পুলিশের শটগানের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত মুখ, একসময়ের স্টাইলিশ খোকন এখন ভয় পান নিজের চেহারা দেখে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ৬ আগস্টের পরিবর্তে একদিন আগেই ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
পুরো জুলাই বিপ্লবের সময়ে ঢাকার অন্যতম কঠোর সংঘাতপূর্ণ এলাকা ছিল যাত্রাবাড়ী। ৫ আগস্ট যেন পুরো রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এই এলাকা। ওই দিনই প্রায় ৩৬ জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলি চালানোর পরও জনগণের বিপ্লবের প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে দমানো যায়নি। হাজার হাজার মানুষ জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমে আসেন, লক্ষ্য ছিল একটাই শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেননি খোকন চন্দ্র বর্মনও। পেশায় ড্রাইভার খোকন, সরকার পতনের আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে তিনি বলেন, "দেশের এই স্বাধীনতায় আমিও যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম না এর জন্য আমার চেহারা বিসর্জন দিতে হবে"।
খোকনের নাক, ঠোঁট এবং মুখমণ্ডলের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই, একটা বড় গর্ত হয়ে আছে চেহারাজুড়ে। একটি ক্যানুলা সরাসরি তার শ্বাসযন্ত্রের সাথে সংযুক্ত, যা দিয়ে তিনি অক্সিজেন গ্রহণ করছেন।
৫ আগস্ট দুপুরে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও তার অনুগত পুলিশ বাহিনী যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। সেদিন দুপুরে এক পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে, মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে শটগান দিয়ে সরাসরি খোকনের মুখে গুলি করেন।
খোকনের বড় ভাই বলেন, "আমার ভাই সব সময়ই স্টাইলিশ আর নিজের চেহারা নিয়ে সচেতন ছিল। এখন তার আগের মুখ আর নেই, ভয়াবহ অবস্থায় আছে। প্রথম যখন হাসপাতালে গিয়ে তাকে দেখলাম, চিনতেই পারিনি আমার ভাইকে"।
মুখ বরাবর গুলি
খোকন পুলিশের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন, তাকে গুলি না করার জন্য। কারণ এত কাছ থেকে গুলি চালানো মানেই নিশ্চিত মৃত্যু।
সেদিন যাত্রাবাড়ী যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, কীভাবে যাত্রাবাড়ী থানার আশেপাশে পুলিশ খুব কাছে থেকে মানুষকে গুলি করছে।
খোকন বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে তার মুখ লক্ষ্য করে গুলি করেন।
"আমি সেখানেই পড়ে যাই। সবাই ভেবেছিল আমি মরে গেছি। কিন্তু আমি মরিনি। আমি হাত তুলে সাহায্য চেয়েছিলাম। তখন কিছু লোক আমার কাছে ছুটে আসে এবং আমাকে তুলে নিয়ে যায়," বলেন খোকন।
খোকনকে গুলি করার ঠিক পরের মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করেন আরেক আন্দোলনকারী। সেই ভিডিও আমাদেরকে দেখান খোকনের ভাই। স্পর্শকাতর ওই ভিডিওতে খোকনের বিকৃত ও রক্তাক্ত মুখ দেখা যায়।
খোকন বলেন, "এমনভাবে গুলি লেগেছিল, যেন আমার পুরো মুখটাই উড়ে গেছে"।
তবে গুলি খাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ জ্ঞান ছিল তার। আহত অবস্থাতেই নিজের মুঠোফোন আনলক করে একজন আন্দোলনকারীর হাতে তুলে দেন, যাতে তারা তার পরিবারকে খবর দিতে পারে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
'হয় দ্রুত চিকিৎসা করুন, না হয় আমাকে মরতে দিন'
গুলিতে খোকনের পুরো মুখের মাংস প্রায় খুলে খুলে পড়েছিল। অনেকটা আলৌকিকভাবেই বেঁচে আছেন তিনি। তবে, তিনি আর বাঁচতে চান কি না, তা নিয়ে সন্দিহান।
খোকন বলেন, "আমি যখনই আমার মুখ দেখি, নিজেকেই ভয় পাই। আমি এভাবে বাঁচতে চাই না"।
খোকন জানান, তার ভাই তীব্র যন্ত্রণা ও মানসিক চাপের কারণে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন। পরিবারের সদস্যরা গত দুই মাস ধরে তাকে নিয়মিত হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। আমরা যখন তাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তাদের শেরপুরের বাড়িটি বন্যায় প্লাবিত ছিল।
খোকনের পরিবার আর্থিকভাবেও সচ্ছল না। তার ভাইও পেশায় তার মতো একজন ড্রাইভার। ভাইয়ের খেয়াল রাখতে গিয়ে চাকরি থেকে ছুটি নিতে হয়েছে তাকে।
অন্যদিকে, সার্জারি করে তার মুখমণ্ডলের বীভৎস অবস্থা ঢাকতে চাইলেও তার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। অবশ্য খোকনের এ অবস্থার ছবি ভাইরাল হওয়ার পর, সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্প্রতি সমন্বয়ক সার্জিস আলম হাসপাতালে খোকনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। তবে তার চিকিৎসায় অন্তত কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে।
"এই সময়ে অনেকেই আমাকে সাহায্য করেছেন, অনেককে আমি চিনি না, অনেকের নামও ভুলে গেছি। তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। কিন্তু আমি এভাবে বাঁচতে পারছি না। হয় আমাকে মরে যেতে দিন, নয়তো দয়া করে আমার দ্রুত চিকিৎসা করুন," অনুরোধ খোকনের।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন