১৯৩৭ গোল্লা সাবান যেভাবে চট্টগ্রামের সেরা!
বলের মতো গোল, ওজনেও হবে প্রায় হাফ কেজি। ক্ষুধার্থের চোখে সুকান্ত যেমন দেখেছিলেন ঝলসানো রুটি, তেমনি চট্টগ্রামের মানুষের স্মৃতিতে আজও এই সাবান দেখতে যেন ঠিক পূর্ণিমার চাঁদ।
হাজী নূর আলী সওদাগরের হাত ধরে ১৯১৯ সালে সাবানটির যাত্রা এবং পরে ১৯৩৭ সালে এটি নিবন্ধিত হয়। সাল অনুসারেই সাবানটির নাম হয়ে যায়, '১৯৩৭ বাংলা সাবান'। এছাড়াও, এ সাবানকে অনেকে চেনেন 'গোল্লা' সাবান নামে, কেউ আবার বাংলা সাবান বলতেই বোঝেন '১৯৩৭ সাবান'।
ভারতের মাটিতে প্রথম সাবান তৈরি করেছিল মেরঠের 'নর্থ ওয়েস্ট' কোম্পানি। সেটা ১৮৯৭ সাল। যদিও তা ব্রিটিশ লগ্নি ও প্রযুক্তিতে তৈরি হতো। এরপর স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে সম্পূর্ণ দেশীয়ভাবে ভারতবাসীর হাতে এসেছিল চন্দনের গন্ধে সুরভিত 'মাইশোর স্যান্ডেল সোপ'। তারও দু'বছর পরে, ১৯১৮ সালে, স্বদেশী পণ্য বানানোর ভাবনা থেকে সাবানের ব্যবসায় এসে পড়ে টাটাগোষ্ঠী। উৎপাদন করতে শুরু করেছিল কাপড় কাচার সাবান। সে বছরই বাজারে এসেছিল গোদরেজ সোপ লিমিটেডের কাপড় কাচার বার সাবান। আর তার ঠিক একবছর পরই চট্টগ্রামের নূর আলী সওদাগর গড়ে তুললেন ১৯৩৭ বল সাবান।
চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাই খালের পাশে গড়ে ওঠা এই সাবান কারখানাটিই স্থানীয়ভাবে প্রথম সাবান কারখানা। এখনো চট্টগ্রামবাসীর কাছে কাপড় কাচার সাবানের জন্য অন্যতম ভরসার নাম '১৯৩৭ সাবান'।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর পাশ করা বিধোরা রওশন বলেন, "আমাদের বাসায় তো বটেই, মামাকেও দেখতাম, তার বাসার জন্য সাবান টুকরো করে কিনে আনতেন। এখন আমরা হুইল, রিনের মতো কাপড় ধোয়ার পাউডার সাবান ব্যবহার করলেও, গ্রামের দিকে মানুষেরা এখনো বিশ্বাস করেন এই সাবান ছাড়া কাপড় পরিষ্কার হবেনা। যতই পাউডার থাকুক, তার এই সাবান কাপড়ে ঘষবেনই!"
