ডুবুরি যায়, ডুবুরি!: তারাই স্বর্ণখোঁজা ডুবুরিদের শেষ পুরুষ
তপ্ত দুপুর। গ্রামের মেঠোপথে গাছ-গাছালির ছায়া পড়েছে। সে পথ ধরে কখনো বাঁশবাগান, কখনো সুদীর্ঘ মাঠ পেরিয়ে হেঁটে চলেছেন বেদেপল্লির সর্দার মোহাম্মদ কালাম। পরনে তার লুঙ্গি, কোমরে বেঁধেছেন গামছা। একটা লোহার আঁচড়া কাঁধে। হাতে বাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বড় ঝাঁই [ঠোঙা]। কিছুক্ষণ পরপর তিনি হাঁক ছাড়ছেন তারস্বরে: 'ডুবুরি যায়, ডুবুরি! সোনা-রুপা হারানো গেলে খুঁজে দেওয়া হয়।'
হাঁক শুনে বাড়ি থেকে ছুটে এলেন এক গৃহবধূ। দিনতিনেক আগে পুকুরে গোসল করতে নেমে একখানা কানের দুল হারিয়েছেন তিনি। ডুবুরির সঙ্গে দরদাম নিয়ে কথা চলল কিছুক্ষণ। ঠিক হলো, দুল খুঁজে দিতে পারলে চারভাগের একভাগ মূল্য দিতে হবে তাকে। অগত্যা তাতেই রাজি হলেন গৃহবধূ।
নিজের সরঞ্জাম নিয়ে পুকুরে নেমে পড়লেন কালাম। পাড়ে জটলা করে দাঁড়াল উৎসাহী ছেলে-ছোকরাগুলো। ডুবের পর ডুব, তারপর আবার ডুব। এভাবে আধাঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একসময় হাত উঁচিয়ে ধরলেন কালাম। পুকুরপাড়ে হট্টগোল পড়ে গেল। হারিয়ে যাওয়া কানের দুল খুঁজে দিয়ে নিমিষেই সকলের কাছে নায়ক বনে গেলেন তিনি। সঙ্গে ট্যাকে যোগ হলো নগদ তিনটি হাজার টাকা!
কাল্পনিক এ দৃশ্যটি বছরদশেক আগেও গ্রামবাংলায় খুবই পরিচিত ঘটনা ছিল। কালাম সরদারের মতো বেদে সম্প্রদায়ের হাজারও পুরুষের উপার্জনের প্রধান মাধ্যম ছিল হারিয়ে যাওয়া অলংকার খোঁজা। তবে আজ এ পেশাটি বিলুপ্তির পথে। গ্রামের পথে-প্রান্তরে ডুবুরিদের খুব বেশি দেখা মেলে না, কেবল দেয়াল কিংবা গাছে দেখতে পাওয়া যায় তাদের মোবাইল নম্বর।
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় কুমার নদের তীরে অস্থায়ীভাবে বাস করেন একদল বেদে। এদের অনেকেই একসময় গ্রামে-গ্রামে ঘুরেছেন স্বর্ণখোঁজার কাজে। এখনও ডাক পেলে ছুটে যান। তবে গ্রাম পরিব্রাজন হয় কদাচিৎ। এ দলটির প্রধান মোহাম্মদ কালাম সর্দার। বংশপরম্পরায় সর্দারি করছে তার পরিবার। একসময় স্বর্ণখোঁজা আর সাপ ধরাই ছিল মূল পেশা। এখন মূলত কবিরাজি করেই সংসার চলে তার।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে গ্রামে-গ্রামে ডুবুরি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন কালাম। এখন বয়স ষাটের কোঠায়। এ দীর্ঘ সময়ে কতশত অলংকার তুলে দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। দেশের সব অঞ্চল ঘুরেছেন। গিয়েছেন ভারতেও। স্বর্ণখোঁজার ডুবুরির কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। শুধু তা-ই নয়, পুরাতন পুকুর পেলে সেখানে নেমেও কুড়িয়ে এনেছেন মূল্যবান সম্পদ। ভাঙ্গার বেদেপল্লিতে বসে এক মধ্যাহ্নে সেসব গল্প শোনালেন কালাম সর্দার।
"আমরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরতাম, আর ডাক দিতাম: 'ডুবুরি যায়, ডুবুরি।' কোনো মেয়েছেলে পুকুরে গোসল করতি নামত, সোনাদানা হারায় ফালাতো, আমরা সেগুলাই খুঁজতাম। আমাগোরে জায়গাখান দেখায় দিলি আমরা নেমে পড়তাম," বলতে লাগলেন কালাম।
পারিশ্রমিক নিতেন গহনার দামের চারভাগের একভাগ। কিন্তু না পেলে কী হতো? 'দামের কথা আগেই বলা থাকতো। সবসময় তো আর খুঁজি পাইতাম না। না পাইলি তখন চা-পান খাবার অল্প কিছু দিতো।'
এ পল্লির আরেক সদস্য মোহাম্মদ হাশেম। বৃদ্ধ বয়সে এখন অবসর যাপন করছেন তিনি। তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তিনি কুমার নদের পাড়ে বসে বিশ্রাম করছিলেন। দীর্ঘ জীবনে হাজারও পুকুরে নেমেছেন তিনি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। তিন ছেলে এখন কাজ করে বলে নিজে অবসরের সুযোগ পেয়েছেন।
হাশেম জানালেন, খোঁজাখুঁজির কাজে মূলত দুটি যন্ত্র ব্যবহার করেন তারা। বাঁশের লাঠির সঙ্গে লোহার বাঁকা কাঠি সংযুক্ত করে বানানো হয় একটি যন্ত্র। এটি দিয়ে পুকুরের মাটিতে আঁচড় কাটা হয় বলে এর নাম আঁচড়া। অন্যটি বাঁশ, টিন আর প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ত্রিকোণাকৃতির ঝুড়ি। এটিকে তারা বলেন ঝাঁই।
'যেখানে গহনাটা পড়ছে, তার চারপাশের মাটি আঁচড়া দিয়ে টেনে টেনে কাছে আনি। তারপর ঝাঁই দিয়ে মাটি তুলি। সে মাটি ওই ঝাঁইয়ের মধ্যে ধুই। ধুলে পরে সোনাখান যদি সত্যিই পুকুরে পড়ে থাকে, তালি পাওয়া যায়,' বলেন হাশেম।
বিক্রমপুরে স্থায়ী বাড়িঘর রয়েছে ফরিদপুরের বগাইল অঞ্চলের একদল বেদের। তবে ফরিদপুরই তাদের কর্মক্ষেত্র। এ পল্লির মোহাম্মাদ রুবেল এখনও ডুবুরির কাজ করেন। তবে আগের মতো গ্রাম ঘোরা হয় না তার। মাসে একবার বের হয়ে গ্রামে-গ্রামে নিজেদের মোবাইল নম্বর লিখে দিয়ে আসেন। প্রয়োজনে কেউ যোগাযোগ করলে তবেই ছোটেন।
রুবেল জানালেন, স্বর্ণখোঁজার পেশা অন্য যেকোনো পেশা থেকেই লাভজনক। দিনে একটি বা দুটি কাজ পেলেই তাদের এক সপ্তাহের আয় হয়ে যায়। কিন্তু কাজ খুব কম মেলে। তাই গ্রামে না ঘুরে নম্বর লিখে দেন তারা। তা কেমন ডাক পান তিনি? 'খুব বেশি কল আসে না। মাঝেমধ্যে আসলি যাই। অনেক দূরদূরান্ত থেকে ডাক পাই। অনেকসময় যাওয়া হয় না। তবে বিক্রমপুর অঞ্চলে এ কাজ এখনও অনেকেই করে।'
এদিকে কালাম সর্দারের শঙ্কা, একসময় তাদের পেশাটি আর থাকবে না। 'আগে বড় বড় পুকুর ছিল, খালবিল ছিল, মানুষি গোসল করতো। তখন দুই একটা সোনা-দানা পড়লি আমরা তুলি দিতাম। এখন ধরেন পুকুরও নাই, খালও নাই। মানুষ স্বর্ণ পরে না। সবাই নকল সোনা ব্যবহার করে। এখন এই ব্যবসাটা হারাতি বসেছে,' বলেন তিনি।
শুধু এ পেশাটি নয়, জাতিগত প্রায় সব পেশাই হারিয়ে যাবে বলে শঙ্কা এ সম্প্রদায়ের মানুষদের। ব্রাহ্মণকান্দা রেলস্টেশনের বিপরীতে থাকা একদল বেদে জানালেন, জাতপেশা ছেড়ে এখন সাধারণ মানুষের কাজকর্ম করতে হচ্ছে তাদের। কখনো কৃষিকাজ, কখনো আবার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে অন্নসংস্থান করছেন তারা।
কালাম সর্দারের কন্যা আখিনূর বলেন, 'আগে আমরা সাপ ধরতাম, সাপ বিক্রি করতাম, খেলা দেখাতাম, সাপের বিষও চলত। সাপুড়ে ছিল সবাই। এখন আর কেউ সাপ নেয় না, কেনে না। এখন বাড়ি বাড়ি খেলা দেখাতে গেলিও খেলা দেখে না।'
কবিরাজিই এখন তাদের একমাত্র কাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাতের তেল, গাছগাছড়া বিক্রি করি। আর পাখি শিকার করাটা আছে। কয়দিন পর সোনাদানা খোঁজার কাজও থাকবে না।'
বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় একসময় নৌকায় বাস করত। এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে ঘুরে বেড়াত তারা। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীগুলোই ছিলো তাদের আবাসভূমি। তাদের হয়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দিন লিখেছিলেন: 'মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি, আরেক ঘাটে খাই, মোদের ঘর বাড়ি নাই।'
তবে এখন আর সে দিন নেই। দেশের বেদে সম্প্রদায়টি নিজেদের যাযাবর তকমাটি ঘুচিয়ে ফেলেছে। টিনের ছাপরা ঘরের সামনে বসে কালাম সরদার স্মৃতিচারণ করলেন পুরোনো সে দিনের কথা। 'আগেতো আমরা নৌকায় থাকতাম, এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে যাইতাম। এখন খাল-বিলও নাই, নৌকায় থেকে লাভও নাই। এই ভাঙ্গা টাউনে আছি প্রায় বছর বিশেক হলো। কিন্তু আমাগো জায়গা-জমি নাই। থাকি সরকারি জমিতে। তাও ভালো যে, ঝুঁকি নিয়ে ঘুরাঘুরি করতি হয় না।'
স্থায়ী-বসবাস শুরু করার পর থেকেই জাতিগত পেশায় পরিবর্তন আসছে বেদেদের। বর্তমানে এ বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের জাতিগত মূল পেশা বাত-ব্যথার চিকিৎসা, শিঙ্গা লাগানো, মালিশের তেল বিক্রি। এছাড়া ঔষধি গাছ-গাছড়া বিক্রি ও দাঁতের পোকা বের করেন তারা। অন্যদিকে পুরুষেরা ক্রমে আদিপেশা থেকে সম্পূর্ণ সরে আসছেন। তাদের কেউ এখন শ্রমিক, কেউ গাড়ি চালান, কেউ আবার ব্যবসা করেন। অর্থনৈতিকভাবে এখন তারা বেশ ভালো আছেন। আস্তে আস্তে মূলধারার মিশে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই।
কালাম সর্দার জানালেন, তাদের তো লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিলই না, ছেলেমেয়েদেরও পড়াতে পারেননি। তবে তার পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষার দিক ঝুঁকছে। 'আমার নাতিরা স্কুলে যায়, মাদ্রাসায় যায়। লেখাপড়া শিখতিছি। সিওর থাকেন, আমাদের নাতিপুতিরা বেদের কোনো পেশায় আসবে না। এরা বলবেই না তারা বেদে ছিল,' বলেন এ পোড়-খাওয়া বেদে।