পত্রিকার পাতায় ফিরে দেখা: ১৯৭২–৭৫
আজকের বর্তমান আগামীদিনে হয়ে যায় ইতিহাস। একেকজন একেকভাবে ইতিহাসকে দেখার চেষ্টা করে, ফলে একেকজনের বয়ানে ইতিহাস ধরা দেয় একেক রূপে। কারও বয়ানের মহানায়ক অন্য কারও বয়ানে হয়ে উঠতে পারেন খলনায়ক।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয়েছে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের। ২০০৯ থেকে ২০২৪ অব্দি একটা গোটা প্রজন্ম শুধু এক বয়ানেই দেখেছে বাংলাদেশকে, আওয়ামী লীগের বয়ান। সে বয়ানে প্রশ্নাতীতভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখানো হয়েছে একজন অবিসংবাদিত নেতা ও শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে।
তবে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, একজন ভালো নেতা কী সবসময়ই একজন ভালো শাসক হয়ে উঠতে পারেন? মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাকি সকল নেতাদের অবদানকে স্বীকার করেই কি বলা যেতে পারে না তাদের রাজনৈতিক ভুল-ত্রুটি এবং অপশাসন সম্পর্কে?
প্রতিটি সমাজে সংবাদের কাজ নিত্যদিনের সত্যকে ধারণ করা। সে সত্য যুগের পর যুগ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম। তাই তো সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধে যুগে যুগে হয়েছে নানা আয়োজন।
সে সত্যকে ধারণ করেই যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পুরোনো পত্রিকার আর্কাইভটি হয়ে আছে ইতিহাসের জাদুঘর হয়ে। আজ সে ইতিহাসের জাদুঘরে ১৯৭২–৭৫ সালের পত্রিকাগুলোকে ঘিরে তারুণ্যের উৎসুক চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে সত্য, বাস্তবকে।
তারা বর্তমান বাস্তবতায় জানতে চাইছে শেখ মুজিবের শাসনামল সম্পর্কে, জানতে চাইছে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন আসলেই কতটা 'আদর্শ' নির্বাচন ছিল, কিংবা '৭৫-এর দুর্ভিক্ষের পেছনে মুজিব শাসনামলের দুর্নীতির ভূমিকা কতটা। তাই তো আজ হুট করে ভিড় দেখা যাচ্ছে পত্রিকা আর্কাইভে। উদ্দেশ্য সত্যকে জানা; পত্রিকায় উঠে আসা বাস্তবতার দিনলিপির ভিত্তিতে।
পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়ির নিজস্ব ঘ্রাণটুকু নিশ্চয়ই চেনা আছে? পুরোনো সবকিছুর কেমন স্বকীয় এক ঘ্রাণ আছে ব্যতিক্রম নয় পুরোনো পত্রিকাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশেই পত্রিকা আর্কাইভের সেকশনের ভেতরে ঢোকা মাত্রই তীব্রভাবে নাকে এসে লাগে নিউজ প্রিন্ট কাগজে কালি আর ইতিহাসের মিশেলে তৈরি হওয়া পুরোনো পত্রিকার নিজস্ব এক ঘ্রাণ।
সেলফের তাকে তাকে সারি সারি পুরোনো পত্রিকা নাম আর সাল দিয়ে বেশ গোছালোভাবে সাজানো। সমসাময়িক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি পত্রিকা এ আর্কাইভে রয়েছে। কখনো দৈনিক সংবাদ, কখনো দৈনিক ইত্তেফাক—শুধু তা-ই নয়, ১৯৭১ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পত্রিকার পাশাপাশি দেশভাগপূর্ব পত্রিকাও রয়েছে।
আগে এ আর্কাইভে ঢুকলে দেখা মিলত অল্প কিছু মানুষের, যাদের অধিকাংশই আসতেন হয়ত গবেষণা বা এ ধরনের কাজে। ইদানিংকালে একটু একটু ভীড় লক্ষ্য করা যায়।
এমনিতে সবাই পত্রিকা আর্কাইভে নানা সময়ের নানা পত্রিকা খুঁজে বেড়ালেও এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোকে ঘিরে।
অনেকের মতে, ২০১৩ সাল-পরবর্তী সময় থেকে এক প্রকার অলিখিতভাবে বন্ধই হয়ে যায় এসব পত্রিকা দেখার সুযোগ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সম্প্রতি এ আর্কাইভটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
তবে গ্রন্থাগারের কর্মকর্তাদের দাবি, কোনো বিশেষ নির্দেশের কারণে ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালের পত্রিকাগুলোর প্রদর্শন বন্ধ ছিল, এমন নয়। সম্প্রতি মানুষের নতুন করে তৈরি হওয়া ব্যাপক আগ্রহের কারণেই মূলত পত্রিকাগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. নাসিমুল জানান, মানুষ ১৯৭২–৭৫ পর্যন্ত পত্রিকার ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী হওয়ায় অনেকেই এসে এ পত্রিকাগুলোই সবার আগে খুঁজত। এভাবে পত্রিকাগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল, পাতাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
এ কারণে সেগুলো আলাদা করে আর্কাইভেরই একটি নির্দিষ্ট ঘরে রাখা ছিল। কেউ পড়তে চাইলে তার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয়পত্র দেখা হতো। আর যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কেউ হতেন, তাহলে তাকে কারণ উল্লেখপূর্বক একটি আবেদনপত্র জমা দিতে হতো।
এ ধরনের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সবাইকেই পত্রিকা পড়তে দেওয়া হত। কর্তৃপক্ষের দাবি, পত্রিকাগুলো সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাদের মতে, এ কারণেই পত্রিকাগুলো এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
পত্রিকাগুলোতে হাত দিলে অবশ্য বোঝা যায়, আদতেই খুবই জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় আছে পাতাগুলো। যেন একটু জোরে ওলটালেই ছিঁড়ে যাবে। অনেক পাতা ইতোমধ্যে ছিঁড়ে আছে, নষ্ট হয়ে গেছে অনেক সংবাদ।
'৭২ থেকে '৭৫-এর অনেক অসহায়ত্ব, অনাচার, দুর্নীতি, রাজনীতি, অপরাজনীতির খবরকে পুরোনো কাগজের ঘ্রাণে আগলে রেখেছে এসব পত্রিকা যেন। সেই সঙ্গে ভিন্ন দৃষ্টিতে ধরা পড়ে '৭৫-এর ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট।
গায়ে কাঁটা দেয় দূর্ভিক্ষের সংবাদ। দূর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার আগেই দেখতে পাওয়া যায় ২০০ টাকা কেজি চালের খবর। চাল, নুন, তেলের আকাশচুম্বী দাম। মানুষের পাত থেকে খাবার চুরি হয়ে যাচ্ছে, পাঁচ টাকার বিনিময়ে স্নেহের সন্তান বিক্রি চলছে। পত্রিকায় শিশুদের জন্য 'এক পেয়ালা দুধের গ্যারান্টি চাই' শিরোনামের সংবাদেও দেখতে পাওয়া যায়।
জানতে পারা যায় বিরোধী রাজনীতির মানুষের গুম, ধরপাকড়ের খবর, ১৯৭৩ সালের নির্বাচন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ ও সে সম্পর্কে গণমানুষের প্রতিক্রিয়া।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট পর্যন্ত অনেক সংবাদের পাতাই ছিঁড়ে আছে। তবু ১৭ আগস্ট থেকে অনেক পত্রিকাতেই রেকর্ড আছে, কিন্তু ১৬ আগস্টের কোনো সংবাদই সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না বলে উপস্থিত শিক্ষার্থীরাও নিশ্চিত করেন।
এক্ষেত্রে ইংরেজি জাতীয় দৈনিক The Bangladesh Times-এর ১৬ আগস্ট সংখ্যার আধা ছেঁড়া প্রথম পাতায় অর্ধেক শিরোনামে দেখতে পাওয়া যায়, 'Martial Law proclaimed in the country'। এর সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আহমেদের শপথপাঠের ছবি।
শুধু মুজিব শাসন নয়, মুজিব শাসন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানকালীন পরিস্থিতির খবরও রয়েছে পত্রিকাগুলোর পাতায়।
পত্রিকার এহেন বেহাল দশা নিয়ে কথা হয় শিক্ষার্থী নূর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'পত্রিকাগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে পড়তে দেওয়া হয় অনেক বছর ধরে, তার আগে এ ধরনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এখন সম্প্রতি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আগে যখন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, অনেকেই এখানে পড়তে এসে কোনো বিশেষ সংবাদ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে, ছিঁড়ে ফেলেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে ওই সংবাদগুলো কিন্তু আর আর্কাইভ করা নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।'
