পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী করোনেশন পার্ক ও লেডিস পার্ক ধ্বংস করে মার্কেট ও আড়ত প্রতিষ্ঠা
পুরান ঢাকার সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী করোনেশন পার্ক ও লেডিস পার্কের জায়গায় গড়ে উঠেছে কাঁচা পণ্যের আড়ত এবং হোসিয়ারী ও গার্মেন্টস পণ্যের পাইকারি মার্কেট। সরেজমিনকালে করোনেশন পার্কের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তবে লেডিস পার্কের স্মৃতি বহন করছে পার্কটির তত্ত্বাবধান করার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক সদরঘাটে নির্মিত তিনতলা 'লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেট' নামটি।
পার্কের স্থলে মার্কেট নির্মাণের ঘটনাকে দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি এবং বিষয়টিকে অবৈধ দখলদারিত্ব বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশবাদী ও পুরান ঢাকার বাসিন্দারা লেডিস পার্ক ও করোনেশন পার্ক থেকে সকল অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে পুনরায় পার্ক প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন।
করোনেশন পার্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বিশ শতকের শুরুতে। ঢাকা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন-এর লেখা 'ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ২য় খণ্ড' শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের করোনেশনকে স্মরণীয় রাখতে ঢাকার ইংরেজ প্রশাসকরা সদরঘাটে পার্কটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রন্থে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আরো উল্লেখ করেন, 'এর সীমানা ছিল নর্থব্রুক হলের মোড় থেকে লেডিস পার্ক পর্যন্ত। সদরঘাটেই মহিলাদের জন্য আরেকটি ছোট পার্ক ছিল যার নাম ছিল লেডিস পার্ক।'
পঞ্চম জর্জের করোনেশন বা রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ১৯১১ সালে। করোনেশন পার্কটি তখন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু সদরঘাটের লেডিস পার্কটি কবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ পাওয়া যায় না। ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনেশন পার্ক প্রতিষ্ঠার পর এর পশ্চিম অংশে পরবর্তীকালে লেডিস পার্ক প্রতিষ্ঠা পায়। করোনেশন পার্ক প্রতিষ্ঠার সময় নর্থব্রক হল থেকে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ পর্যন্ত ছিল সীমা। পরবর্তীকালে করোনেশন পার্কের পশ্চিম অংশটি মহিলাদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং অংশটির নামকরণ করা হয় লেডিস পার্ক নামে।
করোনেশন পার্কে স্থাপন করা হয়েছিল একটি রাজ্যাভিষেক স্মারক সৌধ। গবেষক হাশেম সূফী জানান, সৌধটি ছিল দেখতে অনেকটা চার্চের মতো। সৌধের দেয়ালে ছিল পার্ক প্রতিষ্ঠার শিলালিপি। করোনেশন পার্কের পশ্চিমাংশে ছিল সৌধটির অবস্থান, যে অংশটি পরবর্তীকালে লেডিস পার্ক নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ১৮৬৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল বাকল্যান্ড বাঁধ। বাঁধটি নির্মাণের পর ঢাকা শহরবাসসীর কাছে এটি প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণের জন্য এক মনোরম স্থানে পরিণত হয়। বিশ শতকের প্রথমভাগে বাঁধ সংলগ্ন উত্তর দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় করোনেশন পার্ক। এতে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নাগরিকদের অবসর সময় কাটানোর জন্য উন্মুক্ত স্থানের পরিসর আরো বেড়ে যায়। অবসর সময় কাটানোর শহরের প্রধান আকর্ষণীয় স্থান হয়ে ওঠার পাশাপাশি রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে অঞ্চলটি।
ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী এ প্রসঙ্গে আরো জানান, ব্রিটিশ আমলে বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকার রাজনৈতিক জনসভার প্রধান কেন্দ্র ছিল করোনেশন পার্ক। পল্টন ময়দানে রাজনৈতিক জনসভা প্রচলন হওয়ার আগে করোনেশন পার্কেই ঢাকার বড় বড় জনসভার আয়োজন করা হতো। নেতাজী সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশসহ ভারতীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দর অনেকেই করোনেশন পার্কে আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, করোনেশন পার্কের আকৃতি বদলে যায় গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষভাগে। করোনেশন পার্কের মাঝখানে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় 'কায়েদে আযম ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার' ও কুস্তি স্টেডিয়াম। এতে পার্কটি বিভক্ত হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, কায়েদে আযম ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার পর বিভক্ত অংশ দুটির মধ্যে পূর্ব দিকের অংশটি করোনেশন পার্ক এবং পশ্চিমের অংশটি লেডিস পার্ক নামে পরিচিত লাভ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের পর কায়েদে আযম ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নবযুগ শরীর চর্চা কেন্দ্র। ২০০৯ সালে নবযুগ শরীর চর্চা কেন্দ্র ও কুস্তি স্টেডিয়াম বিলোপ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধান করার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তখন সেখানে তৈরি করে ৫তলা বিশিষ্ট 'মাল্টি পারপাস ভবন' নামে একটি বিশাল স্থাপনা। তবে নবযুগ শরীর চর্চা কেন্দ্র বিলোপের আরো আগে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছিল করোনেশন পার্ক ও লেডিস পার্কের অস্তিত্ব।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের শৈশব কেটেছে ষাটের দশকের প্রথম ভাগে পুরান ঢাকায়। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, শৈশবে তিনি মায়ের সাথে সদরঘাটের লেডিস পার্কে যেতেন। তখন লেডিস পার্কের কাছে হকাররা মেয়েদের ব্যবহৃত বিভিন্ন পন্য বিক্রি করতো। মাকে তিনি মাঝে মাঝে হকারদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে দেখেছেন।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী এ প্রসঙ্গে বলেন, সদরঘাটের লেডিস পার্কের অস্তিত্ব বিগত শতকের সত্তরের দশকে, এমনকি আশির দশকে প্রথম ভাগেও ছিল। আশির দশকের শেষভাগে তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপিলিটি লেডিস পার্কের পার্কের স্থলে স্থায়ী মার্কেট ভবন নির্মাণ করে। অন্যদিকে করোনেশন পার্কের স্থলে ব্যক্তি উদ্যোগে দোকানপাট গড়ে ওঠে ১৯৯০ সালের দিকে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, করোনেশন পার্কের স্থলে গড়ে ওঠা দোকনসমূহ সেমি পাকা। সিটি করপোরেশনের মাল্টিপারপাস ভবন থেকে নর্থব্রুক হল সংলগ্ন সড়ক পর্যন্ত অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে এসব দোকানপাট। ইটের দেয়াল এবং টিনের ছাদ বিশিষ্ট দোকানসমূহ ব্যবহৃত হচ্ছে পিয়াজ, রসুন, আদা, আমড়া, লেবু, মরিচ ইত্যাদি পণ্যের আড়ত রূপে। বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন করোনেশন পার্কের জায়গায় সারিবদ্ধভাবে গড়ে ওঠা আড়ৎসমূহের মধ্যে মেসার্স যমুনা ট্রেডার্স, মেসার্স কাজল ব্রাদার্স, মেসার্স সিটি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জননী ভাণ্ডার, মেসার্স কর্ণফুলী বাণিজ্যালয়, মেসার্স মিতু এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স অজয় ট্রেডার্স, মেসার্স নুর বাণিজ্যালয়, মেসার্স হাবিব এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স হাওলাদার ফার্ম উল্লেখযোগ্য। সরজমিনকালে আরো দেখা যায়, করোনেশন পার্কের স্থলে গড়ে উঠা আড়তসমূহের কাচা পণ্যের বর্জ্যরে কারণে বাকল্যান্ড বাঁধ অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
