মানুষের সান্নিধ্য যেভাবে বদলে দিয়েছে পশু-পাখিদের
আজ থেকে প্রায় ৮ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যাযাবরেরা বনমোরগ পালতে শুরু করেন। এশিয়ার এ অংশের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে এখনো পাওয়া যায় এই পাখি। বর্তমানের পোষা মোরগ-মুরগি এই বনমোরগেরই উত্তরসূরি।
সুইডেনের লিঙ্কোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার জেনসন মুরগিকে পোষ মানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি লাল বনমোরগের প্রজনন ঘটিয়ে মাত্র ১১টি প্রজন্ম পর এই পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে পান।
জেনসেনর গবেষণা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানুষের সান্নিধ্য প্রাণীদের আচরণে কতটা নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে।
জেনসন জানিয়েছেন, প্রথম প্রজন্মের বনমোরগ মানুষ দেখলেই পালানোর চেষ্টা করত। কিন্তু সর্বশেষ প্রজন্মের মোরগ মানুষ দেখলেই এগিয়ে আসে। এছাড়া আশেপাশে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতেও পছন্দ করে। সর্বশেষ প্রজন্মের মোরগ-মুরগি আকারেও অনেক বড়, এদের ডিমও বেশ বড়। আর বনমোরগের চেয়ে এদের মস্তিষ্কের আকার বেশ ছোট।
কয়েক হাজার বছর ধরে বিভিন্ন পশুপাখি পোষ মানিয়ে আসছে মানুষ। চার্লস ডারউইন প্রথম লক্ষ করেন, কুকুর, বিড়াল ও পোষা খরগোশের মধ্যে 'পোষ মানা'র গুণ ছাড়াও আরও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পোষা প্রাণীদের লেজ তাদের বুনো পূর্বপুরুষদের লেজের চেয়ে বেশি বাঁকানো। এছাড়াও পোষা প্রাণীদের চোয়াল ও দাঁত তুলনামূলক ছোট, এদের পশম বেশিরভাগ সময়ই সাদা হয় এবং পোষা প্রাণীরা বাচ্চার জন্মও দেয় বেশি।
১৯৫৯ সালে সোভিয়েত জীববিজ্ঞানী দিমিত্রি বেলায়েভ ও লুদমিলা ট্রুট সাইবেরিয়া থেকে কয়েক ডজন রুপালি শিয়াল ধরে সেগুলোর মধ্য থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে শান্তগুলোকে প্রজনন করান। কয়েক প্রজন্ম পরেই দুই বিজ্ঞানী শান্ত ও বন্ধুভাবাপন্ন শিয়াল প্রজনন করাতে সক্ষম হন। এতে শুধু যে শিয়ালগুলোর স্বভাবই বদলে গেল, তা নয়—এদের চেহারাও বদলে গেল। মানুষের সান্নিধ্যে থেকে শিয়ালগুলোর মুখ ছোট হয়ে এলো, চামড়ায় দেখা দিল রংবেরঙের ফুটকি। আর শিয়ালগুলো মানুষ দেখলেই খুশিতে লেজ নাড়ানো শুরু করল।
ধারণা করা হয়, পোষ মানানোর জন্য মানুষ এমন প্রাণী বেছে নেয় যেগুলোর অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি সুগঠিত নয়। 'পালাব নাকি লড়াই করব'—এই সিদ্ধান্ত আসে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে। ছোট অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিওয়ালা প্রাণীরা একটু কম হিংস্র হয়।
জেনসনের গবেষণায় দেখা গেছে, বনমোরগের মস্তিষ্ক পোষা মোরগের চেয়ে বেশ বড়। আর মস্তিষ্ক যত বড় হয়, এর পেছনে প্রাণীর শক্তিও খরচ হয় তত বেশি। বনে-জঙ্গলে থাকলে নানা ধরনের বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বিস্তর শারীরিক শক্তি যেমন খাটাতে হয়, তেমনি খাটাতে হয় বুদ্ধিও। এ কারণে বনমোরগের মস্তিষ্ক বড় থাকে।
অন্যদিকে, পোষা মুরগির যেহেতু এত বিপদ-আপদ থাকে না, তাই এই বেঁচে যাওয়া শক্তি এরা শরীর ও বংশবৃদ্ধিতে ব্যয় করে। এ কারণেই পোষা প্রাণীরা আকারে তুলনামূলক বড় হয় এবং বাচ্চাও জন্ম দেয় বেশি।
শুধু যে পোষা প্রাণীই বদলে গেছে, তা নয়—মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে বদলে গেছে ইঁদুরও। ধারণা করা হয়, মানব বসতিতে ইঁদুরের প্রবেশ ঘটে আজ থেকে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে ইঁদুরের ডিএনএ-ই বদলে গেছে।
আরও দেখা গেছে, মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে ইঁদুর তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষের লুকিয়ে রাখা খাবার খুঁজে বের করতে করতেই এত বুদ্ধিমান হয়েছে মানব বসতিতে থাকা ইঁদুরেরা।
মানুষের সান্নিধ্যে থেকে ইঁদুরের বুদ্ধি বাড়লেও সাধারণ মাছির ক্ষেত্রে কিন্তু উল্টোটা ঘটেছে। ডি. মেলানোগাস্টার প্রজাতির এ মাছি সম্ভবত ১২ হাজার বছর আগে ফলের সুগন্ধ পেয়ে মানুষের সংস্পর্শে আসে। সেই থেকে মানব বসতিতে বিভিন্ন আবর্জনার ডিপোতে আস্তানা গাড়ে এই মাছি।
প্রায় এক শতাব্দী আগে এ মাছির ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, মানব বসতিতে থাকা মাছি তাদের বুনো জ্ঞাতিভাইদের চেয়ে কম চটপটে। তখন সাধারণ মাছির জিন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর ৫০-১০০ বছর আগে মাছিগুলোর জিন আমূল বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের ফলে এদের মন থেকে মানুষের ভয় উঠে গেছে।
কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, মুরগি, ইঁদুর, মাছি—এই প্রাণীগুলো গত কয়েক হাজার বছরে মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে। খাবার সংগ্রহের জন্য এদেরকে মানবভীতি জয় করতে হয়েছে। এর ফলে পরিবর্তন এসেছে এই প্রাণীগুলোর শারীরিক গঠন এবং স্বভাব-চরিত্রে।