হারিয়ে যাচ্ছেন ঘড়ির ডাক্তার!
পুরান ঢাকার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন বাংলার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য। নাম না জানা হাজারো গলিঘুপচির কিনারায় যেন থেমে থাকা ইতিহাস আর আটকে থাকা সময় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সেই পুরোনো আমল থেকে এই এলাকায় অলিগলি আর বাজারের উপস্থিতি। সেসব গলি কিংবা বাজারের নামেরও বাহার তেমনি। সেজন্যেই বোধ হয় এখানকার মানুষ আদর করে পুরান ঢাকাকে বলেন 'বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলি'।
নবাবি আমল, সাবেকি খানা, প্রাচীন স্থাপত্য সবকিছুতেই একটা পুরোনো সময়ের প্রলেপ। সেই সময়কে খুঁজতে একদিন পুরান ঢাকার সদরঘাটে গুটি গুটি পায়ে পৌঁছে গেলাম সময় আগলে রাখা মানুষের সন্ধানে। সময়কে যারা যত্নে বাঁচান, তাদেরকে কেউ কেউ বলে 'ঘড়ি সারাইওয়ালা'। আমি বলি এ তো সময় মেরামতির কাজ।
১৯৩৪ সালে প্রকাশিত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের কাঁটা' গল্পে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের মক্কেল শ্রীআশুতোষ মিত্রকে পকেট ঘড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়। বস্তুত এই পকেট ঘড়িই নীরব ঘাতক গ্রামোফোন পিনের হাত থেকে আশুবাবুর জীবনকে বাঁচিয়ে দেয়। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়ে আশুবাবু ব্যোমকেশের শরণাপন্ন হন। এই জনপ্রিয় গল্প থেকেই ত্রিশের দশকে বাঙালির ঘড়ি ব্যবহারের স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। সেকালের পকেট ঘড়ি ছিল খানিকটা কম্পাসের মিটারের মতন, সাথে থাকত সোনালী রঙের এক ধরনের চেইন। ডিসপ্লেটা বেশ বড়।
তখনকার দিনের ফ্যাশন অনুযায়ী, এ সমস্ত ঘড়ি রাখবার চল ছিল জামা বা ফতুয়ার বুকের বা দিকের পকেটে, সেই হেতু নামটিও পকেট ঘড়ি। চড়া দাম হওয়ায় এ ধরনের ঘড়ি কেনার সামর্থ্য আবার সকলের ছিল না। সুতরাং, ঘড়িখানা মালিকটির আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, তা বুঝতেই পারছেন!
এ তো গেল ব্রিটিশ আমলের কথা। ষাট-সত্তরের দশকের দিকটাতে বাঙালির বিয়েতে জামাইকে হাতঘড়ি কিনে দেওয়ার এক ধরনের রেওয়াজ চালু হয়। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে সোনার চেন-আংটি-ঘড়ি আর নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে হাত ঘড়ি, সাইকেল আর টর্চ লাইট— এ সমস্ত উপহার ছিল জামাই আদরের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এমনকি, নব্বইয়ের দশকেও ঘড়ির চল ছিল ব্যাপক। বিয়ে, জন্মদিনের উপহারের তালিকায় টেলিভিশন, রেডিওর মতন করে ঠাঁই পেত ঘড়ি। একেবারে কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক থেকে অফিসের চাকুরে সবার হাতেই কম বেশি ঘড়ির দেখা মিলত। এছাড়া, অভিজাত বাড়ির দেওয়ালগুলোতে থাকত বিশাল আকারের দেওয়ালঘড়ি। সেসব দেওয়ালঘড়িতে ছিল ঘণ্টার ব্যবস্থা। অর্থাৎ, যে কটা বাজবে ঘণ্টাটা সে কবার ঢংঢং আওয়াজ করবে। তাই এসব দেওয়ালঘড়ির কাটায় চোখ না রেখেও শব্দ গুনে জানা যেত সময়।
'সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।' সময়কে ধরে রাখা যায় না। জল ঘড়ি, বালি ঘড়ি, সূর্য ঘড়ি, আগুন ঘড়ির যুগ পেরিয়ে একসময় আসে আধুনিক ঘড়ির যুগ। সময়ের এই বয়ে চলাকে টিকটিক শব্দে দুটো কাটার সাহায্যে হিসেব করতে শেখে মানুষ। ঘড়ির আধুনিক যুগও পুরোনো হতে সময় লাগে না। নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্যে দিয়ে কালের বিবর্তনে বিশের দশকে এসে আস্তে আস্তে ঘড়ির যৌবন ফুরোতে শুরু করে। সংসারে বৃদ্ধ অক্ষম মানুষের প্রয়োজন আস্তে আস্তে যেমনি করে ফুরিয়ে যায়, তেমনিভাবে মোবাইল ফোনের ব্যবহার ঘড়িকে ফেলে দিচ্ছে বাদের খাতায়।
যুগ বদলের হাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যায়। বদলে যাওয়া জীবনযাত্রায় নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়। আবার কিছু কিছু কাজ, পেশা হারিয়ে যেতে শুরু করে। ফলে এসব পেশার মানুষেরা হয়ে পড়েন বেকার, কর্মহীন। যারা যুগের ধর্মকে মানিয়ে নিতে পারেন তারাই এগিয়ে যান। কিন্তু কেউ কেউ সময় আগলে থাকেন। কারণ ওটাই তাদের একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, পেশা ও নেশা। এমনই একজন সদরঘাট মোড়ের মোহাম্মদ সেলিম। যে ঘড়ির গল্প এতক্ষণ বললাম, মোহাম্মদ সেলিম সেই ঘড়ি মেরামতের কাজ করেন।
সালটা ১৯৮৪। মোহাম্মদ সেলিমের বয়স তখন বছর পনেরো। পরিবারের আর্থিক অনটনের জন্য পড়ালেখা তেমন কিছুই করে উঠতে পারেননি। তবে সেলিম ছোটোবেলা থেকেই দারিদ্রের ভয়ংকর রূপ দেখে বুঝতে পেরেছিলেন বাঁচতে হলে খাটতে পারা চাই, কোনো একটা কাজ শেখা চাই। পরিবারের অভাব অনটন কাটিয়ে উঠতে ঘড়ি সারাইয়ের কাজ শেখার শুরুটা তখনই। দম দেওয়া ঘড়ি মেরামতের কাজ দিয়ে সেলিমের হাতেখড়ি ঘটেছিল এই পেশায়।
আশির দশকে ঘড়ির চল একেবারে কম নয়, বরং বেশ ভালোই। কথায় বলে, শরীর থাকলে অসুখ তো হবেই। অসুখ হলে ডাক্তার-বদ্যির ব্যবস্থা থাকে। সেরকমই ঘড়ির অসুখ-বিসুখের জন্যেও ছিল ঘড়ির ডাক্তার। ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে তখন ঘড়ির ডাক্তারের ছড়াছড়ি। ঘড়ি সারাই করতে তাই ছুটতে হতো না খুব বেশি দূরে। পাড়া মহল্লায় দুই-একটি ঘড়ি সারাইয়ের দোকান থাকবেই। আর ঘড়ির অসুখ সূত্রে সেসব ঘড়ির ডাক্তারদের সাথে ঘড়ির মালিকের গড়ে উঠতো আন্তরিক সম্পর্ক।
কোনো ঘড়ি হয়তো খুব কাছের বন্ধুর থেকে উপহার পাওয়া, কোনোটা বা বিয়ের ঘড়ি। একেকটা ঘড়ির সাথে কত না স্মৃতি... সুতরাং যতই অসুখ-বিসুখ করুক না কেন, ঘড়ির মালিক কিছুতেই সেটিকে ফেলে দিতে চাইতেন না। অনেক সময় সারাই করা না গেলেও স্মৃতির সেই ঘড়ি রেখে দিতেন মালিক। ঘড়ি সারাইয়ের কাজ তাই তখন ভালোই পসারের।
