শুকা রুটি ওরফে বাকরখানি: তন্দুর না ওভেনে?
নবাবের নাম ছিল বাকের আর তার স্ত্রীর নাম খানি। দুই নাম জুড়ে হয়ে হয়েছে বাকরখানি। সেটা কত বছর আগের কথা? দুলাল মিয়া তা জানেন না। গল্পটি শুনেছেন তার বড় চাচার কাছ থেকে। তিনি এখন আর কাজে নেই, বাড়িতে অবসর সময় কাটান। দুলালের বাড়ি হবিগঞ্জে।
ঢাকার প্রায় সব বাকরখানি দোকানের মালিক ও কারিগর বৃহত্তর সিলেটের লোক। এটাও জানার বিষয় ছিল, কীভাবে সিলেটের লোক এ পেশায় যুক্ত হলো? দুলাল তার পরিষ্কার উত্তর জানেন না। তবে বললেন, 'সিলেটের সব জায়গার নয়, কোনো কোনো এলাকার লোক এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। দাদা থেকে নাতি হয়ে দক্ষতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়েছে।'
দুলালের দোকানের নাম বিসমিল্লা বাকরখানি। নারিন্দার এ দোকানের নাম উত্তর বাড্ডা, মিরপুর, ধানমন্ডির লোকেও জানে। প্রতিদিন ৮০-১০০ কেজি বাকরখানি তারা বিক্রি করে। যারা বিসমিল্লার বাকরখানি খেয়েছেন, তারা বার বার ফিরে আসেন।
বাকরখানির চলতি নাম শুকা রুটি। তন্দুরে তিন বা চার ধরনের বাকরখানি দুলালরা তৈরি করেন, তারপর ভরে রাখেন কাচের বাক্সের ভিতর। সে বাক্সে আবার হলুদ বাতি জ্বলে।
মুঘলরা আনে বাকরখানি
হাকিম হাবিবুর রহমান তার 'ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে' বইয়ে লিখছেন, রুটি বিক্রেতাদের তন্দুরে আগুন জ্বললেই ঢাকাবাসী বুঝত সকাল হয়েছে। ঢাকার শহুরে বাসিন্দারা রুটি খেতে অভ্যস্ত। বিশেষ করে বাকরখানি ছাড়া তাদের সকাল হয় না।
তুর্কি ও আফগানরা ঢাকায় প্রথম তন্দুর নিয়ে। আসে আর তাতে যে রুটি তৈরি হয় তা নানরুটি। এরপর আসে মুঘলরা। তারা নিয়ে আসে বাকরখানি, যা একরকম গোল রুটি। এতে ঘি দেওয়া হতো না। তিন ধরনেরের শুকি যেমন শুকি, নিমশুকি ও খাস্তা বাকরখানি পাওয়া যেত। ঢাকা এবং আগ্রায় এটি কাবাবের সঙ্গে অথবা কোরমা বা কালিয়ার সঙ্গে খাওয়া হতো।
তিনি আরও লিখেছেন, ঢাকার বাকরখানি এতই প্রসিদ্ধ যে সারা বাংলায় এটি এখান থেকে উপঢৌকন হিসাবে প্রেরিত হয় এবং এখনো এর থেকে সুস্বাদু কোনো রুটি নেই।
হাকিম সাহেবের জীবদ্দশায় বাকরখানির বহু উত্থান-পতন ঘটেছে। যেমন, দুধের বদলে গুড়-পানি মেশানোর চল হয়েছিল। গাওযবান নামের আরেক বাকরখানি দেখেছিলেন হাকিম সাহেব যাতে পনির মেশানো হতো।
আরো একটি রকমের কথাও বলেছেন যাতে সুজির হালুয়া বা মোহনভোগ লাগানো হতো পরতে পরতে। তিনি সকাল সকাল এক ব্যক্তিকে দেখতেন বাকরখানি মিষ্টি দুধে ভিজিয়ে পাড়ায় মহল্লায় ফেরি করে বেড়াতে আর হাঁক দিতে: 'গেজায়ে লতিফ' বা সুস্বাদু খাবার।
