মিনিকেট উপাখ্যান: যে চালের কোনো অস্তিত্বই নেই
চালের দোকানে ঢুকলেন জনৈক ক্রেতা। তার চোখ সরাসরি চলে গেল সামনে রাখা ঝকঝকে সাদা চালের দিকে। ৫ কেজি মিনিকেট চাল নিতে চাইলেন তিনি, চড়া দামে কিনলেন এবং খুশিমনে বাড়ি ফিরে গেলেন।
বাড়িতে নিয়ে রান্নার পর ভাত যদি খেতে ভালো না লাগে কিংবা বেশি সেদ্ধ হয়ে যায়; ক্রেতা ধরেই নেন এটা রান্নার গাফিলতি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাইস মিলের মালিক হাসতে হাসতে বললেন, "ভাত রান্না খারাপ হলে তারা তাদের স্ত্রীর সাথে রাগারাগি করে।"
কিন্তু আসল সমস্যাটা কোথায়?
গত দুই দশক ধরে দেশে 'মিনিকেট চাল' এতটাই জনপ্রিয় যে শহরে তো বটেই, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষেরাও খাওয়ার পাতে তুলে নেয় এটি। চালের বাজার খুচরা হোক বা পাইকারি, মিনিকেট চাল নেই এমন দোকান খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাংলার মাঠে মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্বই নেই।
এদিকে মিনিকেট চালের নামে সস্তা চাল বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ লাভ করছেন মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিল মালিকেরা ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান থেকে পাওয়া চাল দিয়ে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল তৈরি করছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এই দুটি জাতের ধানই সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। সাধারনত ৪০ টাকা কেজি দরে এই চাল বিক্রি হয়। অন্যদিকে, বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম ৫৫ টাকা থেকে ৬০ টাকা কেজি।
মিনিকেট চাল নিয়ে খোঁজখবর ও গবেষণার জন্য গত কয়েক বছরে সরকার বেশকিছু কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু চালের এই অসাধু ব্যবসা বন্ধ করা আজও সম্ভব হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সংস্থা, খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ২০২০ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, আধুনিক অটো রাইস মিলের মালিকেরা মেশিনের মাধ্যমে চালের আকার পরিবর্তন করেন এবং পলিশ করে চালকে চকচকে রূপ দেন। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'রাইস মিলিং'।
এর ফলে কোন চাল কোন ধান থেকে আসছে তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না ক্রেতার।
এছাড়া জরিপে আরও দেখা গেছে, পলিশিং ও হোয়াইটেনিং (সাদা বানানো) এর সময় চালে বিদ্যমান প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের মতো পুষ্টিগুণগুলো চলে যায়।
এফপিএমইউ প্রকাশিত ২৫ পৃষ্ঠার ওই গবেষণাতে বলা হয়, "যেহেতু রাইস মিলিং বা চালের আকার-আকৃতি বদলানো এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই; তাই তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে যাচ্ছে এবং ক্রেতাদের এই চাল কিনতে বাধ্য করছে।"
এদিকে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের নামে অন্যান্য জাতের চাল বিক্রি করার কথা স্বীকার করেছেন রাইস মিলাররা। তারা জানান, বাজারে মিনিকেটের প্রচুর চাহিদা থাকায় এই পন্থা অবলম্বন করেন তারা। এমনকি কখনো কখনো চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, "আমরা যদি এটাকে মিনিকেট নামকরণ না করি, তাহলে ক্রেতারা এটা কিনবে না। মানুষ খাওয়ার টেবিলে মিনিকেট চালের ভাত চায় বলেই আমরা এর নাম দিয়েছি মিনিকেট।"
"আমরা যদি এর নাম দেই 'জিরাশাইল', আপনি তো এটা কিনবেনই না। কিন্তু মিনিকেট নাম দিলে কেনার আগে আর দ্বিতীয়বার ভাববেন না," যোগ করেন তিনি।
লায়েক আলী জানান, দেশজুড়ে ব্যাপক হারে জিরাশাইল ধানের আবাদ হচ্ছে। তারা জিরাশাইল ধানকেই মিনিকেট নামে বিক্রি করছেন। অন্যদিকে নাজিরশাইল চাল বানানো হচ্ছে কাটারি ও জিরা ধান থেকে।
"আমাদের কাছে নাজিরশাইল চালও নেই। অতীতে আমরা পাইজাম ধান থেকে নাজিরশাইল বানাতাম। কিন্তু এখন আমন ধানের মৌসুমে বিভিন্ন স্লিম ভ্যারাইটি পাওয়া যায় যা থেকে নাজিরশাইল বানানো হয়। বর্তমানে কাটারি থেকে নাজিরশাইল বানানো হচ্ছে", বলেন লায়েক আলী।
চালকে অতিরিক্ত পলিশিং করার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে লায়েক আলী বলেন, চাল দেখতে সুন্দর-ঝরঝরে না হওয়া পর্যন্ত এটিকে পলিশ করে মিলাররা।
কিন্তু অটো রাইস মিল মালিকদের কাছ থেকে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন জানানোর পরেও তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমনকি ভোক্তা অধিকার-সংরক্ষণ অধিদপ্তরও এই ব্যবসা ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
ভোক্তা অধিকার-সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক শামীম আল মামুন বলেন, "আমরা কোনো ভোক্তার কাছ থেকে মিনিকেট চালের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পাইনি।"
তিনি জানান, রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের আছে।
অতিমাত্রায় পলিশিং এর কারণে চালের পুষ্টিগুণ চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অবগত আছেন লায়েক আলীর মতো নেতারাও। তবুও কেন এই চাল বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তার সোজাসাপ্টা উত্তর, "ক্রেতারা চায়, তাই আমরা এই চাল সরবরাহ করি।"
হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ
চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় উচ্চ আদালতের কাছে একটি লিখিত পিটিশন দায়ের করে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ 'মিনিকেট' ও 'নাজিরশাইল' চাল প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী সবগুলো রাইস মিলারের তালিকা দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।
চালের আকৃতি পরিবর্তন ও পলিশিংয়ের ফলে চালের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে কিনা এবং তা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি কিনা জানিয়ে চার মাসের মধ্যে একটি গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশও দেয় হাইকোর্ট।
তাছাড়া, কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি চাল তৈরি ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে সরকার কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করে আদালত।
'মিনিকেট' নাম কীভাবে এলো?
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক ডিরেক্টর-জেনারেল জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস জানান, মিনিকেট নামে ধানের কোনো ভ্যারাইটি বাংলাদেশে নেই।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার 'শতাব্দী' নামে ধানের একটি ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করে এবং ছোট ছোট প্যাকেট, অর্থাৎ মিনিপ্যাকে করে এটি ধান চাষীদের মধ্যে বিতরণ করে। ২০০২ সালের দিকে এটি 'মিনিকেট' নামে পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমানে আমরা যে মিনিকেট চাল খাই তা সেই ২০ বছর আগের মতোই ছোট প্যাকেটে করে বিক্রি করা হয়। এভাবেই 'মিনিকেট' শব্দটির আবির্ভাব।
জীবন কৃষ্ণ আরও জানান, যশোর ও ঝিনাইদহের সীমান্ত অঞ্চলের কৃষকেরাই প্রথম ধানের এই ভ্যারাইটি বাংলাদেশে আনেন এবং চাষ শুরু করে্ন। কিন্তু এখন আর ধানের সেই জাতটির আবাদ করা হয় না।
নতুন পদক্ষেপ
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মত নাজমানারা খানম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরি করতে চান তারা। ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাজা আবদুল হান্নানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সচিব বলেন, "আমরা প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিলিং প্রক্রিয়াও দেখবো। তারপর আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করবো। একটা প্রোগ্রামে আমি শুনেছি ডিজি (ব্রি) বলছেন, মিলিং যদি ৮ শতাংশ হয় তাহলে চালের পুষ্টিগুণ রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে মিলিং এর মাত্রা ৩০ শতাংশ।"
নাজমানারা খানম মনে করেন, গাইডলাইন তৈরি যখন সম্পন্ন হবে, তখনই সরকারের পক্ষে অসাধু মিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।