মোহাম্মদ সেলিম এ কাজ শিখে ছোটো থেকে সংসারের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করছিলেন। পরবর্তীতে বিয়ে করেন। ৬ জন সদস্যের সংসারে অভাব অনটন তেমন ছিল না। ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার পর না খেয়ে থাকতে হয় নি কখনো।
আজ থেকে বছর বিশেক আগের কথা। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা একখানা সোনার ঘড়ি সারাইয়ের জন্যে নিয়ে আসেন সদরঘাট মোড়ে। ওই জায়গাটাতে অনেক বছর ধরেই বেশ কয়েকখানা ঘড়ি মেরামতের দোকান। সদরঘাট এলাকার এসব দোকানের সুনামও তেমনি। শেষ অব্দি কয়েকটি দোকান পেরিয়ে সেই সোনার ঘড়ি মেরামতের কাজ পান মোহাম্মদ সেলিম। এমন সুন্দর ঘড়ি সেলিম তার জীবনে কখনো দেখেননি।
ঘড়িটা সারাই করতে সময় লেগেছিল অনেক। সে কাজের জন্যে সেই সময়ে প্রায় ৮ হাজার টাকা মজুরি পেয়েছিলেন তিনি। যখন ঘড়িখানা মেরামত করে ফিরিয়ে দেবেন মালিককে, তখন মনের মধ্যে একটা দুরন্ত ইচ্ছে জাগলো এই ঘড়ির ডাক্তারের। ভাবলেন, যত কষ্টই হোক ঘড়িখানা তিনি কিনে নেবেন। ঘড়িখানা যে সোনার শুধু সেজন্যেই নয়, বরং পুরোনো বলে সে ঘড়ির মূল্যটা এই ঘড়ির ডাক্তারের কাছে বেড়ে গিয়েছিল হাজার গুণে। সেই ঘড়ির জন্যে নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দর হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু এ প্রস্তাবে মালিক কিছুতেই রাজি হননি। সেই সোনার ঘড়ি আর কেনা হয়নি সেলিমের। স্মৃতিচারণায় সেলিমের চোখে ভেসে উঠছিল অতীতের সেসব দিন।
মোহাম্মদ সেলিমের এই ঘড়ির দোকানের চেহারাটা আর পাঁচটা সাধারণ দোকানের মতো নয়। কিছুটা চৌকো সাইজের বাক্সের মতো দেখতে, চারপাশে কাঁচের ঘেরাটোপ। মাথার ওপর ছাদের বালাই নেই। এই বাক্সসদৃশ কাচের ঘেরাটোপে লাল, কালো, সাদা বেল্টের ঘড়ি। চামড়া আর প্লাস্টিকের বেল্টের পাশাপাশি আছে স্টিলের ঘড়িও। বর্তমানে দোকানটার অবস্থা মলিন, জরাজীর্ণ। যেন কিছুটা বার্ধক্যের ছায়া পড়েছে। তবু মাথার ওপর খোলা আকাশ রেখে এই ভাসমান দোকানটাকেই ভরসা করে এতদিন সেলিমের জীবন-জীবিকা চলেছে হেসেখেলে।
শুধু কী সেলিম? এমন অনেক ঘড়ির ডাক্তারের আস্তানা ছিল কলেজিয়েট স্কুলের পাশের এই জায়গাটাতে। সদরঘাটের স্থানীয় মানুষ দু'পা এগিয়ে পৌঁছোতেন বাটার শোরুমের ঠিক বিপরীত দিকের এই ঘড়ি সারাইয়ের দোকানগুলোতে। দূরত্বটা কম বলেই ঘড়ি সারাইয়ের গরজটা বেশি। তাছাড়া, শুধু তো মেরামতির কাজ নয়। স্থানীয় মানুষের সাথে ঘড়ির ডাক্তারদের দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয়। সুতরাং ভাসমান দোকানগুলোর সামনে মাঝেমধ্যে টুল পেতে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে গল্পগাছাও জমত। কাউকে সপ্তাহখানেক দোকানে আসতে না দেখলে খোঁজখবর করতেন এলাকার মানুষ। শুধু প্রয়োজনটুকুই না, সাথে অনেকখানি আন্তরিকতা। অন্যরকম এক হৃদ্যতার সম্পর্ক।
