এক জাতি, অনেক পতাকা: জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের পাশে ছিলেন পতাকা বিক্রেতারাও
২৮ বছর বয়সী আমাল সরকার পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় বসবাস করেন। প্রায় পাঁচ মাস আগে তিনি গার্মেন্টস কারখানার চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে ঘুরে পতাকা বিক্রি শুরু করেন।
পোশাক কারখানা থেকে প্রতি পিস পতাকা ৫০-৬০ টাকায় কিনে প্রতিদিন অল্প কয়েকটি বিক্রি করেই তার দিন চলে যেত বলে জানান আমাল। তবে তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আন্দোলনকারীদের মধ্যে পতাকার চাহিদা হঠাৎ করেই কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
আমাল বলেন, "জুলাই অভ্যুত্থানের সময় প্রতিদিন ১৫০টিরও বেশি পতাকা বিক্রি করেছি। সেসময় প্রতিটির আকার অনুসারে দামও ছিল ১২০ থেকে ১৮০ টাকা। তার মূল ক্রেতারা ছিলেন শিক্ষার্থীরা।"
তিনি আরও বলেন, "আমিও আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আর আন্দোলন আমাকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করেছে।" পতাকার বর্তমান চাহিদা ও মূল্য সম্পর্কে আমাল বলেন, "এখন দাম কিছুটা কমে গেছে। প্রতিটি পতাকা ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি করছি। তবে চাহিদা এখনও আছে।"
আমালের মতো জুলাই অভ্যুত্থানের সময় অনেক পতাকা বিক্রেতা শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মতো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুগুলোতে পতাকা বিক্রি করতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পথের হকার, যারা আন্দোলনের সময় পতাকা বিক্রি শুরু করেন। এছাড়া অনেক দর্জিও শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ ব্যানার ও পতাকা তৈরি করে দিয়েছেন।
৫০ বছর বয়সী শহিদুল ইসলাম ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পতাকা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, "সাম্প্রতিক আন্দোলনে যা দেখেছি তার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা করা যায় না।" নিজের রিকশাভ্যানে রাখা পতাকার স্তূপ দেখিয়ে তিনি বলেন, "হাতে রাখার জন্য ছোট পতাকা থেকে শুরু করে মিছিলের সামনে বহন করা বড় ব্যানার এগুলো এখন আর শুধু কাপড় নয়। এগুলো আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।"
তবে বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি অন্য আরও দেশের পতাকারও চাহিদা রয়েছে। শহিদুল বলেন, "সম্প্রতি ফিলিস্তিনের পতাকার বিক্রিও ব্যাপক বেড়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতেই অনেকে কিনছেন এ পতাকা। এর পাশাপাশি কালেমা খচিত কালো পতাকার স্টিকারের বিক্রিও বেড়েছে।"
স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে পতাকা বিক্রি করা কিশোর বিক্রেতা নাসিম রানা জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় এত বেশি চাহিদা হবে, তা তিনি ভাবেননি। তিনি বলেন, "আমি ভেবেছিলাম, পতাকা কেবল জাতীয় দিবস বা খেলাধুলার জয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখন বুঝছি, এমন সময়ে এগুলো কতটা শক্তিশালী প্রতীক হতে পারে। শিক্ষার্থীরা এমন কিছু হাতে রাখতে চায়, যা তাদের আন্দোলনের তাদের অঙ্গীকারকে প্রকাশ করে।"
তবে আন্দোলনকে সমর্থন করতে গর্ব অনুভব করলেও সেসময় ঝুঁকিও ছিল বলে জানালেন নাসিম। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রাস্তায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে বিক্রেতাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানো বা নিরাপদ থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে কারফিউ চলাকালে তারা বাড়ি থেকে বের হতেও পারতেন না।
শহিদুল বলেন, "পুলিশ, টিয়ার গ্যাস, আর পরে গুলির ভয়ে থাকতাম। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আমাদের দরকার ছিল। পতাকা ছাড়া আন্দোলন অসম্পূর্ণ মনে হতো। তাই ঝুঁকি নিয়েছি।"
অভ্যুত্থানের পরও দেশে বিভিন্ন আন্দোলন চলছে। পতাকার চাহিদা বাড়ার কারণে দামও বেড়েছে। কারণ, উপকরণ জোগাড় করা এখন বেশ কঠিন। বিক্রেতারা স্থানীয় দর্জি ও কারখানা থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন, যেখানে বাড়তি কাজ করেও চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তবে এই বিক্রেতাদের কাছে এটি শুধুই জীবিকার বিষয় নয়। এ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ ও আন্দোলন অনেকের কাছে আবেগের। তারা জানেন, এসব প্রতিবাদ শুধু স্লোগানের জন্য নয়, এটি সবার জন্য একটি ন্যায়সংগত ভবিষ্যৎ গড়ার সংগ্রাম।
নাসিম বলেন, "আমি যা করি, তাতে গর্ব অনুভব করি। তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ ও সবার ভবিষ্যৎ নিয়ে লড়াই করছে। তাদের কাছে একটি পতাকা বিক্রি করলে আমার মনে হয়, আমিও সেই লড়াইয়ের অংশ হয়ে উঠছি।"
প্রতিবেদনটির লেখক একজন কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক। তার সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা- [email protected]