লেডিস পার্কের স্থলে গড়ে ওঠা মার্কেটটিও দেখতে নোংরা। নবযুগ শরীর চর্চা কেন্দ্রের পশ্চিমে লেডিস পার্ক চত্বরে বর্তমানে রয়েছে একটি মার্কেট ও একটি মসজিদ। সিটি কপোরেশনের উদ্যোগে নির্মিত ৩ তলা বিশিষ্ট মার্কেটটির পশ্চিম দিকে দোতলার কার্নিসে দুটি স্থানে এবং দক্ষিণ দিকে তিনতলার কার্নিসে তিনটি স্থানে বেশ বড় করে লেখা রয়েছে 'লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেট ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন'। মার্কেটটির ১ম ও ২য় তলায় হোসিয়ারি ও গার্মেন্টস পণ্য পাইকারিভাবে বিক্রি হয়। মার্কেটটির ৩য় তলায় রয়েছে গুদাম এবং দর্জির দোকান।
পার্কের স্থলে দোকানপাট গড়ে ওঠার ঘটনা সম্পর্কে বিশিষ্ট পরিবেশ অ্যক্টিভিস্ট ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী তীরবর্তী বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন করোনেশন পার্কের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে দোকান নির্মাণের জন্য শুধু একজন ব্যবসায়ী দায়ী থাকে না। এটা আসলে একটা নেক্সাস। অবৈধ দখলদারিত্ব বজায় রাখার পেছনে আরো অনেকে জড়িত থাকে। থাকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠাপোষকতাও । শরীফ জামিল আরো বলেন, বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী বাকল্যান্ড বাঁধ এবং করোনেশন পার্ক ও লেডিস পার্ক থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার দায়িত্ব ও অধিকার সরকারের। তাই বুড়িগঙ্গা নদী ও তীরভূমি রক্ষা করতে হলে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। আদালতের রায় যথাযথভাবে মেনে নদী ও নদীর তীর থেকে সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে তিনি আহ্বান জানান।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার বুড়িগঙ্গা নদীর বিউটিফিকেশনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। নদীর তীরে সবুজায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সরকার যদি যথার্থভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করতে চায়, নদীর তীরে বৃক্ষরাজি চায়, তাহলে করোনেশন পার্ক ও লেডিস পার্ককে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, পার্কের মধ্যে মার্কেট করা এবং সেই মার্কেটের নাম আবার পার্কের নামে রাখা হচ্ছে জনগণের সাথে চরম অভদ্রতা। পার্কগুলোকে পার্ক হিসাবে ব্যবহার করতে হবে, এটাই আইনের বিধান। একটা পার্কে পার্ক উপযোগী অল্প কিছু স্থাপনা করা যায় এবং কতটুকু ভূমিতে স্থাপনা করা যাবে, এটা আইনে বলা আছে। লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেটের ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে পার্ক সংশ্লিষ্ট কিছু স্থাপনা হতে পারত, কিন্তু এই মার্কেট অনেক বেশি জায়গায়। এই পার্কের সঙ্গে মার্কেটের কোনা সম্পর্ক নেই। এই মার্কেটটি পার্ক থেকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া আইনত আর কোনো বিকল্প আছে বলে আমার জানা নেই। যেখানে জনপ্রতি উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ ঢাকায় সবচেয়ে কম, সেখানে বিদ্যমান পার্কে মার্কেট করে জনপ্রতিনিধি সিটি করপোরেশনগুলো অসংবেদনশীলতার সাক্ষর রাখছে। একটা বেআইনি কাজকে প্রতিহত করা যায়, একটা বেআইনি কাজকে অপসারণ করা যায়। কিন্তু যে মানসিকতার কারণে বেআইনি কাজগুলো বার বার ঘটছে, আমার মনে হয়, এখন জরুরি হয়ে পড়েছে একটা জনআন্দোলন গড়ে তুলে সেই মানসিকতা পরিবর্তন আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করা।
করোনেশন পার্ক এবং লেডিস পার্ক সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, তিনি ব্যস্ত আছেন। এজন্য এখন কথা বলা যাবে না এবং এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পরে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেয়া হয়। কবে যোগাযোগ করলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে জানানো হয়, তিনি কবে কথা বললেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। পরে যোগাযোগ করতে হবে।