ভারতের অস্থির তরুণ প্রজন্ম আসলে কী চায়!
১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ভারতীয় তরুণরা নানাভাবে চিরায়ত রীতিনীতি ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু এই তরুণদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কি তাল মেলাতে পারবে দেশের অর্থনীতি? ইন্টারনেট উদ্যোক্তা অঙ্কুর ওয়ারিকুরকে ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রামে অনুসরণ করেন লাখ লাখ তরুণ। 'জেন জি' তরুণদের কাছ থেকে দিনে ৩০০টি করে ইমেইল পান তিনি। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান কেন তরুণ ভারতীয়রা তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে আলাদা-
আমাদের চোখে তরুণ, মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের অবয়বটা এমন- তারা পরিশ্রমী, পড়ুয়া এবং পরিবারের ইচ্ছা ও রীতিনীতির প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল।
আমরা ভাবি, এই তরুণেরা সব প্রতিযোগিতামূলক বোর্ড পরীক্ষার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। এবং তাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, কোনো শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া। তারা নিজেদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ক্যারিয়ার গড়ার এবং বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
এই ধারণাগুলো এখন বাঁধাধরা স্টেরিওটাইপ ছাড়া কিছু না।
অনেক তরুণ মধ্যবিত্ত ভারতীয়র সঙ্গে আমি কথা বলেছি, যারা নিজের বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে, বিদ্রোহ করেছে এবং বিকল্প পথে হেঁটেছে। তারা সবসময় নিরাপদ অপশনটি বেঁছে নেয়নি। কিন্তু বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে, তারা কিছু অংশে বা কিছু সময়ের জন্য অবাধ্য হলেও আবার ঠিকই সেই পুরনো ধারায় ফিরে এসেছে।
দুই বছর আগে তরুণদের নিয়ে ইউটিউবে ভিডিও বানাতে গিয়ে আমার এই প্রজন্মের ব্যাপারে যেসব ধারণা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়।
আমি খেয়াল করি, এই তরুণেরা ইংরেজি বুঝে। কিন্তু তারা মায়ের ভাষাতে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের কাছ থেকে প্রতিদিন আমি শত শত ইমেইল পাই। এসব ইমেইলের বিষয়বস্তুও হয় বেশ বিস্তৃত। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে ক্যারিয়ার, রিলেশনশিপ থেকে মানসিক স্বাস্থ্য; সব বিষয়েই তাদের সঙ্গে কথা হয় আমার।
আমার কথা হয়েছে ১৫ বছর বয়সী এক প্রোগ্রামারের সঙ্গে, যে কলেজ ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজে কোডিং শিখেছে। এখন বাবার পারিবারিক ব্যবসা ডিজিটালাইজ করতে সাহায্য করছে সে। এক ২৪ বছর বয়সী চিত্রশিল্পীর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, যিনি ছয় বছর বয়স থেকে আঁকাআঁকি করছেন। একজন ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে কথা হয়েছে, যিনি কলেজ থেকে বের হয়েই যেকোনো ফুল-টাইম চাকরির তিনগুণ আয় করা শুরু করেছেন। একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে যিনি দিনে হিসাবরক্ষকের চাকরি করেন এবং রাতে বিটবক্সারের দায়িত্ব পালন করেন।
একটা সময় পর্যন্ত আমি ধরে নিতাম, এই ঘরানার লোকগুলো আসলে ব্যতিক্রম এবং সংখ্যায় খুব কম। কিন্তু এখন আর এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা যায় না তাদের।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি নেওয়ার জায়গা না
বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু ডিগ্রি নেওয়ার বা চাকরি পাওয়ার পথ হিসেবে দেখেন না এই প্রজন্ম।
ক্লাস, পরীক্ষা, পাঠ্যক্রমের উপর স্থির থাকেন না তারা। বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা দেখেন নেটওয়ার্কিং এবং এক্সপেরিমেন্ট করার জায়গা হিসেবে। স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠার চিন্তা এই সময়েই করেন তারা। অনেকে স্টার্ট-আপের প্রাথমিক সংস্করণ চালু করে দেন শিক্ষার্থী থাকাকালেই। এছাড়া আর্থিক ঝামেলা না থাকলেও তাদেরকে দেখা যায় একাধিক ইন্টার্নশিপ করতে।
চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করেন না তারা
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে এক বছর গ্যাপ নেওয়া, এই প্রবণতা আগে কখনো দেখা যেত না ভারতীয় শিক্ষার্থীদের মাঝে।
একটা বছর কিছু না করে পার করাকে অপচয় ও বিলাসিতা হিসেবেই দেখত সবাই। কিন্তু আমি যে ১৮ বছর বয়সীদের সঙ্গে কথা বলি তারা হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকি জীবন পস্তাতে চায় না। নিজে যেই ব্যক্তি না, সেই ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করে জীবন নষ্ট করতে চায় না এই তরুণেরা। যে কারণে, কয়েক মাস বা এক বছর সময় নিয়ে নিজে আসলে কে ও কী হতে চাই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন তারা।
বিয়ে করলেও দেরিতে
অনেক তরুণকে দেখেছি যারা রিলেশনশিপকে একটি ফাঁদ হিসেবে দেখেন। তাই প্রথম জীবনে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চান না তারা। তাদের কাছে অন্য কারোর হাত ধরার চেয়ে নিজেকে চেনা এবং নিজের কর্তৃত্ব নেওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থিক ঝুঁকি নিতে ভয় পান না তারা
বাবা-মা আর্থিক স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, এটা দেখেই বড় হয়েছেন অধিকাংশ তরুণ। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছেন সময় বদলে গেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়েছে, মানুষের স্বপ্ন বড় হয়েছে এবং সাফল্যের পথও অনেক বেড়েছে।
আগের প্রজন্মের মতো বেঁচে থাকার জন্য টাকা উপার্জন করতে হয় না তাদের। তারা টাকাকে দেখে স্বাধীনতার উৎস হিসেবে।
একটি সম্ভ্রান্ত এলাকায় বাংলো করাটা তাদের লক্ষ্য না। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে মাসিক সঞ্চয় স্টক এবং ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগ করা এবং বাড়তি টাকা এক জোড়া এয়ার জর্ডানের উপর খরচ করা।
শিক্ষার মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া
ইউটিউবই তাদের স্কুল।
কোথায় পড়ানো হচ্ছে, এটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাদের। ব্যবহারযোগ্য জ্ঞানের জন্য তারা ইনস্টাগ্রামে পছন্দসই লোকজনকে অনুসরণ করেন।
এই তরুণ প্রজন্মের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সাহস আছে। তবে একটি গুণ পূর্ববর্তী সকল প্রজন্ম থেকে তাদের আলাদা করে দেয়। সেটি হচ্ছে- ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা।
এর আগ পর্যন্ত, প্রতিটি ভারতীয় প্রজন্মেরই মূলমন্ত্র ছিল স্থিতিশীলতা। ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স, কাজের প্রভাব ও পরিপূর্ণতা, এসব বুলি শুধু অভিজাত শ্রেণির মুখেই শোনা যেত।
কিন্তুএই প্রজন্ম শুধু সামনে থাকা বৈশ্বিক সুযোগ-সুবিধাগুলো সম্পর্কে অবগতই না, এসবের জন্য বড়সড় ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত তারা।
এ কারণেই দুর্দান্ত স্টার্ট-আপ দিয়ে দেশ মাতানো ব্যক্তিগুলো, যেমন- ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম 'পেটিএম'-এর বিজয় শেখর শর্মা বা ভারতের বৃহত্তম হোটেল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার রীতেশ আগরওয়াল তরুণদের মাঝে আইকন হয়ে উঠেছেন৷
তবে এই প্রজন্মের একটি বিষয় নিয়ে আমি চিন্তিত। আমরা যখন বড় হয়েছি, আমরা অপেক্ষা করা শিখেছি। দুধ কিনতে লাইনে দাঁড়াতে হতো আমাদের, একজনকে ফোন করার জন্য কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, বা কারো চিঠির জবাবের জন্য কয়েক দিন বা মাস অপেক্ষা করতে হতো। একটি গাড়ি কেনার জন্য অনেকে পুরো জীবন অপেক্ষা করতো।
ধৈর্য ধরাটা কেউ আমাদের শেখায়নি। বরং ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই ধৈর্য ধরতে শিখেছি আমরা। কিন্তু এখন আমাদের যা কিছু দরকার - খাবার, কাপড়, বই, সিনেমা, এমনকি সঙ্গী - সবই একটি ক্লিকের দূরত্বে অবস্থান করছে।
জে জির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এই প্রজন্ম যেন একসঙ্গে সবকিছুকেই চাইছে। বর্তমানে বিশ্বের সব জায়গার জে জিদের সমস্যাই এটি। কিন্তু ভারতে সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি এই প্রজন্মের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।
সেই তরুণ হিসাবরক্ষক কি ফুল-টাইম বিটবক্সার হতে পারবেন? সেই তরুণ শিল্পী কি একটি গ্রাফিক ডিজাইন ফার্মে চাকরি পাবেন?
এই অস্থির প্রজন্ম কি তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং বিকল্পের মধ্যে ব্যবধান কমাতে পারবে? নাকি এই দুইয়ের মাঝখানেই থেকে যাবেন তারা? সময়ই বলে দিবে।
সূত্র: বিবিসি।