দেশের ‘রাজা-বাদশারা’ এখন গাবতলীতে
ফি বছর এ সময় দেশের 'রাজা-বাদশা'দের একটি বড় অংশ চলে আসে গাবতলীতে। এদের দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না, গতরে-বহরে এত বিরাট হয় যে, মুখ ফুটে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে: 'অবিশ্বাস্য'! চলনে-বলনে-গড়নে রাজা-বাদশার মতোই তাবড়। তাই সুলতান, রাজা, বাদশা, বাহাদুর নামে এরা ভূষিত হয়।
গরুগুলো ওজনে এক হাজার কেজির কম হয় না। কেউ কেউ বড় গরু উৎপাদনে ধারাবাহিক সাফল্য দেখিয়ে নাম করেছেন, আছমত আলী তাদের একজন। এবার তিনি দুটি বিরাট গরু প্রস্তুত যেগুলোর নাম রেখেছেন 'বিগ বস থ্রি' ও 'সুপার বস থ্রি'।
তারকাদের নামেও নাম রাখা হয় কিছু গরুর। ওজনে যা-ই হোক, এগুলো গোলগাল, নাদুস-নুদুস হয়। গায়ে আলতার নকশা, শিংয়ে দেওয়া হয় মেহেদী। বেপারী বলেন, 'পরীমনিকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাই, প্রতিদিন ৫–৭টা শ্যাম্পু লাগে। সুপারস্টার, হ্যান্ডসাম ছেলে পেলে তবেই ছাড়ব।'
১৩ জুন বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় ২২টি গবাদি পশুর হাট কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বিকিকিনি শুরু করেছে। গাবতলী হাট ঐতিহ্যবাহী, বিশাল এবং নামকরা। বড় বড় গরু এ হাটেই বেশি ওঠে, কারণ ক্রেতা পাওয়া যায় তুরন্ত।
আঁচ করা যাচ্ছিল, তবে ভরসা করা যাচ্ছিল না। আগের দুদিনও আকাশ মুখ ভার করেছিল, কিন্তু বৃষ্টি ঝরায়নি। বৃহস্পতিবার বিকেলে হাটের মুখে গিয়ে মাত্র নেমেছি, আর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি ঝরা শুরু। এরপর রীতিমতো ঝড়। থামলে পরে হাটের গেট দিয়ে ঢুকে সোজা পাশাপাশি দুটি শেডে সব বড় বড় গরুর সঙ্গে মোলাকাত।
নূর ইসলাম ফকির ফ্রিজিয়ান জাতের বিরাট এক ষাঁড় নিয়ে এসেছেন রাজবাড়ির পাংশা থেকে। উপজেলা সদরে নিয়ে গিয়ে মেপে দেখেছেন, সাড়ে তিনবছর বয়সি ষাঁড়টির ওজন প্রায় এক হাজার ৫০ কেজি। নাম রেখেছেন কিং, 'রাজবাড়ির কিং'। ধান, পাট, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা আবাদ করেন নূর ইসলাম। ঘাস, ভুষি, ভুট্টার গুঁড়ো, বুটের ডাল খাইয়েছেন কিংকে, বাড়তি ফিড খাওয়াননি। দাম হাঁকছেন ১০ লাখ টাকা।
প্রবাসী সবুজের 'জায়েদ খান'
সৌদি আরব থেকে সবুজ দেশে আসবেন ১৮ জুন। গরুর 'জায়েদ খান' নামটি দিয়ে গেছেন ইউটিউবারেরা। ময়মনসিংহের ফুলপুর থেকে চার বছর বয়সি ২৫ মণ ওজনের গরুটিকে গাবতলীতে নিয়ে এসেছেন সবুজের ভাই আজহার। এক লাখ টাকা দিয়ে গরুটি কিনেছিলেন সবুজ। তখন বয়স ছিল ছয় মাস।
সবুজ গরুটিকে খুব ভালোবাসত, সৌদি আরব চলে যাওয়ার পরও নিয়মিত খবর নিয়েছে, গরুর জন্য পাকা ভিটি তুলে দিয়েছে, জেনারেটর কিনে ২৪ ঘণ্টা বাতি ও বাতাসের ব্যবস্থা করেছে, খাবারের জন্য আলাদা করে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। সবুজের ইচ্ছে ছিল ১৩ জুন দেশে ফিরে নিজে গাবতলী উপস্থিত থেকে গরুটিকে বিক্রি করবেন। কিন্তু বিমানের টিকিট পেয়েছেন ১৮ জুনের। তাই আজহার গরু বিক্রি করে ঢাকাতেই থেকে যাবেন, সবুজকে বিমানবন্দরে রিসিভ করে বাড়ি ফিরবেন।
মালেকের 'জাম্বু' ও অন্যান্য
এ দলটির সবগুলো গরুই সাড়ে তিন থেকে চার বছর বয়সের, ওজনে হাজার কেজির আশপাশে। গরুগুলোর মালিক আব্দুল মালেক আদর করে প্রতিটির নাম রেখেছেন। ডাকলে ওরা সাড়াও দেয়। ডানদিক থেকে প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিলেন শাহীওয়াল জাতের 'বরকতউল্লাহ'র সঙ্গে। তারপর আছে 'জাম্বু', 'দোয়েল', 'আসওয়াদ' ও 'রানা'।
প্রতিটির নামকরণের কারণ নিহিত আছে। 'বরকত থাকলে ১০০ টাকার জিনিসে হাজার টাকার সন্তুষ্টি পাওয়া যায়, তাই নাম বরকতউল্লাহ। জাম্বুর ঘাড় ও পা মোটা মোটা, শক্তিশালী হওয়ায় এ নাম দিয়েছি। পরের গরুটির গায়ের রং সাদা-কালো হওয়ায় জাতীয় পাখি দোয়েলের নামে নাম রেখেছি।'
আসওয়াদের গায়ের রং পুরোপুরি কালো, তাই ওই নাম। 'মক্কা শরীফের হাজরে আসওয়াদ নামের পাথরের অনুকরণে এ নাম দিয়েছি। শেষ গরুটির নাম রানা, যার কাছ থেকে কিনেছিলাম তার নাম ছিল রানা, মালিকের নামেই ওর নাম রেখেছি।'
আব্দুল মালেকের বাড়ি পাবনা সদর থানায়। বাড়ির পুকুরের চারধারে গরুর জন্য ঘাস লাগিয়েছেন। গরুর শেড করেছেন খোলামেলা জায়গায়। যেখানে মাঝারি আকারের ১৬টি গরু রাখা যায়, সেখানে ৫টি গরু রাখেন। ঘাস ছাড়া ভুষি, খড়, কুড়া, ছোলার ডাল, ভুট্টা, কলাইয়ের ডাল খাওয়ান। দিনে একেকটি গরু ৬০০–৮০০ টাকার খাবার খায়। প্রতিটির দাম হাঁকছেন নয় থেকে দশ লাখ টাকা করে।
মহেশপুরের 'রূপচান'
প্রায় ১২ ঘণ্টা জার্নি করে এসেও 'রূপচান' কাহিল হয়নি এতটুকু। ঝিনাইদহের মহেশপুর থেকে একটা পিক-আপে একাই চড়ে এসেছে। মমিনুলরা তিন ভাই রূপচানকে নিয়ে এসেছেন গাবতলীতে। 'রূপ ভালো, দেখতে ভালো, কথা শোনে, তাই নাম দিয়েছি রূপচান। আমাদের চেয়ে ভালো ঘরে রেখেছি, নিজেরা কম খেয়েছি কিন্তু ওর খাওয়ায় কম পড়তে দিইনি। তাই রূপচান এতো সুন্দর,' বললেন মমিনুল বিশ্বাস।
রূপচানের ওজন তিনি দাবি করছেন সাড়ে এগারশ কেজি, দাম হাঁকছেন ১২ লাখ টাকা। উচ্চতায় এটি ছয় ফুটের বেশি, দৈর্ঘ্যে ১০ ফুট। রূপচানের প্রতিদিন দুইবেলা পাঁচকেজি ভুষি, পাঁচকেজি খুদ, এককেজি ছোলা, আধাকেজি মশুর ডাল, ২৫০ গ্রাম কলাই, এক কেজি বুটের ডাল লাগে। খাবারে তার অনীহা নেই একেবারে। গতবারের আগেরবার রূপচানের বাবাকে গাবতলী হাটে সাড়ে সাত লাখ টাকায় বিক্রি করে গেছেন মমিনুল।
রাজ্জাকের 'রাজা'
রাজ্জাক মোল্লা দাবি করলেন, তার 'রাজা'র ওজন ১৪শ কেজি হবে। দিনে সে প্রায় ২০ কেজি খাবার খায় যার বাজারমূল্য হাজার-১২০০ টাকা। কোনো ময়লা-আবর্জনা পছন্দ করে না রাজা নামের গরুটি। অপরিষ্কার জায়গায় বসতেও তার আপত্তি, তাই গাবতলীতে আসার পর থেকে সে দাঁড়িয়েই আছে।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে তার শানবাঁধানো পাকা ঘর, সবসময় ঝকঝকে-তকতকে রাখা হয়। সন্ধ্যায় ঘরে ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়। দুদিনে একবার তাকে হাঁটানো হয়। খুদের ভাত, ভুষি, মশুর ডালের সঙ্গে রাজাকে গাজর, লাউ, বাঁধাকপি, বেগুন বা মৌসুমী সবজি খাওয়ান রাজ্জাক।
রাজাকে দেখভালের জন্য চারজন সহকারী নিয়ে এসেছেন রাজ্জাক। রাজ্জাকের মতে, এটি হাটের সবচেয়ে সুন্দর গরুগুলোর একটি। রাজার চলন-বলন রাজকীয়, গলার ঝুল সুদৃশ্য, মাথা উঁচু করলে উচ্চতা আট ফুট হয়ে যায়। রাজ্জাক মোল্লা দাম চাইছেন ১৫ লাখ টাকা।
আটষট্টি সালে ৮০–৯০ টাকায়ও গরু বিক্রি হতে দেখেছেন প্রবীণ বেপারী তবারক মুন্সি। মাঝারি সাইজের দুটি গরু নিয়ে ছেলের সঙ্গে হাটে এসেছেন। গরু পালন তার কাছে নেশার মতো, পেশায় তিনি কৃষক। গরু পালতে অনেক পরিশ্রম যায় কিন্তু কৃষকের সঙ্গে গরুর সম্পর্ক স্বজনের মতো। সে আমলে হালের বলদই হতো বড় গরু, সংকর গরু তখন দেখা যেত না। এখন দিন যত যাচ্ছে, তত গরুর দাম বাড়ছে, গরু গা-গতরেও বড় হচ্ছে। তবারক মুন্সি শুনেছেন, ৫০ লাখ টাকাও দাম উঠছে গরুর, অবাক হননি। বড় গরু খেতে ভালো হয় না যদিও, দেখতে মন্দ লাগে না তবারক মুন্সির।