ভাঙা ডিমের জমজমাট ব্যবসার ভেতর-বাহির
মোহাম্মদ আবদুল জলিল রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় একটি পাইকারি ডিমের দোকান চালান। প্রতিদিন অন্তত তিন হাজার ডিম বিক্রি হয় তার দোকান থেকে।
স্বাভাবিক ডিমগুলো খুচরা দোকানদারদের কাছে বিক্রি করলেও ভাঙা ডিমগুলো স্থানীয় বেকারি, রেস্তোরাঁ, রাস্তার ধারের খাবারের দোকান এবং কখনও কখনও সাধারণ মানুষের কাছেও বিকোন তিনি।
আর কেবল সামান্য ফাটা ডিম নয়, সম্পূর্ণ ভাঙা ডিমও বিক্রি হয় অনেক কম দামে।
গত সপ্তাহে জলিল প্রতি পিস ভালো ডিম ১১ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করেছেন। সামান্য ফাটা ডিম ৯ থেকে সাড়ে ৯ টাকা আর ভাঙা ডিম ৫ টাকা করে বিক্রি করেন তিনি।
বাজার অনুযায়ী ডিমের দাম ওঠানামা করলেও 'ক্রুটিপূর্ণ' ডিম সবসময় ভালো ডিমের চেয়ে কম দামে বিক্রি হয়।
জলিল, ওসমান, সাব্বির এবং আরও ১২ জন পাইকারি ডিম বিক্রেতা জানিয়েছেন, পরিবহনের বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু ডিম ফেটে বা ভেঙে যাওয়া স্বাভাবিক। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০টি ডিমে চিড় ধরে বা ফেটে যায়।
দোকানগুলোতে সামান্য ফাটা ডিম এবং সম্পূর্ণ ভাঙা ডিম আলাদাভাবে রাখা হয়।
কয়েক মাস আগেও এসব ডিমের তেমন চাহিদা ছিল না। দিনের বিক্রি শেষে বিক্রেতারা বেশিরভাগ ডিমই ফেলে দিতেন বা গরীবদের দিয়ে দিতেন।
জলিল বলেন, 'কখনও কখনও আমরা ডিমগুলো বিনামূল্যেও দিয়ে দিই। বেশিক্ষণ রাখলে সেগুলো পচে যায়। তাই দিয়ে দেওয়াই ভালো; অন্তত কেউ খেতে পারে।'
তবে সম্প্রতি মুরগি ও হাঁসের ডিমের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের মধ্যে ভাঙা ডিমের চাহিদা বেড়েছে। তাই বিনামূল্যে দেওয়ার পরিবর্তে বিক্রেতারা এসব ডিমে কিছু দাম রাখছেন।
গত সপ্তাহে সাবের মিয়া খিলগাঁও রেলগেট বাজারে তার ছোট দোকান থেকে স্বাভাবিক আস্ত ডিম প্রতি পিস ১০ টাকা এবং ফাটাগুলো ৮ টাকা ৪০ পয়সায় বিক্রি করেছেন।
তার মতে, আশপাশের ভাতের হোটেল এবং বেকারিতে এসব ভাঙা ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
'মাঝেমধ্যে দরিদ্র মহিলারা প্লাস্টিকের বাটি নিয়ে আসে। আমি ভাঙা ডিম বাটিতে ফেলে দিই। প্রায়ই মানুষজন আমার কাছ থেকে দুই থেকে তিন ট্রে (প্রতি ট্রেতে ৩০টি ডিম) ফাটা ডিম নেয়,' বলেন এ বিক্রেতা।
এসব ফাটা ডিম আদতে কারা কেনেন?
মোহাম্মদ ওসমান গনি খিলগাঁওয়ে একটি পাইকারি ডিমের ব্যবসা চালান। সেখানে তার একটি বেকিং কারখানাও রয়েছে। বেকারির শেফ মো. হেলালের মতে, তারা প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার মাফিন ও ৩০০-৩৫০ পাউন্ড কেক তৈরি করেন।
এতগুলো আইটেম তৈরি করতে বেকারিতে প্রতিদিন ৬০০ থেকে সাড়ে ৭০০ ডিমের প্রয়োজন হয়, যার সবই ওসমানের দোকান থেকে আসে। আমরা ১৩ মে'র একটি বিল পরীক্ষা করে দেখেছি, সাড়ে ৬০০ ডিম ছয় হাজার ৭৮০ টাকায় কেনা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম পড়েছে ১১ টাকা ৩০ পয়সা।
ওসমান গনি বলেন, 'আমরা সম্পূর্ণ ভাঙা ডিমগুলোও বেকারিতে পাঠাই কারণ এগুলোতে বেশি তরল থাকে যা বেকিংয়ের জন্য ভালো।'
সাধারণত, উচ্চ তাপমাত্রা এবং কম আর্দ্রতায় ডিম সংরক্ষণ করলে ডিমের সাদা অংশ তরলের মতো হয়ে যায়।
এ কারণেই ফাটা ডিমগুলো অক্ষত ডিমের চেয়ে বেশি জোলো, কারণ এগুলো বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সংস্পর্শে আসে।
রাস্তার ধারে খাবারের কার্টে করে নুডুলস, ডিমচপ ইত্যাদি বিক্রি করেন আরিফ হাসান। তিনি মাঝে মাঝে সাবের মিয়ার দোকান থেকে ভাঙা ডিম কেনেন।
'সবসময় এ ডিমগুলো পাই না; মাঝেমধ্যে তাকে [সাবের মিয়াকে] আমার জন্য কিছু ডিম রাখতে বলতে হয়। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবারে আমার প্রচুর ডিমের প্রয়োজন হয়,' বলেন আরিফ।
ডিমের বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন আরিফ। তাই তিনি নুডলসের জন্য ফাটা ডিম বেছে নিয়েছেন।
কিন্তু রান্নায় ফাটা ডিম ব্যবহার করা কি ভালো?
'ভয় নাই, ম্যাডাম, আগুনের আঁচে সব জীবাণু মরে যাবে!' আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন আরিফ।
ফাটা ডিম কি পেট 'ফাঁসাতে' পারে?
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ভালো, অক্ষত খোসাযুক্ত ডিমের শেলফ লাইফ কমপক্ষে তিন সপ্তাহ থাকে। তাপমাত্রা ওঠানামা না করলে খোসাযুক্ত ভালো ডিম পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকতে পারে।
কিন্তু ফাটা খোসাযুক্ত ডিমের শেলফ লাইফ মাত্র দুই ঘন্টা, তারপরে সেগুলো পচে যায়। অনেক সময় এসব ডিমের খোসায় কালো দাগ পড়ে।
বাংলাদেশে ফাটা ডিমের ব্যবহার ও বিক্রয় অনুমোদিত কি না সে বিষয়ে টিবিএস বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) পরিচালক (ভোক্তা ঝুঁকি ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা) মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে।
তিনি বলেন, 'ফাটা খোসার ডিমগুলো সালমোনেলা এবং অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে, যা খেলে খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। আমরা এসব ডিম না খেতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করি। আর এসব ডিম দোকানে বিক্রি করাও অনুমোদিত নয়।'
মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সালমোনেলা দ্বারা আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষের সংক্রামিত হওয়ার ১২ থেকে ৭২ ঘন্টা পরে ডায়রিয়া, জ্বর, পেটে খিঁচুনি এবং বমি হয়। এসব লক্ষণ সাধারণত চার থেকে সাত দিন স্থায়ী হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়।
তবে কারও কারও ডায়রিয়া এত গুরুতর হতে পারে যে, তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন হতে পারে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা না করালে এসব রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ)-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তাপ ডিমের সালমোনেলা এবং অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে।
'সালমোনেলা টাইফিমুরিয়াম সম্পূর্ণ বিনষ্টের জন্য সাত মিনিটের মতো ফোটানো প্রয়োজন ছিল এবং স্টেফিলোকক্কাস অরিয়াসকে [আরেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া] ধ্বংস করতে 12 মিনিট ফোটানো লাগে,' নিবন্ধে বলা হয়েছে।
নিবন্ধে উল্লিখিত পরীক্ষা অনুসারে, সম্পূর্ণরূপে জীবাণু মারার জন্য রান্নার সময়-তাপমাত্রার সম্পর্ক রান্নার পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
মিজানুর রহমান বলেন, 'ডিমগুলো যদি পুরোপুরি ভেঙে যায়, অথবা কখন ভেঙেছে আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিত না, তাহলে এগুলো না খাওয়াই ভালো।'
সংক্ষেপিত অনুবাদ