সেগুনবাগিচা: ঢাকার সাংস্কৃতিক রাজধানী থেকে যেভাবে বাণিজ্যিক কেন্দ্র
ঢাকার মাঝে একটুকরো দ্বীপ। দ্বীপের মতো স্থলের চারদিকে পানি ঘিরে নেই এখানে ঠিকই; তবে, চারপাশে তাকালে বাড়িঘরের চেয়ে শান্ত স্রোতহীন জলাধারই দেখা যায় বেশি। বর্ষার মৌসুমে সে জলাধার কাণায় কাণায় ভরে ওঠে। সে জলে কেউ মাছ ধরছে, কেউ নৌকা বাইছে, কেউ বা প্রাতস্নান সারছে।
সব মিলে বিশটি বাড়িও হয়তো নেই এখানে, আছে প্রকাণ্ড বড় দুটি মাঠ। ভরদুপুরে স্কুল ছুটি হলেই পাড়ার ছেলেগুলো বেরিয়ে পড়ে সে মাঠে। মাঠে এই ছুটাছুটি চলতে থাকে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত। ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে যার যার বাসায় ঢুকে পড়ে সবাই। সারা দিনজুড়ে যত কোলাহল, গাড়িঘোড়ার আনাগোনা, ছেলেপেলেদের হৈচৈ– সব থেমে যায় মাগরিবের আজানের সাথে সাথেই। সন্ধ্যা নামলেই যেন কালো চাদরে নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো পাড়া। মহাপ্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে কেউ বের হননা। নয়টার সময় খেয়েদেয়ে, দশটা বাজলেই অতল ঘুমে তলিয়ে যায় পুরো এলাকা।
সেগুনবাগান থেকে সেগুনবাগিচা
এ–ই ছিল গত শতকের ষাট, সত্তর, আশি দশকের সেগুনবাগিচার চিত্র, যা আজ আমাদের কাছে কেবলই অফিসপাড়া। সেগুনবাগিচার শুরুটা কিন্তু উপরের ষাট সত্তর দশকেই নয়। এর ইতিবৃত্ত আরও অনেক পুরোনো। ব্রিটিশ আমলেই এর গোড়াপত্তন। যেভাবে হয়েছিল গেন্ডারিয়া এবং ওয়ারী অঞ্চল।
ইন্টারনেট থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনানিবাস ছিল পুরান পল্টন, নয়পল্টন ও তোপখানায়। পরে তা সরিয়ে রমনা, বেগুনবাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনানিবাস সরিয়ে নেওয়ার পরে এ জায়গাটিতে বাগান তৈরি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসীর মামুনের অনুমান সাপেক্ষে বলা যায়, জায়গাটি ঘিরে নতুন এ বাগানটিই সেগুনবাগান হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা বর্তমানের সেগুনবাগিচা।
আমরা জায়গাটিকে এখন সেগুনবাগিচা হিসেবে চিনলেও, এর নাম ছিল আগে সেগুনবাগান। বাগান বাগিচা দুটো শব্দই সংস্কৃতি থেকে এসেছে। তবু পাকিস্তানি শাসকদের বাগান নামটি পছন্দ হলো না, তারা নাম পরিবর্তন করে রাখলো 'বাগিচা'। সেই থেকেই আমরা আজ চিনি সেগুনবাগিচা নামে।
আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি
যা বলছিলাম— শুরুটা এই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নয়। ব্রিটিশ আমলেই এটি আবাসিক হতে শুরু করে। সেগুনবাগিচার আদি ইতিহাস জানার জন্য যে কয়জন আদি অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ টুটু সা'দ( বয়স আশির কোঠায়)। জন্মেছিলেন কলকাতায়। ১৯৫০ সালে চলে আসেন সেগুনবাগানে।
তিনি জানান, "সেগুনবাগানের খোলা জায়গাগুলো একসময় ভাওয়াল রাজার তালুক ছিল। এরপর ইস্ট পাকিস্তান এগুলো নিয়ে নিলো, ভাওয়াল রাজাদের আর আধিপত্য থাকলো না। জায়গাগুলো প্লট আকারে ভাগ ছিল ১৯৩০ এর দিকেই, বারো কাঠা, দশ কাঠার নিচে কোনো প্লট ছিল না।"
এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এই অঞ্চলটি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীদের অধীনে। সেই যুদ্ধে যুদ্ধবিমানগুলো নামার জন্য এক পরিত্যক্ত রানওয়েও ছিল বলে ধারণা টুটু সা'দের। তিনি বলেন, "এখন যেটা ফরেন অফিস, সেখান থেকে বারডেম হাসপাতালের যে রাস্তাটা ভেতরে ঢুকে গেছে সেটা পুরোটাই সরকারি জায়গা ছিল। যে রাস্তাটা এখন তোপখানার ভেতর দিয়ে নর্থ সাউথ রোড করা হলো, এই জায়গাটা ছিল খোলা মাঠ।"
"প্লেন দেখিনি, কিন্তু সে মাঠে প্লেন ড্রপের ট্যাঙ্কগুলো দেখেছি। ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের সাথে যুদ্ধ করে, সম্ভবত সে সময়ের ড্রপ ট্যাংক ওগুলো," যোগ করেন তিনি।
ছিল হিন্দু ধনবানদের বসতি
ওয়ারী, গেন্ডারিয়ার মতো সেসময় হিন্দু ধনবানদের বাড়িও ছিল এখানে। যারা দেশভাগের পর বিক্রি করে বা বিনিময় সম্পত্তি করে চলে যান ওইপারে। সেগুনবাগিচার বর্তমান ও আদি অধিবাসীদের একজন দেলোয়ার রমিজ, পেশায় আইনজীবী। তিনি জানান, "সেগুনবাগিচার চল্লিশ সালের পুরোনো বাড়িগুলো ছিল ১৯৩৫ সালের দিকে বানানো। আর এই বাড়িগুলোতে থাকতেন অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ও আমলা। যারা অনেকেই সাতচল্লিশের পর চলে যান। ব্রিটিশরা প্রথম ইস্টবেঙ্গলের ঢাকায় আবাসিক প্রজেক্ট করে গেন্ডারিয়া, এরপর ওয়ারীতে। এই গেন্ডারিয়া, ওয়ারীর পরই তারা বেছে নেয় সেগুনবাগানকে।"
সানজীদা খাতুনও তার স্মৃতিচারণায় এমনটাই জানিয়েছেন, "পাড়াটা ছিল হিন্দু প্রধান। আমরাই এক বাড়ি মুসলমান। আমাদের বাড়ি থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে খানিক দূরে ছিল ডাক্তার টি.পি. বোসদের বাড়ি। তার উত্তরে রসিক বাবুর বাড়ি ছিল শুনেছি। সেদিকে একবার ধূধূ আগুন জ্বলে আকাশ লাল হয়েছিল। শুনেছিলাম, ওটা রসিকবাবুরই চিতার আগুন।"
দেলোয়ার রমিজ বলেন, "রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী জাহিদুর রহিমের বাড়িটি যে হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হয়, তারা এখানে দেশভাগের পরও আরও দু বছর ছিলেন। তাদের দেখতাম, সকালবেলা পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ধুতি পরে পুবদিকে ফিরে নমস্কার করতেন।"
কিংবদন্তীর ঢাকা বইয়েও লেখক নাজির হোসেন লিখেছেন তেমনটাই। তিনি লিখেছেন, 'সেগুনবাগিচায় একসময় প্রচুর সেগুন গাছ ছিল। পরবর্তীকালে সেগুন বাগান সাফ করে স্থানটিকে আবাসিক এলাকায় পরিণত করা হয়েছে। এখানে বসবাস করার জন্য বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন অধ্যাপক ড. এস এন রায়, ড. জে কে চৌধুরী, চারু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।'
এরপর পাকিস্তান আমলে এখান থেকে চলে যেতে থাকে তারা। নামও বদলে হয়ে যায় সেগুনবাগিচা। পুরান ঢাকা, ঢাকার বাইরে অন্য জেলা থেকে এবং ওপার থেকে অনেক মুসলিমরা তখন এ জায়গায় এসে প্লট কিনে বাড়ি তৈরি করেন। কেউ বা হিন্দু সম্পত্তিতেই থাকা শুরু করেন।
জঙ্গলে ঘেরা সেগুনবাগান
চল্লিশের দশকে কী ছিল জানা যায়নি, তবে বলা যায় পঞ্চাশ থেকে প্রায় সত্তর দশক পর্যন্ত এ অঞ্চলে বাড়িঘরের সংখ্যা সর্বোচ্চ হবে ১৫-১৬টি। তারমধ্যে ৭-৮টি বাড়ি বিনিময় হিন্দু সম্পত্তি ছিল। বাড়িগুলো হতো একতলা কি দোতালা। এই গুটিকয়েক বাসা বাদে পুরোটো ছিল জঙ্গল আর খালে ভর্তি। এই জঙ্গলে সাপ, শিয়াল এমনকি বাঘও ছিল বলে জানা যায়। বাড়ি থেকে শিয়ালের মুরগী ধরে নিয়ে যাওয়া ছিল তখন সে অঞ্চলের স্বাভাবিক ঘটনা।
সেগুন গাছের মতো, প্রচুর নারকেল গাছও ছিল সেখানে তখন। ছিল একটি প্রকাণ্ড বটগাছ। কাজী আনোয়ার হোসেন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, 'আমাদের একতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পুবে তাকালে ফাঁকা মাঠের ওপারে বহুদূরে দেখা যেত পল্টন লাইনের বিশাল এক বয়োবৃদ্ধ বটগাছ।'
দাওয়ায় বসে বর্শি দিয়ে মাছ ধরতেন
উঁচু উঁচু গাছপালা বেষ্টিত নিরিবিলি, শান্ত ছিমছাম এই লোকালয়ের চারপাশে বয়ে গেছে অবাধ জলাধার। দুই দিক থেকে পানি আসত এই জলাধারে। পশ্চিম দিক থেকে বুড়িগঙ্গার পানি আসত ধানমণ্ডি লেক হয়ে কলাবাগানের মধ্য দিয়ে রমনা লেকে, সেখান থেকে পুবের রাস্তার নিচ দিয়ে বর্তমান শিল্পকলা একাডেমির বুক চিরে একটা পুরানো কালভার্টের নিচ দিয়ে। সেই কাল্ভার্টটি এতই ছোট ছিল যে, একটি ট্রাক গেলে আর কিছু যেতে পারত না।
আরেকটি ধারা আসত পুরানো ঢাকার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণ দিক থেকে। সেটারও উৎস ওই বুড়িগঙ্গাই। তখন বর্ষা এলে কর অফিসের (বর্তমান) পেছন থেকে এই পানি রমনা পার্ক হয়ে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর ছাড়িয়ে চলে যেত পুবের কোনো নদীতে। সম্ভবত একেবারে গাজীপুরের ভাওয়াল পর্যন্ত। এখন যেখানে কচিকাচার স্কুল, জানা যায়, বর্ষাকালে সেটা না-কি পুরোপুরি নিম্নভূমি হয়ে থাকত!
সেগুনবাগান মানেই তখন চারদিকে পানি আর পানি। এই পানিতে মাছ ধরার কতশত স্মৃতি আছে এখানকার অধিবাসীদের। বর্ষাকালেই ঘরের দাওয়ায় বসে বর্শি দিয়ে মাছ ধরতেন রমিজ। আবার টুটু সা'দের ছিল এক মামা। সে আর মামা মিলে ঠ্যাঁটা দিয়ে মাছ শিকার করতেন।
কাজী আনোয়ার হোসেনও কালেরকন্ঠে লেখা এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন এই মাছ শিকারের কথা— 'রাতে হারিকেন ও টেঁটা (কোঁচ) নিয়ে সেগুনবাগিচার এই মস্ত জলাশয়ের হাঁটুপানিতে মাছ মারতাম আমি, আমার ছোটভাই নুরু (কাজী মাহবুব হোসেন) আর বাবু (শিল্পী জাহিদুর রহিম)। পায়ের নিচে পিচ্ছিল ঢোঁড়া সাপ কিংবা বড়সড় কুচে মাছ পড়লে ভয় পেয়ে ছপ্-ছপ্ সে কী দৌড় আমাদের!'
তখন বিজয়নগর, রমনাসহ সেগুনাবাগানের কিছু কিছু পুকুর ছিল তৎকালীন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের অধীনে। সেগুনবাগানের পুকুরটি ১৯৮২-৮৩ সালের দিকেই ভরাট করে দেওয়া হয়। ফিশারিজের জেলেরা এসে বছরে এক দুইবার এখান থেকে মাছ ধরে নিয়ে যেত বলে জানান দেলোয়ার রমিজ।
কারা থাকতেন
স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এক একটি বাড়ি থেকে এক একটির দূরত্ব ছিল তিনশো থেকে চারশো গজ। এই বাড়িগুলো হতো একতলা কি দোতালা। তিনতলা ছিল কেবল কাজী মোতাহের হোসেনের ১১৩ নাম্বার বাড়িটিই। বাড়িগুলোতে না ছিল কোনো দেওয়াল, না ছিল তারকাটার বেড়া। সামনের উঠোনে ফুলের গাছ, কেউ করতেন সবজি বাগান, কেউ ফলের বাগান।
টুটু সাদ জানান, "পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পরিবার নিয়ে থাকতেন সেগুনবাগিচার ১১৫ নাম্বার বাড়িতে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সে বাড়িটি ছিল কাজী মঞ্জিলের একটা রাস্তা পরেই। কাজী মোতাহের হোসেনের নাতনী (মেয়ের মেয়ে) টিয়া ছিলেন শেখ হাসিনার বান্ধবী। বাড়িটি এখন আর নেই। বর্তমানে সেখানে দণ্ডায়মান গাজী টিভির ভবন।"
"ষাটের দশকের দিকে তিনি থাকতেন ৭৬ নাম্বার বাড়িতে, যার উল্টদিকে এখন সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার হয়েছে। দোতালা একটা বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকতেন শেখ মুজিব ও তার পরিবার।"
বাংলা ট্রিবিউনের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার সময় বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সপরিবারে সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বর সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলা হয়। পরে বেগম ফজিলাতুন্নেছা সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় মাসিক ২০০ টাকায় বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে পুলিশ কর্মকর্তার মালিকানাধীন বাড়ি ভাড়া নেন। সরকারি এজেন্সির হুমকির মুখে এই বাড়িটিও ছাড়তে হয়। পরে বেগম সুফিয়া কামালের প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় ওঠেন। এখন যেখানে গাজী টিভি— একাত্তরের ঠিক দুই তিন বছর আগ পর্যন্ত ওই বাড়িতে ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান।
সেগুনবাগানের ছিল দুটি পাড়া। খালের ওইপাড়ে ছিল ড. ইব্রাহীমের বাড়ি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও আজিমভিলা নাসিমভিলা নামে একটি বাড়ি, দুই যমজ ভাইয়ের নামে নাকি বাড়ির নাম। ড. ইব্রাহীমের একটি ঘটনা বলেন টুটু সা'দ, "খুব বড় ডাক্তার ছিলেন ড. ইব্রাহীম, জেনুইন ডাক্তার। একবার সিএনবির কন্সট্রাকশন ডিপার্টেমেন্টের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জব্বার সাহেবের কাছ থেকে একটা জায়গা চেয়ে নিলেন। কারণ, এখানে এতে করে মর্নিং ওয়াকে আসা লোকজনদের তিনি সুগার টেস্ট আর বিপি টেস্ট করাতে পারবেন বিনামূল্যে।"
আর এ পাড়ায় থাকতেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহিদুর রহিম, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী চিকিৎসক ডা. জোহরা কাজী। তিনি ছিলেন গাইনি রোগের চিকিৎসক। সে আমলেই তার ভিজিট ছিল ১৬ টাকা। তার ভাই আশরাফ মাহমুদ ছিলেন খুব নামকরা কবি। কথিত আছে, আশরাফ মাহমুদ এবং ইন্দিরা গান্ধীর মাঝে না-কি একধরনের সম্পর্ক ছিল। থাকতেন ব্রিটিশ আমলে, কলকাতা থেকে পরে এখানে চলে আসেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার এম এ জব্বার, শিল্পী বারীন মজুমদার (বাপ্পা মজুমদারের বাবা) আরও ছিলেন আইয়্যুব খানের মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হাফিজুর রহমান– যার বাড়ির ঠিক বিপরীতেই থাকতেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর আশকার আলী।
