বইয়ের জাহাজ: বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রথম বই আনতে শুরু করে যে অনলাইন শপ...
একসময় নিউমার্কেটের লাইব্রেরীগুলো থেকে নিয়মিত বিদেশি সাহিত্যের বই কিনতেন সাকু চৌধুরী। কিন্তু এখন অনলাইনেই সেই সুবিধা পাওয়া যায় বলে সরাসরি গিয়ে বই কেনা আর হয়ে ওঠে না তার। অ্যামাজনসহ ফেসবুকের অনেকগুলো পেজ থেকেই তিনি বই কিনে থাকেন কম-বেশি। তবে, বাইরের বই কোত্থেকে নেওয়া ভালো সে বিষয়ে কেউ পরামর্শ চাইলে তিনি সবার আগে যে নামটি উচ্চারণ করেন তা হলো, 'বইয়ের জাহাজের সাগর'দা'।
এই সাগরদার পুরো নাম সাগর কান্তি দেব, যিনি পেশায় চাকরিজীবী এবং বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাসরত। দেশের বাইরে বহুবছর ধরে থাকলেও মনটা তার থাকে বাংলাদেশেই। আর তাই সময়ে-অসময়ে নিজ দেশের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছে জাগত মনে। সেই প্রেরণা থেকেই শেষমেশ বিদেশের মাটিতে বসেই বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করলেন বইয়ের ব্যবসা (বইয়ের জাহাজ)।
'বইয়ের জাহাজ'-এর পাল তোলার শুরু
সাগর কান্তি দেবের ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস। এই অভ্যাসে ছেদ পড়ে ২০০৯ সালে দেশের বাইরে চলে যাবার পর। হাতের কাছে বই পাওয়া যেত না বলে পিডিএফ ফরম্যাটে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়। সেইসাথে বইপ্রেমী হওয়ায় ফেসবুকের বিভিন্ন বইয়ের পেজেও এসব বই নিয়ে গল্প, আলোচনা, আড্ডা দিতেন সাগর।
'২০১১-১২ সালের দিকে বইপড়ুয়া নামে ফেসবুক গ্রুপে আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম। তখন খেয়াল করলাম, অনেকেই বিদেশি বইগুলোর জন্য ছটফট করেন। তখন তো একটা সিনেমা বা বই বের হলে সাথে সাথে সেটা দেশে পাওয়া যেত না। পাঠাতে পাঠাতে অনেক সময় লাগত। সেখান থেকেই ২০১৩ সালের শেষের দিকে কবি খান রুহুল রুবেলের সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে অনলাইনে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আমরা শুরু করি এই যাত্রা,' বলেন সাগর।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ড. ওয়াসিফ ই এলাহী এবং তার মা খালেদা আক্তারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের রাজধানীর রামপুরাস্থ বাসাতেই শুরু থেকে এখন অবধি চলছে বইয়ের জাহাজের কার্যক্রম। মাঝে ২০১৭-তে ড. ওয়াসিফ অস্ট্রেলিয়া চলে গেলে ২০১৭ থেকে ২০২০ এই তিন বছর বইয়ের জাহাজের দেশের সমস্ত কার্যক্রম দেখাশোনা করতেন তাদের আরেক বন্ধু সুখ পাখি খান। যিনি পরবর্তীতে ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাতিঘরে ছিলেন।
অন্যদিকে শুরু থেকে বইয়ের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আর টান থাকার কারণে একটা সময় পর্যন্ত দেশের সবকিছু পরিচালনা করে গেছেন খালেদা আক্তার। বর্তমানে তিনিও ছেলের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়াতে আবারও সমস্ত দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে বইয়ের জাহাজেরই একসময়ের ক্রেতা এবং অনুবাদক, লেখক ফারুক বাশারের হাতে।
বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটি খুব শক্ত
প্রথমদিকে বন্ধুবান্ধবরা মিলেই বই অর্ডার নেওয়া এবং পাঠানোর কাজ করতেন। যার যে বই দরকার, ইনবক্সে বা ফোনে জানিয়ে দিলে এরপর তারাই সেগুলো কিনে পাঠিয়ে দিতেন দেশে। তখন পর্যন্ত কোনো অগ্রিম চার্জ নেওয়া হতো না বইগুলোর জন্য। ফলে দেখা যেত অনেকেই বইয়ের অর্ডার দিয়ে, সে বই আর নিচ্ছে না।
এরকম আরও কিছু সমস্যা দেখা দিলে, তখন যারা প্রকৃত বইপ্রেমী, বই নিচ্ছিলেন, তারাই বইয়ের জাহাজের জন্য একটা নিয়ম করে দিলেন। তাদের পরামর্শমতো বইয়ের খরচের ওপর চার্জ রাখা শুরু হলো।
এ ব্যাপারে সাগর কান্তি দেব বলেন, 'আমরা তো মূলত একটি বিজনেস পেজ, কিন্তু কাস্টমাররা নিজেরাই যখন এরকম কোনো পরামর্শ দিল, তখন বুঝলাম যে আমরা আসলেই আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটি ধরে রাখতে পেরেছি তাদের কাছে।'
বিশ্বাসযোগ্যতার এ জায়গাটি খুব শক্ত বলেই এখনো নিয়মিত বইয়ের জাহাজ থেকে অর্ডার করেন হাসান শিবলি। সেই ২০১৫ সালে যখন বইয়ের জাহাজ যাত্রা শুরু করে, সেবার ৫-৬টা বই অর্ডার করেন শিবলি। সবগুলোই ছিল মূলত অক্টাভিও পায, পাবলো নেরুদার মতো লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের বই।
হাসান শিবলি বলেন, 'আমাদের দেশে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকর্মগুলো খুব একটা পাওয়া যায় না। এর আগে আমি অ্যামাজন থেকেই বই নিতাম, কারণ তখন বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক সেরকম বইয়ের কোনো দোকান ছিল না। বইয়ের জাহাজই প্রথম এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আসে।'
এখন পর্যন্ত তিনি নিয়মিত প্রতিমাসে এখান থেকে বই কেনেন। আগে হয়তো মাসে ২০-২৫টি বই অর্ডার করতেন, এখন সে সংখ্যা বছরে চলে গেছে। তবে সংখ্যা কমে এলেও নিয়মিত লেপটে আছেন বইয়ের জাহাজের সঙ্গে।
বিভিন্ন দেশের সাহিত্য, কমিক্স, ফ্যান্টাসি, ফিকশন, আর্ট বা পেইন্টিংয়ের বইগুলোর পাশাপাশি একাডেমিক বইগুলোও অর্ডার করা যায় এখানে। ব্যক্তিপর্যায় থেকে যেমন অর্ডার আসে, তেমনি বিভিন্ন প্রসিদ্ধ বইয়ের দোকান (ব্যবসায়িক কারণে নাম উল্লেখ করা হয়নি) থেকেও অর্ডার আসে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বইয়ের জাহাজ থেকে বই সংগ্রহ করে থাকে।
সাগর বলেন, 'করোনার আগে ব্যক্তিপর্যায় থেকে বইয়ের অর্ডারের সংখ্যা কমে গেছে। হয়তো মানুষের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের জন্যই। তাই এখন আমাদের বেশিরভাগ অর্ডার আসে বিভিন্ন বুকশপ আর ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে। এই তো গত মাসেও বুয়েটে দিলাম বই!' এছাড়াও ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ আরো বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই দেবার কথা জানান তিনি।
সাহিত্য, ফিকশন, কমিক্স সব ধরনের বইয়ের ক্রেতাই আছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে সাগর মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষ শিল্পকলা, চিত্রকর্ম—এই বিষয়গুলোতে অনেক পিছিয়ে এবং অনাগ্রহী। তাই ব্যক্তিগতভাবে হোক আর বইয়ের জাহাজের মাধ্যমেই হোক, সাগর চেষ্টা করেন তার সংগ্রহে আর্ট, পেইন্টিং সম্পর্কিত বইগুলোর সমৃদ্ধ সংগ্রহ রাখতে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে কালেকটরস এডিশনের বইয়ের প্রতি বইপ্রেমীদের আগ্রহ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
