ছোট, অপরিসর ঘরও যেভাবে আমাদের ভালো থাকা না থাকাকে প্রভাবিত করে!
সারা বিশ্বেই মানুষের থাকার জায়গাগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটের অপ্রশস্ত ছোট কামরাগুলো হয়ে উঠছে মানুষের আশ্রয়স্থল। হংকংয়ের মতো জনবহুল শহরের কথাই ধরা যাক। এখানকার প্রায় দুই লাখ মানুষ 'কফিন ঘর' নামে পরিচিত বাড়িতে থাকে। বাড়িগুলো এতটাই ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত যে পূর্ণবয়স্ক কারও পক্ষে পা ছড়িয়ে ঘুমানোও অসম্ভব।
যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোতেও ছোট হচ্ছে থাকার জায়গা। ব্রিটেনে যারা ভাড়া থাকেন, তাদের লিভিং স্পেস ১৯৯৬ সালে ৩১ বর্গমিটার থেকে ২০ বছরে ২৫ বর্গমিটারে নেমে এসেছে। অসংখ্য মানুষ এখন বাসা ভাগাভাগি করে একসাথে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
নগরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আধুনিক অর্থনীতি। জমির দাম হুহু অরে বাড়ায় সৃষ্টি হয়েছে আবাসন সংকট। ভাড়াটিয়া এবং নতুন যারা বাড়ি নির্মাণ করছেন, তারা একরকম বাধ্য হয়েই বেশি দামে ছোট বাড়ি বেছে নিচ্ছেন। যাদের ইতোমধ্যেই বাড়ি আছে তারা সম্পদের মূল্য বাড়তে দেখেছেন। একইসঙ্গে অন্যদের তুলনায় বড় জায়গা নিয়ে থাকার মতো সুবিধাও পাচ্ছেন। ফলে বড় শহরগুলোতে লিভিং স্পেস নিয়ে বাড়ছে বৈষম্য।
গবেষণা বলছে, বাসস্থান ছোট হওয়ার বিষয়টি সার্বিকভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলছে। থাকার জন্য মানুষ কতটুকু জায়গা পর্যাপ্ত মনে করে, সেই বিষয়টি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। মানুষ কেমন জায়গায় বেড়ে উঠেছে এবং বর্তমানে আশেপাশে কতটুকু জায়গা পাচ্ছে তার ওপর তাদের প্রত্যাশা নির্ভর করে। সামাজিকভাবে এই বৈষম্য আরও জটিল অর্থসামাজিক অসঙ্গতি নির্দেশ করে।
কত বড় বাড়িতে থাকতে চায় মানুষ?
মানুষের ভালো থাকার সঙ্গে লিভিং স্পেসের কোনো সার্বজনীন সম্পর্ক নেই। ভিন্ন ভিন্ন সমাজে লিভিং স্পেসের ধারণাও ভিন্ন। আর তাই বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে বিষয়টি মজার হতে পারে।
৯০-এর দশকের শুরুর দিকে প্রকাশিত এক গবেষণায় নৃতাত্ত্বিক এলেন জে প্যাডার একজন মেক্সিকান অভিবাসীর বক্তব্য তুলে ধরেন। ম্যাক্সিকান ব্যক্তিটি বলেন, "অনেক আমেরিকানকে আমি নিজের মতো বসবাস করতে দেখি। আমার মনে হয়, না জানি তারা কত একা"। এই বৈচিত্র্যের কারণেই ছোট ঘর সব মানুষকে একইভাবে প্রভাবিত করবে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে বাড়ি হলো বাড়ি হলো স্থাবর সম্পত্তি যা আমাদের অর্থ ও রুচি প্রদর্শনের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে। কোনো ব্যক্তির বাড়ি তার জন্য পর্যাপ্ত বড় হলেও প্রতিবেশি, আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের ঘরবাড়ির তুলনায় ছোট হলে তা নিয়ে মানসিক অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বাড়ি অন্যদের তুলনায় বড় হলে তা পরিতৃপ্তি আনে।
যুক্তরাজ্যের মানুষের আবাসন প্রত্যাশা নিয়ে এক সাম্প্রতিক গবেষণার সাক্ষাৎকারে একজন বলেন, এক বেডরুমের ফ্ল্যাটে থাকার জন্য মানুষ তাকে বাঁকাচোখে দেখে বলেই মনে হয়েছে। "মানুষ কোথায় থাকবে এবং তাদের জীবনের অর্জন কী তা নিয়ে সমাজ ও বন্ধুবান্ধবদের দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে চলা বেশ কঠিন।"
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ সারা সোলনিক এবং ডেভিড হ্যামেনওয়ের ২০০৫ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশ মানুষই জানান, তারা একটি শর্তেই ছোট বাড়িতে থাকতে পছন্দ করবে, যতক্ষণ তা অন্যদের বাড়ির চেয়ে বড়।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি গবেষণা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মানুষের বড় বাড়িতে থাকার আকাঙ্খা ওই এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়িটিই নির্ধারণ করছে। এলাকায় কোনো বাড়ি যত বড় হয়, সেই এলাকার মানুষের আবাসন নিয়ে পরিতৃপ্তিও তত কমতে থাকে।
বাড়তে থাকা বৈষম্য
তবে সব মানুষ অন্যদের ছোট বাড়ি থেকে আত্মপ্রসাদ লাভ করে এমন নয়। অধিকাংশ মানুষই একটি 'স্বাভাবিক' মাপের বাড়িতে থেকেই খুশি যেখানে তারা স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারে।
তবে যারা মোটামুটি ভালো পরিসরের জায়গা পায় না, তারা অন্যান্য সমস্যার সম্মুখীনও হয়। যেমন ব্রিটেনের বাড়িগুলোতে শিশুরা যাতে নীরবে শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ির কাজ ও পড়াশোনা করতে পারে, সেজন্য নিরিবিলি আলাদা জায়গার ব্যবস্থা থাকে। দেখা গেছে যেসব বাড়ি এই জায়গা দিতে ব্যর্থ হয়, সেখানকার শিশুরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে।
মহামারির সময় আমাদের ঘরে অবস্থানের সময়ও বেড়েছে। ঘরে জায়গার স্বল্পতা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোভিড ছড়ানোর ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা বাড়িতে বসে কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন, সেই কথাও জানান। জুমে অংশ নিতে গিয়ে বাড়তি ঘর না থাকায় বিপাকে পড়েন তারা। সোফা বা অন্যান্য আসবাব না থাকার মতো বিষয়গু্লোও তারা সহকর্মীদের জানাতে বাধ্য হয়।
এই নেতিবাচক বিষয়গুলো এড়াতে লিভিং স্পেসের গড় পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি যেসব জায়গায় আবাসন সংকট রয়েছে সেখানে বাড়িঘর নির্মাণে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তবে এই লিভিং স্পেসের বৈষম্য কমাতেও উদ্যোগ নিতে হবে। বাসাবাড়ির ওপর আরোপিত কর নিয়ে নতুন করে ভাবার পাশাপাশি সমবায় আবাসন প্রকল্প নির্মাণের দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে দরিদ্র পরিবারগুলো নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতেই থাকবে।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন