয়াল্টার থমসন ইত্যাদি।
স্বদেশি আন্দোলনের ফলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ বিজ্ঞাপনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ১৯০৭ সালে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার লাইনোটাইপ মেশিন স্থাপনও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এর ফলে সংবাদপত্রের মুদ্রণ সস্তা হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমলে বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিস ছিল কলকাতায়। এতে আর্ট স্কুলের ছাত্ররা তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পান। তাদের অন্যতম ছিলেন সত্যজিৎ রায়, মাখন দত্ত, অন্নদা মুন্সি, রণেন দত্ত, আইবি দাশগুপ্ত, শিবরাম দাশ প্রমুখ। তখন অন্নদা মুন্সির রেল পরিবহন বিষয়ক লর্ড গৌরাঙ্গ ট্রাভেলস এবং সত্যজিৎ রায়ের পরিকল্পনায় মাখন দত্ত চিত্রিত ইন্ডিয়ান টি বোর্ডের বিজ্ঞাপন নজর কেড়েছিল। আর রণেন দত্তের জবাকুসুম ও শালিমার তেলের বিজ্ঞাপন তো মাইলফলক হয়ে আছে।
তারকাদের বিজ্ঞাপন
বিশ শতকের বিজ্ঞাপনে আলোকচিত্র হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রথম রঙিন বিজ্ঞাপন ছাপা হয় ১৯১০ সালে। ওই শতকের ত্রিশের দশকে স্থানীয় কমদামী পণ্য ও ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে ইলাস্ট্রেশনের চেয়ে টেক্সটের পরিমাণ থাকত বেশি। অন্যদিকে নামী ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন ছিল রঙিন ও বিশদ ইলাস্ট্রেশনযুক্ত। ত্রিশের দশকেই বিজ্ঞাপনকে আকর্ষণীয় করতে নতুন কৌশল যুক্ত হয়। মডেল হিসেবে আবির্ভুত হন অভিনয়শিল্পীরা; যার শুরু ১৯২৯ সালে। লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী লিলা চিটনিসকে দেখা যায় মডেল হতে। এরপর থেকে এ কৌশল এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, ফি বছরই এর নজির দেখা যায়।
১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের দেবদাস মুক্তি পাওয়ার পর সুচিত্রা সেনের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপনদাতা খোলাখুলি বলল, শুভ্রতা ও বিশুদ্ধতার জন্য সুচিত্রা সেন পছন্দ করেন লাক্স টয়লেট সাবান। ১৯৫৬ সালে তিব্বত স্নোর একটি বিজ্ঞাপনে চিত্রতারকা সন্তোষ কুমার বললেন, ক্ষৌরকার্য্যের পর তিব্বত স্নো ব্যবহার আরামদায়ক। ১৯৬৫ সালে কসকো কোল্ড ক্রীম সোপের এক বিজ্ঞাপনে দস্তখত দিয়ে রূপসম্রাজ্ঞী রানি বলেন: "লাবণ্যময় ও মসৃন ত্বকের জন্য 'কসকো কোল্ড ক্রীম' সাবানই একমাত্র উপযুক্ত সাবান যা পূর্বে আমি কখনো ব্যবহার করিনি।"
চিত্রনায়িকা নূতনকে নিয়ে প্রথম বাংলাদেশে লাক্সের বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে এশিয়াটিক, ১৯৮৩ সালে। নব্বইয়ের দশকে চম্পা হয়েছিলেন এ সাবানের মডেল। আজ অবধি এ ধারা অব্যাহত এবং সম্ভবত আরও অনেকদিন থাকবে।
বিজ্ঞাপনের পাকিস্তান আমল
পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প কারখানার বিকাশ না ঘটায় বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তাও তেমন প্রকট ছিল না। মাঝে-সাঝে শুধু জানান দেওয়ার তাগিদে দু-চারটি পণ্যের বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। তখন বিজ্ঞাপনের সকল প্রচার পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই করা হতো। জে. ওয়ালটার থমসন, লিনটাজ অ্যাডভার্টাইজিংয়ের মতো কিছু বিদেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থা শাখা অফিস খুলেছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানে। এসবের মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানে গ্রীনওয়েজ পাবলিসিটি, স্টার অ্যাডভার্টাইজিং, নবাঙ্কুর পাবলিসিটি নামের যে গুটিকয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা গড়ে উঠেছিল, তারা মূলত পত্র-পত্রিকার প্রেস লে আউট, প্রসাধন পণ্যের প্যাকেট ডিজাইন ও চলচ্চিত্রের প্রচারণার কাজ করত। তাই বিজ্ঞাপনশিল্পে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটতে পারেনি।
