সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসীদের দ্বন্দ্ব: সৌদি কারাগারে বন্দি বাংলাদেশি বহু শ্রমিক
সিলেটের কোলাপাড়া গ্রামের আলামিন ও আবুল কাইয়ুমের বাবা আমান আলী সাত মাস ধরে চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন। কারণ, তার দুই প্রবাসী ছেলেই সৌদি আরবে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে, যার সাথে তার সন্তানদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে তিনি মনে করেন।
শুধু আমান আলীর ছেলেরাই নন; বরং সৌদি আরবে গত ঈদুল ফিতরের রাতে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুটি দল মধ্য রিয়াদের নিম্ন আয়ের মানুষদের আবাসিক এলাকা হারা আল-ওয়াজরাতে পাল্টা মিছিল করে।
আমান আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা অসহায় অবস্থায় আছি। আমি জানি না আমাদের কে সাহায্য করতে পারে কিংবা আমরা কোথায় যেতে পারি। কিছু দুষ্ট গোষ্ঠী মারামারি করেছে এবং টিকটকে ভিডিও করেছে। কিন্তু আমার ছেলেরা ও অন্যরা এই মামলায় ফেঁসে গেছে।"
আমান আরও বলেন, "আমার ছেলেরা কারাগারে ভেঙে পড়ছে। তারা কোনো অন্যায় করেনি। তাই দয়া করে তাদের ফিরিয়ে দিন। যেমনটা দুবাইয়ের শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।"
সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় সৌদি আরবে যেসব বাবা-মায়ের ছেলেদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় ৯০ জনেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টিবিএস ৫০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকের তালিকা পেয়েছে।
রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলর মুহাম্মদ রেজা-ই-রাব্বি বলেন, "এগুলো বেশ অপ্রীতিকর ঘটনা। পরপর এমন তিনটি ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসীদের দুটি ভিন্ন গোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তারপরে দুই গ্রুপের মাঝে (এখানে) একটি গ্রামীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। অবশেষে ঈদের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের (প্রবাসী শ্রমিকদের) মধ্যে আরেকটি লড়াই শুরু হয়।"
আসলে যা ঘটেছিল
১১ এপ্রিল ঈদের দিন সন্ধ্যায় হারা এলাকায় সিলেটি অভিবাসী শ্রমিকরা একটি মিছিল শুরু করে। সেখানকার একটি ক্লিপ টিকটকে ভাইরাল হয়েছে। ঐ মিছিলে থাকা লোকজন 'সিলেটি' ভাষায় স্লোগান দিচ্ছিলেন।
সিলেট প্রবাসী বুখারি সৌদি আরবে জনশক্তি ব্যবসার সাথে যুক্ত। তিনি জানান, এই মিছিলের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসী শ্রমিকদের আরেকটি মিছিল দেখা যায়।
এসব মিছিল কেন হচ্ছিল এমন প্রশ্ন করা হলে বুখারি বলেন, "একটি 'ডাকাতির ঘটনা' থেকে এমন পরিস্থিতির উৎপত্তি। যেখানে সিলেটের একজন ভুক্তভোগী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন অভিযুক্ত। এই ঘটনায় দুই জেলার প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।"
এমতাবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসী শ্রমিকেরা নিজেদের লোকের পক্ষে রাস্তায় বিক্ষোভ করে। অপরদিকে প্রবাসী সিলেটি শ্রমিকেরাও পাল্টা বিক্ষোভ করে।
তবে সংকটের শুরু হয় তখনই যখন কেউ মিছিলের ফুটেজ ধারণ করে সেটি টিকটকে পোস্ট করে দেয়। ফলে এটি সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যায় এবং সৌদির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলির কাছেও পৌঁছে যায়।
বুখারি বলেন, "ঈদের রাতে পুলিশ আমাদের এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। প্রথমদিকে আমি তাদের দেখিয়েছিলাম, আমার আকামা (বৈধতা) আছে এবং আমার ফোনে টিকটক নেই। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। তবে আমাকে গ্রেফতারের জন্য ফের ডাকা হয়েছিল। কিন্তু ভ্যানটি ইতিমধ্যে ভর্তি থাকায় আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।"
