'প্রতি বাড়িতে অন্তত ১টি গাছ': সুপারি চাষে যেভাবে দেশের এক নম্বর জেলা লক্ষ্মীপুর
গ্রামের মোড়ে মোড়ে সুপারির বাজার। গ্রামের পর গ্রামজুড়ে যেন উৎসব চলছে। এ এক ভিন্ন উৎসব।
হাটের দিন গ্রামের শিশু, কিশোর, যুবক এবং বৃদ্ধ সবার হাতে হাতে সুপারির ব্যাগ। সবার হাতে নগদ টাকা। গ্রামের কিশোরদের খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। হাটের দিনের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে সুপারি যেন লক্ষ্মীপুরবাসীর প্রধান অর্থনৈতিক পণ্য। চারিদিকে শুধু সুপারি আর সুপারি।
চলতি সপ্তাহে লক্ষ্মীপুর জেলার কয়েকটি বাজার ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
এ সময় স্থানীয়রা জানায়, বিগত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে সুপারির উৎপাদন কম হয়েছে। তবে দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সুপারি মৌসুম এখন শেষ পর্যায়ে। ডিসেম্বর মাসে মৌসুম শেষ হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রকাশিত 'কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০২৩' সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে জেলাভিত্তিক সুপারি চাষের পরিসংখ্যানে সারাদেশে সুপারি চাষে এখন এক নম্বর জেলা লক্ষ্মীপুর।
এ জেলায় ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩১ টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে। প্রতিকেজি ২৫০ টাকা হিসেবে সেগুলোর দাম প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
সুপারি উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় জেলা কক্সবাজারে ২০২২-২৩ বছরে ৫৯ হাজার ২৯৩ টন, তৃতীয় জেলা চাঁদপুরে ২৩ হাজার ৭৪৩ টন এবং চতুর্থ ভোলা জেলায় ১৪ হাজার ৩৩৪ টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে কম সুপারি উৎপাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে।গত বছর মাত্র ১৯ টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে এই জেলায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতোই বিশ্বব্যাপী সুপারি উৎপাদনে কোন দেশ এগিয়ে রয়েছে তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে অর্থনৈতিক জরিপ প্রতিষ্ঠান 'ট্রিজ'।
ট্রিজ'র পরিসংখ্যান অনুসারে সুপারি উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দেশ হলো বাংলাদেশ। সুপারি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম হলো ভারত; সেখানে বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন কেজি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের উৎপাদন ৩৩৩.৭ মিলিয়ন কেজি এবং মিয়ানমারে বছরে সুপারি উৎপাদিত হয় ২৩৬ মিলিয়ন কেজি।
জেলার সদর উপজেলার দালাল বাজারের ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন জানান, প্রতি পন (৮০টি বা ২০ গন্ডা) বাজারে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকায়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা এলাকার কবির খাঁ জানান, গত বছরের তুলনায় এবার সুপারির বাজারদর ভালো। গত বছর যেখানে প্রতি কাওন (১৬ পন) সুপারি বিক্রি হয়েছিল ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায়। এবার সেগুলোর দাম ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা।
এলাকার বাগান মালিক ফারুক হোসেন শিহাব জানান, চলিত বছর অতিবৃষ্টির কারণে গাছে সুপারি ফল ধরেছে কম, তবে দাম বেশি। তার পাঁচ গন্ডা (৪০ শতক) জমিতে ৪৫৮টি গাছে সুপারি ধরেছে। চলতি মৌসুমে বাগান থেকে প্রায় ৩-৪ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছেন, আরও বিক্রি হবে বলে জানান শিহাব।
স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার কয়েকটি এলাকায় সুপারির জমজমাট হাট বসে। দালাল বাজারে হাটের দিন শুক্র ও মঙ্গলবার। এই বাজারে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে সুপারি কিনে নিয়ে যান।
দালাল বাজারে হাটের দিন গড়ে ২০-৩০ টন (৯-১০ ট্রাক) সুপারি দেশের বিভিন্ন আড়তে যায়। যেগুলোর বাজার মূল্য প্রায় ৪০-৬০ লাখ টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে অন্তত একটি সুপারি গাছ নেই। রায়পুর আর রামগঞ্জ উপজেলাকে আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে পুরো দুই উপজেলা যেন একটি বড় সুপারি বাগান। স্থানীয়রা জানায়, বাড়িতে সুপারি গাছ থাকা লক্ষ্মীপুর জেলার বাসিন্দাদের প্রধান একটি সামাজিক মর্যাদার বিষয়।
দালাল বাজার এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাইয়ুম রিগ্যান বলেন, লক্ষ্মীপুর জেলায় উৎপাদিত সুপারি তিনভাবে ক্রয়-বিক্রয় ও সংরক্ষণ করা হয়। তিনি জানান, মৌসুমের শুরুতে সুবজ চামড়ার কাঁচা সুপারি; এরপর হলুদ বর্ণের পাকা সুপারি; পরে পানিতে ভেজানো সুপারি।
"এক একজন মানুষের সুপারির চাহিদা ভিন্ন রকম। তবে কাঁচা সুপারির চাহিদা সবার আগে, পরে ভোজানো সুপারির চাহিদা রয়েছে।"
রিগ্যান আরও বলেন, "অনেক বাগান মালিক কাঁচা সুপারি বিক্রি করেন। কেউ কেউ শুকিয়ে বিক্রি করেন। প্রত্যেক প্রকারের সুপারির চাহিদা রয়েছে সারাবছর।"
কৃষক ভাস্কর বসু জানান, একটি গাছ থেকে এক ছড়া সুপারি পেড়ে আনতে হলে কিশোরদের ১০ টাকা দিতে হয়। এরপর থোকা থেকে সুপারি ছাড়ানো, গণনা করা, হাটে নেওয়ায় অনেক খরচ। তবুও সুপারি বিক্রি করে অনেক লাভ হয়।
উদিচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের লক্ষ্মীপুর জেলা সম্বনয়ক অধ্যাপক কার্তিক সেন গুপ্ত জানান, বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে পান-সুপারির ব্যবহার। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে প্রীতিভোজ শেষে পান সুপারি দেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে। এছাড়া, বাড়িতে মেহমান এলেও পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করা একটি সামাজিক শিষ্টাচার। তাই সুপারি শুধু পানের সাথেই বেশি ব্যবহার করা হয়।
তবে ভারতে জনপ্রিয় কেনাকাটার প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ামার্ট সূত্রে জানা গেছে, সুপারির রয়েছে প্রায় শত রকমের ব্যবহার। যার বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রকার ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে সুপারিকে মাদক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
লক্ষ্মীপুর পাঁচ উপজেলার ছোট বড় অনেক বাজারে সুপারি কেনাবেচা হলেও বড় বড় হাট বসে ২০টি স্থানে। এসব হাটে সুপারিকে কেন্দ্র করে মৌসুমে শ্রমিক, গাড়ি চালক এবং ব্যবসায়ী মিলে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের নতুন কর্মসংস্থান হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় থেকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ১৪৮৬ বর্গকিমি আয়তনের লক্ষ্মীপুর জেলার ৬ হাজার ৮৭৬ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান রয়েছে। আর প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়িতে সুপারি বাগান বাড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক ড. জাকির হোসেন জানান, একটি সুপারি গাছ রোপণের ৩-৪ বছরের মধ্যে সুপারির ফলন দেওয়া শুরু করে। কমপক্ষে ৪০-৫০ বছর সুপারি পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, "সুপারি অর্থনীতি লক্ষ্মীপুরকে অকাতরে টাকা দিচ্ছে।"