কেন হজ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মধ্যপ্রাচ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া?
সময়টা ১৯৫০ এর দশক। মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোয় তখনও তেল সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দেয়নি। এ সময় যেসব ভারতীয় সেখানে যেতেন, তাদের আগেভাগে বিদেশি মুদ্রা কেনার প্রয়োজন হতো না। শেখদের শাসিত ওইসব এলাকায় ভারতীয় রুপিতে লেনদেনই ছিল বৈধ।
আজকের সংযুক্ত আরব আমিরাত তখন শেখ শাসিত ৭ রাজ্যে বিভক্ত। এরা সকলে ছিল ব্রিটিশ সরকারের সুরক্ষাধীন। এসব রাজ্যের পাশাপাশি কুয়েত, বাহরাইন, ওমান আর কাতারেও প্রায় সকল আর্থিক লেনদেনে ছিল ভারতীয় রুপির প্রচলন।
ভারত শাসনকালে ব্রিটিশ সরকারই এ ব্যবস্থা চালু করে। যার ব্যাপক সুবিধাভোগী হতো দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। কারণ তখন ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে রুপি কিনতো উপসাগরের দেশগুলো। পাউন্ডের বিপরীতেই তখন নির্ধারিত হত রুপির মূল্যমান।
ফলে ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পেট্রোলিয়াম রপ্তানির স্বর্ণযুগ শুরু হতে তখনও অনেক বছর বাকি।
কিন্তু, এই ব্যবস্থাকে নিজেদের জন্য অবৈধ উপার্জনের সুযোগ হিসেবে নেয় চোরাচালানিরা। তারা রুপির বদলে স্বর্ণ কিনে ভারতে আনা শুরু করে। ভারতীয়দের স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকায় এটি হয়ে ওঠে লাভজনক এক ব্যবসা।
চোরাচালানের উপায়ও ছিল সহজ। বাণ্ডিল বাণ্ডিল রুপি দিয়ে তরুণদের উপসাগরীয় কোনো দেশে পাঠানো হতো। সেখান থেকে সোনা কিনে ভারতে আনা হতো। ফলে উপসাগরীয় দেশে ভারতীয় রুপির অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়। যা আরবিআই এর কাছেই বিক্রি করা শুরু করে দেশগুলো। ফলে আরবিআই এর কোষাগার বিপুল পাউন্ড স্টার্লিং বা বৈদেশিক মুদ্রা হারায়।
কাস্টমস কর্মকর্তারা এই চোরাচালান বন্ধে তৎপর হলেন তখন। কিন্তু, আজকের মতোই সেকালের চোরাচালানিরা সৃজনশীল! সব উপায়ে তাদের ফাঁকি দিত। উপসাগরীয় দেশ থেকে নিয়ে আসা ঘড়ির ভেতর স্বর্ণের বার ভরা এমন একটি চালানসহ ধরা পড়ে মালায়মভাষী এক শ্রমিক।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে অস্ট্রেলীয় গবেষক ও কাগজের মুদ্রা বিশেষজ্ঞ পিটার সাইমস লিখেছেন, "চোরাচালান সব দেশে, সব যুগেই এক বড় সমস্যা। কিন্তু, ভারতে ১৯৫৭ ও ৫৮ সালে তা আশঙ্কাজনক মাত্রায় রূপ নেয়। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে।"
১৯৫৯ সালের এপ্রিলে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৫৭ সালে পারস্য উপসাগরীয় দেশের মুদ্রা ব্যবসায়ী ও ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে রুপি কিনে নিতে ভারতকে ৯ কোটি ২৪ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং দিতে হয়েছে।
সে আমলে যা ছিল বিশাল বড় অংক।
প্রতিবেদনটি আরো জানায়, ১৯৫৭ সালের প্রথম ৯ মাসেই পাচার হয়ে আসা স্বর্ণের কারণে ৬ কোটি ৯৩ ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যায়।
উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য পৃথক রুপির জন্য প্রচলন:
স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসা রমরমা আকার নেওয়ায় ১৯৫৯ সাল নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে পড়ে ভারত। শত শত মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং রিজার্ভ থেকে হারায়।
আরবিআই এর তথ্যমতে, "এ ধরনের অসদুপায় ঠেকাতে উপসাগরীয় অঞ্চলের (কুয়েত, বাহরাইন, কাতার ও সুরক্ষাধীন রাজ্যগুলো) জন্য পৃথক রুপি নোটের প্রচলন করতে বাধ্য হয় ভারত সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক।"
পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে আইন রূপে পাস হওয়ার পর ১৯৫৯ সালে মে'তে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ আরবিআই এর একটি সংশোধনীকে অনুমোদন দেন।
এই আইনের বলে শুধু উপসাগরীয় দেশে ব্যবহারের জন্য- বিশেষ ব্যাংক নোট ছাপানোর অনুমতি পায় আরবিআই। নতুন মুদ্রার মান হবে ভারতীয় রুপির সমান। এটি গালফ রুপি বা এক্সটার্নাল রুপি নামেও পরিচিতি লাভ করে।
গালফ বা উপসাগরীয় রুপির নোটগুলো নকশায় একইরকম হলেও রঙ ছিল আলাদা। একশ, দশ ও এক রুপির এ নোটগুলো শুধুমাত্র আরবিআই এর বোম্বে অফিস থেকেই ভাঙ্গানো যেত।
