টমটম গাড়ি: খুর ক্ষয়ে যায়, পেটে আহার জোটে না, তবুও চলতে হয়...
শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত, চারপাশে ময়লা-দুর্গন্ধ, রাস্তার প্রচন্ড শব্দ, ঢুলু ঢুলু চোখে পা টেনে টেনে হাঁটছে ঘোড়াগুলো, তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠার শক্তিটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই শরীরে। করুণ, অসহায় দৃষ্টি যেন 'সব সয়ে গেছে' অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মানুষের দিকে। ঢাকার আনন্দবাজার, বকশীবাজার এলাকায় গেলে দেখা যায় মহাজনদের দোকানের সামনে রাস্তার মাঝেই ঘোড়াগুলোর থাকার বন্দোবস্ত।
ঠিকা গাড়ি- বর্তমানে পরিচিত টমটম গাড়ি নামে। কয়েক শত বছর পুরনো এ যানবাহনের এখনো দেখা মেলে ঢাকার রাজপথে। ঢাকায় এই ঘোড়া টানা গাড়ির ব্যবসা জমে ওঠে জি.এম সিরকো নামের এক আর্মেনীর হাত ধরে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের 'ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-১' বই থেকে জানা যায়, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে আর্মেনীরা প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সম্প্রদায় হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৮৫৭ সালে জি এম সিরকো ঢাকায় প্রথম ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রির দোকান খোলেন, শাঁখারিবাজারের দোকানটির নাম ছিল 'সিরকোর এন্ড সন্স'। ১৮৫৬ সালে সিরকোর প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, তখন এর নাম ছিল 'ঠিকাগাড়ি'। ঢাকায় ১৮৬৭ সালে ঠিকাগাড়ির সংখ্যা ছিল ৬০টি, মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে তা দাঁড়ায় তিনশোতে। ১৮৮৯ সালের দিকে আরও দ্বিগুণ বেড়ে ছয়শোর বেশিতে দাঁড়ায়। ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন নিয়েও মতভেদ আছে। ইতিহাসবিদদের অনেকের মতে, ১৮৫৬ সালের আগেই ১৮৩০ সালে টমটমের যাত্রা শুরু হয়।
কুষ্টিয়া, বিক্রমপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, দোহার, মানিকগঞ্জের হাটে একেকটি ঘোড়ার দাম ৫০ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা হয়ে থাকে। তবে কুষ্টিয়ার ঘোড়ার দাম সবচেয়ে বেশি। এসব হাট থেকেই ঘোড়াগুলো কিনে আনা হয়।
ঘোড়া তো নয় যেন লোহার যন্ত্র
বর্তমানে আধুনিক যানবাহনের কারণে ঘোড়ার গাড়ির চল না থাকলে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি অমানবিক এ প্রথা। রাজধানীর বকশীবাজার, আনন্দবাজার, সিদ্দীকবাজার, কামরাঙ্গীচরের টমটমের দোকানগুলো বিয়ে, জন্মদিন, র্যালি, র্যাগডেসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য টমটম ভাড়া দেয়। সময় ও দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া কম-বেশি হয়।
অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকার ভেতরে ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও এসব টমটম গাড়ি যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরো রাস্তা গাড়িসহ হাঁটিয়েই নেওয়া হয় ঘোড়াগুলোকে। সঙ্গে থাকে কোচোয়ান (চালক), হেল্পার, ব্যান্ডপার্টিও।
আনন্দবাজারের নবাবী ডিজিটালের টমটম সার্ভিসের টিপু রাজা বলছিলেন, গতকালই ময়মনসিংহ থেকে এক অনুষ্ঠান শেষে রাতে ঢাকায় ফেরে তার একটি ঘোড়ার গাড়ি।
পিক-আপ ট্রাকে না নিয়ে হাঁটিয়েই নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, গাড়ি টেনেই ওরা ঢাকার বাইরে আসা –যাওয়া করে সবসময়।
শুধু কোনো অনুষ্ঠানের জন্যই না, এখনো গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায় টমটমে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন হয়। দিনে ৬-৭ বার গুলিস্তান-সদরঘাট আপ-ডাউন করে গাড়িগুলো। এই গাড়িগুলো আবার আকারে অনেক বড় হয়ে থাকে। বর্তমানে সদরঘাট থেকে গুলিস্তান রুটে ৩০টির বেশি ও বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস, বকশীবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিক বাজার, পশু হাসপাতাল, কেরানীগঞ্জ এলাকায় ৪০টির মতো টমটম চলাচল করে।
দেড় কিলোমিটারের মতো রাস্তায় প্রতিদিন যাতায়াত করে ঘোড়াগুলো, প্রতি ট্রিপে সর্বোচ্চ ১৪ জন পর্যন্তও যাত্রী ওঠানো হয়। যাত্রী ছাড়াও সামনে আছে চালক আর হেলপারের আসন। যাত্রী আর গাড়ীর ওজনসহ প্রায় ৫০০ কেজির মতো ওজন টেনে নিয়ে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে ঘোড়াগুলো।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ঘোড়াকে দিয়ে এতো বেশি পরিমাণ ওজন টানানো অমানবিক। পিচঢালা রাস্তায় পায়ে খাঁজ পড়ে হাঁটা ঘোড়াগুলোর জন্য এমনিতেই কষ্টকর, তার ওপর এতো ওজন টেনে নেওয়ায় তাদের স্বাস্থ্য আরও ঝুঁকির মুখে পড়ে।
ঘোড়াগুলোর খাদ্যাভ্যাসও করুণ। ঘোড়ার প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস হাই-ফাইবার সমৃদ্ধ, পুরো দেহের তুলনায় পেটের আকার ছোট হওয়ায় কিছুক্ষণ পরপর অল্প পরিমাণে খেতে হয়। মানুষ যেমন দিনের নির্দিষ্ট সময় বেশি পরিমাণে খেয়ে নেয়, ঘোড়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একেবারেই ভিন্ন। সারাদিন ঘাস, খড় খেতে হয় কিছুক্ষণ পরপরই। একবারে খুব বেশি খেতে পারে না প্রাণীটি। প্রাকৃতিকভাবে দিনের বেশিরভাগ সময় খেয়েই কাটায় প্রাণীটি। নির্দিষ্ট প্রজাতিগত এ নিয়ম মেনে না চলায় ক্ষুধা নিয়েই সারাদিন গাড়ি টেনে যায় ঘোড়াগুলো।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ বলেন, ঘোড়া হার্বিভোর (তৃণভোজী) হওয়ায় প্রাণীটির মূল পুষ্টি চাহিদার বেশিরভাগই আসে ঘাস থেকে। শরীরে পুষ্টির সঠিক চাহিদা পূরণের জন্য সবসময় ঘাসের যোগান থাকতে হয়। এছাড়াও যব, বার্লি ও গমের মতো খাদ্যশস্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট পরিমাণে, কিন্তু শুধু এসব খাবার দিলে সঠিক পুষ্টি পাবে না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসবে, ফলস্বরূপ জীবনকাল কমে আসে। অন্যদিকে, বেশি পরিশ্রম করানোয় তাদের খাবারের প্রয়োজনটা আরও বেশি।
ধানের তুষ, গমের মতো খাবার খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া ক্ষতিকর, শরীরে মিনারেল ইমব্যালান্স দেখা যায়। কিন্তু টমটম গাড়ির জন্য ব্যবহৃত ঘোড়াগুলোকে এসব খাবারই বেশি খাওয়ানো হয়।
ঘোড়াগুলোকে ছোলা, ভুসি, বা গম খেতে দেওয়া হয় সকালে আর রাতে, কোনোদিন দিনে গাড়ি না বের হলে দুপুর বেলার খাবারটা জোটে। খড় দেওয়া হয় অল্প পরিমাণে। দাম বেড়ে যাওয়ায় তিন বেলাও খেতে দেওয়া হয় না এখন। ভাই ভাই টমটম সার্ভিসের কালাম হোসেন জানালেন, সকালে কাজে যাওয়ার আগে আর সন্ধ্যায় ফিরে- এই দু'বেলা ঘোড়াগুলোকে খেতে দেওয়া হয়।
চাহিদা দিন দিন কমে আসায় আবহাওয়া যেমনই হোক, ঘোড়াগুলোর রাস্তায় বের হওয়া ছাড়া উপায় নাই।
পিচঢালা পথে বেশিদূর দৌঁড়ালেই পায়ের শক্ত খুর ক্ষয়ে যেতে থাকে, এক পর্যায়ে খুর ক্ষয়ে ভেতরের নরম মাংস বের হয়ে আসে। এ কারণে ঘোড়াগুলোর পায়ে খুর ঢেকে দিতে স্টেইনলেস স্টিলের খাঁজ পরানো হয়। কিন্তু এই খাঁজ পেরেক দিয়ে পায়ের মাংসে লাগানো হয়। পায়ের ভেতর পেরেক ঢুকে থাকা অবস্থায়ই অসম্ভব ওজন বয়ে দৌঁড়াতে হয় ঘোড়াগুলোকে। দুর্দশা এখানেই শেষ নয়।
নবাবী ডিজিটাল টমটম সার্ভিসের সামনে চোখে পড়ে ঘোড়াগুলোর পা উচিয়ে ধরে স্যাভলন ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। পায়ে সৃষ্ট ক্ষতে দেওয়া হচ্ছিল স্যাভলন, আর কোনো চিকিৎসা না করিয়েই। এটিই ঘোড়াগুলোর নিত্যকার জীবন।
প্রচন্ড ওজন টেনে দৌঁড়ানোর কারণে এসব খাঁজও দুই-একদিনের বেশি টেকে না। এক কেজি স্টিলের খাঁজের দামও পাঁচশোর বেশি। এরফলে প্রতিদিন এসব খাঁজ বদলানো হয় না। ক্ষত পায়ে নষ্ট খাঁজ পরেই দৌঁড়াতে হয় ঘোড়াগুলোকে।
'প্রতিদিন কি আর বদলানো সম্ভব? এমনেই ব্যবসা চলে না,' বলছিলেন নবাবী ডিজিটালের কোচোয়ান।
ঘোড়াগুলোর থাকার জন্য নেই কোনো আস্তাবলও। বঙ্গবাজারে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ঘোড়াগুলোর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এখনো এই ব্যবসা টিকে আছে কেন?
টিপু রাজা জানালেন, ঘোড়া কেনা সহ একটি টমটম গাড়ি বানাতে লাখ দুইয়ের কাছাকাছি খরচ হয়। এককালীন দশ লাখ বিনিয়োগ করে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, ঘোড়ার পেছনে খরচ, কোচোয়ানসহ বাকি কর্মীদের খরচের পর সবশেষে মালিকের লাভ থাকে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা। এই আয়ও স্থির নয়, মূলত শীতের মৌসুমে আয় হয় সবচেয়ে বেশি। বছরের অন্যান্য সময় ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো থাকে না। করোনা মহামারির সময় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতেই আরও ২-৩ বছর লাগতে পারে।
কিন্তু তারপরও কেন এই ব্যবসায় আছেন তারা? টিপু রাজা জানালেন, তিনি নিতান্তই শখের বশে এই ব্যবসায় এসেছিলেন। পুরনো ঐতিহ্যের প্রতি টানই তার এই ব্যবসায় থাকার কারণ।
'আমাদের ছেলেরা টমটম দেখবে, আগের কথা মনে রাখবে, এটাই চাই আমি।"
নবাবী ডিজিটালের একটু পরেই ভাই ভাই টমটম সার্ভিস। মালিক মো কামাল হোসেন। পাশেই তার ভাই মোহাম্মদ আলী ভান্ডারীর দোকান। বংশ পরম্পরায় এই ব্যবসায় আছেন তারা। ছোটবেলা থেকে তার বাবাকে দেখেছেন এই টমটমের ব্যবসা করেই জীবন ধারণ করতে। তার বাবার ক্ষেত্রেও একই চিত্র।
এই খাতে বংশ পরম্পরার কারণেই বেশিরভাগ এই কাজ করে জীবন ধারণ করেন। কামাল হোসেন বলছিলেন, কখনো অন্য কোনো কাজ করবেন এমন চিন্তা আসেনি তার। বাবা-দাদারা যেই পেশায় ছিলেন তিনিও সেই পেশা বেছে নিয়েছেন।
অসুস্থ হলেই করুণ পরিণতি
বঙ্গবাজারেই কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতাল (সিভিএইচ)। বিনামূল্যে চিকিৎসক দেখানো গেলেও ওষুধ কিনতে হয় নিজেদের। আবার, হাসপাতালে ঘোড়া রাখার জায়গাও নেই। বাড়তি খরচটুকু করতে চান না কেউই। অসুস্থ হলেই প্রথমে কম দামে ঘড়াগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া যায় নাকি সে চেষ্টা করা হয়।
টিপু রাজা জানান, ঘোড়াগুলো অসুস্থ হলে কেনা দামের দশ গুণ কম দামে বিক্রি করে দেয় প্রায় সবাই। ওষুধ কেনার খরচের কারণে চিকিৎসা করানো হয় না বেশিরভাগ সময়ই। শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপের দিকে গেলে যখন বিক্রিও করা যায় না, দূরে কোনো মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসা ঘোড়াগুলোকে। সেখানেই খাবার-পানির অভাবে খোলা পরিবেশে ধুকে ধুকে মারা যায় ঘোড়াগুলো।
অন্যদিকে, এসব ঘোড়ার গড় আয়ুষ্কাল ৪০ বছরের কাছাকাছি হলেও এর অর্ধেক সময়ও বেঁচে থাকে না গাড়ি টানা ঘোড়াগুলো। ভাই ভাই টমটমের কামাল হোসেন জানান, আশেপাশের দোকানের অনেক ঘোড়াই পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে মারা যায়। অনেক সময় কিনে আনার দুই বছরের মাথায়ই মারা যায় ঘোড়াগুলো। করোনার সময় তো না খেতে পেয়েই মারা গিয়েছিল অনেক ঘোড়া। করোনার সময় ব্যবসায়ে যখন ধস নামে, ভাই-ভাই টম টমের তিনটি ঘোড়া না খেতে পেয়ে মারা যায়। পাশের দোকানগুলোর বেশ কিছু ঘোড়াও মারা যায় সেই সময়টায়।
এসব ঘোড়ার বেশিরভাগই মারা যায় স্ট্রোক করে। কামাল হোসেন জানান, তাদের বেশিরভাগ ঘোড়াই কাজে বেরিয়ে স্ট্রোক করে মারা যায়। একই কথা জানান নবাবী ডিজিটাল টমটমের টিপু রাজা আর রাব্বি শান্ত টমটম সার্ভিসের মোহাম্মদ আলী ভান্ডারীও।
এভাবেই চলছে 'রাজকীয়' এ প্রাণীটির যাপিত জীবন। নির্দিষ্ট প্রজাতিগত খাদ্যাভ্যাস তো দূরে থাক, দিনে কিছুক্ষণ পর পর খেতে হয় এমন প্রাণীটির খাবার জোটে দিনে মোটে দু'বেলা। পুষ্টির অভাবে জীর্নশীর্ণ শরীর প্রচণ্ড পরিশ্রমের সাক্ষী। যথাযথ পরিচর্যা আর উপযুক্ত বাসস্থানের অভাবে বয়স হওয়ার আগেই শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে ঘোড়াগুলোর। কখনো কাজে বেরিয়ে মৃত্যু হয়, কখনো বা অসুস্থ অবস্থায় দূরে কোথাও খাবার খুঁজতে খুঁজতেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। মানুষের 'ঐতিহ্য' টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এভাবেই নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনে অসহায় প্রাণীগুলো।