মোগলাই পরোটার লড়াই! মোগল না ব্রিটিশদের?
ডুবো তেলে ভাজা মুচমুচে পাতলা আস্তরণের ভেতর ডিম, মুরগি বা ছাগ মাংসের পুর। ময়দার খামিরে খামের মতো দেওয়া শৈল্পিক আকার। ভোজন রসনায় অনন্য এ আবিষ্কার যুগ যুগ ধরে আমাদের জিভে জল আনছে। কথা হচ্ছে মোগলাই পরোটা নিয়ে। উত্তম মানের মোগলাই পরোটায় ডিম বা মাংসের কিমার সাথে থাকে স্বাদমতো হরেক মশলা। ভাজার পর চারকোণা আকারে কেটে শসা আর পেঁয়াজের সালাদ সহকারে পরিবেশনই দস্তুর।
নাম শুনেই বোঝা যায় বাহারি এ খাদ্যের উৎপত্তি মোগল রসুই। মোগলাই পরোটা নিয়েও শোনা যায় বেশকিছু মজার কাহিনী। তবে ধারণা করা হয়, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে (১৫৬৯-১৬২৭) তার বাবুর্চি আদিল হাফিজ উসমানের অনবদ্য সৃষ্টি এটি।
শোনা যায়, রোজ রোজ একই রকম সব পরোটা খেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন শাহেনশাহ। তাই উসমানকে ডেকে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে নতুন পরোটা আবিষ্কারের হুকুম জারি করলেন। ১০ দিনে সম্রাটকে খুশি করার মতো খাবার, মাথায় যেন বাজ পড়লো উসমানের। তবে হাল ছাড়লেন না, ৯ম দিনেই আবিষ্কার করলেন 'জাবির ফালা' বা ডিম পরোটা।
জাবির ফালা খেয়ে সম্রাট এত খুশি হয়েছিলেন যে তিনি উসমানকে ১০০১টি স্বর্ণমুদ্রা এবং বর্তমানের পশ্চিম বাংলায় একটি জায়গির (জমিদারি) পুরস্কার দেন। একটি পরোটার জন্য ১৬ শতকে ১০০১ স্বর্ণমুদ্রা! একবার ভেবেই দেখুন।
উসমানের আদিবাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। তিনি দিল্লি বা লক্ষ্ণৌর মোগল খানসামাদের কাছে জাবির ফালার রন্ধনশৈলী কোনোদিন ফাঁস করেননি। এমনকি তার ছেলেকেও মোগল রসুইয়ের অন্যান্য বাবুর্চিদের এটি না বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এভাবে কয়েক প্রজন্ম ধরে তার পরিবারের হাতেই ছিল জাবির ফালার রহস্য। তবে রাজার ধনও একদিন ফুরিয়ে যায়, ব্রিটিশ রাজের সময়ে অভাব-অনটনে পড়েন উসমানের বংশধররা। তারা পুরো বাংলাজুড়ে এ সুস্বাদু পরোটা বিক্রি শুরু করেন।
তবে অবিভক্ত বাংলায় তুর্কি-আফগান শাসনের হাত ধরেই এ খাবার এসেছে বলে ধারণা করেন অনেকে। ১২০১ সালে বিখ্যাত সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি এ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। তারপর ১২০৪ থেকে ১২২৭ পর্যন্ত বাংলা শাসন করে খিলজি রাজবংশ। জাহাঙ্গীরের তিন শতক আগে ১২৯০ থেকে ১৩২০ সাল পর্যন্ত দিল্লির সালতানাতও ছিল এই রাজবংশের অধীনে।
তুর্কিরা ভারতে তাদের গোজলেমে নামের খাবার আনে। সুস্বাদু এ তুর্কি খাবার আসলে ময়দার খামিরে মশলা ও ভেড়া বা গরুর মাংসের কিমার মিশ্রণ। অনেকটা মোগলাই পরোটার মতো এই খাবারকেই এর পূর্বসূরী বলা যেতে পারে।
মোগলাই পরোটার মতো আরেকটি খাবারের সন্ধান পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রে। যার স্থানীয় নাম বায়দা রোটি, এখানেও বায়দা মানে ডিম। ময়দার তালে পুর হিসেবে থাকে মাংস, ডিম ও মশলা। আধা-ডুবো তেলে ভাজা এ খাবার নাস্তা বা মধ্যাহ্নভোজ হিসেবেও জনপ্রিয়।
'বার্মা রোটি' নামেও পরিচিত বায়দা রোটি। এটাও এক ধরনের মোগলাই পরোটা। বার্মায় 'পালাতাস' নামের এ খাবার বেশ জনপ্রিয়। ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা ও শ্রীলঙ্কাও ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। ধারণা করা হয়, তখনই বার্মা থেকে আসা অভিবাসীরা এটি ভারতবর্ষে প্রচলন করেন।
আবার চৌকোনো ময়দার তালে মাংস ভরে ডুবো তেলে ভাজা আরব ও লেবাননের কিছু রুটি জাতীয় খাবারের সাথেও মোগলাই পরোটার রয়েছে অনেক বেশি মিল। আরব বণিকেরা অতীতে মহারাষ্ট্র, বাংলা, গুজরাটসহ অনেক ভারতীয় রাজ্যে ব্যবসার জন্য আসতেন। তাদের মাধ্যমেও এর স্থানীয় সংস্করণ অনুপ্রাণিত হতে পারে।
মুসলিম ঐতিহ্যের প্রভাবে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের অনেক আগে থেকেই তুর্কি, আফগান ও মধ্যপ্রাচ্যের নানান সংস্কৃতির খাবারের প্রচলন ছিল। বিশেষ করে পূর্ব বঙ্গের অভিজাত মুসলমানদের খাবারে কিমার বহুল ব্যবহার মিশ্র আঞ্চলিক রন্ধনশৈলীর নিজস্বতা তৈরি করেছিল। তাই অনেকেই মনে করেন, মোগলাই পরোটা আসলে ঢাকা থেকেই কলকাতায় যায়।
কলকাতায় পূর্ববঙ্গের খাবার পরিবেশনে বিখ্যাত রেস্তোরাঁ অনাদি কেবিন। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বলরাম জেনা। এই রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জা ও খাবারের মান আজো এতটুকু বদলায়নি। অনাদির গরমা-গরম সুস্বাদু মোগলাই পরোটা এবং সাথে কুচি করা আলুর তরকারির স্বাদ নিতে আজো ভিড় জমান রসনাপ্রেমীর দল।
২১ শতকে যখন হাজার পদের পশ্চিমা খাবারের বাড়বাড়ন্ত, তার মধ্যেই আজো ঢাকা ও কলকাতায় নিজ পরিচয় ও অনন্য স্বাদ নিয়ে সর্বজনের প্রিয় হিসেবেই রয়ে গেছে মোগলাই পরোটা।
ইতিহাসবিদ ড. পুস্পেশ পন্ত বলেন- মধ্য এশীয় ও দিল্লি সালতানাতের রন্ধনপ্রণালীতে ছিল আদা, গোলমরিচ, জাফরান এবং কাঠবাদামের নিত্য ব্যবহার। ব্রিটিশরাই 'মোগলাই খাবার' খাবার নাম দেয়। কারণ, তারা মোগলদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে, পরিবর্তীতে দীর্ঘসময় পর্যন্ত নিজেদের মোগল শাসনের উত্তরসূরি হিসেবে জাহির করেছে। ভারতীয় খাবার তাদের সময় মোগলাই খাবারের সমার্থক হয়ে উঠেছিল।
১৮৫৭ সালের সেপাহী বিদ্রোহের পর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের অনেক দক্ষ বাবুর্চি ছোট ছোট রাজ্য ও জমিদারিতে গিয়ে আশ্রয় নেন। তারা এসব অঞ্চলের রেসিপিকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। মোগলাই পরোটাও ভারতের বিভিন্ন অংশের স্থানীয় রসনার সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন স্বাদে তৈরি হতে থাকে। তাছাড়া, সে সময়ের অভিজাতদের দস্তরখানে মোগল দরবারের শান-শওকত যোগ করেছিল এসব খাবার।
- সূত্র: গেটবেঙ্গল ডটকম