ঢাকার শুকা রুটি বা বাকরখানির সঙ্গে সারা হিন্দুস্তানের আর কোনো রুটির মিল নেই, বলছিলেন সূত্রাপুরের মামুন মিঞা। চল্লিশ বছর বয়সি মামুন একজন অভিজ্ঞ বাকরখানি কারিগর। তাদের দোকানের কোনো নাম নেই। সূত্রাপুরের চারধারের ফরাশগঞ্জ, মালাকারটোলা, কাগজিটোলা, ডাইলপট্রির সবাই মামুনের দোকান চেনে এবং নিয়মিত তার বানানো শুকা রুটি কেনে।
'দেশি মুরগি আর ফার্মের মুরগি'
মামুনদের এ দোকানের প্রতিষ্ঠা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই। মামুনের নানা ছিলেন ভালো কারিগর, মামা আর বাবাও ছিলেন দক্ষ কারিগর। সূত্রাপুর এলাকার কিছু লোক আছেন যারা প্রতিদিন দুই বেলা শুকা রুটি খান।
পঞ্চাশ বছর বয়সি সাজিনা বেগমের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, 'রাতে কোনোদিনই ভাত খাই না। দুধ দিয়ে বাকরখানি খাই, আবার মাছ-গোশত দিয়েও খাই। প্রতিদিন আমার ঘরে আধা কেজি বাকরখানি লাগে।'
জিজ্ঞেস করলাম, এ দোকান থেকেই কেনেন কি না? তিনি বললেন, 'হ্যাঁ। অভ্যাস হয়ে গেছে। মামুনের রুটিই ভালো লাগে।' আবার জিজ্ঞেস করলাম, এখন তো ওভেনে অনেক রকম শুকা রুটি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো কেনেন না?
সাজিনা বেগম বেশ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, 'ওগুলা কি বাকরখানি? না আছে গন্ধ, না স্বাদ। দেখতেই যা সুন্দর। আমি এক-দুইদিন খেয়েছিলাম, আর কোনোদিন খাব না। দেশি মুরগি আর ফার্মের মুরগির মধ্যে পার্থক্য যেমন, তন্দুরের বাকরখানি আর ওভেনের বাকরখানির পার্থক্যও তেমন।'
চাহিদা বাড়ছে, প্রতিযোগিতাও
তবে পরিস্থিতি কিন্তু আগের মতো সাদাসিধা নেই। মামুনের দোকানের এবং বিসমিল্লা বাকরখানির বিক্রি কমে গেছে। গত বছরখানেকের মধ্যে ঢাকার নানা জায়গায় অনেক ওভেন বাকরখানির দোকান তৈরি হয়েছে। আগে উত্তর বাড্ডা থেকে ড্রাইভার পাঠিয়ে বিসমিল্লা থেকে এক লপ্তে ৫-৬ হাজার টাকার বাকরখানি কিনিয়ে নিতেন সাহেব-মেমসাহেবরা।
এখন সময়ও বড় বাধা। হাতের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা-ই কিনে নিচ্ছে লোকে। তবে সুবিধা একটা হয়েছে—বাকরখানির চাহিদা অনেক বেড়েছে, বাজার বড় হয়েছে।
বিসমিল্লা বাকরখানির দোকানে বসেছিলেন শামসুদ্দিন মিঞা। তিনি চকবাজারে একটি নতুন দোকানের খবর দিলেন, যা মাসখানেক আগে উদ্বোধন হয়েছে। ওই দোকানটির জন্য অ্যাডভান্স দিতে হয়েছে ১৭ লক্ষ টাকা আর ভাড়া ৬৪ হাজার টাকা। এ টাকার অঙ্ক থেকেই বোঝা যায়, বাকরখানির বাজার কতটা বড় হয়েছে!
মামুন কারিগরের বড় ভাই সুবিদ মিঞা দুঃখের হাসি হেসে ঘটনাটি বললেন, বছরখানেক আগের কথা। যারা ওভেন বিক্রি করার জন্য ফিকির করছিল, তারা মাঝে মধ্যে আসত। সময়-অসময়ে হাজার টাকা ধার দিত, বেনসন সিগারেট খাওয়াত।
তারপর একদিন মেশিন (ওভেন) দেখাল, বলল, দামের কথা ভাববে না, তোমরা তো আপন লোক। অনেক সুবিধা আছে। ধোঁয়া নেই, কষ্ট কম, ৪ জনের জায়গায় কারিগর লাগবে ২ জন। আগে নিয়ে বসাও, টাকা আস্তে আস্তে শোধ দিও। সে থেকে শুরু।
এখন ঢাকায় কয়েক হাজার ওভেন আছে, যেখানে তন্দুর মাত্র তিন-চারশ।
টিনপ্রতি কয়লা ১২০ টাকা
তন্দুরের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও রয়েছে বাজারে—যেমন এতে শ্মশানের কয়লা ব্যবহার করা হয়। আগের মতো ভালো মাটি পাওয়া যায় না, ময়লা মাটি দিয়ে তৈরি হয় তন্দুর।
এ অভিযোগগুলো মামুন মিঞার সামনে উপস্থাপন করা হলে তিনি বললেন, 'মোটেই সত্যি কথা নয়। আমরা বাসাবাড়ি থেকে কয়লা সংগ্রহ করি, টিনপ্রতি ১২০ টাকা দিয়ে। তন্দুর কিনে আনি রায়েরবাজার থেকে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা দিয়ে।
'এঁটেল মাটি দিয়ে তন্দুর তৈরি হয়। দোকানে এনে বসানোর পর চারপাশে সিমেন্ট দিয়ে লেপে দিই। আমি নিজে সকালে বাকরখানি দিয়ে নাস্তা করি। শ্মশানের কয়লা দিয়ে হলে আমার নিজেরই ভক্তি আসত না।'
তিনি আরও বলেন, 'তন্দুর যাদের আছে, তারা নিজেরাই বাকরখানির বড় ভোক্তা। আমার চাচাত ভাই প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে রুটি পাঠায়, তার মা খায়, ছেলেরা খায়। আসলে ওভেনের রুটির স্বাদ-গন্ধ নেই বলে, এসব কথা তারা এখন ছড়াচ্ছে।'
ওভেন ও তন্দুর রুটির মধ্যে পার্থক্য কী কী? সংক্ষিপ্ত ভোক্তা জরিপে জানা গেল, ওভেনের বাকরখানি চাষের মাছের মতো আর তন্দুরের বাকরখানি নদীর মাছের মতো।
বিসমিল্লা বাকরখানির একজন ভোক্তা, যার জন্ম এবং বিয়েও হয়েছে দক্ষিণ মৈশুণ্ডিতে, নাম শাহনাজ বেগম, বললেন, 'সম্প্রতি মেশিন দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন দোকানে। রুটিও হয় ঝকঝকে কিন্তু খাওয়ায় কোনো মজা নেই। আমি গত ১২-১৪ বছর ধরে নিয়মিত বিসমিল্লা থেকেই রুটি কিনি। সাধারণত সকাল বিকাল চায়ের সঙ্গে খাই। আমেরিকায় ননাসের কাছেও পাঠাই।'
ইসলাম মিঞা ওভেনেরই পক্ষে
ওভেনের বিরুদ্ধের অভিযোগগুলো নিয়ে মিরপুর ১১ নম্বরের মায়ের দোয়া বাকরখানি দোকানে রাহাত মিঞার কাছে হাজির হলাম। এ বাজারে রাহাতের একটি তন্দুরের দোকানও আছে। ওভেন দিয়েছেন বেশিদিন হয়নি। তিনি স্বীকার করলেন, 'তন্দুরের মতো মজা ওভেনে হয় না। কিন্তু সময়ের কথা বলেন বা যুগের কথা বলেন, চাহিদা কিন্তু ওভেনের। আর এ চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে।
'নতুন দিনের ভোক্তারা চাকচিক্য বেশি পছন্দ করে। ওভেনে আপনি কাচা রুটি ঢুকিয়ে দিয়ে সময়মতো বের করে আনেন, দেখবেন কত সুন্দর গড়ন ও আকারে বের হয়ে আসছে। ওভেনে ৮-১০ রকমের বাকরখানি বানাতে পারছি, এর মধ্যে মাংস বাকরখানি, পনির বাকরখানি, তিলের বাকরখানিও হয়।'
রাহাত মিঞা আফসোস করলেন, 'আগের মতো সমঝদার মানুষ নেই, যারা প্রকৃত রস আস্বাদন করতে আগ্রহী। সময় অনেক বদলাচ্ছে। ছাপড়া ঘর বিল্ডিং হচ্ছে। ধোঁয়া ওঠে বলে বিল্ডিং বাড়ির মালিক তন্দুর চুলা ভাড়া দিতে চায় না। যদি জায়গাই না পান তবে তন্দুর বসাবেন কোথায়? ওভেনের দাম ১ লাখ টাকা হলেও সাশ্রয়ী সবকিছুতে।
'৪ জনের জায়গায় কারিগর লাগে মাত্র ২ জন। জ্বালানি লাগে এক-দেড়শ টাকা, যেখানে তন্দুরে লাগে তিন টিন কয়লা, মানে প্রায় ৫০০ টাকা।'
'সবাই এখন শর্টকাটের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে'
নারিন্দার নামকরা বাদশা বাকরখানির বাদশা মিঞা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর ফেরালেন। তিনি জানালেন, নতুন প্রজন্ম থেকে কারিগর তৈরি হচ্ছে না। তারা এত কষ্ট করতে রাজি নয়। বাদশা নিজে ৭ বছর বয়সে এ কাজে লেগেছিলেন। এখন তার বয়স চল্লিশের বেশি।
খামির তৈরির দক্ষতা আসে অভিজ্ঞতা থেকে। বাবা-চাচাদের থেকে শিখে শিখে হাত তৈরি হয়। খামির যত ভালো, বাকরখানিও তত ভালো। এর জন্য ব্যাপক পরিশ্রম করতে হয়। এখনকার প্রজন্ম এ পরিশ্রম করতে রাজি নয়।
তিনি বললেন, 'তন্দুর আর বেশিদিন টিকবে না। কারিগর পাওয়া যাবে না, কাস্টমারও থাকবে না, সবাই এখন শর্টকাটের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। আমাদের প্রজন্ম চলে যাওয়ার পরই থাকবে না তন্দুরের বাকরখানি।'
বাদশা যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন চার আনা দাম ছিল একটা বাকরখানির। কাগজে পেঁচিয়ে সুতায় বেঁধে দেওয়া হতো। তারপর এল ঠোঙা, এখন ঠোঙায় পুরে পলিথিনে করে দেওয়া হয়। এখন এক কেজি বাকরখানির দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।
প্লাস্টিকের বাক্সে বাকরখানি বিক্রির চলও শুরু হয়েছে সম্প্রতি, আধা কেজির বাক্স ১২০ টাকা। বাদশা বললেন, 'ময়দা, লবণ আর তেল লাগে বাকরখানি তৈরিতে। এখানে ভেজাল দেওয়ার সুযোগ নেই, তবে ময়দা আর তেল আগের মতো খাঁটি পাওয়া যায় না। এটি এমন এক খাবার, দুধ দিয়ে যেমন, তেমনি ইলিশ মাছের ঝোল দিয়েও খেতে পারেন। কিন্তু যদি স্বাদই না পান, তাহলে আর খেয়ে লাভ কী?'
ছবি: সালেহ শফিক