ঢাকার রাস্তায় তিন দিন
শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের পতনের পর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর দৃশ্যপটে নেই। ফলে, আমাদের মতো হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিষ্কার করেছে, দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছে, আবর্জনা সংগ্রহ করছে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, পুলিশ স্টেশনগুলোর সুরক্ষা দিচ্ছে এবং ডাকাতদের দূরে রাখতে রাতের বেলা রাস্তায় টহল দিচ্ছে।
যখন আমি এই লেখাটি লিখছি, তখন প্রায় মধ্যরাত। আমি রাস্তায় শিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যা বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করছে যে তারা নিরাপদ।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার, ৬ই আগস্ট। গভীর রাতে ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজের (ডিআরএমসি) এক বন্ধুর ফোন পেলাম। সে বললো, "ইউশা, আমরা কাল আসাদ গেটে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছি। সেখানে আসবি, নাহলে তোকে পরেরবার দেখলেই মুখ ভেঙে দিব।"
তাই পরদিন আমি সেখানে উপস্থিত হলাম, হাতে লাঠি নিয়ে। তবে দেশে প্রতি দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে কম, নিজের মুখ বাচাতেই মূলত গিয়েছি।
আমরা ছয়জন মিলে বিকেল ৩টা থেকে ৪ ঘণ্টা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করলাম। সত্যি বলতে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে যে পরিমাণ পরিশ্রম লাগে, আমরা তা সম্পূর্ণভাবে ভুলভাবে অনুমান করেছিলাম।
রোদে পুড়ে যাওয়া, গাড়ির হর্নের অবিরাম শব্দ, রাস্তার ধোঁয়া এবং ধুলাবালি মিলে এমন এক নরকীয় পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেন কোনো ডিস্টোপিয়ান ভিডিও গেমের দৃশ্য।
প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, এবং সেই বন্ধুকে অভিশাপ দিতে থাকি যিনি এই 'ব্রিলিয়ান্ট' আইডিয়াটি দিয়েছিলেন। তবে আমাদের দুঃখগুলো দ্রুতই ম্লান হয়ে যায় যখন আমরা মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা ও স্নেহ পাই।
যাত্রীরা আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা করছিল এবং আমাদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিল। তাদের অনেকেই রিকশা থেকে বা পায়ে হেঁটে আমাদের মাঝে পানির বোতল, পানীয় এবং খাবার বিতরণ করছিলেন।
দিনের শেষে, আমরা মাত্র ৪ ঘণ্টায় দুই থেকে তিন কার্টন মিনারেল ওয়াটার, সফট ড্রিংকস এবং অগণিত খাবার পেয়েছিলাম। আমাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ খাবার প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল, কারণ সেগুলো রাখার আর কোনো জায়গা ছিল না।
অনেক রেস্টুরেন্টও আমাদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিল, তারা আমাদের প্যাকেটজাত খাবার সরবরাহ করেছিল। আমরা বাড়ি ফিরেছি আমাদের ব্যাগপ্যাক ভর্তি পানীয়, বিস্কুট, বন, পিয়াজু, কলা ইত্যাদি নিয়ে।
এমন প্রতিকূল পরিবেশে যানবাহনের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ট্রাফিক পুলিশ যেভাবে সারাদিন কাজ করে, তার প্রতি আমাদের নতুন করে সম্মান জাগ্রত হয়েছে। আমি আমার বন্ধুকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, আমাকে যদি এক সপ্তাহ ধরে এই কাজ করতে হতো, তবে আমি ঘুষ নিতে শুরু করতাম।
পরবর্তী দিনগুলোতে, আমরা রাস্তাগুলো পরিষ্কার করেছি এবং দেয়ালে স্লোগানসহ গ্রাফিতি এঁকেছি। আমরা রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছি এবং আবর্জনা সংগ্রহ করেছি, বিশেষ করে প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি।
সত্যি বলতে, বৃষ্টিতে ভিজে নর্দমা থেকে ময়লা সংগ্রহ করা আমার কাছে খুব একটা মজা লাগছিল না। কিন্তু আগের মতোই, মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা এবং প্রশংসা আমাদের সব কষ্ট পুষিয়ে দিয়েছে।
তারা ব্যালকনি থেকে আমাদের উল্লাস করে অভ্যর্থনা জানাতো এবং আমাদের জন্য পানি ও খাবার ছুড়ে দিতো। দ্বিতীয় দিন থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে গিয়েছিল, কারণ আমরা ধীরে ধীরে কাজের ধরন বুঝতে পেরেছিলাম, এবং গাড়ির প্রবাহ কীভাবে আরও দক্ষভাবে সামাল দিতে হয় তা শিখে ফেলেছিলাম।
তবে সবচেয়ে মজার কাজ ছিল পেইন্টিং। একটি শিল্পকর্ম ধীরে ধীরে একত্রিত হতে দেখার মধ্যে আলাদা একটা আকর্ষণ আছে।
আমাদের শহীদ ভাইদের সাহস এবং ত্যাগ আমাদের কাজে প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে মুগ্ধ হাসিমুখে পানি বিতরণ করছে, আবু সায়েদ সাহসীভাবে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং আরও অনেক কিছু।
আমরা কমিকস এবং এনিমেশন থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছি। গোজো সাতোরুর "নাহ, আমি জিতব" বলা বা ব্যাটম্যানের ঢাকার উপর নজরদারি করা হলো জেনারেশন-জি'র দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিজস্ব উপায়।
মহামারি থেকে যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা- এ প্রজন্ম সবই দেখেছে। আমরা বড় হয়েছি হতাশা ও অসহায়তার মধ্যে ডুবে থেকে।
দেশে স্বৈরাচারী শাসনের এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় দেখতে পাইনি আমরা। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ আমাদেরকে আশার এক ঝলক দেখিয়েছে। এ আশার আলো, দেশে সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে, যা বহু বছরের দুর্নীতি ও বৈষম্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবে এবং দেশের আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করবে।
[লেখক ঢাকার একজন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী]