দেশের প্রথম বেসরকারি হর্স রাইডিং প্রতিষ্ঠান
নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে ওয়েস্টার্ন মুভি দেখাতো প্রতি শনিবার। আর এই মুভি দেখবার জন্য সারাসপ্তাহ মুখিয়ে থাকতেন ছোট্ট জাহেদুল। টিভির পর্দায় দেখতেন দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে ঘোড়া। রাতে শুয়ে শুয়ে কল্পনা করতেন, ইশশ আমিও যদি এমন দাপিয়ে বেড়াতে পারতাম! এ-ই দেখতে দেখতে ঘোড়ার প্রতি কবে যে এমন ভালোবাসা তৈরি হলো খেয়াল করেননি জাহেদুল নিজেও। মা কে বলতেন, একটা ঘোড়া যদি থাকত মা! বীরপুরুষের খোকার মতো মা'কে নিয়ে ঘোড়ায় চড়তেন। কিন্তু সে সুযোগ তো আর নেই।
জাহেদুল তাই ঘরের মধ্যেই ঘোড়ার ছবির পোস্টার-ব্যানার টাঙ্গিয়ে রাখতেন। পড়ার টেবিলে আর বসে বসে কল্পনা করতেন, সেসব ঘোড়ার পিঠে চড়ছেন। যদি বা সুযোগ পেতেন কোনো ঘোড়ার পিঠে চড়ার, তবে তো হলোই। জাহেদুলের ভালো নাম জাহেদুল ইসলাম। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সবই চট্টগ্রাম শহরে। ফলে সুযোগ পেলেই মায়ের কাছে বায়না ধরতেন পতেঙ্গা সৈকতে গিয়ে ঘোড়া চড়ানোর। অন্যরা যেখানে সমুদ্রে ঢেউ দেখছেন, জাহেদুল সেখানে পড়ে থাকতেন ঘোড়া নিয়ে।
ঘোড়ার লেজে হাত বুলোতেন, ঘোড়ার পিঠে চড়তেন, ঘোড়ার দেখাশোনায় যারা থাকতেন— তাদের সাথে ঘোড়া নিয়েই আলাপজুড়ে দিতেন। নানাবাড়িতে গেলে দেখতেন ঘোড়া দিয়ে হালচাষ হয় কীভাবে। পাশের এলাকায় যে মানুষটা ঘোড়া পুষতেন, স্কুল ছুটি হলেই ছুটে যেতেন তার কাছে। একপর্যায়ে 'ঘোড়ারোগ'টা যেন বেশিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
কিশোর বয়সেই ঘোড়ার মালিক
তখন এসএসসি রেজাল্টের আগে তিন মাস অবসর। ব্যাংকার বাবা, ফারুকুর রহমানের কাছে গিয়ে একটা ঘোড়া কিনে দেওয়ার আবদার করলেন বালক জাহেদুল। শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা। কিন্তু ছেলের শখের দিকে তাকিয়ে অগত্যা ঘোড়া একটি কিনেই দিতে হলো তাকে। যদিও সেবার মা'ই বাবাকে ঘোড়া কিনে দিতে রাজি করিয়েছিলেন।
বাবার কাছ থেকে শেষমেশ অনুমতি পেয়ে এবার নিজেই নেমে পড়লেন মাঠে। কোথায় ঘোড়া কিনতে পাওয়া যায়, খোঁজখবর শুরু করলেন জাহেদুল। পরিচিত এক ঘোড়াপালকের মাধ্যমে বিক্রেতার সন্ধানও পাওয়া গেল। চট্টগ্রামের সাগরিকা এলাকায় থাকেন ভদ্রলোক। নিজের ঘোড়াটাই বিক্রি করে দেবেন। দাম হাঁকালেন দেড় লাখ টাকা। শেষে এক লাখ বিশে রফা হলো।
এদিকে আশেপাশের মানুষজনের তো চোখ কপালে। দেড় লাখ টাকা দিয়ে কি-না কলেজে পড়ুয়া এক ছেলেকে ঘোড়া কিনে দিলেন ব্যাংকার বাবা? পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি আত্মীয়স্বজনদেরও যেন বিষয়টি হজম করতে কষ্ট হতো। হাসাহাসি, ঠাট্টা বিদ্রূপও বাদ যায়নি…।
এদিকে, জাহেদুলের দুনিয়াই যে হয়ে গেছে সে ঘোড়াটি। পড়ালেখার সময়টুকু বাদে বাকি পুরোটা সময় সে ঘোড়ার পেছনেই দিতেন। ঘোড়া তো কিনলেন, কিন্তু ঘোড়া রাখবেন কোথায়? ঘোড়া রাখার কোনো ঘর তো নেই। অগত্যা ঘর তুলতে হলো। এছাড়া, অপরাপর কাজগুলো যেমন— খাওয়া-দাওয়া, পরিচর্যার জন্যও সার্বক্ষণিক একজনকে ঠিক করা হলো। আর ছায়ার মতো লেগে থাকতেন জাহেদুল নিজেই।
বাবার বকার ভয়ে কোনোমতে পড়া শেষ করে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়েই চলে যেতেন নিজের ঘোড়াটির কাছে। যারা ঘোড়া পালতেন, তাদের কাছে তিনি নিজেই গিয়ে দেখতেন, কীভাবে ঘোড়াকে খাওয়াতে হয়, খাবার তৈরি করতে হয়। এছাড়া ঘোড়ার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, লালন-পালন প্রভৃতি নিয়ে জানতে শুরু করলেন। ছেলে ঘোড়া কিনতে চায় বলে যে বাবা একদিন ছেলেকে বলেছিলেন, 'বাড়িতে হয় তুমি থাকবে, নাহয় ঘোড়া!' সে বাবাই পরবর্তী সময়গুলোতে পাশে থেকে সাহস উদ্দীপনা যুগিয়েছেন। ঘোড়ার নামটাও শেষমেশ রাখলেন বাবাই, নাম রাখা হলো 'লাকি'। এই লাকির কারণে হাসাহাসির পাত্র যেমন হয়েছেন, আবার কারো কারো কাছে বিশেষ করে বন্ধুমহলে হয়ে উঠেছিলেন সমীহের পাত্র। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় এলাকায়ও পরিচিত মুখ তিনি।
ঘোড়া চালনা শিখতে বিদেশ বিভুইয়ে…
এদিকে ধীরে ধীরে উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে ব্যবসায় হাতেখড়ি হলো জাহেদুলের। কিন্তু ঘোড়ার নেশা তার কাটছে না তখনো, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঘোড়া তো কেনা হলো। নিজের একটি যে ঘোড়া থাকবে সে শখও মিটলো। কিন্তু ছোটোবেলা থেকে রাতে শুয়ে শুয়ে কল্পনায় ক্ষিপ্রগতিতে ঘোড়া ছোটানোর যে আকাঙ্ক্ষা তিনি বুনেছেন, তা কীভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়?
ততদিনে ঘোড়াপ্রেমী অনেকের সঙ্গেই জানাশোনা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ভারতের কানপুরে ঘোড়াচালনা প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। ২০০৯ সালে গেলেন কানপুরের সেই স্কুলে ভর্তি হতে। কিন্তু লাভ হলোনা কোনো। কয়েকটা ক্লাস করেই বুঝলেন এখানে নতুন কিছু শেখার নেই— যা কিছু শেখানো হয়, আগে থেকেই জানেন জাহেদুল।
সেখানে থাকতে থাকতেই আরও ভালো কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খোঁজ করতে লাগলেন। সন্ধান পেলেন। সবিস্তার জেনে হায়দ্রাবাদে একটি ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হলেন। সেখানকার স্কুলে তিনি শিখলেন ঘোড়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পদ্ধতি, ঘোড়ায় ওঠানামা, ঘোড়াচালনা, ঘোড়া ছোটানো, ঘোড়া থামানো, ঘোড়াকে ঘোরানো ইত্যাদি।
এরপর এলেন দেশে ফিরে। অধীর উত্তেজনায় ঘোড়া নিয়ে মাঠে নামলেন জাহেদুল। চোখেমুখে স্বপ্নকে ছুঁতে পারার তৃপ্তি। কিন্তু সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছেও দমে যেতে হলো তাকে। কারণ, ভারতে ঘোড়ায় চড়ে যে রোমাঞ্চ পেয়েছেন, নিজের বয়স্ক ঘোড়ার পিঠে বসে সেটা পাচ্ছিলেন না তিনি। বুঝলেন অল্পবয়সী ঘোড়া কিনতে হবে। কিনেও ফেললেন মাড়োয়ারি জাতের নতুন একটি ঘোড়া।
কিন্তু বাঁধা যেন জাহেদুলের পিছুই ছাড়ছে না। নতুন ঘোড়াটার আচরণ নিয়ে বেশ বেকায়দার পড়ে গেলেন। আচমকা কামড়ে দেয়, ডানে বললে বাঁয়ে যায়। জোরে ছোটার নির্দেশ দিলে আস্তে ছোটে— কোনোভাবেই তাকে বশে আনতে পারছিলেন না। এতদিন ঘোড়া চালানো শিখেছেন বটে, কিন্তু ঘোড়াকে বশে আনার শিক্ষা তো জাহেদুলের নেই।
এবার ঠিক করলেন, কোনো ইকোয়েস্ট্রিয়ান স্কুলে ভর্তি হবেন। যেখানে অশ্ব-সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে পারবেন তিনি। যেন ঘোড়া চালানো থেকে শুরু করে একটি ঘড়ার আদ্যপান্ত নিয়ে জানতে পারবেন। হয়ে উঠবেন প্রকৃত অশ্বারোহী।
সৌদিপ্রবাসী এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে ২০১০ সালে চলে গেলেন সৌদি আরব। 'আল-বদরিয়া ইকোয়েস্ট্রিয়ান স্কুল' থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলেন জাহেদুল।
দেশের প্রথম বেসরকারি হর্স রাইডিং প্রতিষ্ঠান
কিছুদিনের চেষ্টায় বেয়াড়া ঘোড়াকে বশও মানালেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেই ঘোড়াটাকে নিয়েই চট্টগ্রামের এখানে-সেখানে ঘুরেছেন জাহেদুল। তারপর বিক্রি করে আরও উন্নত জাতের মাড়োরারী ঘোড়া কেনেন তিনি।
তাকে দেখে তার অনেক বন্ধুই আগ্রহ দেখালো ঘোড়া চালনা শেখার। এলাকার মাঠে এই বন্ধুদের শেখাতে গিয়েই প্রথম মনে হয় প্রশিক্ষণ একাডেমি খোলার কথা। ২০১৭ সালে অবাণিজ্যিকভাবে সেটা শুরুও করেন। বিনা পয়সায় ঘোড়া চালানো শিখতে অনেকেই তার কাছে আসতেন। যারা একসময় হাসাহাসি করত, তাদের অনেকের হাসিই এবার যেন গেল বন্ধ হয়ে।
মহামারি কেটে গেলে ২০২১ সালে চট্টগ্রামে চালু হয় দেশের প্রথম বেসরকারি হর্স রাইডিং প্রতিষ্ঠান, হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার। পরবর্তীসময়ে ২০২২ সালে ঢাকায় ১০০ ফিটে স্থানান্তরিত করা হয় এই হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার।
জাহেদুল বলছিলেন, "ঢাকা থেকে আগ্রহী অনেক মানুষের সাড়াও পেতাম। একসময় মনে হলো বাণিজ্যিকভাবেই কাজটা শুরু করা যায়। এরমধ্যে করোনাকাল শুরু হলো। মহামারি কেটে গেলে ২০২২ সালে ঢাকায় ১০০ ফিটের কাছে এক জায়গায় শুরু করি প্রশিক্ষণ দেওয়া। ভাড়া ঘোড়া দিয়ে এটা শুরু করেছিলাম।"
সেখানেই প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলেন উত্তরার তরুণ সৌভিক আহমেদ। ব্যবসায়ী এই তরুণের সঙ্গে মিলেই এখন পূর্বাচলের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালাচ্ছেন জাহেদুল বর্তমানে।
রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী সৌভিক আহমেদ। পড়াশোনার মাঝেই ২০১৩ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করা এই তরুণ বেশ কিছু সফল ব্যবসার সাথে জড়িত। ছোটবেলা থেকেই ঘোড়া চালানোর শখ তাকে জাহেদুলের সাথে পরিচয় করায়। ব্যবসায়ী মস্তিষ্কের হওয়ায় সহজেই বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবসার সম্ভাবনা দেখতে পান এবং জাহেদুলের সাথে যুক্ত হয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টারকে।
ফারুকুর রহমানের মতো সৌভিকের বাবা ডা. শাহেদ আহমেদ ও মা সেলিনা আহমেদ শুরু থেকেই ছেলের এই ব্যবসায়ে সায় দিয়ে এসেছিলেন। এ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোট ১৫০-২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে হর্স ট্রেনিং সেন্টার।
ঢাকা চট্টগ্রাম মিলিয়েই চলছিল প্রশিক্ষণপর্ব। সপ্তাহের প্রতি শুক্র ও শনিবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কয়েক পর্বে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতো তখন। তবে আপাতত চট্রগ্রামের কেন্দ্রটি বন্ধ আছে। ঢাকাতেই এখন বেশি সাড়া আসায় ঢাকার পূর্বাচলের কেন্দ্রটিতেই এখন পুরোপুরি প্রশিক্ষণ চলছে।
জাহেদুল এখন সপ্তাহে সাতদিনই সেখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এরমধ্যে তুলনামূলক মেয়েদের সাড়াটাই বেশি পাচ্ছেন বলে জানান জাহেদুল। বর্তমানে এক একটা ব্যাচে শেখাচ্ছেন ৪০ জনকে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আসেন শখের বশে।
স্বপ্ন পূরণের সাথে পারছেন কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দিতে
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্বারোহী হিসেবে জাহেদুল ইসলাম নামটি বেশ পরিচিত হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ক্লাব, খামারবাড়ি থেকে মাঝেমধ্যেই ডাক আসতে থাকে জাহেদুলের এখন। সেই ডাক কখনো ঘোড়াকে বশে আনতে, কখনোবা অশ্বারোহণ শেখাতে। আবার অনেকে তার ঘোড়া ভাড়াতেও নেন বিভিন্ন মডেলিং বা ফটোগ্রাফির কাজে।
ঘোড়া কেনার আবদার যখন করেছিলেন জাহেদুল, তখন তিনি নিজেও জানতেন না, এই ঘোড়া তার ভাগ্যের চাকাই অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিবে। তার জীবনে এনে দেবে নতুন এক পরিচয়। বাংলাদেশে তার হাত দিয়েই প্রথম কোনো ঘোড়া চালানো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পথচলার শুরু। তাই জাহেদুলের স্বপ্নগুলোও এখন বিস্তৃত।
যে জাহেদুল একসময় রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতেন সিনেমার নায়কের মতো একা মাঠে ধূলো উড়িয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটছেন, তার স্বপ্নে আজ থাকছে তারই মতোন অন্য ঘোড়াপ্রেমীদের চরিত্র। শুধু শেখানোতেই তিনি আটকে থাকতে চান না, ঘোড়াপ্রেমীদের সাড়া পেয়ে ব্যবসায়ী জাহেদুল ভাবছেন ভিন্ন কিছু কর্মসূচির কথাও।
যেমন— সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জাহেদুল চান ঘোড়াকে ক্রীড়াঙ্গনে নিয়ে যেতে। তিনি বলেন, "শুধু ঘোড়া চালানোতে না থেকে বিভিন্ন ইন্ডোর গেমসে, অলিম্পিয়াডে ঘোড়ার রেসিং, জাম্পিং, পোলো গেমস, এই জায়গাগুলোতে ঘোড়াকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আমার।"
এছাড়া থাকছে সদস্য হবার ব্যবস্থা। কেউ একবার এই কেন্দ্রের সদস্য হলে, ছুটির দিনগুলোতে, অবসর সময়ে এসে ঘোড়া চালিয়ে যেতে পারবেন। কেউ চাইলে নিজস্ব ঘোড়া এনেও বিচরণ করতে পারবেন এইচআরটিসির আস্তাবলে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি সময় বা স্লট ভাড়া নিয়ে পারবেন বিচরণ করতে। ভবিষ্যতে এই সদস্যদের নিয়ে ক্লাব করারও চিন্তা আছে তার।
এছাড়া আছে কিছু আনন্দভ্রমণের ব্যবস্থাও। ঘোড়া চালাতে পারেন এমন কেউ চাইলে নির্দিষ্ট সময় ভাড়া নিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন। আবার আগের দিনের সেই ওয়েস্টার্ন সিনেমার মতো 'সাফারি রাইডে' র কথা ভেবে শিঘ্রই চালু করছেন 'সাফারি রাইড' কর্মসূচি। যেখানে পাঁচ সাত জন মিলে ঘোড়ায় চড়ে একঘণ্টা, চল্লিশ মিনিটের জন্য পাহাড়ে বা নদীর কাছে কোনো আনন্দভ্রমণে যেতে পারবেন।
