বাঙালি বাবুদের বড়দিন ও শীতবিলাস
এক সময় শিক্ষিত ও ধনী বাঙালি পুরুষের নামের আগে 'বাবু' শব্দ ব্যবহার করা হতো। নবাব প্রদত্ত উপাধি ছিল বাবু। ইংরেজ আমলে কাঁচা টাকা কামিয়ে অনেকেই হুট করে বাবু বনে যান। সেইসঙ্গে শুরু হয় বাংলার বাবু সংস্কৃতি। নব্য ধনী এই বাবুরা মাত্রাতিরিক্ত শৌখিনতায় অভ্যস্ত ছিলেন। কবজিতে বেলি ফুলের মালা দিয়ে, আতর মেখে জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে চলতেন তারা। ঘুড়ি উড়ানো, বুলবুলির লড়াই, বাঈজি বাড়িতে নাচ-গানের আসর, উপপত্নী রাখা, মদ-মাংস-ভুরিভোজ ইত্যাদি নিয়েই মেতে থাকতেন বাবুরা। সমালোচনা থাকলেও বাবু সংস্কৃতি থেকেই পরবর্তীতে শিক্ষিত শিল্পমনস্ক ভদ্রলোকের সংস্কৃতির উদ্ভব।
বাঙালি বাবুদের রঙিন জীবন নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও তাদের শীতকালীন জীবনযাপন কেমন ছিল সে বিষয়ে আলাদা করে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ এই শীতের সময়ই বড় বড় রেস, সার্কাস, গার্ডেন পার্টির মতো আয়োজনগুলো হয়ে থাকত। ইংরেজদের দেখাদেখি সেই আমলেই শুরু হয়েছিল বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাবুরা এসব আয়োজন কেন্দ্র করে শীতের সময় কোট-টাই পরে পুরোদস্তর সাহেব বনে যেতেন। লাখ টাকার কাশ্মিরী শাল ও জামেয়ার নিয়েও চলত বাবুয়ানি। ঘরকুনো বাঙালির ভ্রমণ আয়োজনও এই শীতকাল ঘিরেই। দেখে নেওয়া যাক বিলাসী বাবুদের যাবতীয় শীতবিলাস।
বড়দিন ও নববর্ষ উদযাপন
ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় ইংরেজরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে বড়দিন উদযাপন করত। ১৯১১ সালের পর রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়ার পরেও ইংরেজ সাহেবরা বড়দিন উদযাপনে কলকাতায় চলে আসতেন। বড়দিনের সঙ্গেই ইংরেজি বর্ষবরণও উদযাপিত হতো।
২৫ ডিসেম্বরের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই শুরু হতো বড়দিন উদযাপন। এরপর পুরো জানুয়ারি মাসজুড়েই থাকত পার্টি, রেসের মতো নানা আয়োজন।
ইংরেজদের দেখাদেখি বাঙালি বাবুদেরও বড়দিন উদযাপনের শখ জাগে। শীতের চিরাচরিত নবান্নের পিঠা-পুলির সঙ্গে যুক্ত হয় কেক। কলকাতা ও আশেপাশের বাগানবাড়িতে বড়দিন উপলক্ষে নাচগানের আসর বসাতেন বাবুরা। সাহেবদেরও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হতো। খাওয়া-দাওয়া, পানীয়তে জমে উঠত সেসব আয়োজন।
ইংরেজ ব্যারিস্টার অ্যান্টনি ফের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন তার স্ত্রী এলিজা ফে। ১৮৮১ সালের ২৭ জানুয়ারি এক চিঠিতে এলিজা তার বোনকে লিখেন, 'গত চিঠি লেখার পর থেকে এখানে ক্রিসমাসের আয়োজনে মশগুল হয়ে আছি। ইংল্যান্ডেও বোধহয় এত সমারোহ হয় না।'
কবি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় বাঙালি বাবুদের বড়দিন উদযাপনের চিত্র পাওয়া যায়। কবি লিখেছিলেন:
খ্রিস্টের জন্মদিন বড়দিন নাম
বহুসুখে পরিপূর্ণ কলিকাতা ধাম
কেরানি, দেয়ান আদি বড় বড় মেট