দেশীয় (তৎকালীন ভারতবর্ষ) সাবানগুলোর উৎপাদন যেহেতু সব কলকাতাকেন্দ্রিকই ছিল, নূর আলীও তার সাবান উৎপাদনের জন্য কারিগর নিয়ে আসলেন কলকাতা থেকেই। প্রায় ১০ থেকে ১২ জন কারিগর নিয়ে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন নিজ বাড়ির ভেতরেই। বাড়ির একাংশে তার পরিবারের বসতবাড়ি, একাংশে কারখানার কাজ এবং আরেক অংশে কারিগরদের থাকার ব্যবস্থা। এখন কারিগরের সংখ্যা ১৫০ এর আশেপাশে। যদিও তারা এখন চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন।
বর্তমানে সাবানের কারখানার জায়গায় যে সবুজ রঙের দোতালা বড় বাড়ি দেখা যায়, সেটি ১৯৫৪ সালে বানানো। তার আগ পর্যন্ত কারখানার কাজ চলত একচালা একটি ঘরেই। খাতুনগঞ্জে গিয়ে, এমনকি চট্টগ্রামের যে কাউকে খাতুনগঞ্জের সাবানের কারখানা বললেই তারা নিয়ে আসবেন সবুজ রঙের দোতালা এই ভবনের সামনে। এক সময় হাজী নূর আলী সওদাগরের বসতবাড়িও ছিল এই ভবনটি। দোতালায় থাকতেন তার পরিবার। আর নিচতলায় চলত কারখানার কাজ। বাড়িটি ঘুরে দেখলে, নারীদের জন্য বারান্দায় টানানো পর্দার হুক, এখনো সে সময়ে কথা মনে করিয়ে দেয়।
সাবানটির জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে পাকিস্তান আমল থেকে। ১৯১৯ থেকে এখনো এই কারখানাটি সম্পূর্ণ হাতে-বানানো সাবান বানিয়ে যাচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ সেদ্ধ, বা 'ফুল বয়েল্ড' সাবান। বাজারের দাপুটে অন্যান্য সাবানের মতো 'কুলিং প্রসেস' এ বানানো হয়না। ফলে অন্য সাবানগুলোর তুলনায় পানিতে এটি গলেও কম। সাবানটিতে নেই কোনো বাড়তি কেমিক্যাল। ফলে সুগন্ধী বা ফেনা কোনোটাই নেই। কাঁচামালগুলো পাকিস্তান আমলে বাইরে থেকে আসত। ফ্যাট ও হোয়াইট মাটন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা থেকে আসত। এখন দেশীয় চর্বি দিয়ে বানানো হয়।
এছাড়া সাবানের মান ধরে রাখার জন্য এর সাথে দেওয়া হয় পামওয়েল, সয়াবিন তেল, তিশির তেল, শীতকালীন পুন্ন্যাহ তেল। সাবান শক্ত করার জন্য সোডিয়াম সিলিকেট আর পরিস্কারের জন্য সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড, অর্থাৎ কাস্টিক সোডা ব্যবহৃত হয়। এই সোডাও এক সময় জার্মানি, সৌদি আরব, চীন, কুয়েত থেকে নিয়ে আসা হতো।
সন্ধ্যার সময় কাঁচামালগুলো বিশাল লোহার পাত্রে দিয়ে চর্বিগুলো গলতে দেওয়া হয়। রাতভর পাকানো চলতে থাকে। চর্বি গলে গেলে এর ভেতর কেমিক্যাল আর তেল দিয়ে নাড়িয়ে তা যখন গলিত সাবানের রূপ নেয়, তখন তা রেখে দেওয়া হয় কয়েকঘণ্টা। সকালে ৮-৯টার দিকে চুলার সেই লোহার পাত্র থেকে নামিয়ে মাঝারি ছোটো পাত্রে রাখা হয় ফ্যানের বাতাসে। এরপর সেগুলো নিচে নামিয়ে ছোটো ছোটো পেয়ালায় নিয়ে রাখা হয়। এরপর ফ্যানের বাতাসে সব শুকানো হলে ওগুলো চামচ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে গোল করা হয়।
এরপর 'হাজী নূর আলী সওদাগর, ১৯৩৭ বল সাবান' স্ট্যাম্প বসিয়ে রেখে দেওয়া হয় পুরোপুরি জমাটবেঁধে শক্ত হওয়া পর্যন্ত। এরপর মোড়কে ঢোকানোর কাজ।
বলের মতো গোলাকার এই সাবানের ওজন প্রায় হাফ কেজির মতো। একটি সাবান কিনে তা তার দিয়ে চার টুকরো করে কেটে নিয়ে যেত বাসায়। এক সাবানেই কয়েক মাস পার। আর যারা পুরোটা কিনতেন না, তারা কেটে টুকরো কিনে নিয়ে যেতেন।
সাবানের এই চার টুকরো করার স্মৃতি থেকে ফেসবুকে একজন লিখেছেন, 'ছোট বেলাতে যখন দোকানদার তারের সাহায্যে ওই গোল সাবানটাকে চার ভাগে কেটে দিতেন, তখন সবটাকেই আমার চাঁদ মনে হতো। পুরোটাকে পুর্ণিমার চাঁদ, অর্ধেকটাকে আধা চাঁদ আর চার ভাগের এক ভাগকে চার দিনের চাঁদ......।'
নূর আলী সওদাগরের নাতি রফিক আহমেদ—বর্তমানে অন্যতম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত— জানালেন, "হাতে তৈরি সাবানের আকার দিতে গেলে মাপটা সবসময় একইরকম থাকেনা। কখনো বেশি কখনো কম হয়। তাই মেশিনের মাধ্যমে যদি আকার দেওয়া যায়, মাপে ঠিক হবে। এজন্য সাবানটির শেপ দেওয়ার জায়গাটুকু আমরা মেকানাইজড করার চিন্তা করছি।"
যদিও ২০১০ সাল থেকেই নতুন মোড়কে পাওয়া যাচ্ছে ১৩০ গ্রামের ১৯৩৭ সাবান— যা আর আকারে গোলাকার নয়, বরং বাজারে অন্যান্য সাবানের মতোই গোলাকৃতির। তবে আগের গোল্লা সাবান এবং মোড়ক এখনো আছে। করোনাকালীন যখন হাতে বানানো বল সাবানগুলোর চাহিদা বেড়ে যায়, তখন ১৯৩৭ সাবানেরও বিক্রি বেড়েছিল স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ৫০ ভাগ। একটি সাবান পুরোপুরি বানাতে ১৮-২০ ঘণ্টা সময় লাগে।
রফিক আহমেদের দেওয়া তথ্যমতে, আগে সাবান প্রতিদিন উৎপাদন হতো ১৫০-২০০ মণ। বর্তমানে প্রতিদিন কারখানায় ১২-১৩ টন উৎপন্ন হয়— যা সর্বোচ্চ ১৫-১৬ টন পর্যন্ত বাড়ানো যায়; হিসেবে আগের চেয়ে কম তো নয়ই বরং বেশি।
এত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এই সাবান এখনও আগের মতো বিক্রি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে রফিক আহমেদ বলেন, "আগে মানুষ ছিল কম। এখানের আশেপাশে এখন কত ফ্যাক্টরি, পাকিস্তান আমলেও এগুলো ছিল খালি মাঠ, খালে পণ্যভর্তি জাহাজ এসে ভিড়ত। এখন মানুষ বেড়েছে। ফলে চাহিদা না বাড়লেও, আমাদের বিক্রি বা উৎপাদন না কমে উলটো বেড়েছে।"
"বাজারে অন্যান্য পাউডার সাবান এলেও, হাতে ঘষার সাবানের জন্য চট্টগ্রামের মানুষজন এখনো আমাদের ওপর আস্থা রেখে আসছেন। কারণ সাবানের মানে আমরা ছাড় দেইনি। ব্যবসা বড় না করে আমরা সাবানের আগের মানটুকুই ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। ফোকাসটা সেখানেই ছিল, ফলে এখনো টিকে আছি ভালোভাবে," যোগ করেন তিনি।
শাহানা রহমান একজন গৃহিনী, থাকেন চটগ্রামের চকবাজার অঞ্চলে। তিনি জানান, "আমাদের যুগে তো সবাই কাপড় কাপড় কাচার জন্য এই সাবানই ব্যবহার করতো। এটাই সেরা ছিল, সমসাময়িক অন্যান্য সাবানের চেয়ে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা ছিল। এটাতে কম সময়ে কাপড় বেশি পরিস্কার হতো, হাতে কচলিয়ে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হতো। যতদূর মনে পড়ে, আমরা ৭-৮ টাকা দিয়ে একটা বল সাবান কিনতাম।"
সাবানটির বর্তমান খুচরা মূল্য ৭০ টাকা, আর চার ভাগের এক টুকরার দাম ২০ টাকা। এছাড়া, ১৩০ গ্রামের সাবানটির মূল্য ২২ টাকা।