বছর বিশেক আগে যখন মুঠোফোন এলো বাংলাদেশে, তখনও এই সদরঘাট মোড়ের ঘড়ির ডাক্তাররা তাদের পেট চালিয়েছেন ঘড়ি মেরামতির কাজ করে। তারপর ২০১০ এরপর থেকে ঘড়ির ব্যবহার কেমন করে যেন কমে যেতে থাকলো। যারা এই পেশায় নতুন, তারা বুঝতে শুরু করলেন, এই ঘাঁটে নৌকো বেঁধে বেশিদূর এগোনো যাবে না। সংখ্যায় কমতে শুরু করলো সদরঘাট মোড়ের ভাসমান দোকানগুলো। কেউ কেউ আবার দোকানটুকু তোলবারও প্রয়োজন মনে করলেন না। কী–ই বা দোকান.. খোলা আকাশের নিচের ভাসমান দোকান পড়ে থাকে দোকানীর অপেক্ষায়। সময় বয়ে যায়। দোকানী আর আসেন না। কারো পেশা বদল, কারো বা অসুস্থতা।
"এখন আর ঘড়ির সেই পসার নেই। মোবাইলের যুগ পড়তেই ঘড়ির চাহিদা কমলো। আমাদের পেশাতেও ভাটা পড়া শুরু হলো। কিন্তু ঘড়ি মেরামত ছাড়া অন্য কোনো কাজ তো পারি না। এখন আর নতুন কাজ শেখার বয়সও নেই। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে মেকাররা আসে। বয়স্ক মানুষের ঘড়ির ব্যবহার যুগ বদলেও বদলায়নি। ওরা এখনো কম বেশি আসে। দিনে ১৫/২০ খানা ঘড়ি মেরামত করি। এভাবেই ঢিমেতালে চলছে," জানালেন সেলিম।
কখনো কাঠফাটা রোদ্দুর, কখনো বা ঝমঝম বৃষ্টি। আবহাওয়ার চোখ রাঙানি পেরিয়ে রোজ সময় মেরামতের কাজ করে চলেন সদরঘাট মোড়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের পাশে বসা এই মানুষগুলো। এ যে শুধু তাদের রুটি-রুজির উপায় নয়, ভালোবাসার জায়গাও। সারিয়ে তোলার আনন্দও। ঘড়ির থেমে যাওয়া কাটাকে সচল করে তুলতে পারলে এদের ঠোঁটে হাসি ফোটে। মিনিট আর সেকেন্ডের টিকটিক শব্দটা কানের কাছে না বাজলে মনে হয়, কী যেন নেই।
মতিউর রহমান মতিন নামের একজন ঘড়ির ডাক্তার ছিলেন এখানেরই নিত্য বাসিন্দা। ঘড়ির কাজ নিয়েই যার জীবনের ৪০টা বছর কেটে গেছে। এখন বয়স সত্তরের কিছুটা বেশি। ঢাকা শহরের সবথেকে পুরোনো ঘড়ির ডাক্তার হিসেবে মানুষ তাকে চেনে। অনেক দূর থেকে মতিনের খোঁজে সদরঘাটে আসেন মানুষ। সবথেকে পুরোনো এই ঘড়ির ডাক্তারকে দেখার সাধ ছিল আমারও। কিন্তু খোঁজখবর করে জানতে পারি, তিনি গুরুতর অসুস্থ। দারিদ্র্য রেহাই দেয়নি এই সময় মেরামতকারীকে। সাথে বার্ধক্যজনিত রোগ, চোখের নানা সমস্যা। পনেরো দিনের ব্যবধানে দুইবার খুঁজেও মেলেনি মতিউর রহমান মতিনের সন্ধান।
তবু সেই এলাকায় মতিউর নামটা থেকে গেছে। সদরঘাট এলাকায় এক ডাকে মতিন চাচা বলে চেনে সব্বাই। তিনি যেন 'ঘড়ির সকল সমস্যার মুশকিল আসান' এমনটাও বলতে শোনা গেল।
মতিউর রহমান মতিনরা চারদশক ধরে সময় মেরামতির কাজ করেছেন। কিন্তু সময় তাদেরকে ক্ষমা করেনি। সময় সময়ের ধর্মে বয়ে চলেছে, বসে থাকেনি বিন্দুমাত্র। মোবাইল আর স্মার্টওয়াচের ভিড়ে তাই মতিনরা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অনেকটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন। তাদের দিন কাটে অনাহারে... তবু যে সময় যায়, সে আর ফেরে না! ঘড়ির ডাক্তাররাও যাচ্ছেন হারিয়ে।