লেট দেয়ার বি বুকস: বই দেখবারও জিনিস
বই শুধু পড়বার নয় দেখবারও। এই যেমন ইউরোপের কিছু প্রকাশনীর কথাই ধরা যাক— তাদের এমন অনেক প্রকাশক আছেন, যারা বই দেখার আয়োজন করেন। শুনতে অদ্ভুত লাগছে না? লাগারই কথা বৈকি। আমাদের দেশে এমন কিছু কি হয় নাকি! আমরা তো বাপু টেক্সট বই পড়েই অভ্যস্ত। বইয়ে আবার দেখবো কী!
ইউরোপের ঐসব প্রকাশনীর একেকটি বইয়ের ওজন হয় দেড় কেজি, দুই কেজি বা তিন কেজি। বইয়ের চরিত্রগুলোকে তারা নানানভাবে দেখাবার কথা ভাবেন। তারা ভাবেন, বইগুলো হবে এমন— যেখানে পাঠকের কাছে গল্প হবে দৃশ্যমান। পড়তে পড়তে বিরক্তি আসবে না পাঠকের বা কোনোভাবেই মনোযোগ হারাবার উপায়ও থাকবে না। এতসব ভাবতে ভাবতে বছর গড়াবার উপক্রম। বছর শেষে দেখা যায়, কেবল একটি বই-ই প্রকাশ করতে পেরেছে তারা।
তেমনই একটি প্রকাশনী হলো ফ্রান্সের ডায়েন ডি সেলিয়ের। তারা শেকসপিয়ারের 'মার্চেন্ট অব ভেনিস প্রকাশ' করেছে ৩১২ পৃষ্ঠার, এরমধ্যে ইলাস্ট্রেশন ২৫০টি। বইগুলো তারা প্রকাশ করে সীমিত সংখ্যায়। এই যেমন ৩,০০০ বা ৫,০০০ কপি। দাম ধরা হয় দেড়শো, দুইশো বা আড়াইশো ইউরো। বিক্রি হয়ে যায় মাস বা দুই মাসের মধ্যেই। তারপর থেকে সেগুলো সংগ্রাহকরা পুনঃ পুনঃ নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে বিক্রির জন্য তোলেন, নিলাম হয় এবং বিক্রি হয় কয়েকগুণ বেশি দামে।
বইগুলো সংগ্রাহকদের জন্যই প্রস্তুত করা হয় বিশেষভাবে। বিশেষ বিশেষ সিলমোহর বা স্বাক্ষরও থাকে। এগুলো মূলত ইলাস্ট্রেটেড বুক। যে বইয়ে থাকবে ছবি-গল্প। হাজার পৃষ্ঠার বইয়েও আসবে না কোনোরকম ক্লান্তি। মনোযোগের হেরফের হওয়ারও সুযোগ নেই, বরং পাঠক সানন্দে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে বইয়ের জগতে মেতে থাকবেন। আমাদের দেশে এসবের চল নেই। ফলে কোনো ধারণাও নেই এই বিষয়ে। তবে এমন কেউ আছেন, যিনি চান দেশেও হোক এই ধারার চর্চা।
সাধারণত জমি-জমা বা হীরা জহরতে লোকে টাকা বিনিয়োগ করে। সাগর কান্তি দেব বিনিয়োগ করেন বইয়ে। বইয়ের সঙ্গে তার ওঠাবসা স্কুলবেলা থেকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে সেটা আরও বেড়েছে। বলতে গেলে বইয়ের নেশায় মজেছেন। ১৩ বছর ধরে আছেন প্যারিসে। ইউরোপে যাওয়ার পর চোখ খুলে যায় তার। বইয়ের এক আলাদা জগতের সাথে পরিচত হন সেখানে।
দেখতে পান, বই নিয়ে নানান কিছু করে তারা। মুদ্রণে, বাঁধাইয়ে, চিত্রণে বইগুলো হয় অনন্য। তা এতই সুদৃশ্য হয়ে ওঠে যে, মূল্যবান কোনো রত্নের চেয়েও বেশি আকর্ষণ করে। তারা বইকে শুধু বইয়ের মধ্যে আটকে রাখেন না, তারা বইয়ের পুরো জগতটাকেই তুলে ধরেন বাস্তবিক ভাবে। বিখ্যাত সব গল্পের চরিত্র দিয়ে বানান দাবার গুটি বা ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। বইয়ের বর্ণনা থেকে আঁকেন দৃশ্যপট। এমনভাবে সেসব বই বাঁধাই করা হয় যে, যদি কেউ চান, তবে ঘরের দেওয়ালেও তা ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন স্বচ্ছন্দ্যে।
এতেও শেষ হয় না— দিয়াশলাই বাক্সের গায়ে দেখা যায় ডন কিহোতে বা লে মিজারেবলের চরিত্রগুলোকে। তাস বাক্সও বাদ যায় না অথবা চায়ের কাপ-পিরিচ।
২০১৪ সালের কথা। দেশের মানুষ যেন বই ও অনুষঙ্গগুলো দেখতে পান, সে উদ্দেশ্যে জনকয়েক বইপ্রেমী বন্ধুর সঙ্গে মিলে বইয়ের জাহাজ নামে একটি ফেসবুক পেইজ খোলেন সাগর। দেশের অভ্যন্তরের যেসব পাঠক দীর্ঘদিন বিদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো সংগ্রহের উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না, বইয়ের জাহাজ তাদের সে সুযোগও বের করে দিল। দশ বছর ধরে বইয়ের জাহাজ পশ্চিমা দুনিয়ার নান্দনিক বইপত্র ও সংশ্লিষ্ট সংগ্রহযোগ্য পণ্য সুলভমূল্যে ইউরোপ থেকে সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছে দেশের পাঠক ও সংগ্রাহকদের হাতে।
দুষ্প্রাপ্য ও সুগ্রন্থিত বই ও বইয়ের অনুষঙ্গ সংগ্রহ সাগরের নেশা। পেশাগত কাজের বাইরের বাকি সময় তার ওতেই কাটে। বইয়ের সঙ্গে সাগর গেল এক যুগে মিনিয়েচার পেইন্টিং, ভাস্কর্যের অনুকৃতি, আফ্রিকান মুখোশ, দাবার বোর্ড, তাস বাক্স ইত্যাদি সংগ্রহ করেছেন। তার সংগ্রহে আছে বেশ কিছু পপ-আপ বুকও। বইকে জীবন্ত করে তোলে এ পপ-আপ বুক, পাতা ওল্টালেই ভেতরের ছবি বা চরিত্রগুলো ত্রিমাত্রিক রূপ নেয়।
ড্রিমওয়ার্কসের 'দ্য লিজেন্ড অব শ্রেক', জেকে রাউলিংসের 'উইজার্ড ওয়ার্ল্ড' আছে সাগরের সংগ্রহে। 'উইজার্ড ওয়ার্ল্ডকে' ত্রিমাত্রিক করেছেন জেমস ডায়াজ। তাকে বলা হচ্ছে পেপার ইঞ্জিনিয়ার। অবশ্য তার করা প্রচ্ছদেও লেখা হয় পেপার ইঞ্জিনিয়ারিং বাই জেমস ডায়াজ। আমাদের দেশে এমনটা চোখে পড়ে না সচরাচর। নেই এসব নিয়ে কোনো উদ্যোগও। আমরা সেই সাদাকালো ছাপা অক্ষরের টেক্সট বইয়েই কাটিয়ে দিলাম অনেকটা সময়। এখনো সে ধারা থেকেই বের হওয়ার নাম গন্ধও নেই।
সাগর এ প্রসঙ্গে দুঃখ করে বলছিলেন, "অনেক কিছুই হচ্ছে আমাদের দেশে, কিন্তু বইয়ের ব্যাপারে আমরা বেশি একটা আর আগাইনি। অথচ এটি একটি উর্বর ক্ষেত্র, অর্থনৈতিক দিক থেকেও।"
সেলিয়ের প্রকাশিত বাল্মিকির রামায়ণ সংগ্রহ করেছেন সাগর। বইটি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সাগর বলেন, "রামায়নের নানান গল্প ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশজুড়ে। আর হাজার বছর ধরে রামায়ন ঘিরে আঁকা বিচিত্র সব ইলাস্ট্রেশন ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা, কাতার কিংবা সুইজারল্যান্ড কোথায় নেই রামায়ন?"
দীর্ঘ ১০ বছরের গবেষণায়, অনেক পণ্ডিতের সহযোগিতা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে রামায়ণের ৫,০০০ ইলাস্ট্রেশন এক করা হয়, সেখান থেকে বাছাই করা হয় ৬৬০টি। সম্রাট আকবরের নির্দেশে ১৬৬টি ইলাস্ট্রেশন করা হয়েছিল রামায়ণের, রাজপুত রাজারাও করিয়ে নিয়েছিলেন আরও কিছু। আর্ট ডিলার, প্রাইভেট কালেক্টর, মিউজিয়াম থেকেও সংগ্রহ করা হয় অনেক ইলাস্ট্রেশন। চুরি যাওয়া কিছু কাজও উদ্ধার করা হয়। এগুলো একসঙ্গে এর আগে কারোরই সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি।
মূল সংস্কৃত থেকে অনূদিত সাত খণ্ডের এই রামায়ণ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে, ওজন দাঁড়ায় ১৫ কেজি। প্রকল্পটি তত্ত্বাবধান করেছেন গিমে মিউজিয়ামের এশীয় শাখার কিউরেটর আমিনা তাহা হুসেইন-ওকাদা। মাত্র ৩,০০০ কপি প্রকাশ করা হয়েছে বইটির, যাকে চলন্ত জাদুঘর বলতেই বেশি পছন্দ করেন বইপ্রেমীরা। প্রকাশের পর পরই বইটি সাড়া ফেলে দেয় সংগ্রাহকদের মধ্যে। দাম রাখা হয়েছিল হাজার ডলার, কিন্তু তাতে সংগ্রাহকদের উৎসাহে কোনো ভাটা পড়েনি। অল্পকাল পরেই প্রকাশনী ঘোষণা দেয়, আর কোনো কপি স্টকে নেই। এখন তাই সংগ্রাহকের কাছে থাকা কপিই হাত বদল হচ্ছে চড়া দামে।
চার বছর পর, গেল ৫ জুন দেশে এসেছেন সাগর কান্তি দেব। প্রদর্শনীর ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন অবশ্য আগেই। ঘোষণায় বলেছেন, "আমরা বইয়ের জাহাজ, আগামী ০৭-০৮ জুন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আর্ট গ্যালারিতে 'প্যারাডাইজ অ্যান্ড পেপারস: লেট দেয়ার বি বুকস' শিরোনামে একটি ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীর আয়োজন করতে যাচ্ছি। বই তো শুধু পাঠ্য উপাদান নয়, দ্রষ্টব্য উপাদানও বটে। বৈচিত্র্যময় মনোগ্রাহী মুদ্রণ ও বাঁধাই, সংগ্রাহকদের জন্য ছাপা হওয়া বিশেষ বিশেষ সংস্করণ, লেখকের স্বাক্ষর প্রভৃতি নানা কারণে একটি বইয়ের বনেদী আমেজ তৈরি হয়। পশ্চিমের দেশগুলোতে নিয়মিতই এ ধরনের বই বা পণ্যের কেনাবেচা হয়। প্রদর্শনীতে বেশ কিছু দুর্লভ, বর্ণিল ও সংস্করণ বইয়ের পসরা থাকবে। আরও থাকবে বিভিন্ন মহাদেশের মুখোশ, ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, দাবার বোর্ড। দেখার পাশাপাশি থাকবে সীমিত আকারে কেনার সুযোগও।"
জমি-জমা, গাড়ি-বাড়ি, ব্যবসায় বিনিয়োগের ব্যাপারটি আমাদের বোঝাপড়ায় আছে কিন্তু বইয়ে বিনিয়োগের ব্যাপারে জানাশোনা নেই। সাগর কান্তি দেব আশা করছেন, বইয়ে বিনিয়োগ কীভাবে করা যায় এবং প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে– তা জানার সুযোগ মিলবে এই প্রদর্শনী থেকে। ফ্রান্স থেকে আসার সময় সাগর যতগুলো গাট্টি নিয়ে এসেছেন, সবগুলোতেই ছিল বই ও বিভিন্ন অনুষঙ্গ।