বর্তমানে তার সবগুলোই মাড়য়ারী ঘোড়া। খুব শীঘ্রই আরও ঘোড়া আসবে তার আস্তাবলে। সবে তো শুরু করেছেন। একটু একটু করে সাড়াও পাচ্ছেন জাহেদুল। তাই তার স্বপ্ন, ব্যবসা সবকিছুই এখন পুঁজি করছেন এই জায়গাটিতে।
এসব শৌখিন ইচ্ছের মাঝেই জাহেদুলের ইচ্ছে দেশের জন্য কিছু করার। তিনি বলেন, "দেশের বাইরে ঘোড়া চালানোটাকেই অনেকে পেশা হিসেবে নেয়। আমাদের দেশে ঘোড়া প্রশিক্ষণ বা ঘোড়া চালনা প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই বলে অনেকে বাইরে গিয়ে এ পেশায় যেতে পারেন না। বিদেশে গিয়ে এসব শেখার সুযোগ থাকলেও সেখানে কয়েক ধাপে শিখতে হয় এবং তা ব্যায়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। তাই আমার ইচ্ছে এখানেই যদি একটা জনশক্তি তৈরি করতে পারি, আর তারা বাইরে গিয়ে কাজগুলো করতে পারে। তবে আমার এই ব্যবসাকে কেবল শৌখিনতায় আটকে না রেখে বাস্তবিক অর্থেই মানুষের উপকারে আনতে পারব।"
শুধু প্রশিক্ষণই কিন্তু নয়। এ পর্যন্ত তিনজনকে এমন পেয়েছেন, যারা দেশের বাইরে 'পার্টটাইম' কাজ করার জন্য তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে তার ঘোড়া তিনটি। সবগুলোই মাড়য়ারী ঘোড়া।
জাহেদুলের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মোট তিনটি কোর্স আছে। রেগুলার, অ্যাডভান্স, এবং ইকুয়েস্ট্রিয়ান কোর্স। যারা শুধু ঘোড়া চালানো এবং ঘোড়া পরিচালনা শিখতে চান তাদের জন্য রেগুলার কোর্স; যারা ঘোড়া চালনাকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে চান তাদের জন্য অ্যাডভান্স কোর্স— যার সময় তিনমাস। শুধু শেখানোই নয়, বাইরের দেশের সাথে যোগাযোগ করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দেওয়ার সুযোগ আছে এই কোর্সের আওতায়।
আর ইকুয়েস্ট্রিয়ান কোর্সে সময় নেওয়া হয়— ছয় মাসের। এ কোর্সে উপরের দুটি কোর্সে যা শেখানো হবে তার পাশাপাশি অশব-সংক্রান্ত সবকিছু বিশদভাবে শেখানো এবং পড়ানো হবে। কোর্সের কার্যক্রম অনুযায়ী কোর্সের ফিও পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে লাখের উপরে।
তিনটি কোর্সের জন্যই নির্ধারিত ফি এবং সময় নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে এইচআরটিসি ওয়েবসাইটে (https://hrtcbd.com/)। আর যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আপাতত তার এখানে প্রশিক্ষণ নিতে গেলে ওজন, উচ্চতা আর পূর্ববর্তী কোনো বড় দূর্ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে কিনা সেটুকুই দেখা হচ্ছে।
এই ঘোড়া চালনা শেখার জন্য জাহেদুলকে যেভাবে বিদেশ বিভুইয়ে ঘুরতে হয়েছে, তা আজ দেশেই সম্ভব হচ্ছে তারই হাত ধরে। ছোটোবেলার স্বপ্নকে কখনো এতদূর বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন, তা কখনো ভাবেননি জাহেদুল। নিজের স্বপ্নকে পূরণ করতে গিয়ে জাহেদুল এখন তার মতো আরও অনেকের স্বপ্নই পূরণে সাহায্য করছেন। স্বপ্ন পূরণের সাথে পারছেন কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দিতে। এই বিষয়গুলোই জাহেদুলকে আরও প্রেরণা যোগায় সামনে এগিয়ে চলার।