বিয়ের মরসুম: কোথায় গেলে পাবেন বিয়ের সব সাজসজ্জা ভাড়ায়
বাঙালির কাছে বিয়ে মানেই জমকালো সাজগোজ। জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিনে বিশেষ সাজ-পোশাকে কেউ কমতি করতে চায় না কখনো। কিন্তু সাধ্যের মধ্যে সবটুকু খায়েশ মেটানোর সুযোগ কয়জনের আর হয়! শুধু একদিনের জন্য এত খরুচে কেনাকাটা করা অপচয়ও বটে। অতিরিক্ত খরচ না করে বিয়েতে মনমতো সাজসজ্জা করার কার্যকর উপায় হতে পারে বিয়ের সামগ্রী ভাড়ায় নেওয়া।
বিয়ের কেনাকাটার জন্য ঢাকায় সবচেয়ে আদর্শ গন্তব্য হলো এলিফ্যান্ট রোড। গায়ে হলুদের ডালা-কুলা থেকে শুরু করে শেরওয়ানি-নাগরা পর্যন্ত সব পাওয়া এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলোতে। নব্বইয়ের দশক থেকেই এসব দোকানে বিয়ের শেরওয়ানি, পাগড়ি, নাগরা, ওড়না, মালা ভাড়া দেয়ার রীতি শুরু হয়েছে। এলিফ্যান্ট রোডে প্রায় ৫০টির মতো শেরওয়ানির দোকান আছে, সবগুলোতেই বিক্রির পাশাপাশি ভাড়া দেওয়া হয়। একদিনের জন্য বাড়তি খরচ না করে এসব দোকান থকে বিয়ের পোশাক ভাড়া নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে সব শ্রেণির ক্রেতার মাঝেই।
এলিফ্যান্ট রোডের 'বিয়ের কেনাকাটা' নামের দোকানের কর্মচারী হৃদয় বলেন, "আমি ১২ বছর ধরে বিয়ের পোশাক বিক্রির সাথে জড়িত আছি, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সবারই বিয়ের শেরওয়ানি কেনার চেয়ে ভাড়া নেওয়ায় আগ্রহ বেশী।"
তিন থেকে সাত দিনের জন্য পাগড়ি আর ওড়নাসহ শেরওয়ানির সেট ভাড়া পাওয়া যায় এক থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। শেরওয়ানির কাপড় ও ডিজাইনভেদে বিক্রির দামের উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয় ভাড়া। পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা দামের শেরওয়ানি সেট ভাড়া দেওয়া হয় এক-দেড় হাজার টাকায়। আর ২০-২৫ হাজার টাকা দামের শেরওয়ানি সেট ভাড়া হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এই ভাড়ার রেট কিন্তু ফিক্সড না। দোকানদারের সাথে দামাদামি করে ভাড়া কমিয়ে নেওয়ার সুযোগও আছে। কয়েকবার ব্যবহারের পর একটি শেরওয়ানির ভাড়া বেশ কমে যায়।
ভাড়া নেওয়ার সময় চুক্তিতে নির্দিষ্ট করা দিনের চেয়ে বেশী সময় পর শেরওয়ানি সেট ফেরত দিলে মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় জরিমানা হিসেবে।
ভাড়া নেয়ার সময় ক্রেতার নাম, ঠিকানা, আইডি নং, মোবাইল নম্বর সব রেখে দেওয়া হয় , যেন দরকারে যোগাযোগ করা যায় সহজেই। বেশীরভাগ ক্রেতাই নিজেরাই দায়িত্ববান হয়ে ভাড়া নেয়া জিনিস ফেরত দিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে এক দুইজন অসাধু ক্রেতা যে পাওয়া যায় না তা নয়। তারা শেরওয়ানি নিয়ে আর ফেরত দেয় না। এদের কারণে ব্যবসার উদ্যমে ভাটা পড়ে না। দোকানিরা সেটাকে ব্যবসার সাধারণ রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে ধরেই কাজ করেন।
পোশাক ভাড়া দিয়ে ফেরত পাবার নিশ্চয়তা রাখার জন্য আছে জামানত নেয়ার ব্যবস্থা। "জামানত নেওয়া থাকলে কাস্টমার নিজের টাকার চিন্তা করে হলেও তাড়াতাড়ি ফেরত দিতে আসে। কারণ শেরওয়ানিটা তো বিয়ের পর আর দরকার লাগে না, জামানতের টাকাটা দরকারি। আমাদের দোকানে এখন পর্যন্ত কেউ ভাড়া নেয়ার পর ফেরত দেয়নি এমন ঘটনা ঘটেনি," বলেন হৃদয়।
ব্যক্তিভেদে তিন-চার হাজার টাকা জামানত নেয়া হয় দোকানগুলোতে। এলিফ্যান্ট রোডের নিউ নবরূপ নামের দোকানের মালিক মোহাম্মাদ আলিম বলেন, "এতদিনের অভিজ্ঞতায় মানুষ দেখেই আমরা বুঝতে পারি কারা জিনিস ভাড়া নেয়ার পর ফেরত দিতে ঝামেলা করতে পারে। তাই মানুষ বুঝে আমরা জামানতের টাকাটা কম-বেশী রাখি"। শেরওয়ানি সেট ফেরত দিতে আসার সময় এই টাকা দিয়ে দেয়া হয় গ্রাহককে। তবে জিনিসের কোনো ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জামানতের টাকা পুরোটা বা কিছু অংশ রেখে দেওয়া হয়।
"শেরওয়ানি ভাড়া দেওয়ার প্রচলনটা এলিফ্যান্ট রোড থেকে শুরু হলেও এখন মোটামুটি সব এলাকার শেরওয়ানির দোকানগুলোতে ভাড়া দেয়া হয়," বলেন আলিম।
এলিফ্যান্ট রোডে কেনাকাটা করতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দোলা বলেন, "ভাইয়ের বিয়ের শপিং করতে এসেছি। একদিনের জন্য এত টাকা খরচ করে শেরওয়ানির সেট না কিনে ভাড়া নিয়ে নেওয়াটাই সুবিধা আমাদের জন্য।"
করোনাকালে অন্যসব ব্যবসার মতোই অনেকদিন বন্ধ ছিল এলিফ্যান্ট রোডে বিয়ের সামগ্রী ভাড়া দেওয়ার এই ব্যবসা। এলিফ্যান্ট রোডের তাজমহল নামের দোকানের লিটন বলেন, "করোনায় যে ক্ষতি হলো তা আগামী দুই বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। তবে এখন বিয়ের সিজন থাকায় বেশ ভালোই চলছে ব্যবসা।"
ছেলেদের বিয়ের সাজপোশাক ভাড়া নেওয়ার প্রথা এতদিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেলেও মেয়েদের বিয়ের পোশাক ভাড়া দেওয়ার রীতি এখনো খুব পরিচিত না। তবে সম্প্রতি শুরু হওয়া নানা উদ্যোগ মেয়েদের জামা-কাপড়-গয়না ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু করেছে। তেমনি এক উদ্যোগ সাজঘর ওয়েডিং গ্যালারি। অনলাইন কার্যক্রমের পাশাপাশি ঢাকার শনির আখড়ায় শোরুম আছে তাদের।
সাজঘর ওয়েডিং গ্যালারির কর্ণধার খলিল পাটওয়ারী জানান তারা বিয়ের শাড়ি, গয়না, লেহেঙ্গা, ওড়না, শেরওয়ানি, পাগড়ি, তলোয়ার ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস ভাড়া দিয়ে থাকেন। "আগে বাংলাদেশের বিয়েতে কনেরা শাড়ি পরতো বেশীরভাগ সময়। শাড়িটা সহজেই কেনা যেত। তাই ভাড়া দেয়ার চল ছিল না তেমন। এখন বিয়েতে লেহেঙ্গা পরায় অনেকের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। বিয়ের লেহেঙ্গার দাম অনেক বেশী। এটা একবার পরার পর আর পরা হয়না সাধারণত। তাই ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে অনেকেই অপচয় না করে কম টাকায় নিজেদের ইচ্ছাপূরণ করতে পারেন," বলেন খলিল।
তিন থেকে পাঁচ দিনের জন্য লেহেঙ্গার ভাড়া নেয়া হয় দুই থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। লেহেঙ্গার কাপড়, কাজের মান ও দামভেদে ভাড়ার হেরফের হয়। ভাড়া দেওয়ার সময় পরিচিত মানুষ না হলে জামানত হিসেবে চার-পাঁচ হাজার টাকা জমা রাখতে হয়। অনলাইনে তাদের কাছ থেকে সারাদেশের মানুষ শেরওয়ানি-লেহেঙ্গা ভাড়া নিয়ে থাকেন।
'বেন্ড দ্য ট্রেন্ড' নামের আরেক প্রতিষ্ঠানেও ভাড়া পাওয়া যায় মেয়েদের বিয়ের পোশাক। তারা গয়না, শাড়ি, লেহেঙ্গা, গাউনসহ সব ধরনের পোশাক ভাড়া দিয়ে থাকে। ঢাকায় মোহাম্মাদপুরে তাদের শোরুমও আছে।
এছাড়াও ইদানীং বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপও গড়ে উঠছে বিয়ের পোশাক ভাড়া দেওয়ার চর্চাকে কেন্দ্র করে।
করোনাকালে লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে বিয়েতে অহেতুক খরচ করার প্রবণতা। অপচয় না করে কীভাবে নিজের বিশেষ দিনকে স্মরণীয় করে রাখা যায় তার চেষ্টা করে এখন সব পরিবার। ভারি পোশাক-গয়না না কিনে ভাড়া নিয়ে নিলে বিয়ের বাজেট অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বিয়েতে সাধ ও সাধ্যের মেলবন্ধন করতে ভাড়ায় বিয়ের পোশাক নেওয়ার জুড়ি নেই।