'আসলে ব্যবসার চেয়েও তারা বেশি জোর দেয় মানুষের বইপ্রেমকে'
বইয়ের জাহাজের বয়স আজ প্রায় আট বছর। এই আট বছরের পথচলায় বইয়ের জাহাজের প্রাপ্তির ঝুলিতে নেই কোনো বাণিজ্যিক মুনাফা। বরং ক্রেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আর ভরসাই তাদের পুঁজি।
বইয়ের জাহাজের বইয়ের আরেক নিয়মিত পাঠক আশরাফুল আলম বলেন, 'বইয়ের জাহাজ থেকে আমি মূলত বিভিন্ন বিদেশি আউট অভ প্রিন্ট রেয়ার বইগুলোই নিয়ে থাকি। এমনও হয়েছে দু-তিন বছর পর কোনো বই তারা আমাকে খুঁজে দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে নেওয়া আমার খুব আকাঙ্ক্ষিত একটি বই ছিল, "দ্য কমপ্লিট লেটার্স অব ভিনসেন্ট ভ্যানগগ"।'
'আবার, কোনো বইয়ের একাধিক অপশনের মধ্যে দেখা যায় যে বইটির দাম কম, সে বইটি নেওয়ার পরামর্শ দেয় আমাদের, যেন খরচটাও কম হয় কাস্টমারদের। যা আসলে একজন ব্যবসায়ীর বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের করার কথা না। তাই বইয়ের জাহাজ বা সাগর কান্তি দেবকে নিয়ে বলতে হলে বলব, আসলে ব্যবসার চেয়েও তারা বেশি জোর দেয় মানুষের বইপ্রেমকে।' বলেন আশরাফুল আলম।
করোনার আগপর্যন্ত এই ব্যবসার সবকিছু মোটামোটি মসৃণই ছিল। কিন্তু করোনা এসে একদিকে যেমন পাঠক সংখ্যা কমিয়ে দিল, তেমনি সবকিছুতে কড়াকড়ি, খরচগুলোও দ্বিগুণ হয়ে যায়।
'২০১৪-১৫ সালে এক কেজি বই দেশে নিতে ৫ পাউন্ডের মতো খরচ হতো, আর এখন সেটা ৮ পাউন্ড। করোনার শুরুতে ছিল ১০ পাউন্ড। আগে দেশে যেখানে বই যেত ৩০০-৪০০ কেজি, এখন সেটা ৫০-৬০ কেজিতে নেমে এসেছে,' সাগর বলেন।
করোনার আগে প্রতি মাসেই বই কিনতো ১৫-২০ জন, এখন সেটা ৭-৮ জনে এসে ঠেকছে। সাগর মনে করেন, তাদের এই পাঠকসংখ্যা কমে যাওয়াটা আসলে বইপড়ুয়া কমে যাওয়ার জন্য নয়, বরং তিনি মনে করেন পাঠক এখন ভাগ হয়ে গেছে। ২০১৬-১৭ সালে এসে আরও অনেকেই এই ব্যবসা শুরু করেছে। এখন ফেসবুকে ২০-২৫টা বইয়ের পেজ আছে, যারা বিদেশি বই নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু শুরুটা বইয়ের জাহাজের হাত ধরেই।
লেখকের স্বাক্ষরিত লিমিটেড এডিশনের বইও এনে দিচ্ছে বইয়ের জাহাজ
আর এর কারণ হিসেবে অনেকটা নিজেদেরই দায়ী করেন পেজটির দুই পরিচালক সাগর কান্তি দেব ও আরাফাত হোসেন। প্রথমত, বইয়ের জাহাজের নেপথ্যের প্রতিটি মানুষ থাকে দেশের বাইরে। তাদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ ফেসবুকের মাধ্যমেই।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে তাদের নেই কোনো শো-রুম, অফিস বা কর্মচারী। দেশে একসময় যিনি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন—ড. ওয়াসিফ ই এলাহী, বইয়ের জাহাজের যুগ্ম পরিচালক—তিনিও পিএইচডির কাজে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। ফলে পুরো কার্যক্রমটি আসলে পরিচালিত হয় ভার্চুয়াল জগতেই। একে একটা বাধা মনে করেন সংস্থাটির সহপরিচালক আরাফাত হোসেন।
'খুব কম মানুষই জানে বইয়ের জাহাজের পেছনের মানুষগুলো কারা। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই-ই একটু আড়ালে থাকি। যেখানে বইয়ের জাহাজ পেইজের লাইক এক লাখ দশ হাজার, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো এক হাজার মানুষও চেনে না আমাদের,' বলেন ড. ওয়াসিফ ই এলাহী।
এছাড়া পেজে নিয়মিত আলোচনা, পেজ বুস্ট আপ বা স্পন্সর করা, বিভিন্ন ভ্লগ বা ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করা এসব দিক দিয়েও বইয়ের জাহাজ এখনও সরব হয়ে ওঠেনি। যার কারণে অন্যান্য ফেসবুক পেজগুলোর তুলনায় বইয়ের জাহাজ এখন কিছুটা নীরব হয়ে গেছে।
তবে সাগর জানান, কে বই নিচ্ছে, কারা নিচ্ছে বা কতটুকু নিচ্ছে, তাদের কাছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো জাহাজে করে দেশে যাচ্ছে অন্তত! এবং সবগুলো অরিজিনাল বই। কখনো কখনো লেখকের স্বাক্ষর করা লিমিটেড এডিশনের বইও তারা এনে দিচ্ছেন বাংলাদেশি পাঠকদের দোরগোড়ায়। নানান খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ সংবলিত বায়োগ্রাফি কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে দুর্লভ হয়ে যাওয়া কোনো একটা কালেকটরস এডিশনের বই দুনিয়ার এক মাথা থেকে অন্য মাথা হলেও খুঁজে বের করে এনে দেন তারা। আর এসব বইয়ের প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম না!
প্রতিটি বইয়ের ওপর ১০-১৫% চার্জ, আর সেই সামান্য লভ্যাংশটুকুও তারা নেন না!
ভারতীয় বই এনে দিচ্ছে, এমন ফেসবুক পেজগুলোর ব্যবসায়িক লাভ বা পরিচিতি যেখানে তুঙ্গে, সেখানে বইয়ের জাহাজ অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। আবার অ্যামাজনে যেখানে বাজারমূল্যেই চার্জসহ পাউন্ডের হিসেব দেওয়া থাকে, সেখানে বইয়ের জাহাজ কেবল প্রতিটি বইয়ের মূল্যের ওপর ১০-১৫ শতাংশ চার্জ নিয়ে থাকে। কোনো নির্ধারিত চার্জ নেই এখানে। ফলে তাদের মুনাফার দিকটিও অন্যদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
কিন্তু বইয়ের জাহাজ যেহেতু পরিচালকদের কারোরই প্রধান পেশা নয়, বরং দেশের প্রতি একধরনের দায়বদ্ধতা এবং প্রেম থেকেই এই পথচলার শুরু, তাই এখান থেকে উঠে আসা সামান্য লভ্যাংশটুকুও তারা বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার পেছনে ব্যয় করে। যেমন, ২০১৭ সালে বইয়ের জাহাজ, সঙ্গে আরও কিছু বন্ধু মিলে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশের বাচ্চাদের একদিনের খাবার বিতরণ করেছেন। আবার বন্যার্ত, শীতার্তদের ত্রাণ দেওয়া, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বই পাঠানো বা সমমূল্যের খরচ দেওয়া প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত বইয়ের জাহাজ।
শুধু বাইরে থেকে দেশে নয়, বাংলাদেশ থেকে বই কীভাবে বাইরে পাঠানো যায়, সে নিয়েও ভেবেছিলেন সাগর কান্তি দেব। কিন্তু বাংলাদেশের ডাক অধিদপ্তর এক্ষেত্রে সুবিধাবান্ধব কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়।
সাগর বলেন, 'যেখানে ২০১৫-১৬ সালে এক কেজি বই আনতে ১,৪০০ টাকা লাগতো, সেটা বাড়তে বাড়তে এখন ৩,২০০ টাকা। বাংলাদেশি ১০০ টাকার বই ফ্রান্সে বসে পেতে হলে আমাকে খরচ করতে হবে ৩৩০০ টাকা। এই যে মাখখানে খরচটা চলে যায়, এটা পাঠক বুঝতে পারবে না। চীন পোস্টেজে চরমভাবে ভর্তুকি দেয়, যে কারণে আলী এক্সপ্রেসের মাধ্যমে ওদের পণ্য কিন্তু ছড়িয়ে গেল।'
ফেসবুক পেজের শুরু ২০১৪ সালে। আর বইয়ের জাহাজ প্রকাশনীর শুরু ২০১৭ সালে। এ পর্যন্ত চারটি বইমেলায় অংশ নিয়েছে বইয়ের জাহাজ প্রকাশনী। তবে পরিবেশক থাকে অন্য প্রকাশনী। যেমন, প্রথম বইমেলায় বাতিঘর পরিবেশক, এরপরের তিনবার পরিবেশক ছিল চৈতন্য প্রকাশনী। এ পর্যন্ত বইয়ের জাহাজ প্রকাশনী থেকে পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্য প্রথম বই কবি খান রুহুল রুবেলের 'ডুবোপাহাড়' প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে, যার পরিবেশক ছিলো বাতিঘর।
লিওনিড সলোভিয়ভ-এর 'দ্য টেল অভ নাসিরুদ্দিন হোজা'র অনুবাদ 'ফিরে এলেন হোজা'র অনুবাদক ফারুক বাশার এবং ইসমাঈল কাদারের 'দ্য জেনারেল অভ দ্য ডেড আর্মি' বইটির অনুবাদ করেন মোশাররফ হোসেন। পরের বছরই, অর্থাৎ ২০২০ সালে মোশাররফ হোসেনের অনুবাদে অ্যানি ক্যামেরনের বিখ্যাত উপন্যাস 'ডটারস অভ কপারস ওম্যান'-এর বাংলা অনুবাদ 'তাম্রপ্রভার মেয়েরা' আসে বইয়ের জাহাজ থেকে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২-এ এসে দুই বছরের বিরতির পরে প্রয়াত অনুবাদক, লেখক মাসুদ মাহমুদের 'ফুটবল রঙ্গ' নতুন করে প্রকাশ করল বইয়ের জাহাজ।
বইয়ের জাহাজ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত তার চেয়েও বড় যে দিক তা হলো, তাদের প্রকাশিত বইগুলো যারাই পড়ে, তারাই এর প্রশংসা করে। তাই পরিচিতি বেশি না হলেও, প্রাপ্তিটা অনেক বড়! ভবিষ্যতে তাদের ইচ্ছে, তাদের প্রকাশনীকে ঢাকায় একটা স্থায়ী রূপ দেওয়া।
তবে শুধু বই নয়, সাথে কালেক্টিভ দাবার সেট, বই পড়ার কিন্ডল, কাঠের খোদাইকৃত বক্স, বিভিন্ন পেইন্টিংয়ের থিমবিশিষ্ট গলার লকেট, ব্রেসলেট, চাবির রিং, পেইন্টিং সামগ্রীর মতো নানা কিছুও সংগ্রহে রাখেন। এসব শৌখিন সামগ্রীর প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম না!
শুরুটা 'বইয়ের জাহাজ'-এর হাত ধরেই
এখন ফেসবুক ঘাঁটলেই বিদেশি বই এদেশে নিয়ে আসছে এমন অনেক বাংলাদেশি পেজ বা বুকশপ পাওয়া যায়। কিন্তু যখন এসব কিছুই ছিল না তখন এদেশের বইপ্রেমীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল 'বইয়ের জাহাজ' পেজটি।
শুরু থেকে যেভাবে পাঠকদের আস্থা আর পছন্দের স্থানটি দখল করেছিল এই ফেসবুক পেজটি, তা এখনো অপরিবর্তনীয়। নতুন নতুন পেজ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সে পাঠকসংখ্যায় কিছুটা ভাগ হয়তো বসেছে, তবে তাতে হতাশ হয়ে পড়েনি বইয়ের জাহাজ। কারণ ব্যবসার চেয়েও দেশে যে বইগুলো যাচ্ছে, সেটিই তাদের কাছে বড় প্রাপ্তি। আর তাই নিজেদের দায়িত্ব ও সেবাপ্রদানে তারা এতটুকুও সরে আসেনি কখনো। বরং কাজ করে যাচ্ছে ঢাকায় নিজেদের একটি কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নে।
অদূর ভবিষ্যতে ঢাকায় অথবা দেশের অন্য কোন শহরে আবারও বই নিয়ে মেতে ওঠার আনন্দে মাততে পারবেন—এই স্বপ্ন নিয়েই প্রবাসী জীবন যাপন করছেন তারা।