যাত্রীদের জন্য গাড়িতে ১৬ ইঞ্চির ফ্যান লাগিয়েছেন সিএনজি চালক মিরাজ
ক্ষণিকের বৃষ্টিও এখন খুব একটা স্বস্তি আনতে পারেনা ঢাকাবাসীদের জন্য। বরং ট্রাফিক জ্যাম বেড়ে গেলে ভোগান্তি যেন আরও বেড়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে দেখা হয় ৩৬ বছর বয়সী সিএনজি চালক মোহাম্মদ মিরাজের সাথে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারি থেকে ঢাকায় আসা মিরাজের সিএনজিতে উঠে সামনে ১৬ ইঞ্চির একটি বিশাল ফ্যান দেখে আমি একটু অবাকই হই।
আমার অবাক হওয়া নিয়ে মিরাজকে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা গেলো না। বরং পেশাদার এই চালক কোন বিলম্ব না করে রাইডশেয়ারিং অ্যাপে ট্রিপ চালু করে অ্যাপে দেখানো গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু করে দেন।
তার সিএনজিতে এই ফ্যানটি আছে আজ দুই বছর ধরে।
মিরাজ তার বাবা-মায়ের সাথে ১৫ বছর বয়সে প্রথম ঢাকায় আসেন।
তার বাবা এখন বোয়ালমারিতে অটোরিকশা চালান, আর মিরাজ তার মাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ভালো জীবনের স্বপ্ন নিয়ে।
তিনজনের পরিবারে তাদের চাহিদা ছিল সামান্য: দিনে দুইবার খাবার, আর একটা শান্তির জীবন।
খাবার থাকলেও শান্তিটা বেশিদিন থাকেনি। কারণ ২০০৮ সালে মিরাজের মা মারা যান।
সাক্ষাৎকারে ১৬ বছর আগে মায়ের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে ৩৬ বছর বয়সী সিএনজি চালকের মুখে দুঃখের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
আমরা তখন ধানমন্ডির আট নম্বর ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে। মিরাজ মাথা নিচু করে কংক্রিটের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "ওনার কী হয়েছিল?"
মিরাজ বলেন, "মা ক্যান্সারে ভুগছিলেন। আমার বাবা-মা সেই বছরই গ্রামে ফিরে যান, কিন্তু আমি ঢাকায় থেকে গেলাম।''
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা কেউই কিছু বলতে পারলাম না।
আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিলো যে উনার মা কোন ধরনের ক্যান্সারে ভুগছিলেন, তার চিকিৎসার জন্য কী করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নগুলো কিছুতেই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না। আমি মনে মনে ভাবলাম, ক্যান্সার ধনী-গরিব বোঝে না।
মিরাজ নিজেই কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে আবার কথা বলতে শুরু করলেন।
প্রসঙ্গ পাল্টে আমরা বর্তমানে ফিরে আসলাম।
মিরাজ এখন ঢাকায় থাকেন তার স্ত্রী আর চার বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে।
"আমরা মোহাম্মাদপুরের ঢাকা উদ্যানে একটা ভবনের এগারো তলায় থাকি। আল্লাহর রহমতে এবছর আমাদের বিয়ের ৬ বছর হয়েছে," তিনি বলেন।
ফ্ল্যাটটি মিরাজ ভাড়া নিয়েছেন ওনার এক আত্মীয়ের সাথে মিলে। বিদ্যুৎ বিল আর আনুষাঙ্গিক খরচ মিলিয়ে ফ্ল্যাটের পেছনে মাসে আঠারো হাজার টাকা খরচ হলেও একটা রুমের জন্য মিরাজকে দিতে হয় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
প্রতি মাসে সিএনজি চালিয়ে মিরাজের উপার্জন প্রায় ৩০,০০০ টাকা।
"আমাকে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিএনজির ভাড়া হিসেবে ৮৫০ টাকা জমা দিতে হয়। আমি সন্ধ্যায় সিএনজি ফেরত দিলে আরেকজন চালক এটা নিয়ে বের হয়," তিনি বলেন।
ভাড়ার টাকা দেবার পরেও মিরাজের হাতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার টাকা থাকে।
'ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?'
মিরাজ রাতারাতি লটারি জিতে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে না।
"দিনে দুইবেলা খাবার, সম্ভব হলে কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামে একটা জমি কিনে তাতে একটি ছোট বাড়ি তৈরি করা। আর কী?" ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি এমনটাই বলেন।
"ছেলের পড়ালেখা?" আমি জিজ্ঞাসা করি।
"ওর জন্মের আগেই আমি আর আমার স্ত্রী ঠিক করে রেখেছি যে সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা ছেলেকে মাদ্রাসা লাইনে পড়াবো। আমরা চাই সে যাতে একদিন একজন বড় হাফেজ বা আলেম হতে পারে," তিনি বলেন।
মিরাজ বলেন এই বছরই ছেলেকে একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেবেন। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছেলেকে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন।
ফ্যানের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক
মিরাজ বলেন, তিনি প্রায় দুই বছর আগে ফ্যানটি লাগিয়েছিলেন।
"আপনি দেখেছেন যে আমার সিটের পাশে নিজের জন্য একটি ফ্যান আছে। কিন্তু আমার যাত্রীরা যখন তীব্র গরমে সিএনজির পেছনে হাঁসফাস করে তখন আমি কীভাবে আমার ফ্যান চালু করে সেটার সামনে বসে থাকি?" তিনি বলেন।
"অনেক সময় যাত্রীদের সাথে বাচ্চাকাচ্চা থাকে। গরমে ওদের কষ্ট আমার সহ্য হয় না।"
সেজন্যেই দুই বছর আগে মোহাম্মাদপুর বিহারি ক্যাম্পে গিয়ে তিনি একটি চার্জার ফ্যানের উপরের অংশ কিনে নেন। ফ্যান কিনে লাগানো বাবদ ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান মিরাজ।
"গরমে আমি ফ্যানটা চালু করলে যাত্রীরা আমাকে বলে যে তারা আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। অনেক যাত্রী আমাকে বাড়তি পয়সাও দিয়ে যায়। আমি কখনো বাড়তি টাকা চাই না," তিনি গর্বের সাথে বলেন।
"আর কী কী করেন আপনি যাত্রীদের জন্য?" আমি হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করি।
হাসি ফিরিয়ে দিয়ে মিরাজ বলেন, "অসুস্থ যাত্রীদের কাছে আমি কখনও ভাড়া চাই না। তারা তাদের খুশিমতন ভাড়া দিয়ে যান।"
কথার মাঝেই প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসে। গোটা শহরজুড়ে তখন ঘরে ফেরার ব্যস্ততা।
মিরাজকেও এখন আমাকে আমার বাড়িতে নামিয়ে সিএনজি ফেরত দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে হবে। বাড়িতে তার ফেরার অপেক্ষায় স্ত্রী আর সন্তান।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি