জানালা নেই, ভেতরে আলো-রোদ-বৃষ্টি প্রবেশ করছে, লক্ষ্মীপুরের এক বিস্ময়কর মসজিদ
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ও স্থাপত্য আছে। যেগুলোর কোন কোনটি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান পেয়েছে। ওই সকল স্থাপনার বেশিরভাগই পুরাকীর্তি এবং প্রাচীন মোঘল বা বৃটিশ আমলের তৈরি। যেগুলো নির্মাণ করেছিলেন প্রাচীন শাসক কিংবা রাজা-বাদশারা। বর্তমানেও দেশে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। কিন্ত সে তুলনায় মৌলিক শিল্পের সমন্বয়ে ব্যতিক্রম স্থাপনা হয়তো খুব বেশি না। এমন মন্তব্য পৃথিবীর ১৫০ দেশ ও স্থাপনা ঘুরে দেখা পর্যটক নাজমুন নাহার সোহাগীর। অন্যদিকে বর্তমান সময়ে কোন আর্থিক লাভ নেই যেখানে, সেখানে কেউ অর্থও খরচ করতে চায় না।
কিন্ত এমন স্বার্থপরতার আধুনিক যুগে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের জটিল সংমিশ্রণ আর দৃষ্টিনন্দন চেহারার এক অনন্য স্থাপনা আস-সালাম জামে মসজিদ ও ইদগাহ সোসাইটি । যার অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হচ্ছে দোতলা মসজিদটিতে কোন জানালা নেই।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের শেখের কেল্লা এলাকায় স্থাপিত এ স্থাপনাটি বাংলাদেশে নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম একটি বিরল স্থাপনা। বাংলাদেশি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আর্কি গ্রাউন্ড লিমিটেডের স্থপতি নবী নেওয়াজ খান শমীন ও তার দল মসজিদটির নকশা তৈরি করে।
বিরতিহীন কাজের পর ২০২১ সালের শেষের দিকে মসজিদটি মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১০ হাজার ৮শ বর্গফুটের দোতলা এ মসজিদের নির্মাণ ব্যয়ভার বহন করেছে রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্ট। এটি আধুনিককালে লক্ষ্মীপুর জেলা ও বাংলাদেশে নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপনা। এমন দাবি আগত দর্শনার্থীদের।
অন্যদিকে এ মসজিদকে ঘিরে তৈরি হওয়া শিক্ষা কমপ্লেক্সের মধ্যে আস-সালাম হাফেজিয়া মাদরাসাটিকে হাফেজি ও ইংরেজি শিক্ষার সমন্বয়ে একটি আর্ন্তজাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। সরজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
নির্মাণ ও তহবিল
নির্মাতাদের সূত্রে জানা যায়, স্থানীয়দের নামাজ ও জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবেই লক্ষ্মীপুরের রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্ট নিজেদের জায়গায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এ মসজিদ নির্মাণ শুরু করে। বাংলাদেশি একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আর্কি গ্রাউন্ড লিমিটেডের মূল স্থপতি নবী নেওয়াজ খান সমিন ও তার দল মসজিদটির নকশা তৈরি করে।
বিরতিহীন কাজের পর ২০২১ সালের শেষের দিকে মসজিদটি মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ১০ হাজার ৮০০ বর্গফুটের দোতলা এ মসজিদের নির্মাণ ব্যয়ভার বহন করেছে রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্ট।
আস সালাম মসজিদ কেন অনন্য
অনন্য ডিজাইন আর নজরকাড়া সৌন্দর্যের এ মসজিদটি বাংলাদেশে আধুনিক নির্মাণ শৈলীর এক ব্যতিক্রমী নজির। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী ছুটে আসছেন এ মসজিদটি দেখার জন্য।
এ মসজিদের নির্মাণ শৈলীতে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা বাংলাদেশে অন্য কোন মসজিদে চোখে পড়ে না। দোতলা এ মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ মসজিদে কোন জানালা নেই। শুধুমাত্র মুসল্লি প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য রয়েছে দুটি দরজা। জানালা না থাকলেও বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়াই মসজিদটি সব সময়ই আলোকিত থাকে।
আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে ইবাদত করতে আসা মুসল্লিরা মসজিদের ভিতরে বসেই রোদ, বৃষ্টি উপভোগ করতে পারেন। কারণ এ মসজিদটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এর ভেতরে রোদ, বৃষ্টি সরাসরি এসে পড়ে। মুসল্লিরা উপভোগ করতে পারবে কিন্ত বৃষ্টিতে ভিজবে না ও রোদের তাপে পুড়বে না।
গরমের সময় মসজিদকে শীতল করার জন্য মসজিদের ভেতরে রয়েছে বৃষ্টির পানি ও পানি সংরক্ষণের জন্য ৪টি জলাধার। জলাধারগুলোতে রাখা শীতল পাথর গ্রীষ্মকালে মসজিদকে শীতল করে রাখে। দোতলা এ মসজিদটির নিচতলা দু'ভাগে বিভক্ত। সামনে মেহরাব ও মসজিদের মূল অংশ। এর পিছনে মাঝ বরারব গলিপথ (ভল্টেড ওয়াকওয়ে) । তার দু'পাশে শীতল জলাধার এবং রোদ, বৃষ্টির প্রবেশ পথ। মুসল্লিদের জন্য ভেতরে একটি প্রশান্তিময় স্থান তৈরি করতে মসজিদে নরম প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। পেছনের অংশে বড় গ্যালারি। যেখানে বসে মুসল্লিরা নিজ মনে ইবাদত করতে পারেন। গ্যালারি অংশের পিছন থেকে দোতলায় উঠার সিঁড়ি। দোতলায় রয়েছে মহিলাদের নামাজ পড়ার জায়গা।
এ মসজিদটির ছাদ প্রচলিত অন্য স্থাপনার মতো না। পুরো মসজিদের দেয়ালটিতে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় পুরো দেয়াল শুধু ইটের তৈরি। মূলত ইট দেখা গেলেও এর ভেতরে ইট ছাড়াও আছে রড, সিমেন্ট ও ইটের সংমিশ্রণে আরসিসি ঢালাই। নিয়মিত নামাজের পাশাপাশি ইদগাহ হিসেবেও ব্যবহার করা হবে আস সালাম মসজিদ। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর মসজিদ তহবিল থেকে আগত শিশু ও মুসল্লিদের মাঝে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়।
মসজিদ ও কমপ্লেক্স
মসজিদটির নানা দিক নিয়ে নির্মাণের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্টের দায়িত্বশীল একজনের সাথে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এ সিনিয়র আইনজীবি বলেন,তিনি তার বাবা-মায়ের নামে এ ট্রাস্ট পরিচালনা করছেন যা জনহিতকর কাজে পরিচালিত হবে।
তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এ মসজিদকে ঘিরে এখানে আন্তর্জাতিক মানের একটি হাফেজিয়া মাদরাসা, একটি গার্লস স্কুল এবং একটি কলেজ নির্মাণ করছেন তাদের ট্রাস্ট।
রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্টের প্রধান র্নিবাহী এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওই আইনজীবি জানান, "আমাদের উদ্যোগের প্রথম স্থাপনা মসজিদ নির্মাণ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্যোগ হাফেজিয়া মাদরাসাটি কয়েক মাস আগে চালু হয়েছে। অন্যদিকে ২০২৩ সাল থেকে গার্লস স্কুল চালু হবে। পরের ২-৩ বছরের মধ্যে কলেজও চালু হবে।"
ব্যতিক্রমী এ জনহিতকর কাজ সর্ম্পকে তিনি বলেন, ''আইন পেশার বাইরে আমি রাজনীতি করি না। আমি মানুষের জন্য একটা কিছু করতে চাই। আমি সব সময় দেখেছি আমাদের আইনজীবিদের মধ্যে যারা অনেক টাকা রেখে মারা গেছেন, তাদের সবার খুব করুণ পরিণতি হয়েছে। তারা মানবতার কল্যাণে কী পরিমাণ ব্যয় করেছেন তা আমি জানি না। তাদের অনেকেই অনেক টাকা রেখে গেছে কিন্তু তাদের ছেলে মেয়েগুলোই যোগ্য হয়ে গড়ে ওঠেনি।"
"বিপরীতে যারা টাকা রেখে যায়নি, তাদের ছেলে মেয়েগুলো সফল হয়েছে। এমন নজির আছে। এই দেখা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার আয়ের সিংহভাগ জনহিতকর কাজে ব্যয় করবো। আর সে জনহিতকর কাজটি হবে ব্যতিক্রম এবং মানসম্মত। এটা শুরু।"
আস সালাম মসজিদ প্রাঙ্গণের আস সালাম হাফেজিয়া মাদরাসা
আস সালাম হাফেজিয়া মাদরাসা সর্ম্পকে তিনি জানান, "একজন মুসলমান হিসেবে আমি দেখছি যে, আমাদের একজন কোরআনে হাফেজকে সমাজ তেমন ভালোভাবে সমাদর করে না। তারা ভাবে একজন হাফেজ আরবির বাইরে অন্য বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন না। অন্যদিকে নন-অ্যারাবিক ও অমুসলিম দেশগুলোতে মসজিদের ইমামের খুব অভাব। বিশেষ করে আমেরিকার মতো দেশে মসজিদের ইমাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ইমামরা আরবির পাশাপাশি নিজদেশের ভাষায় পারদর্শী তবে তারা ইংরেজি তেমন জানে না। ফলে ইংরেজি ভাষা ভিত্তিক দেশে মসজিদের ইমাম পাওয়া খুবই কষ্টকর। কারণ সে সব দেশে আলেম তৈরি হলেও হাফেজ তৈরি হয় না। আবার নন-ইংলিশ দেশে হাফেজ তৈরি হয় তবে তারা ইংরেজি জানে না। বাংলাদেশে অনেক হাফেজ আছে কিন্ত হাফেজরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না।"
"সে চিন্তা থেকে আমি আর্ন্তজাতিক মানের হাফেজ তৈরির জন্য একটা চিন্তা করি। সে চিন্তা থেকে মসজিদের পাশাপাশি চালু করি আস সালাম হাফেজিয়া মাদরাসা। এ মাদরাসায় পড়তে মেধাবী হতে হবে কিন্ত কোন অর্থ দিতে হবে না। মাদরাসাটিতে হাফেজির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হবে। আর্ন্তজাতিক মানের এ মাদরাসাটি থেকে ভবিষ্যতে যে হাফেজ বের হবে, তারা পৃথিবীর যে কোন দেশে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য প্রদানে সক্ষম হবেন।"
তিনি দাবি করেন, "আমার জানা মতে বাংলাদেশে এ ধরনের হাফেজিয়া মাদরাসা আর একটিও নেই।
প্রতিষ্ঠানে থাকার জায়গা, খাওয়ার জায়গা সবই অত্যন্ত উন্নতমানের। এ মাদরাসার ছাত্ররা যেন অন্যরকম চিন্তা করতে সক্ষম হয়, তারা যেন বিশ্বের মাপকাঠিতে যোগ্য হাফেজ হয়, আমি সে চেষ্টা করছি। তারা যেন পৃথিবীর যে কোন সোস্যাইটিতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। দেশেও যেন তারা নিজেরা নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক মনে করে।"
হাফেজি এবং ইংরেজি শিক্ষার সম্বন্বয়ে গঠিত মাদরাসাটিতে প্রতি ব্যাচে ৬০ জন ছেলে, ৪০ জন মেয়ে এবং ২০ জন হাফেজ হবেন এতিম ছাত্র থেকে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে মাদরাসাটি শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালে একটি গার্লস স্কুল চালু হবে। পরের ২-৩ বছরের মধ্যে কলেজও চালু হবে।
আস সালাম জামে মসজিদ ও শিক্ষা কমপ্লেক্সের বিভিন্ন কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত প্রতিষ্ঠান 'স্বপ্ন নিয়ে' এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আশরাফুল আলম হান্নানের সাথে কথা হয় মসজিদ আঙ্গিনায়। তিনি জানান, "এমন দৃষ্টিনন্দন ও জটিল নির্মাণ শৈলীর আস সালাম মসজিদ লক্ষ্মীপুরকে সারাদেশে এমনকি বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে, মনে করি। পাশাপাশি এ মসজিদকে কেন্দ্র করে যে শিক্ষা প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের শিক্ষার গুণগত ধারাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।" তিনি দাবি করেন, মসজিদ কমপ্লেক্সে স্থাপিত হাফেজিয়া মাদরাসাটি থেকে যে ছাত্ররা বের হবে তারা আগামি মুসলিম বিশ্বে বড় রকমের পণ্ডিত হিসেব নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।