দেশভাগের পর এখানে আসছেন, খান বাহাদুর আব্দুল্লাহ সাহেব। তাদের দোতালা বাড়িটি এখনো আছে। আছে লাল-কালো মেঝের এবং সেগুনবাগানের সকলের চেনা 'মনা মামা'র বাবা মোফাজ্জেল হোসেন কালা মিয়ার তৈরি বাড়িটি। এই 'মনা মামা' ভীষণভাবে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন বলে সবাই বলে থাকেন। আছে উপমহাদেশের বিখ্যাত দাবাড়ু, একজন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ড. কাজী মোতাহের হোসেনের নীল রঙের বাড়িটি। যে বাড়ি থেকেই জন্ম নিয়েছিল গোয়েন্দা-সিরিজ 'মাসুদ রানা' ও 'কুয়াশা' সিরিজ খ্যাত সেবা প্রকাশনীর। এ বাড়িটি নাকি দীর্ঘদিন রুটি কারখানার এক ইংরেজ মালিকের কাছে ভাড়া দেওয়া ছিল। বাড়িটা বহু বছর পাকিস্তান সরকার রিকুইজিশন করে রেখেছিল। অনেক দেন-দরবার করে এই বাড়ি ফিরে পান ১৯৫০ সালের দিকে।
সানজীদা খাতুনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, কাজী মঞ্জিলের পশ্চিম দিকে তখন একটা বাড়ির পরে আর ওদিকে কোনো বিশেষ ঘরবাড়ি ছিল না। ছিল না শিল্পকলা একাডেমি বা দুর্নীতিদমন অফিসের কোনো চিহ্ন, ফলে ওদিকটায় ছিল কেবল মাঠ আর মাঠ। দুপুর হলে কানে ভেসে আসত চিলের চিৎকার। উত্তরের দিকে এগোলে কাকরাইল গির্জার মাথাটা দেখা যেত। সে গির্জার আকাশে কখনো কখনো দেখা মিলত জীবানন্দের শঙ্খচিলের।
কাজী মঞ্জিলের পশ্চিম দিকের দোতালা বাড়িটি তৈরি করেছিলেন কেদারেশ্বর ব্যানার্জি নামের ভদ্রলোক। এই বাড়িতেই পরে টি-বোর্ডের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন পাকিস্তান আমলে। দুর্নীতির অভিযোগ চাপিয়ে একবার কয়েকজন অফিসার ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার জব্বার সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় এ বাড়ি থেকেই।
'মিস্টার ডিক্রুজি আর কালো মেমসাহেব।'
সেগুনবাগান পাড়ার দক্ষিণ দিকেই সরু রাস্তাটার একদম পূর্বদিকে ছিল জে. কে. চক্রবর্তীর একতলা বাড়ি। কাজী মোতাহের হোসেনের বড় মেয়ে যোবাইদা মীর্জা সে বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন। সানজীনা খাতুন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, 'ও বাড়ির দেওয়ালে শান্তিনিকেতনের এক শিল্পী অতি চমৎকার ফ্রেস্কো করেছিলেন। অনেক পরে শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়ে খুব নাম করেছিলেন চিত্রলেখা চৌধুরী। শুনেছিলাম ওর মা চিত্রনিভা ঢাকার সেগুনবাগানে আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেওয়ালে ফ্রেস্কো করেছিলেন। চিত্রনিভা দিদিকেও দেখেছি শান্তিনিকেতনে থাকতে। সেবার জওহরলাল নেহেরু এসেছিলেন ওখানে।'
সেগুনবাগানের বাড়ির উত্তর-পুবে খানিক দূরে ছিল একটি বস্তি। যাদের ভাষা ছিল একরকম হিন্দি। আবার দক্ষিণ দিকে বেশ কিছু বাড়ি ছিল। ইডেন স্কুলের কিছু ছাত্রী থাকত ওদিকে। দোলের সময় ওরা আবির নিয়ে এসে গুরুজনদের পায়ে আবির মাখিয়ে প্রণাম করে যেত।
এই এলাকাতেই থাকতেন ইস্পাহানি ও খোরাসানী পরিবার। পাকিস্তান হবার আগেই তারা এখানে এসেছিল। এ এলাকায় তাদের তিন কি চারটা বাড়ি ছিল বলে জানা যায়। লাল রঙের জমিদার বাড়ি। এখন যেখানে মাসিক সংগীত বিষয়ক পত্রিকা সরগমের কার্যালয় অবস্থিত, ঠিক সেখানেই একতলা বাড়িতে থাকতেন একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার। মগবাজারের দিলু রোডে অ্যাংলোদের অবস্থান বেশি থাকলেও, এই এলাকাতেও চার-পাঁচটা পরিবার ছিল অ্যাংলোদের। সরগমের ভবনে যিনি থাকতেন, তার নাম ছিল মিস্টার ডিক্রুজি, জাতিতে ফ্রেঞ্চ ছিলেন। মিসেস ডিক্রুজি ছিলেন বার্মিজ ইন্ডিয়ান।
রমিজ বলেন, "আমরা তাকে কালো মেমসাহেব বলে ডাকতাম। মিস্টার ডিক্রুজি ছিলেন খুব স্মার্ট, ফ্রেঞ্জ কাট দাঁড়ি ছিল মুখে, আর মিসেস ডিক্রুজিকে সবসময় গাউন পরে থাকতে দেখতাম। মিস্টার মারা গেলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফাইন উইলস তার কাছে এনে রাখেন মিসেস ডিক্রুজিকে।"
একটা ছাতা নিয়ে ঠকঠক করে হাঁটতেন
