ফিরে আসার ফিকে আশা জিইয়ে রেখে ১ দশক পর বন্ধ হয়ে গেল দেশের পপ কালচারের ‘তীর্থস্থান’ নক
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের উত্থান ঘটতে শুরু করে ২০০৫ সালের পর থেকে। বিশ্বের সঙ্গে সাধারণ জনগণের মেলবন্ধনের একটি পথ খুলে যায় ইন্টারনেট আসার পর। তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটের দুনিয়া আবিষ্কার করার পর থেকে তাদের বিনোদনের খোরাকে একটি বড় পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন দেশের পপুলার কালচারের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে সবাই।
পপুলার বা পপ কালচার তথা জনপ্রিয় সংস্কৃতি হলো কোনো সমাজের নির্দিষ্ট কোনো সময়ের প্রাসঙ্গিক সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। পশ্চিমা বিশ্বে পপ কালচার বলতে তরুণ প্রজন্মের প্রিয় গান, সিনেমা, নাটক, কমিক, ভিডিও গেমস ইত্যাদিকে বোঝায়। হ্যারি পটার, গেম অব থ্রোনস, মার্ভেল বা ডিসি'র যেকোনো সুপারহিরো কমিক কিংবা সিনেমা, জাপানিজ অ্যানিমে, কোরিয়ান ড্রামা — সবই পপ কালচারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশে ক্যাবল নেটওয়ার্ক আর ইন্টারনেটের কল্যাণে পপ কালচার দ্রুতই প্রবেশ করতে শুরু করে। তরুণেরা মেতে ওঠেন পপ কালচারের রঙিন দুনিয়ায়। পপ কালচারের বিভিন্ন স্যুভেনির (স্মারক) ও মার্চেন্ডাইজ কেনাবেচার একটি বাজার গড়ে উঠেছিল বিশ্বব্যাপী। পপ কালচারের ভক্তরা নিজেদের পছন্দের সিনেমা, কমিক ইত্যাদির বিভিন চরিত্রের স্যুভেনির সংগ্রহ করেন। এসবের মধ্যে স্টিকার, পোস্টার, অ্যাকশন ফিগার, পোশাক, চাবির রিং, ব্যাগ, মানিব্যাগ, ডায়েরি ইত্যাদি সবচেয়ে জনপ্রিয়।
বাংলাদেশে এমন বিভিন্ন পপ কালচারের স্যুভেনিরের একটি দোকান ছিল নক (Knock)। ঢাকার শুক্রাবাদের প্রধান সড়কে মেট্রো শপিং মলের ঠিক বিপরীত পাশেই চকচকে হলুদ রঙের একটি ভবনের সঙ্গে ঢাকাবাসীর অনেকেই পরিচিত। এ হলুদ ভবনেই নকের একমাত্র দোকান। ২০১৪ সালে মেহেদি হাসানের হাত ধরে নকের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের পপ কালচারের 'তীর্থস্থান' হয়ে উঠেছিল নক। যেকোনো মার্চেন্ডাইজ কেনার জন্য ভক্তদের পছন্দের শীর্ষে সবসময় থাকত নক। দীর্ঘ দশ বছরের পথচলা ২০২৪ সালে শেষ করে তারা। বিভিন্ন কারণে এপ্রিলের ২৭ তারিখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে দোকানটি।
অনলাইন দিয়ে শুরু
২০১৪ সালে মেহেদি হাসান কানাডা থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার পথ বেছে নেন তিনি। তার সঙ্গে যোগ দেন আরও চার বন্ধু। পাঁচ বন্ধু মিলে বছরের ৫ ডিসেম্বর নকের যাত্রা শুরু করেন।
ছোটবেলা থেকেই মেহেদি হাসান পপ কালচারের দারুণ ভক্ত ছিলেন। অ্যানিমে, টিভি সিরিজ, সিনেমা, গেমিং নিয়েই সময় কাটত তার। তাই নক শুরু করার অনেক আগে থেকেই পপ কালচারের বাজার নিয়ে বিশদ ধারণা ছিল তার। কোন জনরার জিনিস কখন বাজারে আনলে বেশি বিক্রি হবে, সেসব ভালো জানতেন মেহেদি।
নকের শুরু হয় ব্যাজ তৈরি করা দিয়ে। ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তরুণদের মাঝে ব্যাগে লাগানোর ব্যাজ ছিল অনেক বেশি জনপ্রিয়। হ্যারি পটার, গেম অব থ্রোনস, ফুটবল, বিভিন্ন ব্যান্ড ইত্যাদি নিয়ে অনন্য সব ব্যাজ তৈরি করে ঢাকার তরুণদের মনে জায়গা করে নেয় নক। ব্যাজের পরে তারা শুরু করে পোস্টার বিক্রি। বিভিন্ন খেলা, গেমিং ও টিভি সিরিজের পোস্টার তখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
'প্রথম দুই বছর নকের কোনো দোকান ছিল না। অনলাইনে ও ফেসবুকে কেনা-বেচা চলত। কিন্তু ক্রেতারা এসব জিনিস হাতে ধরে দেখে, পছন্দ করে কিনতে চাইতেন। এরপর ২০১৬ সালের নভেম্বরে আমরা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নকের শাখা চালু করি জিগাতলায়। পরে তা বন্ধ করে ২০১৮-এর ডিসেম্বরে শুক্রাবাদের দোকানটি নিই। ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা আট বছর চলে নকের শোরুম,' জানান মেহেদি হাসান।
২০১৫ সালে প্রথম চীনে গিয়েছিলেন মেহেদি হাসান। চীনকে বলা হয় পপ কালচার স্যুভেনির ও মার্চেন্ডাইজের স্বর্গরাজ্য। হেন কোনো জিনিস নেই যা দেশটিতে পাওয়া যায় না। নানা জাতের ও মানের পপ কালচার সামগ্রী চীন থেকে আমদানি শুরু করেন মেহেদি হাসান।
নকের আদ্যোপান্ত
নক আসলে কাদের জন্য? মেহেদি হাসান জানান, 'আমরা বাংলাদেশের একদম প্রথম দিকের পপ কালচার মার্চেন্ডাইজ দোকান। পপ কালচার যখন দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে, আমরা তখনই লাইমলাইটে আসি। যারা পপ কালচারের জিনিসগুলোর বেশি ভক্ত, তারাই মূলত তাদের পছন্দের জিনিসের মার্চেন্ডাইজ সংগ্রহে রাখতে চায়। আমরা শুধু কাজ করেছি পপ কালচারের বড় ভক্তদের চাওয়া পূরণ করা নিয়ে।'
প্রথম থেকেই ভালো মানের পণ্যের জন্য পরিচিত ছিল নক। দাম একটু বেশি থাকলেও মান থাকত সবসময় সর্বোচ্চ। ফলে দীর্ঘদিন ধরে দোকানটি পপ কালচার মার্চেন্ডাইজ বাজারে একক আধিপত্য নিয়ে ছিল। ছিল ভক্তদের পছন্দের শীর্ষে।
নকের পণ্যগুলোর দাম গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে ছিল। বেশি বিক্রি হতো মানিব্যাগ, চাবির রিংয়ের মতো স্যুভেনির। এগুলোর দাম পড়ত যথাক্রমে ৮০০ ও ৪০০ টাকার মতো। আবার অ্যাকশন ফিগার ধরনের জিনিসের দাম ছিল দুই হাজার টাকার ওপরে।
নকের কাঙ্ক্ষিত ভোক্তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পণ্যগুলার দাম কি বেশি হয়ে যেত না? মেহেদি হাসান জানান, তাদের কাঙ্ক্ষিত ভোক্তারা ছিল বেশিরভাগই স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা। তাদের জন্য এ দাম একটু বেশি ছিল বটে। 'আমাদের প্রায় সবকিছুই ছিল বাইরে থেকে আমদানি করা। দেশে আমদানি শুল্ক দিয়েও পণ্য ঢুকত। এটা একটা কারণ একটু বেশি দামের।'
তিনি বলেন, অনেক ক্রেতাই এসব পণ্যের এত বড় ভক্ত ছিল যে, দাম নিয়ে তারা মাথা ঘামাত না। 'তাও নক সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সবাই যেন সাধ্যমতো নিজেদের সাধ মেটাতে পারে,' বলেন মেহেদি। অনলাইন থেকে দোকানে আসার পর ঢাকার বাইরের ক্রেতাদের জন্য ভরসা ছিল নকের ওয়েবসাইট। সেখানে চাইলে পছন্দের পণ্য প্রি-অর্ডারও করতে পারতেন ক্রেতারা।
নকের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য ছিল গেম অব থ্রোনস আর হ্যারি পটার সংশ্লিষ্ট। এগুলোর মানিব্যাগ, চাবির রিং, ঘড়ি, স্টিকার, পোস্টার, পোশাক, কোট পিন, মোজা, ডায়েরি, হ্যারি'র ছড়ি ইত্যাদি জিনিস ছিল ভক্তদের পছন্দের শীর্ষে। এছাড়াও হট হুইলসের গাড়ি, লেগো, জাপানিজ অ্যানিমে ও কে-পপের অনেক পণ্য ছিল নকের শীর্ষ কিছু পণ্য। তবে একদম সর্বোচ্চ সংখ্যায় বিক্রি হওয়া পণ্যটি হচ্ছে গেম অব থ্রোনস-এর হ্যান্ড অব দ্য কিং ব্রুচ।
পপ কালচারপ্রেমীদের এই 'স্বর্গরাজ্যের' সবচেয়ে ভালো সময় ছিল ২০১৯ সাল। তখন দেশের সর্বত্র পপ কালচারের বিস্তার ঘটে। নকও একটি দীর্ঘ সময় ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে আসার কারণে ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। নককে ঘিরে একটি পপ কালচার কমিউনিটি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময় পপ কার্নিভালের আয়োজনও করেছে দোকানটি। পপ কালচারের অনেক নতুন ভক্ত গড়ে ওঠে নকের বদান্যতায়। দেশে পপ কালচারের বিস্তৃতিতে নকেরও যে বড় একটা ভূমিকা রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না।
কেন বন্ধ হলো নক?
দোকানটির খারাপ সময় শুরু হয় করোনার পর থেকে। সবাই ঘরবন্দি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও টালমাটাল। নকের বেশিরভাগ পণ্যই ছিল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। করোনার কারণে অনেকগুলো পণ্যের শিপমেন্ট দেরিতে আসে। যার ফলে পণ্যের অপেক্ষায় থাকা অনেক ক্রেতা হারায় প্রতিষ্ঠানটি।
দোকানে লোক কম আসত এরপর। করোনার যে ধাক্কা, তা সামলে উঠতে অনেক সময় লেগেছে এটির। এছাড়া মেহেদি হাসানের কিছু ব্যক্তিগত কারণও ছিল নক বন্ধ হওয়ার পেছনে।
'আমি মে মাসের তিন তারিখে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডা চলে যাচ্ছি। দেশের ফেরার সম্ভাবনা আর নেই। আমার অবর্তমানে নকের দায়িত্ব দিয়ে যাওয়ার মতো কাউকে পাচ্ছি না,' বলেছিলেন মেহেদি।
ব্যবসার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর হওয়ায় সার্বক্ষণিক দোকানের দেখাশোনার জন্য একজন প্রয়োজন। 'কিন্তু আমি সময় না দিলে এ কাজ কেউ ঠিকমতো চালিয়ে নিতে পারবে না। নকের যে ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তারা আমার অবর্তমানে নিম্নমানের পণ্য পেলে নকের নাম খারাপ হবে। এটা আমি কোনোভাবেই চাই না,' বলেন তিনি।
নক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পপ কালচারের ভক্তদের মাঝে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ২৬ এপ্রিল নকের দোকানে বেশ ভিড় দেখা যায়। বন্ধ হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকে দোকান খালি করার জন্য সকল পণ্যে ৫০ ভাগ ছাড় দিয়েছিল এটি। এছাড়া একটা কিনলে আরেকটি বিনামূল্যে নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ দিয়েছিল।
দোকানে জাপানিজ অ্যানিমের ভক্ত মায়িশা মালিহার সঙ্গে আলাপ হয় নক বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে। তিনি বলেন, 'আমি স্কুলে পড়ার সময় থেকে নিয়মিত আমার পছন্দের অ্যানিমের মার্চেন্ডাইজ কিনেছি নক থেকে। তারা সবসময় সেরা জিনিস রাখত দোকানে। অনেকগুলো জিনিস প্রি-অর্ডার দিয়েও আনিয়েছি বাইরে থেকে। ভবিষ্যতে কোথা থেকে পছন্দের মার্চেন্ডাইজ কিনব জানি না। এটা ভাবতেই মন খারাপ লাগছে!'
'সুদিন কাছে এসো…'
তবে নকের ভক্তদের জন্য খানিকটা সুখবর জানিয়েছেন মেহেদি হাসান। কানাডায় যাওয়ার পর আবার আলাপ হয়েছিল তার সঙ্গে। তিনি জানান, 'নক আবার চালু করার জন্য এত বেশি অনুরোধ আসছে যে, আমরা আবার চিন্তা করছি এ বিষয়ে কিছু করা যায় কি না।'
মান ভালো রেখে ক্রেতাদের কাছে সাধ্য অনুযায়ী পণ্য বেচার নকের যে ঐতিহ্য, তা ধরে রাখতে পারবেন এমন কাউকে খুঁজছেন মেহেদি হাসান। যদি সেরকম কাউকে পাওয়া যায়, তবেই নকের ঝান্ডা হস্তান্তর করা হবে। আবারও ফিরে আসবে নক। সে পর্যন্ত — মেহেদি হাসানের ভাষায় — 'আডিওস!'