এই সাবানের গ্রাহকশ্রেণি ছিলেন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে। সবাই যে কাপড় কাচার সাবান হিসেবেই ব্যবহার করত তা নয়। অনেকে শরীরে বা চুলেও এই সাবান দিতেন।
আসমা খাতুন থাকেন চট্টগ্রামের রাহাত্তারপুল বড় কবরস্থান এলাকায়। বয়স হবে সত্তরের উপরে। তিনি জানালেন, ছেলে দুবাই থেকে বিদেশি শ্যাম্পু পাঠালেও, তিনি এখনো ছোটোবেলার অভ্যাস বাদ দিতে পারেননি। তাই এখনো মাথায় মেখে চলেন ১৯৩৭ বল সাবান। তবে শরীরে সাবানই মাখেন। তার ছেলের বউ, নাত্ননিরা কেউই এই সাবান মাখতে চাননা। তবে চুলে এখনো তিনি এই সাবানই ঘষতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বাঙালি জাতির জন্য বিংশ শতাব্দী ছিল পরিবর্তনের মাইলফলক। সত্তর কিংবা আশির দশকে ছিল এদেশে বহুল ব্যবহৃত কাপর ধোয়ার গোল্লা সাবানে জনপ্রিয়তা। ১৯৩৭ বল সাবান শুরু থেকেই চট্টগ্রামের ভেতর সরবরাহ হতো। এখনো তাই। চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর জনপ্রিয়তা সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। হাজী নূর আলীর দেখাদেখি আরও অনেকগুলো সাবানের কারখানার এখানে গড়ে উঠেছিল পরপর সে সময়টায়। যেমন— শুধু ৩৭, ৯৩৭, ১০৩৭ সহ আরও অনেক ব্র্যান্ড। এরপর আশির দশকের শেষ দিকে দ্রুতই আধুনিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাবান বাজার দখল করে। বর্তমানে লিকুইড, পাউডার সাবানের অগ্রগতিতে হাতে ঘষা সাবানের চাহিদা পড়তির মুখে।
সেখানে ১৯৩৭ সাবান তাদের ব্যবসায়িক কৌশলে তেমন কোনো পরিবর্তন না এনেই স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে ভালোভাবেই টিকে আছে। বিশেষ করে– নিম্ন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির কাছে এবং গ্রামগঞ্জে এই সাবানের চাহিদা আজও কমেনি। যেমন— ২০১০ সাল পর্যন্ত সাবানটির একমাত্র সেল ডিপো ছিল, কারখানার সাথেই লাগোয়া বিক্রয় কেন্দ্রে। আগে এই চাক্তাইয়েই বড় বড় এক হাজার, দুই হাজার মণের সাম্পান এসে ভিড়ত। মাল বোঝাই করে সাম্পানগুলো নিয়ে যেত পণ্যদ্রব্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। সাবান তৈরির রান্নার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় লাকড়িও আসত এই সাম্পানগুলোতেই। এখন খাতুনগঞ্জে সে একক বিক্রিবাট্টা আর নেই। তাছাড়া যুগের চাহিদা অনুযায়ী, এখন 'ডিস্ট্রিবিউশন সেল' ও দিয়ে দেওয়া হয়েছে পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে। আলাদা পরিবহন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে গ্রামে গ্রামে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু সেটা চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এবং এর আর্থিক লেনদেন কার্যক্রম সম্পন্ন হয় নগদ টাকার মাধ্যমে।
বছরে একটি ক্যালেন্ডার ছাপা বাদে, কোনো বিজ্ঞাপনও বের হয়না এখান থেকে। এতকিছুর পরও সাবানটি এখনো টিকে আছে তার বিশ্বস্ততা, সততা, মান ধরে রাখার জন্য। যদিও রফিক আহমেদ জানান, "খুব বেশি দেরি নেই, যখন এই দাদার রেখে যাওয়া গোল্লা সাবান থেকে বের হয়ে হয়তো আমাদের লিকুইড বা পাউডারের দিকেই ঝুঁকতে হবে।"
ছবি: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত/টিবিএস