১৯৬৬ সালে ঢাকায় প্রথম আধুনিক একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইস্ট এশিয়াটিক গড়ে ওঠে। নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের তখন করাচীতে কাজ করতেন একটি ব্রিটিশ এজেন্সিতে। তাকে ইস্ট এশিয়াটিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে ঢাকায় আনা হয়। পাশাপাশি মেজবাউদ্দিন, আব্দুল হাই, টেলি সামাদ, মোস্তফার মতো আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা কয়েকজনকে করাচি থেকে প্রশিক্ষণ করিয়ে এ সংস্থায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ইস্ট এশিয়াটিকের মাধ্যমেই বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞাপন শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। তারপর ১৯৬৮ সালে রেজা আলী বিটপী অ্যাডভার্টাইজিং লি. এবং এনায়েত করিম ইন্টারস্প্যান প্রতিষ্ঠা করেন।
তখন শিল্পীদের মধ্যে বিজ্ঞাপনশিল্পে যুক্ত ছিলেন কামরুল হাসান, বিজন চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী। জয়নুল আবেদীনও কিছু কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেছেন বলে শোনা যায়। সেসময় ঢাকা প্রেসক্লাবে নানাদেশের পত্র-পত্রিকা ও বইয়ের কপি পাওয়া যেত। ডিজাইনারেরা সেগুলোর বিদেশি বিজ্ঞাপন থেকে আইডিয়া নিতেন। বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনেই স্লোগান ব্যবহৃত হতো। পণ্যের গুণমান বিষয়ে এক-দু লাইনের হতো স্লোগানগুলো। অনেকক্ষেত্রে এগুলো হতো উপদেশ, নীচে আলাদাভাবে পণ্যের গুণ প্রকাশ করা হতো। সব বিজ্ঞাপনেই মডেলের ছবি সংযুক্ত থাকত।
তবে ১৯৬৬ সালের পর থেকে বিজ্ঞাপন অনেক বেশি নান্দনিক ও চাতুর্যপূর্ণ হয়ে উঠল। মডেল, স্লোগান, রং ও রেখার ব্যবহারে ভারসাম্য দেখা যেতে থাকল। প্রসাধন সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি, যানবাহন, বিদেশি ওষুধ, বিস্কুট, শিশুখাদ্য, পাউরুটির বিজ্ঞাপন দেখা যেত বেশি। পাকিস্তান পর্বের বিভিন্ন সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গ স্পর্শ করলেও তার প্রকাশ বিজ্ঞাপনে দেখা যায়নি। এর কারণ বিজ্ঞাপনশিল্প মূলত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো।
দেশ স্বাধীনের পর
স্বাধীনতার পর দেশ পুর্নর্গঠিত হতে থাকলে নতুন কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থাও গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ছিল অ্যাডকম, নেপচুন, ইউনিট্রেন্ড, ম্যাডোনা, ইস্টল্যান্ড, কারুকৃৎ ইত্যাদি। সত্তরের দশকে বিজ্ঞাপনের পরিসর ছিল সীমিত, কারণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল কম আর বেশিরভাগই জাতীয়করণ করা হয়েছিল। উল্লেখ করার মতো প্রতিযোগিতা ছিল কেবল ইউনিলিভারের সঙ্গে কোহিনূর কেমিক্যালসের। জনপ্রিয় হয়েছিল লালবাগ কেমিক্যালসের গন্ধরাজ কেশতেলের মতো হাঁসমার্কা প্রসাধনসামগ্রীও। নতুন দেশ পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়ে অবশ্য ব্যাংক বা বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্দীপনামূলক বিজ্ঞাপন দিত।
তবে আশির দশকে ব্যবসার নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং শিল্পোদ্যোগ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তাই এ সময় বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে আরও কিছু নতুন বিজ্ঞাপনী সংস্থা যেমন রূপ কমিউনিকেশন, আফজাল হোসেনের মাত্রা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দশকের শেষদিকে দেশে কম্পিউটার এলে বিজ্ঞাপনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়।
নব্বই দশকে বাংলাদেশ বেসরকারিকরণে আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়ে এবং বাজার থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হতে থাকে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশ পরিষেবাভিত্তিক (ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি) অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। প্রযুক্তিগতভাবেও বিজ্ঞাপনশিল্প বিশেষ অগ্রগতি লাভ করে। গ্রে কমিউনিকেশন, স্টেপ মিডিয়া, প্রতিশব্দ, মিডিয়াকম, উইন্ডমিল নামে নতুন নতুন বিজ্ঞাপনী সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এ দশকেরই শেষদিকে আন্তর্জাতিক কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থা বাংলাদেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে জোট বাঁধে। ফলে বিজ্ঞাপনশিল্প নতুন পথে অগ্রসর হয়। এর প্রকাশ মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি টিভি বিজ্ঞাপনেও দেখা যায়। ফিলিপস বাতির বিজ্ঞাপন তার স্মরণীয় নমুনা হয়ে রয়েছে। 'মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস' স্লোগানটি আজও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
ফিলিপস বাতির বিজ্ঞাপনটি এমন সময়ে (আশির শেষে নব্বইয়ের শুরুতে) তৈরি ও প্রচারিত হয়েছিল যখন গ্রামাঞ্চলে কেরোসিনের কুপি-হারিকেনের বদলে ফিলামেন্ট বাল্বের ব্যবহার শুরু হয়েছিল মাত্র। তাই গ্রামের মানুষদের কাছে বাল্বের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা হয়েছিল। এটি নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিল বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইউনিট্রেন্ড লি.। যুৎসই একটি স্লোগান খুঁজে পেতে তারা খনার বচনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। খনা বলে গিয়েছিলেন: 'মাছের রাজা রুই, শাকের মজা পুঁই।' বচনটি এদিক-ওদিক করে নিয়ে তৈরি হয়েছিল কালজয়ী ওই স্লোগান।
সংলাপটি প্রমাণ করে, সুন্দর মডেল বা সুরেলা সংগীত কোনো বিজ্ঞাপনকে তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা দিলেও সংলাপই আদতে টিকে থাকে যুগের পর যুগ। এমনও দেখা যায় পণ্যটি আর বাজারে নেই, কিন্তু সংলাপ ফিরছে মুখে মুখে। তেমন আরও কয়েকটি সংলাপ উল্লেখ করলেই পাঠক ফিরে যাবেন অতীতে, খুঁড়তে বসবেন স্মৃতি।
আজও মনে পড়ে
'ঘরের কথা পরে জানল কেমনে' সংলাপটি আশীষ কুমার লোহকে মনে করিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। এখন তিনি আর ইহলোকে নেই, বউরানি প্রিন্ট শাড়ির কথাও শোনা যায় না আর সেভাবে, কিন্তু সংলাপটি রয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনে আশীষ কুমার লোহ মনভোলা এক মানুষ। স্ত্রী বারবার মনে করিয়ে দেওয়া স্বত্ত্বেও শাড়ি আনতে তিনি ভুলে যান। তখন বুদ্ধি করে স্বামীর কোটের পেছনে শাড়ি আনার কথা কাগজে লিখে লাগিয়ে দিলেন স্ত্রী। এরপর তিনি যেখানেই যান, রাস্তায় বা অফিসে, সবাই তাকে মনে করিয়ে দেয় বউরানি শাড়ি কিনে ফেরার কথা। আর তাতেই আশীষ কুমার লোহ অবাক হয়ে ভাবেন, ঘরের কথা পরে জানল কেমনে।
'সেই ১৯৫৩ সাল থেকে' — রক্সি পেইন্টের বিজ্ঞাপনের এ সংলাপ দর্শকের মনে এতটাই গেঁথে গিয়েছিল যে, পুরোনো সময়কে নির্দেশ করতে গিয়ে বলে ফেলত, সেই ১৯৫৩ সাল থেকে। আরও একটি দারুণ চমকে দেওয়া সংলাপ ছিল: 'ছিল্লা কাইট্টা লবণ লাগাইয়া দিমু।' মোল্লা সল্টের এ বিজ্ঞাপনের নির্মাতাদল অত্যন্ত কৌশলী। তারা সংঘর্ষ বাধিয়ে ভোক্তাকে আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এতে দেখা যায় দুই ট্রেন যাত্রী জানালা খোলা থাকবে কি বন্ধ থাকবে তা নিয়ে বচসায় লিপ্ত। তখনই সংলাপটি ভেসে আসে, 'ছিল্লা কাইট্টা লবণ লাগাইয়া দিমু'। যাত্রী দুজনই আঁতকে ওঠেন, তাকিয়ে দেখেন, মোল্লা সল্ট মাখিয়ে একজন শসা বিক্রি করছে।
শুধু বাণিজ্যিক নয়, জনসচেতনতা বাড়ানোর বিজ্ঞাপনের সংলাপও জনপ্রিয় হয়েছিল কিছু। সেগুলোর বেশিরভাগ নির্মাণ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। 'এই সব দিনরাত্রি'র কয়েকজন অভিনেতা নিয়ে খাবার স্যালাইনের যে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করেছিলেন, তার 'তিন আঙুলের এক চিমটি লবণ, ঘুটা ঘুটা' সংলাপটিও মুখে মুখে ফিরেছে।
কারেন্ট জাল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত সংলাপ 'ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকা, কারেন্ট জালে আটকা'ও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যে বার্তা দিতে চাইছে বিজ্ঞাপনটি, সংলাপটি তার বিপরীতধর্মী। তবে শেষে গিয়ে নির্দিষ্ট বার্তাটি আরও শক্তভাবে প্রকাশ পায় এবং বিজ্ঞাপনদাতার উদ্দেশ্য অধিক সাফল্যে পৌঁছায়। বিপরীতধর্মী আরেকটি চমকানো বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় নাবিস্কো বিস্কুটের। তাতে চন্দ্র অভিযানের নায়কদের ছবি ছাপিয়ে বড় বড় অক্ষরে বলা হয়: আমরা ব্যর্থ হয়েছি আপনাদের চন্দ্রাভিযানের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে। তবে এ গৌরব অর্জনে আমাদের খুব দেরি নেই বোধহয়।
সেরা, তাজা, বিশুদ্ধ
ভদ্রেশু রীটা বলছিলেন, 'বাণিজ্যিক বা সচেতনতামূলক যেকোনো বিজ্ঞাপনেরই লক্ষ্য থাকে ভোক্তাদের প্ররোচিত করা। এ প্ররোচনা হয়ে থাকে দুইভাবে — সরাসরি এবং গুপ্ত। প্রথমটিতে কোনো রাখঢাক ছাড়াই পণ্যটি কিনতে বলা হয়। গুপ্ত প্ররোচনায় সরাসরি কোনো আহ্বান থাকে না, তবে প্রচ্ছন্ন ইশারা থাকে যা অনেকক্ষেত্রেই অধিক ফল দেয়। যেমন, লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে সাবানটি কেনার কথা সরাসরি কোথাও বলা হয়নি কিন্তু বোঝানো হয়েছে সৌন্দর্য লাক্সে লুকায়িত আর তা চাইলে এটিই ব্যবহার করতে হবে। স্টার সিগারেটের বিজ্ঞাপনেও দেখা যায় তৃপ্তি শব্দটিকে মুখ্য করে তুলে বলা হয়: স্টার কেন খাই, পয়লা নম্বর তৃপ্তি পাই। অর্থ দাঁড়াল, তৃপ্তি পেতে চাইলে স্টার খাওয়ার বিকল্প নেই।'
স্টার সিগারেটের এ সংলাপটি অনেক বিশিষ্টজনের মুখ দিয়ে বলিয়েছে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানটি। তারকাদের ছবি ব্যবহার করে এ পণ্যটির আরেকটি স্লোগানও জনপ্রিয় হয়েছিল: তাদেরই মানায়, জীবনে যারা বহুদূর যায়। ক্যাপস্টান সিগারেটের বিজ্ঞাপনে ভাষার ব্যবহার অবশ্য আরেকটু সরাসরি। সেখানে অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের (নবাব সিরাজউদ্দৌলা হিসেবে খ্যাত) ছবি ব্যবহার করে বলা হয়েছে, এটি তার প্রিয় সিগারেট। বিজ্ঞাপনদাতা এখানে বোঝাতে চাইছেন, যদি আনোয়ার হোসেনের প্রিয় হয় তবে আপনারও কেন প্রিয় হবে না?