মুগদা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সাফওয়ান নবী যখন জানতে পারলেন ১৯৭২–৭৫ সাল পর্যন্ত পত্রিকা দেখার সুযোগ পাওয়ার কথা, তখন থেকেই তিনি প্রতিদিন গবেষণাসহ নানা উদ্দেশ্যে পত্রিকার আর্কাইভে আসতে শুরু করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন, ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষ এবং বন্যা, ও ১৯৭৫ সালের ঘটনার পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন।
সাফওয়ান জানান, 'খুবই প্রামাণ্য দলিল আমরা এ পত্রিকাগুলোতে পাচ্ছি। ১৯৭৪-এর দূর্ভিক্ষ সম্পর্কে এতটা জানা ছিল না। এর ভয়াবহতার পূর্ণাঙ্গ ধারণা এখন পাচ্ছি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ বিস্তারিত ধারণা পেয়েছি।'
কলেরা মহামারী এবং দেশব্যাপী চিকিৎসা খাতের ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও জানা যাচ্ছে বলেন তিনি। 'আমাদের কোনো সত্যকেই চাপা দেওয়া উচিত নয়, সত্যকে মেনে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, এটা আমাদের ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা।'
পত্রিকাগুলো ডিজিটাল আর্কাইভের মাধ্যমে সংরক্ষিত রয়েছে বলেও জানা যায়। পত্রিকাগুলোর ডিজিটাইজেশনের ব্যাপারে জানতে চেয়ে রিপোগ্রাফি সেন্টারে কথা বলতে গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপগ্রন্থাগারিক টিবিএসকে জানান, ২০১৫ সাল থেকে তাদের নিজস্ব সফটওয়্যারে ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়।
পত্রিকার পাশাপাশি দুষ্প্রাপ্য বইসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং গবেষণাপত্রও ডিজিটাইজড করা হয়েছে। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালের পত্রিকাগুলো সম্পর্কে তিনি জানান, 'ঐ সময়ের অনেক পত্রিকার পাতা ছিঁড়ে গেছে, প্রচুর সংবাদ হারিয়ে গেছে। এগুলো ডিজিটাইজেশনের আগেই নষ্ট হওয়ায় অনেকগুলোই আর সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
'এ কারণেই আমরা যা আছে তা দ্রুত ডিজিটাইজড করার সিদ্ধান্ত নেই। মূল পত্রিকাগুলো যেন আর ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সে কারণেই নিয়ন্ত্রিত প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সংরক্ষণের জন্যই এ উদ্যোগ, এমন না কেউ দেখতে পারবে না বা তথ্য নিতে পারবে না।'
ডিজিটাইজড করার ফলে তাদের মতে পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হয়েছে। তাদের নিজস্ব লোকাল সার্ভারে বিভিন্ন পত্রিকার তথ্য পাওয়া যায়। তবে লোকাল সার্ভারে হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে ওয়েবসাইটে পত্রিকাগুলো পড়া যায় না। মূলত ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পর্যাপ্ত সামর্থ্য না থাকায় এটি লোকাল সার্ভারে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রিপোগ্রাফি সেন্টারে পত্রিকার সফট কপি থেকে কোনো সংবাদের পুরো পাতার কপি সংগ্রহ করা যায় আর্কাইভ ভবনের তৃতীয় তলায় দুই টাকার বিনিময়ে। যদিও আর্কাইভের কিছুটা অতিরিক্ত জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে, তবুও যথেষ্ট বাজেটের অভাবে আর্কাইভের আধুনিকায়ন সম্ভব হয়নি। পত্রিকাগুলো যেভাবে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে সংরক্ষণে আরও জটিলতা দেখা দিতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ব্যাপারে আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম শাসনামল, '৭৪-এর দূর্ভিক্ষ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশকে জানতে ও বুঝতে এ সময়ে এসে এসব পত্রিকার পাতায় একবার চোখ বোলানো যেতেই পারে।
ছবি: টিবিএস