আরেকজন ব্রিটিশের কথা জানা যায়, যিনি বাংলাদেশ অবজার্ভারে আর্টিকেল লিখতেন। কাজী মঞ্জিলের পাশে সিলেট হাউজে থাকতেন তিনি। কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। তাকে নাকি কেউ কখনো রিকশায় চড়তে দেখেনি। সবসময় হাতে একটা ছাতা নিয়ে ঠকঠক করে হাঁটতেন। ছেলেমেয়েরা নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার অনেক চেষ্টা করেছিল। তিনি যাননি। মৃত্যুর পর নারিন্দার কবরস্থানেই তার দাফন হয়েছে। তার নামটা জানা যায়নি।
নিজেদের বানানো বাড়ির মধ্যে কাজী মোতাহের হোসেনের কাজী মঞ্জিল, চীফ ইঞ্জিনিয়ার এম এ জব্বার সাহেব এবং হাফিজুর রহমানের বাড়িটিই ছিল। বাকি সব হিন্দু বাড়ি। এসব বাড়ির সামনে ছিল বাগান, ছিল উঠোন, ছিমছাম এক পরিবেশ। একটি বাড়ির কথা রমিজের এখনো চোখে লেগে আছে। এখন যেখানে কনকর্ড ভবন, সেখানে ছিল শ্বেতপাথর দিয়ে করা দেখার মতো একটি হিন্দু বাড়ি। বাড়ির টয়লেটের সাথে যুক্ত ছিল লোহার পেঁচানো একটি সিঁড়ি। যেন বাহিরের লোককে টয়লেট পরিস্কারের জন্য ঘরের ভেতরে ঢুকতে না হয়।
ছিল চিড়িয়াখানা, মিউজিক কলেজ, প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট
এখন যেখানে সুপ্রিমকোর্ট সেখানে ছিল ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানা। পরে তা মিরপুরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চ্যানেল আইয়ের ক্রোড়পত্রে ছাপানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি স্মৃতিচারণায় উল্লেখ আছে এই চিড়িয়াখানার কথা। তিনি লিখেছেন, 'আমরা তখন সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে থাকতাম। রমনা পার্ক তখন তৈরি হচ্ছে। ৭৬ নম্বর সেগুনবাগিচার সেই বাসা থেকে হেঁটে পার্কে যেতাম। সেখানে একটা ছোট চিড়িয়াখানা ছিল। কয়েকটা হরিণ, ময়ূর পাখিসহ কিছু জীবজন্তু ছিল তাতে।'
সেগুনবাগান এলাকাটি ছোট্ট একটি পাড়া, যেখানে বসতবাড়িও হাতে গোনা কয়েকটাই ছিল। কিন্তু এই জায়গাটি থেকেই বেড়িয়েছে পত্রিকা, মিউজিক কলেজ, মিশনারী স্কুল, প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট।
এখন আমরা যে শিল্পকলা একাডেমি দেখি, সেটিও এমন ছিল না। বরং বড় খোলা একটি মাঠে গোল একটি দোতলা ভবন ছিল। চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন যে ব্যক্তি, সেই নিল আর্মস্ট্রং এসেছিলেন একবার ঢাকায়, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন চাঁদ থেকে আনা পাথরও। সেটা দেখার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত তরুণ তরুণীরা। শিল্পকলা একাডেমির এখন যে কাঠামো আমরা দেখি, তা নির্মিত হয়েছিল নব্বইয়ের পরে।
একাত্তরের সময় মিউজিক কলেজেই মেয়েদের আটকে রাখা হতো
শিল্পকলা একাডেমির একদম বিপরীতেই ছিল মিউজিক কলেজ, এখন যেটা ২৮ নাম্বার সেগুনবাগিচা। ধারণা করা হয়, ১৯১০ সালের দিকেই প্রতিষ্ঠা হয় মিউজিক কলেজের। মিউজিক কলেজের ভবনটা ছিল একসময় কামরুন্নেসা স্কুলের মেয়েদের হোস্টেল। ১৯৬৬-৬৭ পর্যন্ত মেয়েদের হোস্টেলই ছিল, এরপর বারীন মজুমদার (বাপ্পা মজুমদারের বাবা) এই মিউজিক কলেজটি শুরু করেন এখানে। প্রতিমাসেই এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব পালিত হতো। ভোর হলে ফজরের আজানের পর থেকে ভেসে আসত তবলার আওয়াজ, কোনো ঘর থেকে তানপুরার শব্দ, কোনো ঘর থেকে সুরেলা কণ্ঠ।
১৯৬২ সাল থেকে সেগুনবাগানে থাকতেন মাসিক পত্রিকা সরগম সম্পাদক কাজী রওনক হোসেন। তার থেকে জানা যায়, একাত্তরের সময় পাকিস্তানি আর্মিদের দখলে ছিল এই কলেজটি। ভবনটির উপরে তিনতলায় দুই তিনটা চিলেকোঠা ঘর ছিল। মেয়েদের এনে এনে ওই ঘরে রাখত পাক হানাদার বাহিনী। কলেজ অব মিউজিক মনেহয় ৭৭-৭৮ পর্যন্ত ছিল।
ডনস স্কুলের স্মৃতি
এখন যেখানে ফুড হাট অবস্থিত, সেখানেই ডনস স্কুল নামে একটি স্কুল ছিল। একজন ব্রিটিশ তার ছেলের নামে স্কুলটি নামকরণ করেছিলেন ডনস স্কুল। সেই প্রজন্মের অনেকের কাছেই কিন্ডারগার্টেন বলতে ছিল সেই ডনস স্কুল।
১৯৬৬ সালের পর স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ইংল্যান্ডে চলে যান। কিন্তু তার পরিবার প্রতিবছর এখানে এসে তিন-চার মাস থেকে যেত। একটা মধুর স্মৃতি। বাড়ির নিচতলায় স্কুল আর দোতলায় এয়ারলাইন নামে একটা অভিজাতদের রেস্টুরেন্ট ছিল। সে রেস্টুরেন্টে পাওয়া যেত কন্টিনেন্টাল সব ডিশ। এখন তা বহুতল ভবন আর ফুডহাট নামেই পরিচিত।
তবে এই ডনস স্কুলের মালিক বসলি যখন চলে যান দেশ ছেড়ে, তখন স্কুলটির দায়িত্ব দিয়ে যান মিস্টার ডিক্রুজির ওপর।
রোজগারী বালক বিদ্যালয়
রোজগারী বালক বিদ্যালয় নামে দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি স্কুল ছিল সেগুনবাগিচায়। ১৯৭৩ সালে নিউজিল্যান্ডের নাগরিক মানবতাবাদী লিন্ডসে অ্যালান চেইনি 'আন্ডার প্রিভিলাইজড চিলড্রেনস এডুকেশানাল প্রোগ্রাম' (ইউসেপ) নিয়ে কাজ করার কথা ভাবেন। সে চিন্তা থেকেই প্রতিষ্ঠা করেন রোজগারী বালক সম্প্রদায় বিদ্যালয়— যেখানে কর্মজীবী শিশুদের বিকেলবেলা পড়ানো হতো। একবছর পর এই স্কুলটি সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বর বাড়িতে (বর্তমান ২৫ সেগুনবাগিচা) চলে আসে। সেখানে তাদের জন্য একটি ছাত্রাবাসও ছিল।
এই স্কুলটিতে সারা শহর থেকে অসহায়, দরিদ্র শিশুরা আসতো পড়াশোনার জন্য। স্বাধীনতার পর প্রচুর ত্রাণ দেওয়া হতো এই বাচ্চাদেরকে। এখানকার বাচ্চারা বড় হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল, সচিবালয়সহ বড় বড় জায়গায় কাজ করেছে। এখন স্কুলটি চলে গেছে মিরপুরে। আর সেগুনবাগিচার সেই স্কুলের ওখানটায় এখন রয়েছে গাজী টেলিভিশন।
ক্যাফে চায়না
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় বিশিষ্ট কয়েকজনের উদ্যোগে ৫ নম্বর সেগুনবাগিচার দোতলা বাড়িটিতে চালু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এটি আগে ছিল মজিদ মোল্লা নামে একজনের। পরে ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তার জায়গা বদলে চলে যায় আগারগাঁওয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উল্টোদিকের বাড়িতেই ছিল ক্যাফে চায়না নামে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। ঢাকার প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট হিসেবে চু চিং চাও স্বীকৃতি পেলেও টুটু সা'দ জানান, ক্যাফে চায়না ছিল তারও পুরোনো।
তিনি বলেন, "আমার মনে আছে, দোতালা বিল্ডিং ছিল সম্ভবত ৫৫-৫৬ সালের দিকে। নিচতলায় চাইনিজ আর উপরে মালিকপক্ষের বাড়ি। চাইনিজরাই এদেশে এসে এই রেস্টুরেন্ট খোলে কন্টিনেন্টাল আবহে। তাছাড়া, এই পরিবারটি জুতো বানাতো। এসব চাইনিজরা এদেশে জুতোর ব্যবসা করতো, ওদেরই একজন এই রেস্টুরেন্ট খোলে। ক্যাফে চায়নার যে জিনিসটি এখনো মনে আছে তা হলো– রাত হলেই শেফালী ফুল আর কামিনী ফুলের গন্ধ নাকে ভেসে আসত।"
পত্রিকা বের করতো
ষাটের দশকে কাজী আনোয়ার হোসেন সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাড়িতে গড়ে তোলেন সেগুনবাগান প্রেস। সেগুন বাগানের প্রথম দুই অক্ষর দিয়ে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী।
সেগুনবাগিচা থেকেই প্রথম বের হয়েছিল জাতীয় দৈনিক 'বাংলার বাণী'। ১৯৬৯ সালে সেগুনবাগিচায় একটি জায়গা নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয় হাফিজ হাফিজুর রহমান এবং শেখ ফজলুল হক মণির হাত ধরে। কাজী রওনক বলেন, "হয়তো একটা ফুটবল লাগবে, তার কাছে চলে যেতাম ফুটবল চাইতে। মণি ভাইও জিজ্ঞেস করতো, কত লাগবে, পাঁচ টাকা লাগবে। কিনে নিয়ে আসতাম ফুটবল। তখনকার দিনের চাহিদা এমনই ছিল।"
মহিলাদের মাসিক পত্রিকা ছিল ললনা। এটিও ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে শুরু, যা স্বাধীনতার পর বন্ধ হয়ে যায়। কাজী রওনক হোসেন জানান, "এই ললনা থেকেই উঠে এসেছিল সেবাপ্রকাশনীর রহস্য পত্রিকার শাহরিয়ার কবির, শাহাদাৎ চৌধুরীর মতো গুণী লেখকগণ। এরপর তারা আবার চলে গেলেন বিচিত্রা পত্রিকায়।"
ললনা পত্রিকাটি চালাতেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর জব্বার সাহেবের মেয়ে জিনিয়া এবং সহসম্পাদক ছিলেন তার পুত্রবধূ।
প্রথম রেস্টুরেন্ট আকবর হোটেল
সেগুনবাগিচা যাওয়া-আসা আছে, কিন্তু চিটাগাং হোটেলের নাম জানবেন না– এমন মানুষ বোধহয় একটিও পাওয়া যাবেনা। চিটাগাং হোটেলের জায়গাটা ছিল পানিতে ভরপুর। জলের ওপর একটি চৌকি, একটি কেটলি, একটি বিস্কুটের কৌটো— এই দিয়েই শুরু হয়েছিল চিটাগাং হোটেলের যাত্রা। তিনতলা উঁচু এবং আবাসিক ব্যবস্থাসহ এই হোটেলের বয়স ৭০ বছর হবে হয়তো এখন।
একসময় এই হোটেলই হয়ে উঠে এখানকার কেন্দ্রস্থল। সেগুনবাগিচার অধিবাসীদের কাছে হোটেলটি অবশ্য আকবর হোটেল নামেই পরিচিত। আকবর নামে একজন এই হোটেলটি শুরু করেছিলেন বলে, সে নামেও সবাই ডাকে এখনো। এই আকবর ছিলেন অনেক সাহসী। স্বাধীনতার পর পর ডাকাতি, হাইজ্যাক যখন বেড়ে গেছিল তখনের একটা ঘটনা বলেন দেলওয়ার রমিজ।
তিনি বলেন, "মালিক আকবর ভাই ভেতরে বসা ক্যাশ কাউন্টারে। চার-পাঁচটা ছেলে পিস্তল ঠেকিয়ে ক্যাশের টাকাগুলো চাইলো। আকবর ভাই খপ করে ধরে ফেললেন ওদের একজনের হাত, রিভল্ভার ধরে ফেলেছিলেন, আর ছাড়েননাই। যদিও গুলি লেগে যায় সেবার আকবর ভাইয়ের ডান হাতে।"
পাড়ার ছেলেবুড়োরা মাঠ থেকে ফিরে, বা গল্প করতে বসে যেতেন এই আকবর হোটেলে। তখন মাছ পাওয়া যেত না সব হোটেলে, একমাত্র এই হোটেলে মাছের আইটেম পাওয়া যেত। আকবর সাহেব নিজে সোয়ারিঘাট গিয়ে ভালো দামি দামি মাছ এনে রান্না করতেন। পুরো ঢাকা শহরের মধ্যে সবাই জানত এখানে মাছ পাওয়া যায় দামি দামি।
তবে আশেপাশে এনএসআই, দুর্নীতি দমন, পিডাব্লিউটি, কাস্টমস, ইনকাম ট্যাক্স-এসবের কার্যালয় থাকায় এই হোটেলে উপরি পয়সার লোকদের যাতায়াত ছিল বলেও কথিত আছে।
শিক্ষা-সংস্কৃতি আর শৃঙ্খলার আবহ
একসময় আবাসিক এলাকার মধ্যে সেগুনবাগিচা আর ওয়ারী ছিল অভিজাত একটি এলাকা। তার একটি নমুনা পাওয়া যায় সেগুনবাগিচার প্রশস্ত এবং পরিকল্পিত রাস্তা দেখে। পুরো এলাকার মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি আর শৃঙ্খলার আবহ ছিল। ফলে পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যাষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ সদস্যটিও চলত সেই শৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে।
বাড়ির বাবারা সকাল সকাল অফিসে গিয়ে দুপুরে ফিরে এসে ভাত খেতেন। এরপর একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেলবেলা একটু হাঁটতে বের হতেন। আবার মাগরিবের আজানের পর ঘরে ফিরতেন। সন্ধ্যার পর এই রাস্তায় থাকতেও ভয় লাগতো। তাই পারতপক্ষে, কোনো মহাপ্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বেরোতো না। ছেলেপিলেরাও তেমনই। স্কুল থেকে ফিরে সোজা মাঠ। এরপর সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঢোকা আর পড়াশোনা শুরু। নয়টায় পড়া শেষ করে, সবাই একসঙ্গে খেয়েদেয়ে ঘুমোতে যেত। রাত দশটার পর কোনো বাড়িতেই তেমন আলো আর জ্বলতে দেখা যেত না। আবার ফজরের পর উঠে যেতেন সবাই।
কাজী রওনক বলেন, "পড়াশোনার সাথে কোনোকিছু ছাড় ছিল না আমাদের। আমরা অবসরে খেলতাম, কেউ বা গান গাইত, কেউ বই পড়ত বা লেখালেখির দিকে ঝোঁক, কারও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঝোঁক, এই তো। পুরোনো পল্টন থেকে বই কিনতাম আমরা। পুরোনো বইগুলোও কিনতাম ভাগাভাগি করে। অযথা আড্ডাবাজি বা বাউন্ডুলে স্বভাব কম ছিল, লেখাপড়ার দিকে ঝোঁক আর সংস্কৃতির চর্চাটা বেশি ছিল। অন্য মহল্লার সাথে এখানেই বোধহয় একটু পার্থক্য।"
তারা চাঁদ দেখামাত্রই আকাশে গুলি ছুঁড়বে
পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চা, সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে এই পাড়া ছিল সমসাময়িক অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে আলাদা। প্রতিটি পরিবার থেকেই কেউ হয়তো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কেউ শিক্ষকতা, কেউ প্রকৌশলী, কেউ হয়তো সেনাবাহিনী এরকম বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। প্রতিটা বাড়ির সাথে প্রতিটা বাড়ির খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এক বাড়িতে ভালো রান্না হলে তা অন্যান্য বাড়িতে পাঠানো হতো।
কাজী রওনক বলেন, "কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাতো না। কিন্তু যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে আসত। হয়তো কোনো বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে, সেখানে কোনো আয়োজন বাদ পড়ে গেছে, নিজ দায়িত্বে করে দিয়ে আসত বাকিরা। কোনো বাড়িতে বিয়ে হলে তার আমেজ আশেপাশের বাড়িগুলোতেও পড়ত। আমরা পাড়ার সবাই ছিলাম একটি পরিবারের মতো।"
ফলে সুখে-দুঃখে হাসিকান্নাগুলোও ছিল সবার একসাথে। চাঁদরাতে সবাই ছাদে উঠতো। কিন্তু রেওয়াজ ছিল, যাদের বাসায় বন্দুক থাকবে, তারা চাঁদ দেখামাত্রই আকাশে গুলি ছুঁড়বে। আর এরইমধ্য দিয়ে বাকিরা বুঝবে ঈদের চাঁদ উঠেছে। ঈদের দিন মানেই এই বাসায় ওই বাসায় ছুটাছুটি, জর্দা ফিরনি খাওয়া আর সালামি পাওয়া। সবাই ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু গোঁড়া ছিলেন না। টুটু সা'দ বলেন, "সেসময় আমি এখানে কাউকে বোরকা পরতে দেখিনি। আবার ধর্মকে বাদ দিতেও দেখিনি।"
সততা অনেক ছিল তখন মানুষের মধ্যে। একবারের ঘটনা বলেন কাজী রওনক হোসেন। বিকেলবেলা খেলাধুলা শেষে ফিরেছেন। তার বাবা তাকে ডেকে বললেন, "তোমার কি বন্ধুর এতই অভাব পড়েছে, যে ওই ঘুষখোরের ছেলের সঙ্গে খেলতে হবে?"
টুটু সা'দ জানান, টাকার জৌলুস এখানে ছিল না, কিন্তু সবাই সচ্ছল ছিল, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চার একটা ধারা ছিল। এমন কোনো বাসা ছিল না যেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাচ্চারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না। ভাইবোনদের মধ্যে কেউ না কেউ যুক্ত ছিলই। বাড়ির মায়েরাও অনেকেই বিভিন্ন সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। যেমন— দেলোয়ার রমিজের মা যুক্ত ছিলেন মহিল পরিষদের সাথে। সব কাজ সেরে দুপুরবেলা বিছানায় শুয়ে বেগম, ললনা পড়া ছিল তখনকার মায়েদের নিত্যকাজ।
পাকবাহিনীর কন্সেট্রেশন ক্যাম্প
স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন সেগুনবাগান ছিল পাকিস্তান আর্মির কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং টর্চার সেল। মেয়েদের ধরে নিয়ে এসে মিউজিক কলেজের আটকে রাখত।
১৯৬০-৬১ সালের দিকে শিল্পকলার বিপরীতে যে দুদকের ভবন, সেখানে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সচিবালয়, 'ইস্ট পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট'। যার সামনে ছিল বাঁশ দিয়ে লাগানো টিনের একটি সাইনবোর্ড। কাজী আনোয়ার হোসেন, টুটু সা'দুল্লাহ তখন তরুণ। সাইনবোর্ড ভেঙ্গে ফেলতে তারা ইট ছুঁড়ে মারতে থাকলেন। প্রতিবাদের ভাষাগুলো তখন থেকেই এভাবে একটু একটু করে ব্যক্ত হতে থাকে।
৭১ সালের দিকে রমিজরা থাকতেন ৪০ নম্বর সেগুনবাগিচায়। তিনি জানান, "২৬ তারিখের দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। বাগিচা রেস্টুরেন্ট থেকে আর্মিরা এলোপাথারি গুলি মারতে শুরু করে। আমার এখনো খেয়াল আছে, আমরা নিচু হয়ে শুয়ে আছি। আমি জানালার দিকে মাথা উঁচু করে একবার তাকালাম, আগুনের গোল্লার মত গুলি যাচ্ছে। ২৭ তারিখের দিকে দেখলাম, নয়াবাজারে কাঠের যে গোডাউনগুলো ছিল, তা সব ছাই। দুই তিনদিন পর্যন্ত আকাশ লাল ছিল।"
যেভাবে কমার্শিয়াল এলাকা হয়ে উঠলো
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এখানে ১৫-১৬টার মতো বাড়ি ছিল, আর এখন একটা কমপ্লেক্সেই আছে (আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের) ৭৮টি ফ্ল্যাট। এছাড়া স্বাধীনতার আগে এ এলাকায় ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা ছিল মূলত যানবাহন। স্বাধীনতার পরও এই রাস্তা দিয়ে ৩০-৪০টার বেশি গাড়ি যেত না। "আর এখন শুধু আমাদের এই ভবনেই আমার গাড়িসহ ৬৫টির বেশি গাড়ির যাতায়াত হবে," বলেন কাজী রওনক।
মফস্বলের মতো একটি ছিমছাম পাড়া হয়ে গেল সরকারি, বেসরকারি অফিস আদালতের পাড়া। দেলোয়ার রমিজ বলেন, ঢাকার ডিসির অধীনে ওয়ারীর পর সেগুনবাগিচা সবচেয়ে পরিকল্পিত অঞ্চল। সেগুনবাগিচা ছিল ঢাকার এলিটদের স্থান, ফলে সরকারও জায়গা ছাড়তে চায়নি।
প্রথম এখানে আসলো ন্যাশনাল বোর্ড অব রিনিউ, ইনকাম ট্যাক্সের কার্যালয়। ষাটের দশকের মধ্যভাগে, বেশি শুরু হয় একাত্তরের পরে কমার্শিয়াল হতে আরম্ভ করলো। স্বাধীনতার পর খেলার মাঠটি হয়ে গেলো এজিবি (একাউন্টেন্ট জেনারেল অব বাংলাদেশ) অফিস। একাত্তরের পর কিছু কিছু মানুষ কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানদের ভাড়া দেওয়া শুরু করলো। পাশের সারগামের ভবনটি বানানো হয়েছিল আবাসিক ভবন হিসেবে, কিন্তু হয়ে যায় কমার্শিয়াল ভবন।
টুটু সা'দ বলেন, "আমার কষ্ট লাগে একটা আবাসিক অঞ্চলকে পুরো কমার্শিয়াল বানিয়ে দেওয়া হলো। মানুষের লোভে, অফিস ভাড়া দেওয়া শুরু। প্রথমে ইনকাম ট্যাক্স শুরু করলো আসা।"
আবার বড় বড় কিছু ব্যবসায়ী ভূমিদস্যু বাজার দর না দিয়েই জোর করে বাড়ি দখল করাও আরেকটি কারণ। নব্বইয়ের পরের দিকে একটা দুইটা করে বাড়ি ডেভেলপার কোম্পানির কাছে দেওয়া শুরু হলো। বেশি পরিবর্তন এসেছে ২০০০ সালের পর। রাজস্ব বোর্ড, দুদক, এনএসআই, কাস্টমসের অফিস ঢুকে গেলো। সেগুনবাগিচার ওই পাড়া বলে পরিচিত জায়গার মধ্যে ছয়টা বাদে বাকি সব বাণিজ্যিক ভবন।
সেই আদি চৌদ্দ পনেরোটি পরিবারের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে এমন পরিবার দুই থেকে তিনটি হবে। বাকিরা দেশের বাইরে বা গুলশান-বনানীতে চলে গেছেন। তবে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরগুলো আগারগাঁওয়ের দিকে চলে যাচ্ছে বলে, এখন আবার এলাকাটি আবাসিকের দিকে ঝুঁকছে। আবাসিক ফ্ল্যাট বেশি হচ্ছে। দুইটা কি তিনটা বাণিজ্যিক ভবন ছাড়া, এখানে এখন বাকি প্রায় সব ভবন আবাসিক।