আর উপসাগরীয় দেশে এই মুদ্রাবাহককে প্রাপ্তির ছয় সপ্তাহের মধ্যে অন্য কোনো মুদ্রা বা স্টার্লিংয়ে এটি ভাঙিয়ে নেওয়ার সময় দেওয়া হয়। সরাসরি ভারতীয় মুদ্রা থেকে নতুন রুপির প্রচলনে তেমন সমস্যা হয়নি। ফলে পুরোনো রুপির নোটে লেনদেন উপসাগরীয় অঞ্চলে বাতিল করা হয়।
এ বাস্তবতায় চতুর স্বর্ণ চোরাচালানিরা ভারতীয়দের বহুল আরাধ্য এ ধাতুর চাহিদা পূরণে অন্য উপায় বের করে। আইনটি পাশের সময় ভারতীয়দের কাছে ব্যক্তিগত ২০০ কোটি ডলার মূল্যের স্বর্ণ ছিল বলে ধারণা করা হয়।
হজ রুপি:
হজ পালনের সময় সাথে করে ভারতীয় রুপিই নিয়ে যেতেন পূণ্যার্থিরা। এরপর তা সৌদি রিয়ালে বিনিময় করে নিতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে, সৌদি ব্যাংকগুলোকে এসব রুপি বোম্বাইয়ে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের রুপান্তরের সুযোগ দেয় ভারত সরকার। তবে চোরাচালানিরা এই পদ্ধতির সুযোগ নিতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দেয়।
এই হুমকি মোকাবিলায়, মক্কা-মদিনাগামী হজযাত্রীদের জন্য বিশেষ হজ রুপি ইস্যু করে ভারত সরকার। দশ ও একশ টাকার এসব নোটের সম্মুখভাগে ইংরেজিতে হজ শব্দ মুদ্রিত থাকতো। সাধারণ রুপি থেকে এটিকে আলাদা করতে আদ্যাক্ষরে এইচএ (HA) লেখাও থাকতো।
১৯৬০ এর দশকের শুরুতেও সৌদি রিয়ালের সাথে বিনিময় হয়েছে হজ রুপির। সেকথা এখনও স্মরণে আছে হাজি সিদ্দিক মোহাম্মদের। ম্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা ৭৯ বছরের এ বৃদ্ধ ১৯৬৩ সালে হজে গিয়ে এটি ব্যবহার করেছিলেন।
তিনি বলেন, "জেদ্দাগামী জাহাজে ওঠার আগে হজ কমিটি অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে আমরা হজ রুপি পাই। কয়েকটি নোট দীর্ঘদিন আমার সংগ্রহে ছিল। তবে অবসরগ্রহণের সময় সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে চলে আসার সময় সেগুলো হারিয়েছি।"
রুপির অবমূল্যায়ন:
৬০ এর দশকের মধ্যভাগ হজ এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য মুদ্রিত বিশেষ নোট মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত ছিল। তবে ধীরে ধীরে কয়েকটি দেশে এগুলো বাতিল হতে থাকে। এর প্রধান কারণ ছিল- এসময়ে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্থর গতি। তার বিপরীতে উচ্চ স্ফীতির যুগে প্রবেশ করছিল উপসাগরীয় দেশগুলো। ১৯৬১ সালেই কুয়েত নিজস্ব মুদ্রা ইস্যু করে। কয়েক বছর পর একইপথে হাটে বাহারাইন। গালফ রুপি ভারতীয় রুপির সমমানের ছিল তখন।
গালফ রুপির অবসানে ভূমিকা রাখে আরেকটি ঘটনা। ১৯৬৬ সালের জুনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সচিন্দ্র চৌধুরী ইন্দিরা গান্দীর সম্মতিতে ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে রাতারাতি এক ডলারের বিপরীতে রুপির বিনিময় দর ৪.৭৬ থেকে সাড়ে ৭ রুপি হয়।
আসলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে। ১৯৬৫ সালে ভারত সফর করে বিশ্বব্যাংকের একটি টিম। তারা অর্থনীতি গতিশীল করতে মুদ্রা মান কমানোর সুপারিশ করে। ভারতের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পশ্চিমা সহায়তা বৃদ্ধির শর্ত হিসেবে এ প্রস্তাব দেওয়া হয় বলে সেকালের গণমাধ্যম প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়।
এই অবমূল্যায়ন মধ্যপ্রাচ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। উপসাগরীয় কোনো কোনো শাসক ব্রিটিশ সরকারের প্রতিও হস্তক্ষেপের আহবান জানান। তবে লণ্ডন তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
রুপি অবমূল্যায়নের মাসখানেকের মধ্যেই গালফ রুপি বাতিল করে কাতার ও দুবাই। এর পরিবর্তে তারা সৌদি রিয়াল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য তারা ধীরে ধীরে নিজস্ব রিয়াল চালু করে। ব্রিটিশ সুরক্ষাধীন অন্যান্য রাজ্যও এই পরিবর্তনে যোগ দেয়। আবুধাবি অবশ্য ১০ গালফ রুপির সমমূল্যের বাহরাইনি দিনার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭০ এর দশকের শুরুতে হজ রুপি ও গালফ রুপি বাতিল করে আরবিআই। এখন এসব মুদ্রার সংগ্রাহকদের কাছে বেশ ভালো সমাদর রয়েছে। নিলাম সংস্থা- স্পিঙ্ক অ্যান্ড সন ১০ গালফ রুপির একটি নোট ১২০ পাউন্ডে বিক্রি করেছে। আর ১০০ হজ রুপির একটি নোট বিক্রি করেছে ৪৪ হাজার পাউন্ডে।
এই দুই মুদ্রা বাতিলের পাঁচ দশক পরও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষা করছে ভারত। তবে এক সময় মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সমৃদ্ধ ধনী রাষ্ট্রগুলো আর্থিক ব্যবস্থার জন্য সদ্যস্বাধীন ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল- এ ইতিহাস স্মরণে রাখার মতোই।
- সূত্র: স্ক্রোল ডটইন