সাহেবের ঘরে ঘরে পাঠাতেছে ভেট
বাবুরা বড়দিন উপলক্ষে সাহেবদের কমলা, মিছরি, বাদামসহ বিভিন্ন উপহার পাঠাতেন। গাঁদাফুল আর ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় ঝলমল করে উঠত তাদের বাগানবাড়ি। তবে গোড়া খ্রিস্টানরা কিন্তু এসব জাঁকজমক একদম পছন্দ করতেন না।
বাবুদের বড়দিন আয়োজনের নমুনা পাওয়া যায় ভোলানাথ শর্মার 'আপনার মুখ আপুনি দেখ' নকশায়। কলকাতার এক বাবু বড়দিনের উৎসব রাখবেন। সেখানে তার স্যাম্পেন, লিকার, ব্র্যান্ডি, বিয়ারের ব্যবস্থা চাই। চেরি-মেরি না রাখলেও নাকি চলবে না। জিনও থাকবে দুবোতল। পাড় নেশাখোরদের জন্য নডেলামের মতো ওষুধও থাকবে! গাঁজা, চন্ডু, চরস, তাড়িও থাকতে হবে।
বাবুদের কল্যাণে বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গে যুক্ত হয় বড়দিন উৎসব। যীশুর জন্মদিনে তারা এতটাই আপ্লুত হয়েছিল যে জন্মাষ্টমীর নাম অনুসারে বড়দিনের নাম দেওয়া হয় খৃস্টাষ্টমী।
ঘোড়দৌড়
ডিসেম্বরে বড়দিনের সপ্তাহে এবং নতুন বছরের শুরুতেই কলকাতার সেরা ঘোড়দৌড়গুলোর আয়োজন হতো। ক্রিসমাসের দ্বিতীয় দিন বক্সিং ডে। সে আমলে বক্সিং ডে রেস, নিউ ইয়ারস ডে রেস আর ইন্ডিয়ান ডার্বি রেস ছিল বেশ জনপ্রিয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বক্সিং ডে রেস ভাইসরয় কাপ বলে পরিচিত ছিল। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বড়লাট সাহেব রোলস রয়েসের বদলে চৌঘুড়ি ঘোড়ার গাড়ি চেপে এসব রেস দেখতে আসতেন। বিদেশি সাহেব-মেমদের সঙ্গে দেশি বাবুরাও কোট-স্যুট পরে পুরোদস্তর বিদেশি সাজে রেসের ময়দানে উপস্থিত হতেন।
শাল ও জামেয়ারের শৌখিনতা
বাঙালির শীত বিলাসের কথা বলতে গেলে শালপ্রীতির কথাও চলে আসে। কাশ্মিরী শাল কিন্তু একসময় সহজলভ্য ছিল না। ধনী বাঙালি বাবুরাই ছিলেন কাশ্মিরী শাল আর জামেয়ারের বড় সমঝদার।
শাল ছিল সম্মান, খ্যাতি, রাজকীয়তা ও প্রতিপত্তির প্রতীক। আর তাই রাজা রামমোহন, দ্বারকানাথ থেকে শুরু করে সে আমলের বহু অয়েল পেইন্টিংয়ে বাবুদের কাঁধে দামি শাল ও জামেয়ার শোভা পেত।
শোনা যায় প্রিন্স দ্বারকানাথ প্যারিসে তার দেওয়া এক পার্টিতে আমন্ত্রিত নারীদের শাল উপহার দেন।
কাশ্মিরের পশমিনা আর শাহতুশ শালের খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। নরম ওমওয়ালা শাহতুশ শাল এতই মোলায়েম যে আংটির ভেতরেও অনায়াসে গলে যেত। আইবেক্স বা বিশেষ কাশ্মিরী পাহাড়ি ছাগলের লোম থেকে তৈরি হতো এই শাল।
শাহতুশে কারুকার্য থাকত না। অন্যান্য কাশ্মিরী শালের পাড় ও জামেয়ারের নকশা অনুযায়ী সেগুলোর ভিন্ন নাম ছিল। এসব নাম ছিল বাঙালি বাবুদের নখদর্পনে।
কাশ্মিরী শালে ছিল চিরাচরিত ফুলপাতা আর কল্কার নকশা। পরবর্তীতে আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা শালের নকশার সঙ্গে মিলে কাশ্মিরী শালের নকশায় আসে নতুনত্ব।
পশ্চিমে 'চেঞ্জে যাওয়া'
ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ই যেন শীতকাল। পথঘাট শুকনো, ঝকঝকে আকাশ, ঝড়-বৃষ্টি নেই আবার তাতানো গরমে হাঁশফাশও করা লাগে না। তবে এখন যাকে আমরা ভ্রমণ বা অবকাশযাপন বলি এককালে তা হাওয়া বদল নামেই পরিচিত ছিল। বিলাসী বাঙালি বাবুরাও 'পশ্চিমে চেঞ্জে' যাওয়ার জন্য শীতকালকেই বেছে নিতেন। কলকাতার বাবুদের চেঞ্জে যাওয়ার জায়গা ছিল শিমুলতলা, মধুপুর যশিডি, বদ্যিনাথ, হাজারিবাগ ইত্যাদি জায়গা। বিহারের দিকে এসব জায়গায় খাবারদাবার থাকত সস্তা ও টাটকা। আর তাই স্বাস্থ্য উদ্ধারে এসব জায়গাকেই বেছে নিতেন তারা।
অনেকের এসব জায়গায় আলাদা বাংলো বাড়িও থাকত। কুঞ্জ, কুটির, নিকেতন, সদন, কটেজ, ভিলা, ধাম প্রভৃতি শব্দ যুক্ত করে এসব অঞ্চলে কত বাঙালি বাড়ির নাম ছিল তার ইয়ত্তা নেই। এই বাবুদের কিন্তু পর্যটক নয়, বরং চেঞ্জার বলা হতো। শীতকালীন অবকাশযাপন ঘিরে বাংলা শিল্পসাহিত্যে যে কত গল্প-উপন্যাস-সিনেমা নির্মিত হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।
গার্ডেন পার্টি
শীতকাল এলেই বড়লাটের বাসভবনে গার্ডেন পার্টির আয়োজন হতো। বিদেশি অতিথি ছাড়াও ভারতীয় রাজ পরিবার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা এসব পার্টিতে আমন্ত্রণ পেতেন। মেয়েদের পোশাকে তখনও শাড়ির জৌলুসের দেখা মিলত। তবে, ধুতি-পাঞ্জাবি বা অন্যান্য ভারতীয় পোশাক ছেড়ে পুরুষদের সাহেবি বেশেই দেখা যেত।
সার্কাস
শীতের আরেকটি আকর্ষণ ছিল সার্কাস। কলকাতার পার্ক সার্কাসে একসময় নিয়ম করে চলত সার্কাস। প্রতিবছর রাশিয়ান সার্কাস দল এসে শীতের আমেজে খেলা দেখাত। ৯০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত এসব সার্কাস খেলা চলত।
প্রিয়নাথ বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস ছিল বাঙালিদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। শীত পড়ার সময় শ্রী রামকৃষ্ণ একবার সার্কাস দেখতে যান। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত রামকৃষ্ণের সেই সার্কাস দেখার বর্ণনা দেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, সার্কাসের গোলাকার রাস্তায় ঘোড়া দৌড়াচ্ছিল আর ঘোড়ার পিঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিবি (নারী খেলোয়াড়)। মাঝে মাঝেই বড় কিছু লোহার রিং বসানো ছিল। ঘোড়া যখন রিংয়ের নিচ দিয়ে চলছে তখন বিবি রিংয়ের মধ্য দিয়ে লাফিয়ে পুনরায় ঘোড়ার পিঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে যেত।
ক্রিকেট
ক্রিকেট এখন বারোমাসি খেলায় পরিণত হলেও একসময় কলকাতায় শীতকালেই ক্রিকেট আয়োজনের চল ছিল। ইডেন গার্ডেনের জানুয়ারির মিষ্টি রোদে খেলা দেখতে যাওয়া বাবু এমনকি কলকাতাবাসীর জন্যও বিলাসের চেয়ে কম কিছু ছিল না।
বাবুদের রঙিন জীবনে ইংরেজরা যে ভালোমতোই প্রভাব ফেলেছিল তা তাদের শীত উদযাপন দেখেই বোঝা যায়। খুব বেশি তথ্য না থাকলেও শীতকালে বাবুরা যে জমিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করতেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
সূত্র: বাঙালির শীত বিলাস, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত