কাল্লু কাবাব ঘর: কাল্লু মামার হাতের জাদু এখনও একমেবাদ্বিতীয়ম!
জানুয়ারির এক শীতের সন্ধ্যায় মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন দিয়ে যাচ্ছিলাম। নতুন রাস্তা হয়েছে এখানে। মূল রাস্তার ঢালু অংশ দিয়ে কিছুদূর এসে বড় মসজিদের সামনে দাঁড়ালাম। রাস্তার দুই পাশেই কাবাব বিক্রেতারা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। অগণিত ক্রেতার ভিড় সেখানে। তাদের পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নাকে ভেসে আসছে ভাজা মাংসের চাপা একটা ঘ্রাণ। ভোজনরসিক ব্যক্তি মাত্রই কাল বিলম্ব না করে বলে উঠবেন 'অপূর্ব!'।
ঠিক করলাম এখানকার সবচেয়ে পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী কাবাবঘরে গিয়ে পেটপুজো সারব। বড় মসজিদের পাশেই 'কাল্লু কাবাব ঘর'। কাল্লুর প্রায় সব খাবারই বিখ্যাত। কী খাব তা ভেবে সময় নষ্ট করলাম না। রেস্তোরাঁর কর্মচারী জুম্মান ভাইকে বললাম মুরগির চাপ দিতে। তিনি জানালেন, আমাকে অপেক্ষা করতে হবে দশ মিনিটের মতো। পাশেই ছিলেন রেস্তোরাঁর এক মালিক আরিফ হোসেন। তার সাথে আলাপ করতে করতেই সেরে নিলাম ভোজন পর্ব।
কাল্লু কাবাব ঘরের মুরগির চাপ খেতে কেমন?
জুম্মন ভাই দশ মিনিটের আগেই মুরগির চাপ এনে সামনে রাখলেন। সাথে দিলেন সদ্য ভাজা গরম চার পিস লুচি। শসার উপর সস দিয়ে আরেক বাটিতে দিলেন সালাদ। অনেকটা হেঁটে আসার পর বেশ ক্ষুধায় তখন কাতর। এমন শীতের সন্ধ্যায় সালাদের সাথে মুরগির চাপ খেতে ভালো না লাগার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আবার তা যদি হয় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হাতে তৈরি, তবে তো কথাই নেই।
কাবাব ঘরে মাংস তৈরি, লুচি বানানো ইত্যাদি কাজের জন্য আলাদা লোক রাখা আছে। তবে, চাপ তৈরি করেন আরিফ হোসেন নিজেই। তার বাবা সাব্বির হোসেন গত বিশ বছর আগে এই কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর থেকে আরিফ হোসেন রেস্তোরাঁটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। কাল্লু কাবাব ঘরে রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয় বড় একটি মাটির চুলা। চুলায় সব সময় লাকড়ি জ্বলতে দেখা যায়। মাটির চুলার দিকে ইঙ্গিত করে আরিফ হোসেন বললেন, "মাটির চুলায় রান্না না করলে আবার কাবাব হয় নাকি! যতক্ষণ দোকান খোলা আছে ততক্ষণ এই চুলা জ্বলতেই থাকবে।"
খানিক থেমে আরো বললেন, "মাটির চুলাতে মাংস ভালো করে সেঁকা সম্ভব হয়। ফলে, চাপ কিংবা মগজ যা-ই রান্না করা হোক, তার স্বাদ হয় অনন্য। এজন্যই আমাদের রেস্তোরাঁ মিরপুরে বিখ্যাত।" আমি মুরগির চাপ খাচ্ছিলাম, আর তার কথায় সায় দিচ্ছিলাম। গ্যাসের চুলায় রান্না করা চাপের সাথে মাটির চুলায় তৈরি চাপের পার্থক্যটা বুঝতে কাল্লু কাবাব ঘরে আসার সিদ্ধান্তটা মন্দ হয়নি।
মুরগির চাপটা খেয়ে বুঝলাম এর পরতে পরতে মশলা মেশানো হয়েছে। এখানে চাপ তৈরির মাংস প্রথমে যত্ন করে পর্যাপ্ত থেঁতলে নেয়া হয়। এরপর নিজস্ব রেসিপির মশলা মিশিয়ে মাংস খণ্ডগুলোকে একটি বাটিতে রাখা হয়। মাটির চুলার উপর রাখা তাওয়াতে সামান্য তেল দিয়ে তার উপর ছাড়া হয় মাংস খণ্ডগুলোকে। সময় নিয়ে আস্তে আস্তে চাপ তৈরি হয়। এখানে একবার ব্যবহৃত তেল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা হয় না। অর্থাৎ, তেল নিয়ে কোনো আপত্তি তোলার অবকাশ নেই। এটিও খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণের একটি প্রক্রিয়া হতে পারে।
এখানে খেতে আসা লোকজন চাপের সাথে সাথে মগজ খেতে একটু বেশি পছন্দ করেন। খাবারের স্বাদের বিষয়েও তাদের কাছে ইতিবাচক মন্তব্য পাওয়া গেল। আমার টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিলেন সাবিদ বিন রেজাউল ও তাঁর বন্ধু। দুজনই মিরপুরে থাকেন। দীর্ঘদিন পরে এখানে খেতে এসেছেন। দুজনেই মনোযোগ দিয়ে মুরগির চাপ খাচ্ছিলেন। তাদের তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখে জানতে চাইলাম প্রথমবার এসেছেন কি না! দুজনই সমস্বরে উত্তর দিলেন এর আগেও কাল্লু কাবাব ঘরে খেয়েছেন তারা। খেতে খেতেই বললেন, "এখানকার চাপের স্বাদ অতুলনীয়। আমরা অন্যান্য রেস্টুরেন্টেও খেতে যাই। তবে এই চাপে একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে।"
আরেক দম্পতি গরুর মগজ ভুনা খাচ্ছিলেন। এখানে খেতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে শহীদুল আলম বলেন, "আমি মিরপুর ১২ নম্বরে থাকি। বিয়ে করেছি ছয় বছর ধরে। বিয়ের পর আজকে আমরা তৃতীয়বারের মতো এখানে একসাথে খাচ্ছি। এর আগের বার দুজনে এসে গরুর চাপ খেয়েছিলাম।" শহীদুল আলম কথা প্রসঙ্গে তার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন। জানালেন, বিয়ের আগেও একা এসেছেন বহুবার। তার মতে, ছোট বেলায় স্কুলে ভালো ফলাফল করার সাথেও কাল্লু কাবাবের সম্পর্ক আছে। শহীদুল আলমেরা ভালো ফলাফল করলে অভিভাবকেরা তাদেরকে কাল্লু কাবাব ঘরের গরুর চাপ খাওয়াতে নিয়ে যেতেন।
কাল্লু কাবাব ঘরের ইতিহাস
অর্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো কাল্লু কাবাব ঘরের সামনে আসতেই রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের তুমুল ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতোই। একজন লুচি বানাচ্ছেন, অন্য কর্মচারী খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। ছোট একটি ছেলে প্লেট পরিষ্কার করতে করতে যেন নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছে না। এদিকে রেস্তোরাঁর পরিচালক ও খোদ শেফ আরিফ হোসেনের সমস্ত মনোযোগ যেন গরু আর মুরগির চাপ তৈরিতেই আবদ্ধ। কয়েকবার ডাকার পরে হাসিমুখেই জবাব দিলেন, "সবকিছুর আগে কাজ, বুঝলেন ভাই!"। এরপর নিজে থেকেই কাবাব ঘরের গল্প বলতে শুরু করলেন।
রেস্তোরাঁর নামকরণ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আগ বাড়িয়ে। উত্তর দিলেন, এই রেস্টুরেন্টের নামকরণ করা হয়েছে তার বাবার নামে। তবে, কাল্লু তার বাবার সার্টিফিকেট নাম না। বলা যায় ডাকনাম। এই নামেই এলাকায় পরিচিত বলে রেস্তোরাঁর নামও 'কাল্লু কাবাব ঘর'। ভদ্রলোকের আসল নাম সাব্বির হোসেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর সাথেই কথা হলো।
শুরুতেই আমাকে বললেন, রেস্তোরাঁর কাজ থেকে তিনি অবসরে গিয়েছেন অনেক আগেই। কিডনি জটিলতার কারণে ইদানীং প্রতি সপ্তাহে তাকে ডায়ালাইসিস করতে হাসপাতালে যেতে হয়।
বেশ শান্তস্বরে জানালেন, ব্যবসা শুরু করেছিলেন মূলত তাঁরও বাবা। নাম মো. শোকুর। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অধীনে। তখন সাব্বির হোসেন খুবই ছোট। অবশ্য ঐ সময়ে আজকের কাল্লু কাবাব ঘর নামে কিছুই ছিল না। পিতার পরে সাব্বির হোসেন এই ব্যবসায় আসেন। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে সাব্বির হোসেন তার পিতার কাবাব ব্যবসায় হাল ধরেন। শুরুর দিকে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বড় মসজিদটার পাশে 'কাল্লু কাবাব ঘর' চালু করেন তিনি। মসজিদ সংলগ্ন বট গাছের ছায়ায় খোলা আকাশের নিচেই কাবাব, চাপ, গরুর বট, গরুর মগজ রান্না করা হতো। এই চিত্র মোটামুটি চার দশক আগের। ঐ সময় খাবারের দোকানটিতে দৈনিক দেড় মণ বা প্রায় ৬০ কেজি মাংসের চাহিদা ছিল।
সাব্বির হোসেন বললেন, "আমরা তখন প্রতি পিস মুরগির চাপ মাত্র ৩০ পয়সাতে বিক্রি করতাম।" বর্তমানে রেস্তোরায় ভীড়ের প্রসঙ্গ উঠতেই জানালেন, "১৫ বছর আগের ভীড়ের তুলনায় এই ভিড় কিছুই না। তখনও গরুর চাপ আর বট সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হতো আমাদের।"
বর্তমান অবস্থা
রাস্তার সাথেই কাল্লু কাবাব ঘর। বিক্রি শুরু হয় প্রতিদিন বিকাল ৫টার পরে। আর বন্ধ হয় রাত ১১টার মধ্যেই। কিছুদিন আগে রেস্তোরাঁটি দোতলায় উন্নীত করা হয়েছে। পরিসর ছোট হলেও ভিড় অনেক বেশি। 'চাহিবা মাত্রই খাবার হাজির হবে' ভাবলে ভুল হবে। কাবাব ঘরের নিচের তলায় রান্না করা হয়। আর দোকানের সামনে এবং দোতলায় খাবার পরিবেশন করা হয়।
রেস্তোরাঁর সামনে যেতেই দেখা যাবে মাটির বড় চুলাটির সামনে একটা ছোট পিঁড়িতে বসে আছেন আরিফ হোসেন। এখানে বসেই তিনি গরুর চাপ, মুরগির চাপ, গরুর মগজ ভুনা তৈরি করছেন। তার পেছনেই এক কর্মচারী ব্যস্ত আছেন গরম গরম লুচি ভাঁজা নিয়ে। গরুর চাপ আর মগজের দাম ১৪০ টাকা করে। আর মুরগির চাপ ১২০ টাকা। লুচি পাওয়া যাবে প্রতি পিস ৫ টাকায়। প্রতিদিন সকালে আরিফ হোসেন নিজেই বাজার থেকে গরু এবং মুরগির মাংস কিনে আনেন। মাংস কেটে রান্নার উপযোগী করা এবং মশলা তৈরির কাজ বাড়িতেই সম্পন্ন করা হয়। এরপরে তা নিয়ে আসা হয় রেস্তোরাঁতে। রেস্তোরাঁয় মূলত কাজ করেন পরিবারেরই তিনজন এবং দুইজন বাইরের কর্মচারী।
কাল্লু কাবাব ঘরের ভিড় দেখলে যেকোন ব্যক্তিই অবাক হবেন। সন্ধ্যা বাড়তেই আরিফ হোসেনের যেন দম ফেলার ফুরসৎ নেই। তবে সাব্বির হোসেনের মতে, আগের তুলনায় বর্তমানে বিক্রির পরিমাণ বেশ কমে গেছে। তাঁর মতে, এখন দৈনিক কাল্লু কাবাব ঘরের মুরগির মাংসের চাহিদা প্রায় ৩০ কেজি। আর গরুর মাংসের চাহিদা ২০ কেজি।
দৈনিক বিক্রির প্রসঙ্গে আরিফ আরো বললেন, "প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করি। এখানে আমাদের লাভ খুবই সীমিত। কারণ, দাম বাড়ালে ক্রেতাদের মাঝে অসন্তোষ দেখা যাবে। কিন্তু, আমরা আমাদের রেস্তোরাঁর সুনাম ধরে রাখতে চাই। তাই মান নিয়ন্ত্রণ করতে দৈনিক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রাও নির্দিষ্ট থাকে।" আগামীতেও ব্যবসা ঠিকভাবে চলতে থাকলে রেস্তোরাঁর পরিসর বাড়ানোর ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন তিনি।