সৌদি প্রবাসী আরেক শ্রমিক জুবায়ের সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। সেই রাতে গ্রেপ্তার থেকে কোনোমতে তিনি বেঁচে যান। কারণ, তিনি ঈদ উপলক্ষে একটি পার্টিতে এক বন্ধুর সাথে ছিলেন। তিনি জানান, সমস্যাটি শুরু হয় টাকা নিয়ে।
জুবারের বলেন, "একজনের কাছে অন্যজনের পাওনা ছিল। সেই রাতে আমাদের এলাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের ৯৩ জন প্রবাসী শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়।"
পরিবারের দুরবস্থা
বুখারি জানান, ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে তিনি বেশ চিন্তিত। কেননা তার কোম্পানির ১৬ জন শ্রমিক ও আত্মীয়রা এতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বুখারি বলেন, "যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বাবা-মা এবং পরিবার আমাকে সারাক্ষণ ফোন করে কাঁদে। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া বেশিরভাগই সমাবেশ ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল না। কয়েকজন ঝগড়াঝাঁটি করেছিল। কিন্তু বেশিরভাগই প্রকৃতপক্ষে নির্দোষ।"
বুখারি বারবার দূতাবাসে গিয়ে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, গ্রেফতারকৃত লোকেরা কোনো ঝামেলায় জড়াননি।
বুখারি বলেন, "দূতাবাস আমাদের জানিয়েছে যে, তারা গ্রেফতারকৃতদের ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কিছুই হয়নি। আমি দূতাবাসে গেলে তারা চেষ্টা করছে বলে জানায়। ধৈর্য ধরতে বলে।"
দূতাবাস যা বলছে
লেবার ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলর মুহাম্মদ রেজা-ই-রাব্বি জানান, বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। কিন্তু তারা বিষয়টিকে বেশি চাপ দিতে পারে না। কারণ ঘটনার ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর সৌদিদের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
মোহাম্মদ রেজা বলেন, "তারা এমন সংঘর্ষ নিয়ে শঙ্কিত। এক্ষেত্রে আমাদের শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার পরিস্থিতি নেই।"
মোহাম্মদ রেজা আরও বলেন, "সাধারণত এখানে শাস্তি বেশ কঠোর হয়। এক্ষেত্রে প্রায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। কিন্তু তারা আমাদের প্রতিনিয়ত করা অনুরোধ বিবেচনা করেছে। এক্ষেত্রে বিষয়টি আদালতে না পাঠিয়ে রিয়াদের আমিরের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমিরের অনুমোদনের পর মামলাটি এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। তাদের মুক্তির বিষয়ে পৃথক চিঠি ইস্যু করে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তারা তাদের প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।"
৯৩ জনের গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান সঠিক কি-না জানতে চাইলে মোহাম্মদ রেজা বলেন, "এটি শুধু একটি ঘটনা নয়। আমি উল্লেখ করেছি, তিনটি ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যাটি সব মিলিয়ে।"
এ ঘটনায় ফজলুর রহমানের দুই ছেলে জুবায়ের আহমেদ ও সাব্বির আহমেদও সৌদি কারাগারে রয়েছেন। তিনি বলেন, "আমার ছেলেরা কোনো ঝগড়ায় জড়ায়নি। আমার ছেলেরা মাত্র দুই বছর পাঁচ মাস ধরে সৌদিতে রয়েছে। ওদের বয়স খুব কম।"
অসহায় ফজলুর রহমান আর্জি জানিয়ে বলেন, "আমরা অসহায় দরিদ্র পরিবার। যদি তারা দোষী সাব্যস্ত না হয় তবে দয়া করে তাদের কাজ করার অনুমতি দিন। আমরা জানি আমাদের ছেলেরা নির্দোষ। অন্তত তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।"