যুক্তরাজ্যের অপরাধ সংস্থার তদন্তের আওতায় আসতে পারে টিউলিপের সম্পত্তি
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে চুরি হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ডের আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে—যুক্তরাজ্যের সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনভিত্তিক সম্পত্তি তদন্ত করতে পারে, ব্রিটেনের শীর্ষ আইন সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি। সোমবার (৬ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস ।
ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিভাগ (ইন্টারন্যাশনাল করাপশন ইউনিট) বর্তমানে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ দিয়ে কেনা সম্পত্তিগুলো চিহ্নিত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছে।
সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বেশ চাপে আছেন টিউলিপ। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট বা শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজনদের থেকে পাওয়া তার বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে।
টিউলিপ ও তার পরিবার বর্তমানে লন্ডনে একটি ২ দশমিক ১ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সেমি-ডিটাচড বাড়িতে বসবাস করছেন। বাড়িটি আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল করিম নাজিমের মালিকানাধীন।
২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় একটি দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট টিউলিপ উপহার হিসেবে পান। ২০০১ সালে ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন আবদুল মোতালিফ নামে একজন ডেভেলপার। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। ২০০৪ সালে কোনো অর্থ না দিয়েই টিউলিপ সিদ্দিক ওই ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছিলেন।
একইভাবে, ২০০৯ সালেও বোন আজমিনা সিদ্দিকের মাধ্যমে আরেকটি ফ্ল্যাট এভাবে উপহার হিসেবে পান টিউলিপ। বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি—ফ্ল্যাটটি টিউলিপের বোন আজমিনার নামে হস্তান্তর করেন। পরে আজমিনা বিনামূল্যে এই ফ্ল্যাটটি টিউলিপকে ব্যবহার করতে দেন।
যুক্তরাজ্যের অপরাধ সংস্থার তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা শত শত মিলিয়ন পাউন্ডের অংশ হিসেবে লন্ডনে সম্পত্তি কেনার ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। এই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে টিউলিপের মালিকানাধীন ফ্ল্যাট এবং অন্যান্য বাড়িও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, টিউলিপ যেহেতু অর্থ পাচার রোধে সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন, তবে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এতে তার দায়িত্বের সাথে স্বার্থের সংঘাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্য যুক্তরাজ্যের একটি স্বাধীন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। এনিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাডভাইজার অন মিনিস্ট্রিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস (প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) লাউরি ম্যাগনাসের কাছে চিঠি লিখেছেন তিনি।
চিঠিতে লাউরি ম্যাগনাসকে তিনি লিখেছেন, সম্প্রতি আমি এবং আমার পরিবারকে ঘিরে গণমাধ্যমে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার বেশিরভাগই ভুল। আমি নিশ্চিত, আমি কোনো ভুল করিনি। তবে এ বিষয়ে কোনো ধোঁয়াশা রাখতে চাই না আমি, স্বাধীনভাবে এর সত্যতা যাচাই করুন। আমি আপনাকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সরবরাহ করতে প্রস্তুত।'
যদিও এখন পর্যন্ত টিউলিপের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে তদন্ত চালু হলে, এসব সম্পত্তি কেনার জন্য ব্যবহৃত অর্থের উৎস খতিয়ে দেখা হবে।
লেবার দলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিউলিপ সিদ্দিক এই সপ্তাহে চ্যান্সেলর র্যাচেল রিভসের নেতৃত্বে চীনে ট্রেজারি প্রতিনিধিদলের সফরে যোগ দেবেন না। তিনি দেশে থেকে তদন্তে সহযোগিতা করবেন।
তবে, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার পরেও তার ওপর আস্থা রেখেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। তার মতে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বার্থ বিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টার কাছে বিষয়টি উত্থাপন করে টিউলিপ যথাযথ পদক্ষেপই নিয়েছেন।
ব্রিটেনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সচিব হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিক অর্থ পাচার ও অবৈধ অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও, তিনি বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনো নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্রিটেনের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। এনিয়ে আলোচনা করতে গত বছর ঢাকা সফর করেছে যুক্তরাজ্যের অপরাধ তদন্ত সংস্থা এবং শুল্ক ও রাজস্ব বিভাগ।
ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) এক মুখপাত্র বলেছেন, এনসিএ সাধারণত কোনো তদন্তের অস্তিত্ব নিশ্চিত বা অস্বীকার করে না।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত বছরের শেষে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠকে দেশের বাইরে পাচার হওয়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও ফেরত আনার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজনদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এদিকে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগেও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাশিয়ার সঙ্গে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনার সময় মধ্যস্থতা করেন টিউলিপ। যদিও ওই সময় তিনি ব্রিটেনের কোনো সরকারি দায়িত্বে ছিলেন না। সেই বছর চুক্তি সই করার সময় তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তার খালা শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি ছবি তোলেন।
তার কাছের সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশি ও রুশ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক পরিচালনার অভিযোগগুলো 'ভুয়া' এবং 'সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'।