৬ জুন সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে গ্যালারি সাজাতে শুরু করেন তিনি। গাট্টি বা ব্যাগ থেকে যা-ই বের করছিলেন তাতেই আমরা চমকে যাচ্ছিলাম। রূপকথায় জাদুর কাঠি নাড়ালে যেমন নতুন নতুন জিনিসের আবির্ভাব হতো, তার ব্যাগ থেকেও ঠিক এমন কিছুই বের করছিলেন তিনি। মিউজিয়ামের সিল লাগানো মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড (ব্রোঞ্জ রেপ্লিকা) আমাদের মন কেড়ে নিল। আফ্রিকান মিউজিশিয়ান ফ্যামিলির সেটটাও অদ্ভুত! রুমির স্পিরিচুয়াল পয়েমস বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বা ফ্রেন্ডশিপ পোয়েমস অব রুমি দেখেও মুগ্ধ আমরা।
এই তালিকা অতি দীর্ঘ, প্রদর্শনী দেখেই কেবল এর হিসাব মেলানো সম্ভব। আমরা অবশ্য বিশেষ সুপারিশ রাখছি অ্যারাবাইন নাইটস বা আরব্য রজনী বইটি দেখার জন্য। জার্মানির তাসেন নামের আরেক বিখ্যাত প্রকাশনী এটি প্রকাশ করেছে। এর ইলাস্ট্রেশনগুলো কে রাসমুস নিয়েলসেনের (১৮৮৬-১৯৫৭) আঁকা। জন্ম মৃত্যুর সাল দেখেই বোঝা যাচ্ছে বইয়ের জন্য তিনি ইলাস্ট্রেশন করেননি। জীবদ্দশাতেই নাম করেছিলেন ড্যানিশ এই ইলাস্ট্রেশন শিল্পী।
আরব্য রজনীর ইলাস্ট্রেশনগুলো ছিল অপ্রকাশিত। ১৯১৯ সালে করেছিলেন অ্যারাবিয়ান গীতল ধারা অনুসরণ করে। ব্যবহার করেছিলেন নীল, ঘন নীল, সোনালি, গাঢ় লাল রং। একটি কাঠের বাক্সে ভরে রেখেছিলেন ওই ২১টি ইলাস্ট্রেশন। বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সয়ে টিকেছিল সেগুলো। তার মৃত্যুরও কয়েক বছর পর সেগুলো উদ্ধার করা হয়। আরও ষাট বছর পর তাসেন ইলাস্ট্রেশনগুলো ব্যবহার করে প্রকাশ করে আরব্য রজনীর ইলাস্ট্রেটেড কালেক্টরস সংস্করণ।
১৪৪ পৃষ্ঠার ঢাউস বইয়ের সঙ্গে ভেলভেট বাক্সে ভরে একটি আলাদা খামে পুরে দেওয়া হয়েছে ইলাস্ট্রেশনগুলো। ৪.৫ কেজি ওজনের বইটি প্রকাশিত হয়েছে ৫,০০০ কপি। শুরুতে বইটির দাম ধরা হয়েছিল ২৫০ ইউরো। কিন্তু বর্তমানে এর বাজারমূল্য লাখের কাছাকাছি।
ইউরোপের বিখ্যাত নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাটাউইকিতে বইটি তুলেছিলেন সাগর। দাম উঠতে উঠতে ৯০০ ইউরোতে উঠেছিল। ইউরোপে বিক্রি ভালো, কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট নন। দেশেই এসবের প্রসার চান সাগর। এবারের প্রদর্শনী সফল হলে সামনের সময়গুলোতেও এমন প্রদর্শনী আয়োজনের ইচ্ছা আছে তার। বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্য আছে কিন্তু সুখ কই? তাই দেশে আসা তার কাছে সুখকর, আর তা যদি হয় বইয়ের জন্য তবে তো সোনায় সোহাগা।