ইংরেজ ভাষাবিদ জিওফ্রে লিচের বিশ্লেষণ থেকে ভদ্রেশু রীটা সংলাপের আরেকটি ধরনের কথা উল্লেখ করেছেন যেটি বিক্রয়শক্তিকে (সেলিং পাওয়ার) প্রাধান্য দেয়। ওইসব বিজ্ঞাপনের ভাষায় নতুন, প্রকৃত, তাজা, সেরা, বিশুদ্ধ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। যেমন নতুন যুগের নতুন লাইফবয় বা নাবিস্কো সুপার মানেই সেরা বিস্কুট। জিওফ্রে লিচ বিজ্ঞাপনের ভাষার ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্যতা বা মেমোরেবিলিটির বিষয়টিও তুলে এনেছেন। এসব বিজ্ঞাপনে ছন্দ বা কবিতা বা বহুল প্রচলিত উপমা ব্যবহৃত হয়। যেমন, তার মেঘের মতো ঘন কালো চুল।
গবেষক রীটা বাংলাদেশ আমলের তিন দশকের (সত্তর, আশি ও নব্বই) বিজ্ঞাপনগুলোকে ধরন অনুযায়ী ৭ ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে প্রসাধন সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র সামগ্রী, যানবাহন, চিকিৎসা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি, এবং জনসেবা ও জনসচেতনতা।
পত্র-পত্রিকায় সত্তরের দশকে প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপনই বেশি প্রচারিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে নীহারিকা, প্রিন্সেস বা জলি ক্রিম, ম্যানোলা স্নো, রওগনে শেফা, নিদ্রাকুসুম বা চন্দন তেল। ট্যালকম পাউডারের মধ্যে ম্যানোলা, রিতা, লাবনী, লোটাস উল্লেখযোগ্য। গোসলের সাবান ছিল লাইফবয়, জান-এ-সাবা, হানিডিউ এবং ফ্লোরা। কাপড় কাচার সাবান ছিল হুইল, শুভ্রা ইত্যাদি।
নব্বইয়ের দশকে চুলের রং পাওয়া গেল ঘোড়া, মারলেন, সিনড্রেলা। টুথ পাউডার যোগ হলো সাধনা দশন, দন্তনা। টুথপেস্ট পাওয়া গেল বেশ কিছু যেমন পেপস, স্পার্কল, কিউট, ক্লোজ আপ। স্পেনসার, ফ্রেশলাইম শেভ লোশন, সানসিল্ক শ্যাম্পু আর ফ্লোরা নেইল পলিশ। নব্বই দশকে চুলের তেলে যোগ হলো এপি। ক্রিম আনল মিল্লাত, মেরিল, লরিয়েল। মিল্লাত আরও আনল ঘামাচি পাউডার। টুথপেস্টে নতুন পাওয়া গেল হোয়াইট প্লাস, মেরিলকে।
সত্তরের দশকে খাদ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপন বেশি খুঁজে পাননি ড. ভদ্রেশু রীটা। পানীয় বলতে চা, কোমল পানীয় ফান্টা। বিস্কুট পেয়েছেন নাবিস্কো আর মিষ্টির মধ্যে আলাউদ্দিন। আশির দশকে বেশি পাওয়া গেল পানীয়ের বিজ্ঞাপন; যেমন গ্লাক্সোজ ডি, ফাইভ স্টার, শরবতে এপি, পেপসি, স্কোয়াশ, দেল আফজা শরবত, সেভেন আপ ইত্যাদি। গুড়া দুধ ছিল রেড কাউ, অ্যাংকর, সেফটি, ডানো ইত্যাদি। কনডেনসড মিল্ক-এ ওমেলা, ওলকর। নব্বই দশকে কোমল পানীয়ে যোগ হয়েছিল ভার্জিন। জুস পাওয়া গেল স্লাইস, হলস্টেন, প্রাণ। পানি এলো মাম। ম্যাগী নুডুলস এসেছিল ওই দশকেই।
জামবাক থেকে ওয়াটার পিউরিফায়ার
বস্ত্র সামগ্রীর মধ্যে সত্তরের দশকে মালা শাড়ি, জিপসী গেঞ্জি, সাঙ্গু লুঙ্গি, লোটাস মোজা ইত্যাদির বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। জুতা ও স্যান্ডেলের বিজ্ঞাপন দেখা গেল বাটা, ট্রপিকানা, কেটেড ও পিভিসির। আশির দশকে পাকিজা, রিমঝিম, জিয়া প্রিন্ট, রুমা নামের অনেকগুলো শাড়ির ব্র্যান্ড পাওয়া গেল। জামা-প্যান্টের বিজ্ঞাপন দিলো এলিগ্যান্স, মিলান, পিয়ারসন্স, সায়হাম। নব্বইয়ের দশকে পাওয়া গেল এপেক্স ও পেগাসাসকে।
চিকিৎসা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মধ্যে সত্তর দশকে জ্বালাপোড়া ও ব্যথানিরোধক ওষুধ পাওয়া গেল বেশি যেমন জামবাক, নিক্স বাম, গ্যাকোরাব সিরাপ, ফ্লাজিল ইত্যাদি। সতেজকরণ টনিকের মধ্যে ছিল মৃতসঞ্জীবনী। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ছিল লিনডিয়ল, মায়া, ওভোস্ট্যাট। রাজা কনডমের বিজ্ঞাপনও দেখা গেছে এ দশকে। আশির দশকে কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়ার ওষুধ এলোস্টোনিয়া সিরাপের বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়। মাথায় চুল গজানোর ওষুধ রেডলের বিজ্ঞাপনও দেখা গেল তখন। নব্বইয়ের দশকে অহরহ দেখা যেদ ওরস্যালাইনের বিজ্ঞাপন।
সত্তরের দশকে বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতির মধ্যে তোশিবা টিভি, হাবিব ফ্যান, কেমি ঘড়ি, সাকসেস সেলাই মেশিন, অপটিমা মুনির টাইপরাইটার, রিগ্যাল ম্যান্টেল হ্যাজাক বাতি, ইয়ানমার ডিজেল পাম্প, লিংকস সুইচ, সনিক ব্যাটারির বিজ্ঞাপন ছিল। আশির দশকে যোগ হলো ফিলিপস, সিটিজেন, নিক্কন, তানিন, ন্যাশনাল প্যানাসনিক, প্যানাভিশন টিভি। সিঙ্গার সেলাই মেশিনের বিজ্ঞাপনও দেখা গেল। প্রচারিত হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের রেডিও বিজ্ঞাপনও যেমন ফিলিপস ১ ও ৩ ব্যান্ড, বেঙ্গল ট্রানজিস্টর, গোল্ডেন স্টার ১ ব্যান্ড ও পকেট রেডিও। বৈদ্যুতিক বাতির মধ্যে দেখা গেল কাশেম ল্যাম্প, সিঙ্গার বাল্ব, ফিলিপস বাল্বের বিজ্ঞাপন। নব্বইয়ের দশকে যোগ হয়েছিল সিঙ্গার, এলজি বাটারফ্লাই টুইনওয়ান, স্যামসাং ওভেন ও ওয়াশিংমেশিন, ক্যানন, ইপসন প্রিন্টার, ল্যানিয়ার ফ্যাক্স মেশিন ও ফটোকপিয়ার, পানির ফিল্টার ওয়াটার পিউরিফায়ার।
সময় যত এগুলো পণ্যের বাজার তত বড় হলো। বিজ্ঞাপনেও এলো বৈচিত্র্য ও সৃজনশীলতা। আশির দশকে অডিও বিজ্ঞাপনে জোয়ার এলো যার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল নব্বইয়ের দশকেও। এর কারিগর ছিল ক্রীড়া উন্নয়ন বোর্ড। তাদের লটারির বিজ্ঞাপন বাজত শহরের প্রায় সব জনাকীর্ণ জায়গা যেমন গুলিস্তান, নীলক্ষেত বা ফার্মগেটে। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের 'যদি লাইগা যায়' বাক্যে মুখরিত ছিল শহর আর গ্রামও। লটারি বিক্রির গাড়ির সামনে লাইন পড়ে যেত। এখন বিজ্ঞাপন তার মোহিনীশক্তিকে সম্মোহনী শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে, তার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে বেশি জায়গাজুড়ে। মেট্রোরেলের কামরায়, শপিং মলের লিফটে পর্যন্ত বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের পৃথিবীতে বিজ্ঞাপন এমন এক মহামন্ত্র যাতে অবশ হয় পা থেকে মাথা সবটুকু।