সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালই কি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভবানী পাঠক?
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন পলাশী যুদ্ধের অন্যতম নায়ক মোহনলাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখায় ইতিহাসে তিনি অমর। কিন্তু নবাবের সেনাপতি হিসেবে পলাশীর যুদ্ধে তিনি নিহত হন কিনা তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের আরেক মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু রহস্যের মতোই মোহনলালের অন্তর্ধান রহস্যও কম চাঞ্চল্যকর নয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রয়াত ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে'র মতে পলাশী যুদ্ধে বেঁচে যান মোহনলাল। নবাব সিরাজের পুত্রকে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ পালিয়ে আসেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণপুর জমিদার বংশে বেড়ে উঠেন সিরাজপুত্র যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। কিন্তু এরপর মোহনলালের কী হয়? জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কোথায় ছিলেন তিনি? তার মতো একজন দক্ষ সেনাপতি আত্মগোপনে যাওয়ার পর কি অবসর নেন? নাকি ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়ে বনে যান ইতিহাসের আরেক মহানায়ক!
পলাশী যুদ্ধের পরেই দানা বাঁধতে শুরু করে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। কিন্তু দুবেলা দুমুঠো ভিক্ষা করে যাদের সন্তুষ্ট থাকার কথা তারা কেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন? সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের ক্ষুদ্ধ হওয়ার একাধিক কারণ থাকলেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের সেই প্রশিক্ষণ, সাংগঠনিক দক্ষতা বা লোকবলই বা তারা কোথায় পেলেন?
মোহনলালের অন্তর্ধানের পরই সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মূল নায়ক ভবানী পাঠকের উত্থান ঘটে। ময়মনসিংহের শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারের সংরক্ষিত পারিবারিক তথ্য অনুসারে বঙ্কিমচন্দ্রের ভবানী পাঠক হলেন মোহনলাল। বঙ্কিম সরকারি নথি থেকেই ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর ইতিহাস সংগ্রহ করেন। কিন্তু তবু দুজন একই ব্যক্তি ছিলেন কিনা তা হুট করে বলে দেওয়া কঠিন। তবে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্য উপাত্ত থেকে মোহনলালের সন্ন্যাসী বেশে আত্মগোপনে থাকার বেশ জোরালো ইঙ্গিত মিলে।
পলাশীর যুদ্ধে কি আসলেই মোহনলালের মৃত্যু হয়
সিরাজের বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন মোহনলাল। তাকে দেওয়ানখানার পেসকার নিয়োগ করে মহারাজা পদবীতে ভূষিত করেন সিরাজ। পলাশী যুদ্ধেও তার দৃঢ় অবস্থানের তথ্য পাওয়া যায়।
কিন্তু ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর ময়দানে মোহনলালের সঙ্গে কী ঘটেছিল? যদুনাথ সরকার সম্পাদিত হিস্ট্রি অব বেঙ্গল (ভলিউম ২) অনুসারে, সেদিন মীর মদনের নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে নবাবের সেনাবাহিনী যুদ্ধ শু্রু করে। তবে মীর মদনের মৃত্যুর পর সিরাজ দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলেন। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের পরামর্শে নবাব সেদিনের মতো সৈন্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। মোহনলালকেও তিনি যুদ্ধ করতে বারণ করেন। নবাবের চরম বিপর্যয়ের শঙ্কায় মোহনলাল প্রথমে পিছিয়ে যেতে সম্মত না হলেও শেষ পর্যন্ত তার কথামতো যুদ্ধ বন্ধ করেন। ফলে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীতে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। বেলা ৪টার পরে নবাব নিজেও পালিয়ে যান।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যে মোহনলালের কী হল? এস সি হিলের গ্রন্থ বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭ উল্লেখ করে যদুনাথ সরকার লিখেন, পলাশীর যুদ্ধে মোহনলাল আহত হন। তবে তার গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে মোহনলালের নিহত হওয়ার তথ্য লেখা। এই অংশটি তার নয় বরং নীরদভূষণ রায়ের তৈরি।
অধ্যাপক রজতকান্ত রায় পলাশী যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলা এবং মোহনলাল নিহত হন বলে উল্লেখ করেন। এর অর্থ হতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে মোহনলাল জীবিত ছিলেন এবং পরে কোনো সময় তার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়। রজতকান্ত আরেক জায়গায় লিখেন মোহনলাল যুদ্ধে 'জখম' হন।
সবচেয়ে বড় কথা পলাশী যুদ্ধে নিহত অন্যদের মতো মোহনলালের কবরের কোনো চিহ্ন নেই। ইতিহাসবিদ সোনিয়া আমিনের মতে মোহনলালের মৃতদেহ দাহ করা হয়ে থাকতে পারে। মোহনলাল হিন্দু ছিলেন বলেই সম্ভবত তিনি এই ধারণা করেন।
পলাশী যুদ্ধের পর সন্ন্যাসীর বেশে আত্মগোপন
মোহনলালকে ইতিহাসে বরাবরই সাহসী ও বীর সেনাপতি হিসেবে চিত্রায়িত করতে দেখা যায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি পালিয়ে যাবেন এমন কাপুরুষ সম্ভবত তিনি ছিলেন না। তবে যুদ্ধে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে মোহনলাল নবাবের বিপর্যয়ের কথা বুঝতে পারেন। বিশ্বস্ত মোহনলাল এমন পরিস্থিতিতে নবাবের একমাত্র পুত্রকে রক্ষার চেষ্টা করবেন এই তথ্য অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না। বিশেষ করে ছেলেটি যখন সম্পর্কে তার আপন বোনের সন্তান।
সিরাজের বংশধর হিসেবে পরিচিত লালা দে পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, সিরাজ এবং মোহনলালের বোন আলেয়ার ছেলের জীবন রক্ষায় তিনি ছয় বছরের শিশুটিকে নিয়ে দ্রুত মুর্শিদাবাদ ছাড়েন। সেসময় তিনি মীর জাফর ও ইংরেজদের বিভ্রান্ত করতেই সম্ভবত তার আহত হওয়ার গুজব প্রচার করেন।
মোহনলালের সঙ্গে বাসুদেব ও হরনন্দ নামের দুই বিশ্বস্ত দুই ব্যক্তি ছিলেন। পদ্মা নদী পার হয়ে তারা ময়মনসিংহ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় নেন। এসময় তিনি ও তার দুই সঙ্গী আত্মগোপনের জন্য সন্ন্যাসীর বেশ নিয়েছিলেন।
জমিদার শ্রীকৃষ্ণের ছোট ছেলে কৃষ্ণগোপাল এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরাজ পুত্রকে দত্তক নেন। ছেলেটির নতুন নাম হয় যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। জানা যায়, মোহনলাল ছদ্মবেশে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি কোথায় যান?
আরও পড়ুন: ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরী কি সিরাজউদ্দৌলার পুত্র ছিলেন!
ইংরেজদের বিরুদ্ধে আবারও প্রতিরোধ গড়ে তুলেন মোহনলাল?
রায়চৌধুরী পরিবারের সূত্রে জানা যায়, মোহনলাল তার ভাগনেকে ময়মনসিংহ রেখে রংপুর চলে যান। সেখানে তিনি কোম্পানির প্রাধান্য বিস্তারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। মোহনলাল নিজে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া আলীবর্দী ও সিরাজের সময় বাংলার সেনাবাহিনীতে যাদব বংশীয় বহু মানুষ ছিলেন। পলাশী যুদ্ধের পর তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মোহনলাল তার অনুগামী ও মজনু শাহকে নিয়ে ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে রংপুর অঞ্চল তখন জঙ্গলে পূর্ণ। সুতরাং এরকম একটি জায়গা মোহনলালের জন্য দল গড়ে তোলার উপযোগী ছিল।
মোহনলালের আত্মগোপনে থাকার বিভিন্ন কাহিনি মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান ও হুগলি জেলায় পাওয়া যায়। ইংরেজরা ক্ষমতায় থাকাকালে এই সংবাদ সংগ্রহ করা ছিল বিপজ্জনক। আর তাই ১৮ শতকের সেসব কাহিনি অজান্তেই হারিয়ে যেতে থাকে। যেসব খবর সংগ্রহ করা গেছে তা থেকে মোহনলালের জীবনের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু পাওয়া যায় না।
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা প্রায় সবাই মূলত সরকারি নথির ওপর নির্ভর করেছেন। অমলেন্দু দে'র মতে, পলাশী যুদ্ধের বিপর্যয়ের পরে মোহনলালের গতিবিধি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরকারি নথিভুক্ত ছিল না বলেই হয়তো স্বাভাবিকভাবেই কেউ তাকে ভবানী পাঠক চিহ্নিত করেনি।
ভবানী পাঠক: সাধু, দেবতা না দুর্ধর্ষ ডাকাত?
'কপালে ফোঁটা, মাথা কামান। ব্রাহ্মণ দেখিতে গৌরবর্ণ, অতিশয় সুপুরুষ, বয়স বড় বেশি নয়'- দেবী চৌধুরানী উপন্যাসে এভাবেই ভবানী পাঠকের বর্ণনা দেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভবানীর ভয়ে তখন পুরো বরেন্দ্রভূমি কম্পমান। তার সাধারণ পরিচয় ডাকাত হলেও তিনি দুষ্টের দণ্ডদাতা, দুর্বলের রক্ষক। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান এই নায়ককে দেশপ্রেমী রূপে তুলে ধরেন বঙ্কিমচন্দ্র।
ভবানীর সাংগঠনিক শক্তিও অদ্ভুত। হাজার হাজার বরকন্দাজ তার অধীনস্ত। নিমেষে সকলকে এক করতে পারেন তিনি। যেন তিনি কোনো দক্ষ সেনাপতি। জলে ও জঙ্গলে তিনি সমানভাবে দক্ষ। একইসঙ্গে দারুণ বিচক্ষণ।
দেবী চৌধুরানী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন যে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক, গুডল্যান্ড সাহেব এই নামগুলো ঐতিহাসিক হলেও মূল ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে এদের পার্থক্যও উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসে ভবানী পাঠক আত্মসমর্পণের পর তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রকৃত ভবানী পাঠক ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা যান বলে জানা যায়।
ইংরেজ শাসনকালে বঙ্কিমচন্দ্র রংপুর জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শুধু লেখকই ছিলেন না, একজন ইতিহাস গবেষকও ছিলেন। দেবী চৌধুরানীর গল্পটি তিনি নিয়েছিলেন হান্টার সাহেবের সংকলিত ও সরকারের প্রচারিত 'স্ট্যাটিস্টিকাল অ্যাকাউন্ট' থেকে। বইটির তথ্যানুসারে,
"কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা থেকে দূরে দিনাজপুর এবং রংপুর স্টেশনের দক্ষিণে এবং বর্তমান বগুড়া জেলার পশ্চিমে গঙ্গার দিকে বিস্তৃত অঞ্চল এই ডাকাতদের পছন্দের বিচরণক্ষেত্র। ১৭৮৭ সালে লেফটেন্যান্ট ব্রেননকে কুখ্যাত ডাকাত দলের সর্দার ভবানী পাঠককে প্রতিহত করতে এই অঞ্চলে পাঠানো হয়। লেফটেন্যান্টের রিপোর্ট থেকে আমরা ভবানী পাঠকের সঙ্গে জোট বাঁধা দেবী চৌধুরানী নামের এক নারী ডাকাত সম্পর্কেও প্রতিবেদনও পাই। তিনি নৌকায় থাকতেন এবং তার বেতনভুক্ত বিশাল বরকন্দাজ বাহিনী ছিল। নিজের মর্জিমতো তিনি ডাকাতি করতেন।"
- আ স্ট্যাটিস্টিকাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল। ভলিউম VII: হান্টার
অনেকেই ধারণা করেন মোহনলাল ছিলেন কাশ্মিরী ব্রাহ্মণ। যদুনাথ সরকার সম্পাদিত হিস্ট্রি অব বেঙ্গল বইয়ের পরিশিষ্টে তাকে মোহনলাল কাশ্মিরী বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ১৮ শতকে বাংলায় কাশ্মিরীদের আগমন অত্যন্ত বিরল। এছাড়া ১৯ শতকের পরিব্রাজক মোহনলাল কাশ্মিরীর সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। নিখিলনাথ রায়ের মতে, মোহনলালকে অনেকে বাঙালি বললেও তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। মুর্শিদাবাদের নবাবদের সময়ে উচ্চ পদে কর্মরত বাঙালিদের বংশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকলেও মোহনলাল সম্পর্কে নেই।
যাদব সম্প্রদায়ের তথ্যানুসারে, বিহারের পূর্ণিয়া অঞ্চলের যাদবদের একটি অংশ নিজেদের মোহনলালের বংশধর দাবী করে থাকে। নবাব সিরাজ মোহনলালকে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করেছিলেন বলেও জানা যায়।
এদিকে হান্টার সাহেবের বিবরণ অনুযায়ী, দুর্ধর্ষ ডাকাত ভবানী পাঠক ছিলেন বিহারের ভোজপুরী ব্রাহ্মণ। তার অনুচররা সকলে রাজপুত। ১৭৮৭ সালের জুন মাসে লেফট্যানেন্ট ব্রেনানের নেতৃত্বে ২৪ জন সেনাসহ ভবানী পাঠকের নৌকায় অতর্কিত আক্রমণ করা হয়। এরফলে ভবানী পাঠকসহ তার তিন অনুচর নিহত হন। এছাড়া আটজন আহত হওয়ার পাশাপাশি ৪২ জনকে বন্দী করা হয়।
বঙ্কিমের সঙ্গে কি যুগলকিশোরের পরিবারের সম্পর্ক ছিল?
আগেই বলা হয়েছে ময়মনসিংহের শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারের সংরক্ষিত পারিবারিক তথ্য অনুসারে বঙ্কিমচন্দ্রের ভবানী পাঠক হলেন মোহনলাল। বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে এই পরিবারের প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরীর পরিচয় ছিল বলেও ধারণা করা হয়।
প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরী নিজের সিরাজের সঙ্গে তাদের বংশের সম্পৃক্ততা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। বাবার কাছ থেকে যুগলকিশোরের জীবনী শুনে প্রসন্নচন্দ্র বোকাইনগর যান। সিরাজপুত্র যুগলকে নিয়ে মোহনলাল সর্বপ্রথম এখানেই পালিয়ে এসেছিলেন। তিনি এই গ্রাম সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করে বোকাইনগরের ইতিবৃত্ত নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধটি জাহ্নবী পত্রিকার ১৩১৫ সালের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরী কলকাতার হিন্দু কলেজে পড়তেন। এই কলেজ থেকে তিনি এমন একটি সময়ে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন যার কিছুদিনের মধ্যেই এই কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ রূপান্তরিত হবার পর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার কোনো পরিচয় ছিল কিনা, সে সম্পর্কে সেভাবে জানা যায় না। তবে বঙ্কিমের মৃত্যুর পর প্রসন্নকুমার দে ইংরেজিতে 'ইজ বঙ্কিম ডেড?' শিরোনামে মর্মস্পর্শী ইংরেজি কবিতা রচনা করেন।
প্রেসিডেন্সির রেজিস্টার থেকে অমলেন্দু দে ধারণা করেছেন বঙ্কিমের সঙ্গে তার পরিচয় না থাকলেও তিনি বঙ্কিমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ভবানী পাঠককে বঙ্কিম ইতিহাসের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করাতেই সম্ভবত তিনি বঙ্কিমের অনুরক্ত হন। এমনও হতে পারে প্রসন্নচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয়সূত্রেই প্রসন্নচন্দ্র বঙ্কিমকে মোহনলালের গল্প বলেছিলেন। যার সঙ্গে আরও ঐতিহাসিক উপাদান যোগ করে বঙ্কিম এই উপন্যাস নির্মাণে আগ্রহী হন।
জুড়ানপুরের সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের মাঝেও মোহনলালের নাম
যাদব সম্প্রদায়ের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মোহনলাল পলাতক অবস্থায় নদীয়া, বর্ধমান ও হুগলি জেলার বিভিন্ন স্থানে ছিলেন। এসব স্থানের প্রাচীন মন্দিরে তিনি সন্ন্যাসীর বেশে থাকতেন।
জানা যায় নদীয়া জেলার জুড়ানপুরের কালীপীঠ থেকে থেকে ভাগীরথী নদী পর্যন্ত একটি গুপ্তপথ যুক্ত ছিল যেখানে একসময় বহু সন্ন্যাসী ও বিদ্রোহী আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী এখানে মোহনলাল, তার ছোট ছেলে হুক্কালাল এমনকি রানি ভবানীর ছেলে রাজা রামকৃষ্ণ রায়ও আশ্রয় নেন। কালীপীঠ তখন প্রাচীন বাংলার তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। মোহনলাল নিজেও শাক্ত ছিলেন।
যাদবদের তথ্য অনুসারে, জুড়ানপুড়ের সতীপীঠের গর্ভগৃহের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে মোহনলাল শতাধিক গ্রামের যুবকদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করেন। ৭৬ এর মন্বন্তরের সময় তাদের নিয়ে তিনি ইংরেজ কোম্পানির রাজস্ব লুটে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের মধ্যে বেটে ওই এলাকার সাধারণ মানুষকে রক্ষার চেষ্টা করেন। একারণে বাংলায় কোম্পানির শাসন সুদৃঢ় হওয়ার পর ওই এলাকাকে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়। এজন্য দীর্ঘকাল এই অঞ্চলের গোপ, যাদবরা ভোগান্তিতে পড়ে।
গুপ্তিপাড়ায় মোহনলালের স্মৃতিফলক
আরেকটি কাহিনি অনুসারে মোহনলাল তার জীবনের শেষ দিনগুলো গুপ্তিপাড়ার শ্রী শ্রী বৃন্দাবন জিউ মন্দিরে কাটান। ভাগীরথী নদীর তীরে গুপ্তিপাড়া পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার প্রাচীন একটি জনপদ। জীউ মঠের সামনে একটি স্তম্ভে এখনও মোহনলালের স্মৃতিফলক আছে।
গুপ্তিপাড়ার বিশিষ্ট কয়েকজনের বক্তব্য অনুসারে, মোহনলালের জন্মস্থান এখানেই। জুড়ানপুরের কালীপীঠ থেকে এখানে এসে তিনি একজন সাধারণ সন্ন্যাসী হিসেবে জীবনের শেষদিনগুলো এই মঠেই অতিবাহিত করেন।
ইতিহাসের ভবানী পাঠকও শাক্ত ছিলেন। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কাচারী পয়রাডাঙ্গা এলাকায় আছে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সন্ন্যাসীদের আশ্রয়স্থল ভবানী পাঠকের মঠ। একে অনেকে শিবমন্দির, অনেকে দূর্গাদেবী চৌধুরানীর আস্তানাও বলে থাকেন। কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৭৭০ থেকে ১৭৭২ সালের মধ্যে এই শিব মন্দির নির্মাণ করেন ভবানী পাঠক। তার নামানুসারে এখানে পাঠকপাড়া গ্রামও আছে।
জলপাইগুড়ির ভবানী পাঠক মন্দির
জলপাইগুড়ির শিকারপুর চা বাগানে দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠকের মন্দির আছে। স্থানীয় চাবাগান জঙ্গলে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইকালে গোপন আস্তানা গড়েন ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী। তিস্তা নদীতে এই অঞ্চল থেকে বজরাযোগে রংপুর যাওয়ার নৌপথও রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রও এই এলাকায় ডিসি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন।
দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক এই এলাকার মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে ঈশ্বরতুল্য ছিলেন। তা না হলেও এত দীর্ঘসময় ধরে দুই কাল্পনিক চরিত্র বা দস্যু ডাকাতকে পূজা করার প্রশ্ন আসে না। মন্দিরের পুরোহিতের তথ্য অনুযায়ী এই মন্দিরে সিদ্ধপুরুষ মোহনলালের একটি মূর্তি আছে। কিন্তু এই মোহনলাল কে? জলপাইগুড়ির ভবানী পাঠকের আস্তানাতেই বা তিনি কীভাবে পূজিত হলেন?
মোহনলালের বংশধরদের পরিণতি
বঙ্গীয় যাদব মহাসভার সভাপতি ডা. স্বপন কুমার ঘোষ অমলেন্দু দে'কে মোহনলাল সম্পর্কিত তথ্যাবলী সরবরাহ করেন। স্বপন কুমার ঘোষের প্রবন্ধ অনুযায়ী, ১৭৫৭ সালের জুনে মোহনলালের বড় ছেলে রাজা শ্রীমন্ত লাল পূর্ণিয়ার নায়েবের দায়িত্বে ছিলেন। মিরনের আদেশে তাকে বন্দি ও হত্যা করা হয়। শ্রীমন্ত লালের একমাত্র ছেলে হনুমন্তলাল মামার বাড়ি থাকায় বেঁচে যান। মোহনলালের বংশধরদের হত্যা করা হতে পারে এমন সংবাদে ছেলেটিকে উত্তর প্রদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মোহনলালের আরেক ছেলে হুক্কালাল মন্বন্তরের সময় জুড়ানপুরে ছিলেন। সেসময় এক মহামারিতে তিনি মারা যান। এই জুড়ানপুরেই মোহনলালও ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ছেলের সঙ্গে কি তার পুনর্মিলন ঘটেছিল? হুক্কালালের পৌত্র মদনলাল নামের সঙ্গে মামাদের 'ঘোষ' পদবী যোগ করে হন মদনলাল ঘোষ। এভাবেই মোহনলালের বংশধারা অব্যাহত থাকে। বর্তমানে পূর্ণিয়ায় যাদবদের লালবংশ নিজেদের মোহনলালের বংশধর দাবী করে। তাদের উদ্যোগেই পরবর্তীতে বিহার গোপ জাতীয় মহাসভা এবং সর্বভারতীয় যাদব মহাসভার উদ্ভব হয়।
মোহনলালের বেঁচে থাকার নানা তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেলেও সেগুলো আজও বিচ্ছিন্নভাবেই রয়েছে। মোহনলালকে ভবানী পাঠক হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা নিঃসন্দেহে কৌতুহলের সৃষ্টি করে। তিনি স্বয়ং ভবানী পাঠক না হলেও সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এমন সম্ভাবনাও বেশ জোরালো। এ কথা সত্যি যে ব্রিটিশ আমলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলো বিশদভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। ইতিহাসবিদরা মূলত ব্রিটিশ আমলাদের সরকারি নথির ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও তথ্যাবলি আলোচনা করেছেন। ব্রিটিশরাও সিরাজ পরিবারের ধারাবাহিক ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা করেনি। বরং এই ইতিহাসগুলো সংরক্ষণের চেয়ে নষ্ট করে দেওয়াই তাদের জন্য লাভজনক ছিল। মোহনলাল ভবানী পাঠক হোক কিংবা না হোক, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক হিসেবে এই দুজনকে নিয়েই আরও গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন।